পাউলো ফ্রেইরি
তর্জমা: সবিতা বিশ্বাস
পাউলো ফ্রেইরি রচিত ‘কালচারাল অ্যাকশন ফর ফ্রিডম’ বইটি ‘মুক্তির জন্য সাংস্কৃতিক প্রয়াস’ নামে বাংলায় প্রকাশিত হতে চলেছে। তার একটি ছোট টুকরো এখানে ‘উদ্ধৃত’ করা হল। এই বই পড়ে পাঠকের সামনে শিক্ষা/সমাজ-চিন্তা/সমাজ-পরিবর্তন সম্পর্কে নতুন দিগন্ত খুলে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। বইটি অনুবাদ/অনুলিখন করেছেন দীর্ঘদিন নানা শিক্ষা-প্রয়াসের সঙ্গে এবং ‘বাংলা মান্থলি রিভিউ’-র সঙ্গে যুক্ত সবিতা বিশ্বাস। টীকা যোগ করেছেন ‘আপনাকে বলছি স্যার’-এর অনুবাদক সলিল বিশ্বাস। বইটি শীঘ্রই প্রকাশ করতে চলেছেন নানারকম চিন্তাশীল বইয়ের জন্য বিখ্যাত ‘মনফকিরা’।
শিক্ষা হবে মুক্তির জন্য সাংস্কৃতিক প্রয়াস। সেইজন্যে তা জ্ঞানার্জনের একটা প্রক্রিয়া,[i] নিছক মুখস্থবিদ্যা অর্জন করা নয়। এই প্রয়াসের জটিল সামগ্রিকতাকে একটা যান্ত্রিক তত্ত্ব হিসেবে গণ্য করা কখনওই যাবে না। তাহলে শিক্ষাকে জ্ঞান আহরণের উপায় হিসেবে প্রতীয়মান করা যাবে না, বিশেষ করে প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষার ক্ষেত্রে। পরিবর্তে তা শিক্ষাকে প্রকৌশলের একটা জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমিত করে ফেলবে, যাকে নিরপেক্ষ ভাবাই হবে অতিসরলতা।[ii] যার ফলে শিক্ষাপদ্ধতি এক বন্ধ্যা এবং আমলাতান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের ছাঁদে বাঁধা চেহারা নিয়ে নেবে।
… … …
দ্বৈতচিন্তাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি[iii] যদি না থাকে তাহলে চিন্তা এবং ভাষা দুইয়ে মিলিত যে পূর্ণতা সেটা চিন্তাশীল পাত্র-ব্যক্তির বাস্তবতার দিকেই সর্বদা দৃষ্টি নির্দেশ করে। ব্যক্তি মানুষ ও তার মূর্ত ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক বাস্তব প্রেক্ষাপটের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক থেকে অকৃত্রিম ভাবনা-ভাষার জন্ম হয়। পরনির্ভরশীল এবং স্বাধীন-অবয়বহীন উদ্দিষ্ট সমাজগুলির প্রকৃতিগতভাবে বিচ্ছিন্নতাক্লিষ্ট (এলিয়েনেটেড) সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়াগুলির ফলশ্রুতিতে তাদের ভাবনা-ভাষাও বিচ্ছিন্ন চেহারা নেয়। ঘটনা হল, চরম বিচ্ছিন্নতার সময়গুলিতে এই সব সমাজ তাদের অকৃত্রিম কোনও চিন্তাধারাকে[iv] প্রতিভাত করতে পারে না। বাস্তবতা বলতে যা ভাবা হয়ে থাকে, বস্তুত তার সঙ্গে মানুষ যে বাস্তব অবস্থায় বাস করে তার কোন মিল থাকে না। বিচ্ছিন্ন মানুষ তার কল্পনার বাস্তবতাতেই নিজেকে দেখে। বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতার