সৈয়দ কওসর-জামাল
বাদুড়িয়ার সাম্প্রদায়িক হিংসার ছবিটা গণমাধ্যমে প্রকাশ্যে এল দুদিন পর। মিডিয়ার লোক হিসেবে জানি এই ধরনের খবর করার সময় খুবই সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়, কিন্তু তাই বলে এমন সংবাদ না করাটাও সত্যবাদিতার পরিচয় নয়। সংবাদ বাতাসের গতিতে ছোটে। অ-সংবাদ ও গুজব এই সুযোগে সংবাদের স্থান নিতে চায়। গণমাধ্যমে প্রকৃত সংবাদের অনুপস্থিতিতে মানুষ গুজবকেই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। সাম্প্রদায়িক অ-সম্প্রীতির এই ঘটনাকে গণমাধ্যমে সংবেদনশীলভাবে উপস্থাপন করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা না করে এই নিস্তব্ধতা পালন সমস্যাকে জটিল করেছে বলেই মনে হয়।
বাদুড়িয়ার ঘটনার সূত্রপাত একটি ফেসবুক পোস্ট বলে যতই প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হোক, আসলে ওখানকার কিছু মুসলমান একটা অজুহাত খুঁজছিলেন বলেই মনে হয়। অবোধ বালকটি কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের মুসলিমঘৃণার ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে, তার এই কাজটিকে উপেক্ষা করা যেতেই পারত। কিংবা বড়জোর থানায় কেউ একটি ডায়রি করতে পারত। একটি পোস্টের জন্য ইসলাম ধর্ম ধ্বংস হয়ে যায়নি। পোস্টটি কোনও ধর্তব্যের বিষয় নয়। এ কারণেই আমার মনে হয়েছে এটি অজুহাত মাত্র। এই আক্রমণের একটা প্রস্তুতি নিশ্চয় ভেতরে ভেতরে ছিল। বাংলাদেশ থেকে আসা জামাতিদের প্রচার ও তৃণমূল কংগ্রেসের এক এমএলএ-র প্রতি ক্ষোভ ইত্যাদি বিষয় কিছু মুসলিমকে উত্তেজিত করে তুলছিল, এমন কথা শোনা যাচ্ছে। কারণ যাই হোক, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের একটা আবহ আগে থেকেই তৈরি হয়েছিল বলেই একটি ফেসবুক পোস্টেই তা অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল। যারা অবরোধ ও অগ্নিসংযোগের কাজ করেছে তারা নিশ্চয় শান্তিকামী মুসলমান নয়। এরা লুম্পেন শ্রেণির, সম্প্রদায়গতভাবে মুসলমান, কাগজের রিপোর্ট অনুযায়ী বয়স তাদের বিশ-বাইশের মধ্যে। এই বয়সে তারা সাম্প্রদায়িক বিষে আক্রান্ত, এমন ভাবতে কষ্ট হয়। অথচ কার্যত তাই ঘটল। অগ্নিসংযোগ, রাস্তা অবরোধ, লুঠ সবই ঘটল। নিরীহ হিন্দুর অত্যাচার করে তারা ‘ইসলামমাহাত্ম্য’ প্রচার করতে যেন বদ্ধপরিকর।
শোনা গেল, এই বীরপুঙ্গবেরা অনেকেই বাইরে থেকে এসেছিল, স্থানীয় মানুষ তাদের আগে দেখেনি। কোথা থেকে তারা এসেছিল, কারা তাদের এনেছিল, এই সব প্রশ্ন মনে জাগছে। মুখ্যমন্ত্রী একে টাকার খেলা বলেছেন। তার অর্থ, সরকার চক্রান্তকারীদের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। খুব ভালো কথা, কিন্তু আমরা তো প্রশাসনের কাছে জানতে চাইতেই পারি, ওই লুম্পেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে অ্যাকশান নিতে যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া হল না কেন? আধাসামরিক বাহিনীকে তৎক্ষণাৎ ডাকা হয়নি কেন? কেন দলনির্বিশেষে স্থানীয় রাজনীতিকদের শান্তিরক্ষার কাজে লাগানো হল না? ওই এলাকায় তাদের নিশ্চয় প্রভাব আছে। তারা কি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রশমনে কোনও ভূমিকাই নিতে পারতেন না? দুদিন ধরে প্রশাসন নীরব দর্শক হয়ে থেকেছে, একটা সভ্য দেশে এমন সম্ভব? প্রশাসন কিছুই করেনি বলে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে, একথা মনে করা অস্বাভাবিক? ফলে যত সময় গড়িয়েছে হিন্দুত্ববাদীরাও এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে উত্তেজনা বৃদ্ধি করেছে, রাস্তায় নেমেছে, অবরোধ শুরু করেছে এবং দাঙ্গাপরিস্থিতি জটিল হয়েছে। মনে রাখা দরকার, দুদিন লাগল সরকারের এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে। সমাজের স্থিতাবস্থা নষ্ট হওয়ার পক্ষে দুদিন যথেষ্ট সময়। এখন আধাসামরিক বাহিনী রাস্তায় মার্চ করবে, শান্তিবার্তা ছড়াবেন অভিভাবকরা, শান্তিমিছিলও বেরোবে, রাজনীতিকরা সদলে এলাকা ভ্রমণ করবেন ও উপদেশ বর্ষণ করবেন, কিন্তু যে সামাজিক ফাটল তৈরি হয়ে গেল, তার কী হবে? তা কি অচিরে পূর্ণ হবে? বিদ্বেষ রাতারাতি সৌহার্দ্যে পরিণত হবে?
ঘটনার তৃতীয় দিনে রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর বিবাদের ফলে মিডিয়ার পক্ষে আর ঘটনাটি চেপে রাখা গেল না, এ যদি সত্যি হয়, তবে বলব, গণতন্ত্রের পক্ষে এ বড় সুখের দিন নয়। সোল সার্চিং তাহলে শুধু বাদুড়িয়ার বিপথগামী মুসলমানদের নয়, মিডিয়ারও করা দরকার। তারা সংবেদনশীল হলে এত গুজব ছড়াতে পারত না। গণমাধ্যম আমাদের আগেই জানাতে পারত যে একদল লুম্পেন মুসলমান যখন আগুন জ্বালাচ্ছে, তখন অন্য একদল হিন্দুমুসলমান সে আগুন নেভাচ্ছে। ক্ষুদ্র হলেও সম্প্রীতির স্থির শিখাটিকে মানুষই জ্বালিয়ে রাখে, সে মানুষ তখন আর মুসলমান নয়, হিন্দুও নয়, তার একমাত্র ধর্ম মানবিকতা।