তন্ময় ভট্টাচার্যের কবিতা
বাৎসরিকী
ভুললে ভোলাই যায়, মনে রাখলে রাখাটা কঠিন
যেমন তোমার মুখ
তোমার মৃত্যুমোহদিন
যেমন দিনের শেষ
শেষের নদীতে নামে কে
কাছার সত্যিটুকু ধরে রাখতে পারছে না সে
বলেছিল
যার কেউ নেই, তার তুমি তো আছোই
না না ঈশ্বর নও, অত ক্ষুদ্র ভাবি না তোমায়
যেন উৎসব, যেন মেলায় বেড়াতে এসে কেউ
চোদ্দপ্রদীপ কিনে ফিরে গেল, সারাটা জীবন
শাড়ির বিধবা পাড় ছিঁড়ে ছিঁড়ে সলতে বানাবে
অন্তরালকথা
পুজোর পরেই যেই লক্ষ্মী এসেছিল
ফিরিয়ে দিয়েছি; ঘরে এক কণা ভালোবাসা নেই
কী খাওয়াব? যদিও সে অভুক্ত থেকে যেতে রাজি
চেয়েছিল শুধুমাত্র ‘পাশে আছি’- এই বোধটুকু
এত অল্প, এত অল্প – এত শূন্য, এত কম চাওয়া
দিতে হাত কেঁপে ওঠে; বিরক্তি এসে পড়ে নখে
কেন সেও অতিরিক্ত চাইল না সকলের মতো
কেন কেন সামান্য বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে
এক কণা ভালোবাসা, একফোঁটা চুমুকের খোঁজে
লক্ষ্মীকে ফেলে আমি অন্যের কৃপাভিক্ষা করি।
কুলদেবতা
সত্তর বছরের পুরনো বাসন
ঘষেমেজে চকচকে করেছি। এবার
ভোগ দেয়া যেতে পারে। রুষ্ট হবেন কিনা
জানা নেই, তবে ভরসা, পুঁটুলি গুছিয়ে
তিনিও তো এসেছেন, সেবারেই, একই ট্রেনে চেপে
ওর যদি কিছু হয়ে যায়
(১)
জানি না জানি না আমি কী করব, কী করা উচিৎ
চুপচাপ শুনব, না চিৎকারে ভেঙে ফেলব সব
নিজেকে ধরিয়ে নেব যেভাবে আগুনে চিতাকাঠ
যেভাবে পাখির লাশে জ্বলে ওঠে বেড়ালের চোখ
অথবা ডাকার পরও সাড়হীন একটি মানুষ
হয়ে যাব আমি আর ওকেও বলব স্বাগতম্
দুজনেই একসঙ্গে পড়ে যাই কী উঁচু মিনার
এত শান্তি কোনওদিন হাওয়া দিতে পারেনি বেগম
(২)
এবারে জেনেছি আমি, হ্যাঁ আমি যা জেনেছি, সঠিক
কুয়াশার ঘরদোর, দূরে কাঁপছে লন্ঠনি রাত
ক্রমশ এগিয়ে এল, দারোয়ান, না আমি তোমায়
ফিরে যেতে বলব না, যদিও সঙ্গে যাওয়া পাপ
ওপাশে দাঁড়িয়ে দ্যাখো তুমিহীন আলোটি এবার
ছুটে আসছে, কী অবাঙ্মানসগোচর তার রূপ
যেন আমি ঝাঁপাব ও বেজে উঠবে মহাশঙ্খনাদ
শনাক্ত করা গেলে তুমি কি আগের মতো চুপ
তীরবর্তী
আমার হাড়ের গায়ে লেগে আছে অপেক্ষা। তোমার
ছড়ি কি শুধুই ঘোরে? ছুঁয়ে দিয়ে ম্যাজিক করে না?
একবার তালু পাতো, চাল দেব ডাল দেব
দেব যা যা গেরস্থবাড়ির
সামনে বসিয়ে, কেন রোজ-রোজ বকো না দুপুরে?
আনাজ গুলিয়ে গেলে, কেন কৌটো বাইরে ফেলে দাও?