ক্ষেত্রে— যে বাস্তবতার সঙ্গে বিচ্ছিন্ন মানুষ চিন্তক ব্যক্তি[v] হিসেবে সম্পর্কযুক্ত বোধ করে না— এই ভাবনা কার্যকরী হাতিয়ার হয় না। কল্পিত এবং আকাঙ্ক্ষিত বাস্তবতার ক্ষেত্রেও তা একই ভাবে কার্যকরী হয় না। অকৃত্রিম চিন্তায় নিহিত থাকে কর্ম-সক্ষমতা, কিন্তু সেই প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই চিন্তা হয়ে পড়ে অফলপ্রসূ, আর মিথ্যা প্রতিশ্রুতির মধ্যে তা হারিয়ে যায়।
নির্দেশক সমাজের[vi] জীবনযাত্রার দুর্নিবার আকর্ষণে আকৃষ্ট বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হল একজন আকাংক্ষা–আর্ত[vii] মানুষ, যে তার নিজের জগতের প্রতি প্রকৃতভাবে দায়বদ্ধ নয়। অস্তিত্ববান[viii] হওয়া নয়, দৃশ্যমান হওয়াই তেমন মানুষের বিচ্ছিন্নতাপ্রসূত অভীষ্ট বিষয়। সাধারণভাবে তার চিন্তাভাবনা এবং জগতকে দেখবার প্রকাশভঙ্গি হল নির্দেশক সমাজের চিন্তাধারা এবং প্রকাশভঙ্গির একটা প্রতিফলন মাত্র।[1] তার বিচ্ছিন্ন সংস্কৃতি তাকে এটা বুঝতে বাধা দেয় যে সে যদি তার নিজস্ব জগতটার প্রতি বিশ্বস্ত না থাকে তাহলে তার এই চিন্তা-ভাবনা এবং দুনিয়া সম্পর্কে তার উচ্চারণ[ix] তার নিজের চৌহদ্দির বাইরে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। কেবলমাত্র সেটুকুই তার নিজস্ব গণ্ডির বাইরে স্বীকৃত হবে যতটুকু সে নিজের জগতকে বিশ্লেষণ দিয়ে অনুভব করে এবং জানে, যা সে তার রূপান্তর-সক্ষম যৌথ তত্ত্ব-কর্ম-সমন্বয়ী[x] কর্মপ্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতার মধ্যস্থতায় জেনেছে।
যাই হোক না কেন, নিজের সম্পর্কে এবং পৃথিবীর সম্পর্কে এই ধরনের সচেতনতা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পছন্দের ফল নয়, উদ্দিষ্ট বা পরিচালিত[xi] সমাজগুলি, এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে, কাঠামোগত পরিবর্তনের কারণে, কেউ ধীরগতিতে, কেউ অপেক্ষাকৃত দ্রুত, নিজেদের পরিস্থিতি বিবেচনা করে ধরে নেয় যে তারা আত্মনির্ভরশীল নয়। এই সমাজগুলির অবস্থান্তরের স্তরগুলিকে বিশেষ চরিত্র দেয় যে সব মুহূর্তগুলো, তারা একাধারে সমস্যাসঙ্কুল এবং সৃষ্টিশীল। এই মুহূর্তগুলি সাক্ষী হয়ে থাকে জনগণের আবির্ভাবের (বা নবজন্মের) এবং ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় তাদের বিভিন্ন মাত্রার তীব্রতায় সোচ্চার উপস্থিতির।[2]
