পীযূষ ভট্টাচার্য
লেখকের অসুস্থতার কারণে বেশ কয়েকমাস ধারাবাহিক উপন্যাস ‘অন্তেবাসী’ প্রকাশিত হয়নি। এই সংখ্যা থেকে আবার তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। পাঠকের সুবিধার্থে এই পর্বের নীচে পূর্বপ্রকাশিত পাঁচটি পর্বেরই লিঙ্ক দেওয়া হল। -- স্টেশন মাস্টার
পঞ্চম পর্বের পর
সেই রামছাগলের চলার ভঙ্গির ভিতর উঠে আসছিল সুরেলা টুং টুং ধ্বনি। সুরেলা তো হবেই, কেননা ওটা ছিল বাবলুর নুপূর থেকে খসে পড়া দানা যা রামছাগলের চার পায়ে গলায় বাঁধা। ঘুঙুর যেন নৃত্যের বোল তুলছে। রামছাগল ঘর পেরিয়ে বেলুদির ঘরে দাঁড়িয়ে ঝমঝমিয়ে উঠল। তখনই মনে পড়ে গেল বাবলুর আজ সন্ধ্যায় নাচ দেখাবার কথা।
ঠিক একবারই মাত্র রামছাগল ঝমঝমিয়ে নেচে উঠে স্থির, মুহূর্তের মধ্যে কিছু একটা ঘটতে চলেছে। যদিও এর আগে রামছাগলকে নাচতে দেখিনি, যা দেখেছি চিৎপুরের কসাইখানাতে ছাল ছাড়িয়ে ঝুলে থাকতে। যদি সেটা প্রথম জবাই হয় তবে তার মলদ্বারে কয়েকটি জ্বলন্ত ধূপকাঠি, তার সুগন্ধি ধোঁয়া ঊর্ধ্বগামী, মুন্ডুহীন দেহ নিম্নগামী। এসব দেখবার অভিজ্ঞতার মধ্যেই কখন যে বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। বুঝলাম মা যখন ছোট বোনকে আমার কোলে বসিয়ে দিয়ে বলে যায়— বেলুর শরীরটা খারাপ, খবরদার ঘর থেকে বেরোবি না…
কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না হঠাত কেন রামছাগলের শরীর থেকে উঠে আসা নুপূরের নিক্বণ বন্ধ হয়ে গেল। কালুদার শিকার চিতাবাঘ, মার কল্পনার ভল্লুক ইত্যাদির মধ্যে বেলুদির জন্য আনা রামছাগলই একমাত্র কোনও ভীতির সঞ্চার করে না এই সুরসৃষ্টির মাধ্যমে। এখন পর্যন্ত রামছাগলের শরীরের বোটকা গন্ধ ঘরময় থাকা সত্ত্বেও কোনও অস্বস্তি হচ্ছে না। অন্যসময় হলে বমি করে ফেলতাম। এটা আমার অভ্যাস। এরই মধ্যে সকালের আপ ট্রেন চলে গেল, দেখতেই পারলাম না। কেননা কোলের ওপর ছোট বোন বসে হাত-পা ছুড়ছে। ওকে সামলাতে হিমশিম। একসময় মনে হল ওকে চিমটি কেটে কাঁদিয়ে দিই। কান্না শুনে মা ছুটে আসবে। হলও তাই। মা অবশ্য ছুটে এল কিন্তু দূর থেকেই নানান মুখভঙ্গি করে বোনের কান্না থামিয়ে চলে গেল। শুধু বলে গেল, ‘বেলুর কাশিটা উঠবে উঠবে করেও উঠছে না, উঠলে যে কী বেরিয়ে আসবে বলা যায় না, শুধু হাঁপাচ্ছে।’
এর মধ্যে রামছাগলের শিল্পীসত্তা মরে ভূত হবার কারণই বা কী বুঝতে পারলাম না। অবশ্য বুঝবার মতন সে বয়সও তখন ছিল না।