তোমার ম্যাজিক-দুঃখে আমিও সোনালি হতে পারি
গলা অব্দি গিলে এসে হাড়গোড় দেখাব তোমাকে
ছুঁয়ে দাও, সেরে উঠি, সতর্ক ঘোড়ার মতো
চাঁটি মারি নিজেরই কপালে
অথবা, অপেক্ষাটিকে এবার ভাসিয়ে দিই জলে…
পরমার্থ
এইসব অনাকাঙ্ক্ষা, প্রিয়বোধ
জীবনের যত শুদ্ধ অনাচার
সব আজ ঘিরে এল
দ্যাখো মৃত্যু, দ্যাখো শোধ
অসমাপ্ত নদীটিকে কীভাবে ফিরিয়ে দিচ্ছে
নবরাত্রি বৃথা আজ, বৃথাই ভাসানো, আর
পাড়ে বসে দেখে নেওয়া, কীভাবে কৃষাণী আলো
কেঁপে কেঁপে চলে যায় – কার কাছে – কে কোথায়
কেউ কি কোথাও আছ – চিৎকারে জাগো মৌন
জাগো হে শ্মশানচারী – এই মৃত্যু ক্ষুরধার
ছোঁয়ামাত্র বসে যাবে শরীরে শরীর, আহা
ত্বং স্বাহা বলে তুমি নিজেকে উপুড় করো
কত ব্যর্থ কথা, কত দ্বন্দ্ব, তুমুল নেশা
ছিটকে পড়বে, যেন ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য
জীবন জীবিত আজও – এর বেশি আমাকেও
বলতে বোলো না, আমি শুয়ে পড়ব, যেভাবে বাচাল
নিজেকে মিলিয়ে দ্যাখে প্রতিবিম্বে, অনুনাদে
সুদূরপ্রসারী কাঁদে – যেন কিচ্ছু ঠিক নেই
হবে না কখনও, আর
গাছের নিরাভরণ পরমার্থ এনে দিল
এই সাধ্বী মতিভ্রমে তুমিও বুঝেছ, শীতকাল…
মানিয়ে নিতে নিতে
(১)
আমার সন্তানছাড়া এ-জীবন। পিতাজন্ম ছাড়া
আর সব দেবে বলল। লেখার আকাশ,
দু’বেলা ভাতের ফুর্তি, দেহশান্তি, দুঃখ পেলে কোল
বুকের পাহাড়িপথে বেজে-ওঠা শিঙা ও মাদল
কিছুই অদেয় নয়। এমনকি, মাঝরাত্রে
অন্য নারীর কাছে চলে যাব – এই স্বপ্নে মৃতা…
আমার সন্তান যেন ভালোবাসে বাংলা কবিতা!
(২)
যে হবে না, তার চিন্তা মেরেছে আমায়
না-হওয়ার কারণও সে। হলে অশ্রু।
হলে দীর্ঘশ্বাস।
নেহাৎ মাটির দায়ে বেড়ে উঠবে সরলাক্ষি ঘাস –
এমন জীবন তাকে দেওয়া যায় না। রোদ চাই। জল…
কলসি রাজি না-হলে, যতই অমৃত হোক,
বরং স্বীকার করা ভালো আজ ছেড়েছি দখল
(৩)
আমরা দুটিই হব। তিন নয়। ও শিকারী ফাঁদ,
কখনও শাবক এলে তাকে দুমড়ে দিও, যেন
আমার কানে না আসে; পেলে কিন্তু কেড়ে নেব, লতা
ও মাংস দিয়ে বড় করে তুলব। তখন আপত্তি করলে,
পিতা কী ভীষণ হিংস্র –
ফাঁদের বিবিধ গল্প রটাব চতুর্দিকে
কেউ ঘেঁষতে চাইবে না আর
যেভাবে সবাই দূর থেকে দ্যাখে, ঢিল ছোঁড়ে
ডাকিনী রয়েছে জেনে একে একে সারা গাঁ উজাড়
(৪)
পেরেছি মানিয়ে নিতে। আর কিচ্ছু না বলা উচিৎ।
জগতের সব তর্ক স্থির হল এখানে, এখন
শুধু কবিতার দিকে জোর করে ঠেলে দেওয়া মন
বিকলাঙ্গ কথাবার্তা, হাসি-ঠাট্টা, একাকিত্বে ভয় –
তোমার সিদ্ধান্তে মুখ বুজে নয়,
ভেবেচিন্তে হ্যাঁ…
বাকিটা হলে কী হত, তা ভেবেও কাটানো কঠিন
শয়তান খুঁড়ে যাচ্ছে – ‘আমাকে সন্তান দিন
আমাকে সন্তান এনে দিন…’
আর আমি, অতুলনীয়, কেঁদেছি শয়তানের পা’য় –
তোমাকে বলে না বসে
আমি অব্দি এসে যেন
ব্যালেন্স হারিয়ে সারাজীবন খাদেই পড়ে যায়!