জনগণের এই উপস্থিতি স্বভাবতই সমাজে এক নতুন জীবনযাত্রার ধরণ তৈরী করে। তা জনসাধারণ এবং তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের কাছে সমাজের অভ্যন্তরীণ এবং বহিরঙ্গের দ্বন্দ্বগুলোকে সামনে নিয়ে আসে যা এযাবৎ অনাবিস্কৃত ছিল। এইভাবে শুরু হয় বিচ্ছিন্ন সংস্কৃতির মূল্যায়ণ। কোন কোন বুদ্ধিজীবী প্রকৃত অর্থে সমাজের কাঠামোটাকে প্রথমবার আবিষ্কার করে এবং সমাজ সম্পর্কে তাদের পূর্বের দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টাতে শুরু করে। যে বিচ্ছিন্নতা জনসাধারণকে স্বভাবতই নিম্নমানের ধরে নিচ্ছিল, তা এখন আসলে বিচ্ছিন্নতার ফল হিসাবে চিহ্নিত হতে থাকে, এখন নতুন করে যা আবিষ্কৃত হতে থাকে আধিপত্যের পরিস্থিতির প্রকাশ হিবে। বিচ্ছিন্নতার সংস্কৃতির আবরণ যত উদঘাটিত হয় ততই যে নিপীড়নের বাস্তবতায় এর জন্ম তা প্রকাশ হয়ে পড়তে থাকে। একটা দ্বিমুখী নকশা ক্রমশ প্রতিভাত হতে থাকে। একদিকে সংস্কৃতিগতভাবে বিচ্ছিন্ন সমাজ সামগ্রিকসা ভাবে নিপীড়নকারী সমাজের উপর নির্ভর করে যার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থগুলিকে আবার এই নিপীড়িত সমাজই সেবা করে। সেই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন সমাজের মধ্যেই জনগণের উপর তাদের উপরতলার ক্ষমতাসীন লোকেরা নিপীড়নের রাজত্ব কায়েম রাখে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে যাদের সঙ্গে বহিরাগত কেষ্ট-বিষ্টুদের তফাৎ থাকে না এবং অনেক ক্ষেত্রে এই বহিরাগত কেষ্ট-বিষ্টুরা দেশীয় ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীদের মধ্যে সঞ্চারিত রোগের চেহারা নিয়ে অঙ্গীভূত হয়ে যায়।
উভয় ক্ষেত্রেই ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের পরিণামে এই ধরনের সমাজগুলির সঙ্গে একটা মৌলিক মাত্রা যুক্ত হয়েছে: এদের সংস্কৃতি ‘নীরবতার সংস্কৃতি’বা ‘নৈঃশব্দের সংস্কৃতি’[3]রূপে প্রতিষ্ঠিত এবং লালিত। এক্ষেত্রেও দ্বি-মুখী নকশা লক্ষ করা যায়। বাহ্যত, বিচ্ছিন্ন সমাজকে সামগ্রিকভাবে পরিচালক সমাজের পরিচালনার পাত্র ছাড়া আর কিছুই ভাবা হয় না। তার বক্তব্য শোনার মত কিছু নয় বলে মনে করা হয়। উল্টে, তাদের মুখের কথাকে বেঁধে দিয়ে মহানগর[xii], এইভাবে কার্যত তাদের কণ্ঠ রোধ করে রাখে। অন্যদিকে, বিচ্ছিন্ন সমাজের ভিতরেও, জনসাধারণকে একই রকম ভাবে নৈঃশব্দের শিকারে পরিণত হতে হয় উপরতলার ক্ষমতাশালীদের হাতে।
যখন সাধারণ মানুষ তাদের নিজেদের আত্মপ্রকাশের প্রাথমিক উল্লাস থেকে উত্তরণের স্তরে পৌঁছয়, এবং একের পর এক দাবী থেকে দাবী থেকে আদায়ে সোচ্চার হওয়ার মধ্যে দিয়ে ঘোষণা করে যে তারা নতমস্তকে নৈঃশব্দকে ভাঙার জন্য সংগঠিত হবার উপযুক্ত হয়ে উঠেছে, তখন ক্ষমতাসীন উচ্চবর্গ মানুষেরা সহিংস উদ্যোগ নেয় সেই প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করার।[4] যদি জনগণকে পূর্বতন নৈঃশব্দের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষমতা উচ্চবর্গ ক্ষমতাশালীদের না থাকে, তখন ‘আমন্ত্রিত’ হোক বা না হোক, পরিচালক সমাজ নিজেদের কাঁধেই এই দায়িত্ব তুলে নেয়[xiii]।