বুঝে ওঠবার বয়সে পৌঁছে, অর্থাৎ যৌবনে যখন কবিতা লিখতাম তখন শৈশবের রামছাগলের টুং টাং ধ্বনি উধাও। তা-ই নিজের অজান্তে বেজে ওঠে ঠং ঠং করে। লিখে ফেলি—
কারও তাজা রক্তে রুটি চুবিয়ে খেতে পারো তো ভালো
নচেৎ রামছাগলের সাথে বসবাস
এ রোগের প্রচলিত ওষুধ।
বিধবার সিঁথির মতন
পায়ে হাঁটা পথে হেঁটে যাই
রামছাগল ঠং ঠং শব্দে নাচে।
বেলুদির পাহাড়ি রামছাগলের গলায় টুং টুং ধ্বনির সুরেলা রেশ কবে যে হারিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। কেননা ততদিনে টুং টুং ধ্বনি রূপান্তরিত হয়ে গেছে ঠং ঠং-এ। এখন তো সবসময়ই মনে হয় আমি পালিয়ে যাচ্ছি— পিছনে বেজে চলছে পাগলা ঘন্টি। এ এক দিগবিদিকহীন শূন্য প্রান্তরের দিকে ছোটা। সেখানে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম-ঈশান-অগ্নি-বায়ু-নৈঋত-ঊর্ধ্ব-অধঃ বলে কিছু নেই। শুধু এক বিরান প্রান্তর।
এখনও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে রামছাগলের শরীরের বোটকা গন্ধ ঘরময় ঘুরে বেড়ায়। যদিও রামছাগল অদৃশ্য, তবুও যেন যেকোনও সময় ঠং ঠং আওয়াজ শুনতে পাব এই আশঙ্কায় ঘুম আর আসে না। মনে হয় আমিও বোধহয় রাজরোগে রোগার্ত। তবে কার রক্তে রুটি ভিজিয়ে খেলে রোগমুক্তি ঘটবে? এসব ভাবতে ভাবতে ছিন্নমস্তা সময়ের মধ্যে নিজেই ঢুকে পড়ি।
যাত্রাপালায় দেখা রাজা যে উজ্জ্বল পোশাক পরে মাথায় স্বর্ণমুকুট নিয়ে হাতে ন্যায়দণ্ড নিয়ে কীভাবে বেলুদির শরীরে প্রবেশ করেছিল সেদিন বুঝতে পারিনি (হয়ত সে বয়সে বুঝে উঠবার মত বুদ্ধিই ছিল না)। তবে, এখন বুঝি রাজারা সব কিছুই পারেন। তাদের অসাধ্য বলে কিছু নেই।
কবিতায় লেখা যে বীভৎস চিকিৎসার কথা উঠে এসেছিল তা বোধহয় নিজেরই রক্তের কথা বলতে চেয়েছিলাম। কেননা বেলুদির প্রচণ্ড কাশির গমকের সঙ্গে উঠে এসেছিল রক্ত। সেই গমকের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় সকলের। প্রথমে মাসিই ছুটে আসে, যেন সে জেগেই ছিল এই কাশির গমকের শব্দ শোনার জন্য। সারাদিনে উঠব উঠব করে ওঠেনি, উঠবি তো ওঠ তবে এরকম মাঝরাত্রিতে! কাশির গমক যে উঠবেই এই আশঙ্কায় রামছাগলটিকে আজ বাড়ি পাঠায়নি, মেয়ের সঙ্গে রেখে দিয়েছে। রামছাগলের রং যে পালটে গেছে রক্তে সেদিকে নজর নেই। যে দৃষ্টিতে বেলুদিকে দেখছে সেই অবাক দৃষ্টিই যেন বলে দিচ্ছে— এত রক্ত কোথায় লুকিয়ে রাখে মেয়েটা!