অশান্তি
নিজেকে কুচিয়ে আকাশে ছুঁড়ে দিয়েছি। এরই মধ্যে কিছু টুকরো হারিয়ে যাবে সমুদ্রে। কিছু আনমনে পিষে ফেলবে মানুষ। ধাতস্থ হলে, টের পাব চোখদুটো এই লেখা পড়তে ব্যস্ত, হাতদুটো লিখতে; আর কাছেপিঠের শরীর, যেহেতু কিছুই নষ্ট হয় না, অপেক্ষা করে আছে কবে তুমি ঘেন্না সরিয়ে বলে উঠবে – সৎকার হোক!
একটা উবু-হওয়া আমি এসব ভাবতে ভাবতে হেসে উঠি। ঘাড় কোথায় গেল খুঁজতে থাকি, কেননা বেঁকিয়ে না-দেখা পর্যন্ত কিছুতেই শান্তি পাব না, তুমি জানো…
তোমার খাতিরে
লোকের অভাবে, বাউলমেশানো সুরে
নদীটি একাই বেরিয়ে পড়েছে পথে
যার সাথে দেখা হয় না কখনও জলে
সেও দুটি গান ফুটিয়ে তুলতে জানে
নদীটি অনেক দেশ দেখেছিল আগে
মানুষের লাশে মানুষের তরবারি
ভেসে যেত যার বুকের ওপর দিয়ে
সে কি গতিপথ বদলাতে পারবে না
একাকী বেরোলে খুঁজে তো নিতেই পারে
ঢালু কিছু খাত, মাথা-নিচু পরিবারও
বহুদিন ছোঁয়া পায়নি এমন গ্রামে
মসজিদ, শেষ জ্বলে-থাকা ভিটেমাটি
এখানে সমাধি পীরসাহেবের গানে
প্রতিদিন ধুয়ে দিতে বলে নদীটিকে
যা-কিছু গরিব, সহজে যায়নি পাওয়া
সহজের পথে সেটুকু বাঁচানো গেল
এ-পথও কঠিন, দমের সাধনা লাগে
ধরে রাখা যার জীবনের শেষ কথা
আসলে সবাই যেতে দিতে পেরে খুশি –
আপাতত হল, পরের ফিকির পরে
নদীও চলেছে এভাবে উজানধলে
বোশেখদুপুরে কীই বা স্রোতের মায়া
খানিক জিরিয়ে নেবে ও-দাওয়ার খুঁটে
যদি কিছু গান ভুল করে আসে হাতে
এমন ভুলের সরোবরে তুমি পাতা
ভেসে আছ আর ভালোও বেসেছ তাকে
তোমার খাতিরে এতদূর আসা গেল
নাহলে জীবন কলকাতা হয়ে থাকে
তন্ময় কবিতায়
বেবী সাউ
শব্দ মানে যাপনের একটা অংশ। শব্দ মানে মায়ামোহক্রোধ। জলজ্যান্ত জীবনের গল্প। তাকে হাঁটার জন্য দিতে হয় পথ। তাকে থাকার জন্য দিতে হয় ঘর। আর তারপরেই যেন শুরু হয় তার বসবাস। তার যাপন। তার একাত্মবাদের দরজা খুলে অপেক্ষা করেন একজন কবি। বহু বহু যুগ থেকে অচানক সেই ধ্বনি, যেন ক্রশবিদ্ধ চিৎকার দরজায় এসে ঠকঠক করে। মাঠের ওপাশে তখন কাটা ধান পড়ে আছে। গভীর জঙ্গলে চেঁচিয়ে উঠছে হত্যা। সবুজ জীবন এইসব রক্তাক্ত জখম দেখে কঁকিয়ে ওঠে বলছে–” উফ! মাগো!” আর তখনই যেন বিরাট বিশাল একটা লোহার মরচে পোড়া গেট খুলে গেল। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা সেই সময়টিতে ভেসে উঠল,
“আমার হাড়ের গায়ে লেগে আছে অপেক্ষা। তোমার
ছড়ি কি শুধুই ঘোরে? ছুঁয়ে দিয়ে ম্যাজিক করে না?
