দেবব্রত শ্যামরায়
সভ্য মানুষ কাকে বলে, এটা নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু ধারণা আছে। শুধু ধারণা নয়, নিজের জন্য একটা বেঞ্চমার্ক বলা যেতে পারে। একমাত্র আমি নই, সম্ভবত অনেকেই এইভাবে ভাবেন। এই ভাবনার সঙ্গে শিক্ষা (যে শিক্ষা সবসময় প্রথাগত নাও হতে পারে), আধুনিকতা ও যুক্তিবোধের মতো বিষয়গুলো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে। এই সভ্যতার ধারণার একটা দিকে রয়েছে বাকস্বাধীনতা ও বিরুদ্ধমতকে গ্রহণ করার ক্ষমতাও।
বাকস্বাধীনতার কথাই ধরি। কোনও স্বাধীনতাই অবাধ নয়, যতক্ষণ না তা চূড়ান্তভাবে মুক্ত। সম্পূর্ণ বাকস্বাধীনতার মানে– আমাকে যা ইচ্ছে বলতে দিতে হবে, যা খুশি লিখতে দিতে হবে। রাষ্ট্র বা অন্য কোনও প্রতিষ্ঠান আমার এই স্বাধীনতায় বিন্দুমাত্র হাত ছোঁয়াতে পারবে না। এই বাকস্বাধীনতার মধ্যে থাকবে যে কোনও ব্যক্তি, বিগ্রহ বা বিশ্বাসকে সরাসরি আঘাত করার অধিকারও। কোনও ব্যক্তি বা সমষ্টির বিশ্বাসে আঘাত লাগতে পারে ভেবে নিজের কণ্ঠকে চেপে রাখার দায় থাকবে না আমার। কোনও আবেগ, অনুভূতি, তা সে ধর্মানুভূতিই হোক না কেন, আমার অপছন্দের হলে তাকে আড়ালে বা জনসমক্ষে, কোথাও সম্মান দেখাতে আমি বাধ্য নই। আমি তথাকথিত পবিত্র কোনও আবেগ নিয়ে যে কোনও মুহূর্তে সমালোচনা, নিন্দা, এমনকি বিদ্রূপ পর্যন্ত করতে পারি। বস্তুত, আদিকাল থেকে মানুষের সভ্যতা যতটা এগিয়েছে, তা প্রতিষ্ঠিত আইডিয়াকে আক্রমণ করেই এগিয়েছে, ফলে মুক্তচিন্তার এই খোলামেলা পরিসরটুকু অর্জন আধুনিক সভ্য সমাজের অনেক লক্ষ্যের মধ্যে একটি। এবং আধুনিক রাষ্ট্রের কাজ হল এই পরিসর যাতে বজায় থাকে যে কোনও মূল্যে তা সুনিশ্চিত করা।
উল্টোদিকে একজন বা অনেকে, আমার বা আমার সম্প্রদায়ের (সম্প্রদায়ের আজকের ধারণাটাই একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এই আশা রাখি) বিরুদ্ধে মুখ খুললে আমি তা শুনব, তুচ্ছ মনে হলে অবজ্ঞা করব। অতিরিক্ত বিরক্ত হলে তার প্রতিবাদ করব (নগ্ন সরস্বতী অপছন্দ হওয়ায় নগ্ন ফিদা হুসেনের ক্যারিকেচার ছাপিয়েছিল দি হিন্দু.. বা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসও হতে পারে, অত্যন্ত পরিশীলিত ও সকৌতুক ছিল সে প্রতিবাদ, কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, আমরা ঘটনাটা সেখানেই শেষ করে ফেলতে পারিনি), দরকারে লেখালেখি, মিটিং, মিছিল, পথসভা, ধরনা এমনকি আদালতেও যাওয়া যেতে পারে, কিন্তু কোনও তরফ থেকেই এই বাদানুবাদ শারীরিক নিগ্রহ বা দেশের আইন হাতে তুলে নেবার পর্যায়ে পৌঁছবে না।