মেসোমশাই একবার উঁকি দিয়ে দেখে নিয়ে স্টেশনের উদ্দেশে হাঁক পাড়ে— ট্রলি নামাও, কার্শিয়াং যাতে হবে। ততক্ষণে অবশ্য হারিকেনের আলোগুলোকে আধবোজা অবস্থা থেকে উসকে দেওয়ার ফলে ছায়াচ্ছন্ন পরিবেশকে হটিয়ে দিতে পুরোটা সক্ষম না হলেও এক আলোর বার্তা নিয়ে আসে। আর তখনই বোন কেঁদে উঠলে মা দৌড়ে এ ঘরে ছুটে আসে, তার পেছু নেয় মাসির কথা ‘গায়ে কিছু একটা দে, ঠান্ডা লাগবে যে, বাচ্চুকে এদিকে আসতে দিবি না।’
এরপর মা বোনকে দেওয়াল ঘেঁষে, অর্থাৎ আমার শোবার জায়গায় আর বোনের শোবার জায়গায় আমাকে শুইয়ে দিয়ে চলেই যাচ্ছিল কিন্তু কিছুটা গিয়েও ফিরে এসে একটা চাদর জড়িয়ে নিল। ‘এইতো ভালোই ছিল। হঠাত করে বাড়াবাড়ি শুরু হয়ে গেল।’ কাউকে শোনাবার জন্য নয়, নিজেই যেন নিজেকে বলছে। তবে কি এখানে আমাদের থাকবার পালা শেষ!
কালুদা পাঁচ পাঁচটা ব্যাটারি টর্চে ভরে দেখে নিল জ্বলছে কিনা, আলোতে ভরে গেল ঘরটা। আর আমি আবিষ্কার করলাম এক শিকারিকে। কাঁধে বন্দুক, বেল্টের খোপে খোপে টোটা ভরছে, এর ফাঁকে মা গামবুটজোড়া এগিয়ে দেয়।
–ফুলদি, তুই এটা আনতে গেলি কেন? আমিই আনতাম…
–তোকে কতদূর দৌড়াতে হবে এখন…
তা শুনে কালুদা এক মুহূর্তের জন্য হলেও কেমন উদাস হয়ে যায়। যেন বলতে চাইছে মানুষকে বেঁচে থাকতে গেলে দৌড়াতেই হবে। কিন্তু মুখে কিছু না বলে বন্দুকে টোটা ভরে বলে— ফুললি লোডেড।
–এখন সেফটি ক্যাচটা লক কর…
মা কালুদা এত কিছুর মধ্যে হেসে ওঠে। ‘তুই জানলি কী করে?’ উত্তরটা অবশ্য চাপা পড়ে যায় নীচে লাইনের ওপর ট্রলিটাকে প্ল্যাটফর্ম থেকে নামাবার যান্ত্রিক শব্দে।
‘মা রেডি’ বলে কালুদা বাহাদুরের উদ্দেশে হাঁক পাড়ে। শুধু বাহাদুর নয়, আরও তিনজন সহ রামছাগলের মালকিনও উঠে এসে দাঁড়ায় নিঃশব্দে। কেবলমাত্র মালকিন ভেতরে যায়।
–দ্যাখ তো রেডি হল কিনা?