নৈঃশব্দের জায়গায় জনসাধারণকে ফিরিয়ে দেওয়ার অবদমনের যে পথটাকে ব্যবহার করা হয় তার পুরো ভাগে এবং পাশে পাশে থাকে একটা ভুল বোঝানোর প্রচেষ্টা, যার উদ্দেশ্য হল সঠিক-চিন্তা থেকে পাওয়া ভাষায় ব্যবহৃত কিছু শব্দপ্রয়োগকে শয়তানি কলাকৌশল হিসেবে চিহ্নিত করে দেওয়া।[xiv] সবাইকে বোঝানো যে, বিচ্ছিন্নতা, দমন, নিপীড়ন, মুক্তি, মানবত্ব আরোপ এবং শাসনের অধিকার – এই সব কথাগুলি বদ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কিন্তু সহজে ভুল করে ফেলা জনমানুষের মধ্যে এই ভুল পথে নিয়ে যাবার প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করতে, এই কথাগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে, লাগাতার কাজ দরকার। এই কাজই দেখাবে শব্দগুলোর প্রকৃত অর্থ কী, দেখাবে এগুলি বাস্তবিক, সামাজিক-ঐতিহাসিক, এবং রাজনৈতিক কিছু অর্থপূর্ণ ধারণার শ্রেণিবিন্যাস, তৃতীয় বিশ্বে যেগুলির নাটকীয় উপস্থিতি কাউকেই নিরপেক্ষ থাকতে দেবে না।
… … …
‘নৈঃশব্দের পৃথিবী’ জন্ম নেয় কোন সত্তাতাত্ত্বিক (অন্টোলজিকাল) অক্ষমতার জন্য নয়, কারণ সেরকম ‘অক্ষমতা’ বস্তুটিই কাল্পনিক। আসলে নীরবতার এই পৃথিবী এখনো সেই মানুষের মনোভাব অনুধাবন করতে অক্ষম যার ‘নিজস্ব কণ্ঠস্বর’ আছে, যে তার নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের ফলশ্রুতি, যে তার নিজের নিয়তিকে স্বাধীনভাবে পরিব্যাপ্ত করতে সক্ষম।[xv] এসব সত্ত্বেও উত্থানশীল তৃতীয় বিশ্ব তার সঙ্কটাপন্ন অবস্থা সম্পর্কে খুব দ্রুত সচেতন হয়ে উঠছে। সে বুঝতে শুরু করেছে বহু-বিজ্ঞাপিত উন্নতির চাহিদাগুলিকে কখনোই এই সর্বত্র-বিদ্যমান নৈঃশব্দ্যের পরিস্থিতির মধ্যে অথবা অলীক/কল্পিত কোনও কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে বাস্তবে রূপায়িত করা সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে নিছক ‘আধুনিকীকরণ’ ছাড়া আর কিছু সম্ভব নয়।
কাজেই তৃতীয় বিশ্বের মূল তৎপরতার বিষয় যা হতে পারে — জনগণের কাছে যা কঠিন হলেও অসম্ভব কোন কাজ বলে গণ্য নয় — তা হল তার সোচ্চার হবার অধিকারকে, তার বক্তব্যকে উচ্চারণ করার অধিকারকে জয় করে নেওয়া। তবেই তাদের কণ্ঠস্বরকে দাবিয়ে রাখে যারা, বা যারা তাদের কন্ঠের ভাষাকে একটা আপাত-নির্ভেজাল রূপ দেয়, তাদের ব্যর্থ করে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ অকৃত্রিম শব্দ উচ্চারণে সফল হবে। কথা বলার অধিকারকে জয় করা, নিজেকে নিজের মধ্যে খুঁজে পাওয়া, নিজের ভবিতব্যকে নিজের মত চালিত করার মধ্যে দিয়েই তৃতীয় বিশ্ব নিজেদের জন্যে নিজে তৈরি করে নেবে সেই পরিস্থিতি বর্তমানের নীরবতায় যার আদৌ অস্তিত্ব নেই, আর সেই তাদের সঙ্গে কথোপকথনে প্রবেশ করতে পারবে, যারা আজ তাদের মুখের ভাষাকে নীরব করে রেখেছে।