যারা এই অবধি পড়ে বাঁকা হাসছেন, তাদের বলে রাখি, আমিও হাসছি। উপরের এই ধারণা আদ্যন্ত নাগরিক, শীতল এবং ইউরোপীয়। সমাজে এই ধারণার সফল প্রয়োগের জন্য চাই প্রায় একশো শতাংশ নাগরিকদের সুশিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, যথাসম্ভব সামাজিক সাম্য ইত্যাদি প্রাথমিক কিছু শর্ত। আমাদের এই উপমহাদেশের রোদ জল হাওয়ার সঙ্গে ঐ ইউটোপিয়ার কয়েক আলোবছরের তফাত। কপালদোষে, আমরা ভারতীয় বা বাংলাদেশি বা পাকিস্তানি, মোদ্দা কথা অসাম্যপীড়িত সমস্যাজর্জর তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক। আমরা উষ্ণ রক্তের প্রাণী। ধর্ম, জাতি, খাদ্যাভ্যাস, এমনকি ফুটবল ক্রিকেট আমাদের রক্ত থেকে মুহূর্তে ভাপ তোলে। খেলার মাঠে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, ভারত-পাকিস্তানের লড়াই আমাদের জাতিপ্রেম, গোষ্ঠীপ্রেম, দেশপ্রেম ইত্যাদি দেখাবার ময়দান। এমনকি ফুটবল খেলার ফল অপছন্দ হলে রেফারিকে উত্তমমধ্যম দিয়ে গ্যালারি থেকে ঝুলিয়ে দিতে পারি আমরা। নিজের আচরণ নিয়ে আমরা সুনিশ্চিত তাই সামান্য জলের বোতল নিয়ে আমাদের খেলার মাঠে ঢুকতে দেওয়া হয় না। রবীন্দ্রনাথ থেকে রামকৃষ্ণ, গোমাতা থেকে মহম্মদের ছবি, রজনীকান্ত থেকে জাল্লিকাটু, এইসব বিগ্রহ দিয়েই আমাদের রোজকার বেঁচে থাকার খামতিগুলো ঢেকে রাখতে হয়। প্রতিটি প্যাশনসঞ্জাত ইস্যুর চূড়া থেকে চূড়ায় লাফিয়ে চলে আমাদের দিন ও রাত। সাধারণভাবে, আমাদের জীবনে সুশিক্ষা, স্বাচ্ছন্দ্য ও সুশাসনের অনুপস্থিতি, ডেমোক্রেসির অভাবকে আমরা মবোক্রেসি দিয়ে ঢেকে রাখি। ভারতবর্ষ নামের এক শিক্ষাহীন গ্রামীণ ধর্মপ্রাণ কৌম সমাজের কাছে এর থেকে বেশি পরিশীলন আশা করা অন্যায় ও অবাস্তব।
অবাস্তব বুঝেই আমাদের সংবিধানপ্রণেতারা বাকস্বাধীনতার অধিকার স্বীকার করেও তার পেছনে একটা কুশলী খোঁচ জুড়ে দিয়েছিলেন। আমার বাকস্বাধীনতার অধিকার ততক্ষণ পর্যন্ত স্বীকার্য যতক্ষণ না তা পারস্পরিক কিম্বা সম্প্রদায়গত ঘৃণা বা হিংসায় উসকানি দিচ্ছে। ব্যস, স্বাধীনতা আর অবাধ রইল না, লোহার বাসরে ছোট্ট একটি ছিদ্র করে দেওয়া হল, যা দিয়ে কালক্রমে ঢুকে আসবে একটি বিষধর সাপ। উসকানি বা সম্প্রদায়গত ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কোনও নির্দিষ্ট মাত্রা বা সংজ্ঞা দেওয়া নেই সংবিধানে। তা দেওয়া সম্ভবও নয়। অনুভূতি ব্যাপারটাই বায়বীয়, পরিমাপযোগ্য নয় মোটেই, এবং তা ব্যক্তিগত রুচি, শিক্ষা, ও মানসিক অবস্থার ওপর নির্ভরশীল। মন্দির বা মসজিদের পাশ দিয়ে যাবার সময় গা চুলকালেও পরম করুণাময়ের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে মনে হতে পারে কারও। গোমাংস ভক্ষণ সংখ্যাগুরুর অনুভূতিতে আঘাত করছে এই অজুহাতে একটা গোটা