মাকে দেখেই মেজমাসি চিৎকার করে ওঠে— তোকে না এদিকে আসতে মানা করেছি, কোলে দুধের বাচ্চা। ধমকে উঠে মাকেই বলে, ‘ওদের আসতে বল…’
মাকে অবশ্য সে কথা বলতে হয় না। এত জোরে বলা, এ ঘরের সবার কানে পৌঁছে গেছে। মা ঘরে ঢুকতেই কালুদা বন্দুকটি মার হাতে ধরিয়ে দেয়, মেসোমশাই হাত বাড়িয়েছিল, কিন্তু মাকেই দেয়, মনে হয় যে সেফটি ক্যাচ বোঝে, তার হাতেই বন্দুক নিরাপদ।
কালুদা তোষক লেপ সমেত বেলুদিকে কোলে করে আনছে। সামনে দাঁড়িয়ে বাহাদুর পিছন ফিরে কালুদার মুখোমুখি। পড়ে গেলেই ধরবে। সিঁড়ি শুরু হওয়ার আগেই পাঁচ ব্যাটারির টর্চ জ্বলে উঠল। আলোময় সিঁড়ি দিয়ে রাজরোগান্ত বেলুদি রওনা হল চিকিৎসার জন্য।
দ্রুত নেমে যাচ্ছে কালুদা, আশ্চর্য কৌশলে বাহাদুরও নামছে পিছন ফিরে। সবার পিছনে বন্দুক কাঁধে মা। মাকে বীরাঙ্গনার বেশে এই প্রথম এবং শেষ দেখা। সিঁড়ির একদম শেষ ধাপে মেজমাসিকে বলতে শোনা গেল— তোর উপর রেখে গেলাম সংসার।
সঙ্গে সঙ্গে কালুদা ধমকে উঠল— কী যা তা বলছ! ইঞ্জেকশন পড়লে সব ঠিকঠাক, এখন যত তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যায়।
ট্রলিতে বেলুদিকে বসিয়ে মার হাত থেকে কালুদা বন্দুকটা নিয়ে নিলে আমি খুবই হতাশ হয়ে যাওয়ার মধ্যে মাকে দেখলাম আমার হনুমানের টুপিটা বেলুদিকে পরিয়ে দিতে। ‘যাক বাঁচা গেল।’ নিজেকে শুনিয়ে বললাম। যেন হনুমান হওয়ার হাত থেকে মা-ই রক্ষা করল এ যাত্রায়।
চড়াই-উতরাইর জন্য সামনে দুজন পিছনে দুজন যখন ছুটতে শুরু করে, কালুদার টর্চের আলো একাধারে সামনের পথ আর আশপাশের জঙ্গলে বর্ষে চলছে। হঠাত উতরাইয়ের পথে এসে কালুদা চিৎকার করে ওঠে— হল্ট। ট্রলি থেমে যায়। কালুদা এক দৌড়ে ছুটে যায় যেখান দিয়ে একটু আগেই একটা শিয়াল ক্রস করেছে। ঠিক সেখানে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করে আবার এক দৌড়ে ফিরে এসে এক দৌড়ে ট্রলির গতিকে সামাল দেয়।
মা, ডলিদিকে পৌঁছে দিয়ে মেসোমশাই আবার ফিরে যান স্টেশনে। যদি কার্শিয়াং স্টেশনে কাউকে পাওয়া যায় টেলিফোনে তবে একটা স্ট্রেচারের ব্যবস্থা রাখতে বলবেন। স্যানেটোরিয়ামের রাস্তাটা এত চড়াই, কালুর পক্ষে দিদিকে কোলে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
ডলিদি ঘরে ঢুকেই বলে— রামছাগলটার কাণ্ড দেখলে! আগে থেকে জায়গা দখল করে বসে আছে, আমার বসবার জায়গাই হল না।
রামছাগলের গলার ঘণ্টা সকালেই খুলে রাখা হয়েছে যাতে করে বেলুদির ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। এই যাত্রাপথে কোনও সুরেলা ধ্বনি নেই— অন্ধকারের ভিতর ছুটে যাওয়া মাত্র।
আর ঠিক এই সময়ে আমার বোনটা ঘুমের ভিতর খিলখিল করে হেসে ওঠে।
মা বলে ওঠে, ‘পূর্বজন্মের কোনও সুখের স্মৃতি দেখে হাসছে।’ আর কথাটা এমনভাবে বলা, এ জন্মের আগামীতে কী ঘটবে বা ঘটতে চলেছে সে সম্পর্কে সে সন্দিহান।
আবার আগামী সংখ্যায়
- অন্তেবাসী — প্রথম পর্ব
- অন্তেবাসী — দ্বিতীয় পর্ব
- অন্তেবাসী — তৃতীয় পর্ব
- অন্তেবাসী — চতুর্থ পর্ব
- অন্তেবাসী — পঞ্চম পর্ব