এই বিশ্বের একজন মানুষ হিসাবে, নৈঃশব্দের সংস্কৃতির অভ্যন্তরে সরব হবার সাহস দেখানোর ফলে যাকে যথেষ্ট এক তাৎপর্যপূর্ণ— হয়ত বলা চলে অত্যধিক আঘাত-জর্জরিত— জীবন যাপন করতে হয়েছে, আমার একটিই আকাঙ্ক্ষা; আমাদের এই চিন্তাধারা যেন ঐতিহাসিকভাবে সহাবস্থানে যায় সেই সব মানুষদের বিক্ষোভের সঙ্গে, যারা বাস করে হয় পুরোপুরি নিঃশব্দ জগতে অথবা সেই সব সংস্কৃতির নিঃশব্দ বৃত্তগুলোর মধ্যে যেখানে তাদের মুখের ভাষাকে শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়, যেখানে তারা নিজস্ব কণ্ঠস্বরের জন্য সংগ্রাম করছে।
[1] এই ধরনের নিয়ন্ত্রক সমাজগুলো স্বাভাবিক কারণেই নিজেরা উল্টো এক রোগে ভুগে থাকে। নিজেদের চিন্তাধারার অমোঘত্ব সম্পর্কে তারা এতোটাই নিশ্চিত থাকে যে তাদের ধারনা হয় এই চিন্তাধারাকে বেদবাক্য মনে করে অনুসরণ করাই নির্ভরশীল সমাজগুলোর কর্তব্য। এই কথা বলতে গিয়ে আমরা শুধুমাত্র একটা সর্বজন-পরিচিত সত্যের প্রতিই দৃষ্টি আকর্ষন করছি। মহানগর এবং নির্ভরশীল সমাজগুলোর সম্পর্কের মধ্যে অধস্তন সমাজের বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে তুলনা করা যায় একমাত্র প্রথমোক্তের প্রভুসুলভ আচরণের সঙ্গে। একেইগেরেরিও রামোস বলেন ‘দৃষ্টান্তবাদীতা’। দুই ক্ষেত্রেই অবশ্য এই উক্তিকে সব সময় সঠিক বলে ধরে নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, কারণ যেমন বিচ্ছিন্ন মানুষদের মধ্যে অ-বিচ্ছিন্ন ধারায় চিন্তা করার মত মানুষ আছে,তেমনি মহানগরেও অ-প্রভুসুলভ মনোভাবের মানুষজনও আছে।উভয়ক্ষেত্রেই, ভিন্ন ভিন্ন যুক্তিতে তাদের নিজ নিজ প্রাসঙ্গিক স্তরের প্রথাসিদ্ধ আচরণের বাইরে কাজ করে থাকে। [বাংলা অনুলেখক – ‘একজেমপ্লারিজম’। আমার দৃষ্টান্তই শ্রেষ্ঠ এবং শুধু সেটাই অনুসরণযোগ্য। যে কোনো ধর্মগুরু বা রাজনৈতিক দলকেই এর উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে।]