সম্প্রদায়ের খাদ্যাভ্যাসকে বদলে দেবার চেষ্টা করছে রাষ্ট্র স্বয়ং। শুধুমাত্র বই লিখে অনুভূতিতে আঘাত দেবার অজুহাতে একজন লেখিকাকে নির্বাসিত করেন তথাকথিত এক সেকুলার বামপন্থী সরকার। এখানে পালটা প্রশ্ন উঠতে পারে, যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা ও কুরুচিকর আক্রমণ দু’টোর মধ্যে অনেকখানি তফাত। তফাত অবশ্যই আছে। কিন্তু সমালোচনা ও ‘অশ্লীল’ আক্রমণের ভেদরেখা নির্ধারণ করবে কে? সারাজীবন ইসলাম ও হিন্দুধর্মের যুক্তিসহ সমালোচনা করে, ফেসবুকে একটিও অশ্লীল পোস্ট না করে মাথায় চাপাতির আঘাতে প্রাণ দিলেন অভিজিৎ রায়, খুনিরা আজও বাইরে। যুক্তি আলাদা কোনও প্রিভিলেজ পাচ্ছে কি? পাবার কথাও নয়। কারণ বিশ্বাসের সামনে প্রতিটি যুক্তিই চূড়ান্ত অশ্লীল।
নিরঙ্কুশ বাকস্বাধীনতা আমাদের দেশে নেই। এই আগ্নেয়গিরির ওপর বসে তা আশাও করছি না। কোনটা আগে থাকা উচিত, অবাধ স্বাধীনতা নাকি সেটাকে ধারণ করার মতো পরিবেশ– এই ডিম ও মুরগির তর্কে হয়তো আরও এক-দু প্রজন্ম কেটে যাবে। কিন্তু প্রশাসন যা পারে তা হল যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আইনের শাসন কায়েম করা। পতাকার রঙ না দেখে আইনভঙ্গকারীদের পর্যাপ্ত প্রহার ও অর্ধচন্দ্র না দিলে সবরকম মৌলবাদের হাত শক্ত করা হবে শুধু। আমাদের এই উপমহাদেশে সেই স্বপ্নের আধুনিক সভ্য সমাজ হবে না এটা মেনে নেওয়া একটা সমঝোতা। কালবুর্গি, নরেন্দ্র ধবোলকর, পেরুমল মুরুগান, তসলিমা নাসরিন, শিরিন দালভি, মার্শেল খান, মহম্মদ আখলাক বা জুনেইদ নিজেদের জীবনের বিনিময়ে এই সমঝোতার দাম চুকিয়েছেন বা আজও চুকিয়ে যাচ্ছেন।
সৌভিক সরকারের পোস্টটি নিতান্ত তৃতীয় শ্রেণির একটি পোস্ট। এই পোস্টটা তাকে দিয়ে করানো হয়েছে এই সম্ভাবনা আপাতত উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে পোস্টটা খুব সহজেই অবজ্ঞা করা যেত, যেমন অবজ্ঞা করা যেত শ্রীজাতের একটি অতিসাধারণ কবিতায় ত্রিশূলে কন্ডোম পড়ানোর রূপক। কিন্তু ঐ যে বললাম, আমরা সভ্য দেশের বাসিন্দা নই। আর মৌলবাদী শক্তি চাইছেও এগুলোকে যেন অবজ্ঞা না করা হয়। অপর পক্ষের অসহিষ্ণুতা দেখিয়ে অসহিষ্ণু করে তোলা যাবে নিজের পক্ষের মানুষদের, আসল সমস্যা পিছু হটবে, মেরুকরণ দ্রুত হবে, যার সুফল মিলবে ভোটের বাক্সে। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-লালনের এই মাটি (বহুব্যবহারে ক্লিশে, খুব কাব্যিক শোনায়, তাও এখনও এঁদের কাছেই ফিরতে হচ্ছে বারবার) মৌলবাদের গোয়ালঘর যেন না হয়ে ওঠে, এটা দেখার দায়িত্ব আমাদের সবার। আর সৌভিক জেল থেকে বেরিয়ে যেন স্বাভাবিক ও নির্ভয় জীবন কাটাতে পারে, তার ভার প্রশাসনকে নিতেই হবে।