[2] অবস্থান্তরের এই প্রক্রিয়া নিজের মত করে মহানগরের সমাজগুলোতেও ঘটতে থাকে, যতই সেই সমাজগুলি অনড় স্হায়িত্বের চেহারা দেখাক না কেন। সেখানেও আমরা সবচাইতে বেশি অবনমিত সামাজিক বর্গগুলির উত্থান দেখতে পাই। আগে এরা সমস্যা হিসাবে উপস্থিত ছিল না, লুকোনো ছিল সমাজের প্রাচুর্যের মধ্যে। এইসব গোষ্ঠীর উত্থান হলে, ক্ষমতার গঠনতন্ত্রে এরাএদের উপস্থিতি অনুভব করায়। সে নিজেদের সংগঠিত করে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় নিজেদের অনিবার্য উপস্থিতির প্রমাণ দাখিল করার উদ্দেশ্যেই হোক, অথবা চরম আক্রমণাত্বক রাজনৈতিক চাপের আকারেই হোক। ছাত্র সম্প্রদায়গুলো, যারা দীর্ঘদিন যাবৎ শুধুমাত্র অধ্যয়ন-বিষয়ক চাহিদাগুলোর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল, তারাও ক্রমশ নিপীড়িত গোষ্ঠীগুলোর অস্থিরতার অংশীদার হতে এগিয়ে আসছে। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যারা সবচেয়ে প্রগতিশীল তাদের ক্ষেত্রেও এমন ঘটনা ঘটছে। এইভাবে মহানাগরিক সমাজের সমস্ত ছকগুলো প্রশ্নের সামনে পড়তে শুরু করছে। এটা সত্যি যে এই সব সমাজের মধ্যে সামাজিক পরিবর্তনের কথা বলতে গেলে মনে রাখতে হবে এদের হাতে আছে উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যা যা এইসব বিরোধগুলোকে অন্তর্লীন করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। হারবার্ট মারকুযা (Herbert Marcuse) এই সত্যের দিকে বারে বারে মনোযোগ দেবার কথা মনে করিয়ে বলেছেন যে প্রযুক্তিবিদ্যার এই শক্তি এইসব প্রতিবাদী আন্দোলনের অনেকগুলিকেইনিছক লোককথারগল্পেরূপান্তরিত করে ফেলতে পারে। যাইহোক, এই দিকটা আমাদের বিষয়ের অঙ্গ নয়,আর,একটা সাধারণপাদটীকায় এর ঠিকমত ব্যাখ্যা করাও যাবে না।
[3] ‘নৈঃশব্দের সংস্কৃতি’ বিষয়ে হিউম্যান রাইট্ স এ্যান্ড দ্য লিবারেশন অফ ম্যান ইন দ্য আমেরিকাস, সম্পাদক, লুইস এম কলোনিস (নোতর দাম, আই এন: ইউনিভারসিটি অব নোতর দাম প্রেস, ১৯৭০)সংকলনে পাউলো ফ্রেইরি-র ‘কালচারাল ফ্রিডম ইন ল্যাটিন আমেরিকা’ দেখুন। (Paulo Freiri, ‘Cultural Freedom in Latin America’ in Human Rights and the Liberatiom of Man in the Americas, ed. Louis M. Colonese (Notre Dame, IN: University of Notre Dame Press, 1970) [বাংলা সম্পাদক – ‘নৈঃশব্দের সংস্কৃতি’ বিষয়ে পাউলো ফ্রেইরি-র অন্যান্য রচনার নাম ও অন্যান্য লেখকের কাজের নাম গ্রন্থপঞ্জীতে পাওয়া যাবে।]
[4] ল্যাটিন আমেরিকার রাজনীতির খুব ভাসা ভাসা বিশ্লেষণও এই বক্তব্যকেই সমর্থন করে। ক্রমান্বয়ে ঘটে যাওয়া ‘ক্যু দেতা’ বা বেআইনি অভ্যুত্থানগুলোকে লাতিন আমেরিকার মানুষের নিজেদের ভাগ্য-নিয়ন্ত্রণের অক্ষমতার নিদর্শন হিসেবে দেখা কখনই যাবে না। বিপরীত পক্ষে, যেসব ‘ক্যু’ বা বেআইনি অভ্যুত্থান, এবং হিংসার দ্বারা, কিছু নেতা নিজেদের তাদের ক্ষমতা কায়েম রাখার চেষ্টা করে থাকে, সেগুলো হল প্রকৃত লড়াকু জনগণের চাপের মুখে মহানগরের নিয়ন্ত্রণাধীন মুখ্যতান্ত্রিক গোষ্ঠী শাসকবর্গের (ওলিগার্কি) প্রতিক্রিয়া।
[i] মুক্তির জন্য প্রয়াসে ব্যাপৃত হতে হলে সত্যিকারের জ্ঞানার্জন প্রয়োজন। পৃথিবীকে, পারিপার্শ্বিককে, গভীরতম পর্যায়ে পৌঁছে জানতে বুঝতে সক্ষম হওয়া তখনই সম্ভব যখন সামাজিক এবং রাজনৈতিক টানাপড়েনের আর নানা পারস্পরিক দ্বন্দ্বের মর্মবস্তুর ভিতরের রূপকে হৃদয়ঙ্গম করে তার মধ্যে প্রয়োজনীয় রূপান্তর নিয়ে আসার উপযোগী জ্ঞান অর্জন করা যায়। যেহেতু পৃথিবী তথা সমাজকে সার্বিক ভাবে (এবং এক কথায়) নিপীড়ক এবং নিপীড়িত এই দুই ভাগে ভাগ করা চলে, পৃথিবীকে পাল্টানো আর মুক্তিলাভ স্বভাবতই নির্ভর করে নিপীড়নের পরিসমাপ্তির উপরে। যার মধ্যে বিশ্লেষণী চেতনা-উন্মেষ (conscientization) ঘটেছে সেই ফলপ্রসূ জ্ঞান অর্জন করতে পারে। এই চেতনা অর্থনৈতিক সামাজিক মানবিক (অ)মানবিক সম্পর্কগুলিকে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে শেখায় এবং একটা নতুন উপলব্ধির জন্ম দেয়। সেখান থেকেই জন্মলাভ করে মুক্তি-স্পৃহা, নিপীড়নের পরিসমাপ্তি ঘটানোর আকুতি।
[ii] মনে রাখতে হবে সব সময়ে, শোষণ-নিপীড়নের ভিত্তিতে যারা নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখে, তাদের শাসিত পৃথিবীতে কিছুই ‘নিরপেক্ষ’ নয়। অনেকেই মনে করেন, শিক্ষাব্যবস্থাকে নানা রকম যন্ত্রপাতি আর হিসেবনিকেশ দিয়ে সাজিয়েগুছিয়ে নিলে, নানা রকম মনস্তাত্ত্বিক ‘বুলি’ দিয়ে ব্যাখ্যা করে, ছাত্রদের লিখনপঠনের ‘অভ্যাস’ করাতে পারলেই শিক্ষা’দান’ প্রক্রিয়ার মধ্যে জ্ঞানার্জনের দুয়ার উন্মুক্ত করা যাবে, জনগণকে ‘নিরপেক্ষ’ ভাবে শিক্ষিত করে তোলা যাবে, এবং, শিক্ষা একটি বিমূর্ত ধারণা যার সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। তা যে আদৌ নয়, এধরনের ভাবনা যে বিশেষ সামাজিক স্বার্থকেই লালন করে, একথা না হৃদয়ঙ্গম করতে পারলে আমাদের অতিসরলীকরণের ফাঁদে পড়তে হবে।
[iii] Non-dualistic। সবকিছুকে নিছক স্বতন্ত্র অস্তিত্বে বিভক্ত করে দেখা যে চিন্তাধারা, তা যদি থাকে তবে বিভিন্ন বস্তু বা অস্তিত্বের মধ্যে অখণ্ড বা দ্বিপাক্ষিক আন্তঃসম্পর্ককে বুঝতে পারা যায় না। তাই দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক দিয়েই পূর্ণতাকে বুঝতে হবে।
[iv] তাদের চিন্তা-ভাবনা পরিচালক সমাজের রপ্তানী করা দৃষ্টিভঙ্গিকেই অনুকরণ করতে শেখায়, এবং অনুকরণ করতে অনেকটা বাধ্যও করে।
[v] ‘thinking subject’ – চিন্তা করতে সক্ষম ব্যক্তি।
[vi] ‘ডাইরেক্টর সোসাইটি’ বা পরিচালক সমাজ। উদাহরণ হতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত যে কোন ঔপনিবেশিক (সাম্রাজ্যবাদী) দেশ, যার সমাজের জীবনযাপন হয়ে দাঁড়ায় অনুকরণযোগ্য। তৃতীয় বিশ্বের মানুষের কাছে যে কোন পশ্চিমী দেশই এই রূপ নিতে পারে।
[vii] ‘আকাঙ্খা-আর্ত’, (নস্টালজিক) কারণ সে নিষ্ফল চাওয়ার ফাঁদে আটক থেকে বেদনা-পীড়িত। সে কখনই পরিচালক সমাজের মানুষের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারে না। প্রয়োজনের খাতিরে কোথাও কোথাও তাকে ‘বিশেষ’ স্থান দিতে বাধ্য হলেও তাকে সব সময় গ্রহীতার ভূমিকাতেই রেখে দেওয়া হয়।
[viii] সত্যিকারের নিজস্ব পরিচয় অর্জন নয়, সে কোনো একটা অলীক পোশাকী ছদ্মমুখের অধিকারী হয়ে উঠেই সন্তুষ্ট থাকে। এই ধারণার প্রতিফলন অন্যভাবে দেখতে পাওয়া যায় তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন মহার্ঘ ‘মল’গুলিতে আর্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা এবং অনুকরণ-কৃত পোশাকআশাকে সজ্জিত অধিকাংশ মানুষের মধ্যে।
[ix] জগত সম্পর্কে তার নিজস্ব ধারণা এবং বক্তব্য।
[x] যে সমবেত ‘প্র্যাক্সিস’ রূপান্তর ঘটাতে পারে।
[xi] পরিচালক সমাজের বিপরীতে।
[xii] ‘মহানগর’ বা ‘মেট্রোপলিস’ বলতে বোঝানো হচ্ছে উচ্চবর্গের সামাজিক অর্থনৈতিক সামরিক ক্ষমতা-কেন্দ্রগুলিকে। সব সময়েই শাসকরা এই সমস্ত কেন্দ্রগুলিতে নিজেদের ঘাঁটি তৈরি করে, অপেক্ষাকৃত নিম্ন-বর্গীয়দের নিয়ে আসে এইসব চক্রে, নিজেদের অভিজাত বলয়ে স্থাপন করে তার দূরতম সীমানার প্রান্তে তাদের স্থান দেয় উচ্ছিষ্ঠভোগী হিসেবে। বাহ্যিক …। দেখতে পারেন, আরও অনেক বইয়ের মধ্যে, ফিলিপস কাসিনিৎস সম্পাদিত ‘মেট্রোপলিস সেন্টার অ্যান্ড সিমবল অফ আওয়ার টাইমস’।
[xiii] এই সময় নির্দেশক সমাজ নিজের স্বার্থে কোনো না কোনো অছিলায় হস্তক্ষেপ করে এবং চরম নিপীড়ন নামিয়ে আনে, নিজেদের পুতুল সরকার স্থাপিত করার জন্য। যেমন দক্ষিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্লজ্জের মত গায়ের জোরে বিভিন্ন সময়ে হস্তক্ষেপ করেছে, যার নবতম উদাহরণ হল ভেনিজুয়েলা। ইরাকের ক্ষেত্রেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই কাজ করেছিল।
[xiv] বিপ্লবী চিন্তা, ধারণা, ভাষা, এগুলোকে নিছক বাঁধা বুলি আওড়ানোর বাগাড়ম্বর বলে চালানো হয়, এই সব শব্দ-ব্যবহারকে “ফালতু কথা” এবং মানুষকে বিপথে চালিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা বলাটা খুব বড় একটা চালাকি। মার্কিন “বিদ্যায়তনিক” প্রতিষ্ঠানের প্রতিভূরা যেমন ফ্রেইরি-র রচনাকে “বুলি কপচানো” বলেছেন। (ডোনাল্ড ম্যাসিদোঃ “পেডাগজি অব ফ্রিডম”-এর মুখবন্ধ) সেই কথা এই চেষ্টারই অন্য এক রূপ।
[xv] এক কথায়, যে নিজেই নিজের ভবিষ্যত গড়ে নিতে পারে।