একবার তালু পাতো, চাল দেব ডাল দেব
দেব যা যা গেরস্থবাড়ির
সামনে বসিয়ে, কেন রোজ-রোজ বকো না দুপুরে?
আনাজ গুলিয়ে গেলে, কেন কৌটো বাইরে ফেলে দাও?
তোমার ম্যাজিক-দুঃখে আমিও সোনালি হতে পারি
গলা অব্দি গিলে এসে হাড়গোড় দেখাব তোমাকে
ছুঁয়ে দাও, সেরে উঠি, সতর্ক ঘোড়ার মতো
চাঁটি মারি নিজেরই কপালে
অথবা, অপেক্ষাটিকে এবার ভাসিয়ে দিই জলে…”
শব্দ আসলে ঈশ্বর। প্রেমিক। প্রেমিকা। নিদারুণ এক রসবোধের আঙ্গিকে মোড়া প্রেম-বিরহ-সুখ- দুঃখের উদযাপন। আর শত সহস্র বছরের লালন যেন তাকে সবুজ করে তুলছে আরও। এমনভাবেও বলা যায় শব্দের ক্লোরোফিল গঠনে সাহায্য করেন কবিরা। শিল্পীরা। পালটে যেমন দিতে পারেন অর্থের খেলাটিকে তেমনি এদিক-ওদিক করে এঁকে দিতে পারেন বাস্তবের, স্বপ্নের, পরাবাস্তবের সুগভীর আয়োজনটিকে। শব্দের মাধ্যমেই ফুটিয়ে তুলতে পারেন আনন্দ দুঃখের যাপনটিকে। এতকথা বলার একটাই কারণ, কেউ কেউ আজকাল বলেন, এখনকার বাংলা কবিতা শুধুমাত্র নাকি শব্দের পর শব্দ সাজানোর পালা। ভাব নেই, আলো নেই, যাত্রাপথ নেই। তাঁরা আরও বলেন, শব্দের এই খেলায় কবিতা ঠিক কবিতা হয়ে ওঠে না। তবে এইযে শব্দ দিয়ে আঁকার খেলা কবিরা করে চলেছেন, এ তাহলে কী? কবিতা মানে কী তবে একটা যাত্রা, যার গন্তব্য আছে? যার শেষ আছে? যাকে কিছু একটা মূল্যবোধ দিয়ে শেষের পথ খুঁজে নিতে হবে? তরুণ কবি তন্ময় ভট্টাচার্য-এর কবিতা পড়তে পড়তে আমরা কী সেই গন্তব্যকে খোঁজার চেষ্টা করবো? নাকি দেখবো কবির চোখ দিয়ে একের পর এক পৃথিবীর রূপকে? দৃশ্যকে? নাকি পথ হারানোর মতো হাত খুঁজবো কারও? আর সেই অন্ধকার পথের পাশে খুঁজে নেব একটি শান্ত, নিবিড় যাপনকে? হ্যাঁ, শান্ত নিবিড় যাপন চেয়েছি আমরা। শান্তির জন্যই অধিকারের জন্যই তো আমরা বারবার রণকৌশল শিখেছি, রক্ত ঝরিয়েছি। হত্যাকারীর হাত নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছি। কিন্তু তারপর? তারপর…
“নিজেকে কুচিয়ে আকাশে ছুঁড়ে দিয়েছি। এরই মধ্যে কিছু টুকরো হারিয়ে যাবে সমুদ্রে। কিছু আনমনে পিষে ফেলবে মানুষ। ধাতস্থ হলে, টের পাব চোখদুটো এই লেখা পড়তে ব্যস্ত, হাতদুটো লিখতে; আর কাছেপিঠের শরীর, যেহেতু কিছুই নষ্ট হয় না, অপেক্ষা করে আছে কবে তুমি ঘেন্না সরিয়ে বলে উঠবে– সৎকার হোক!
একটা উবু-হওয়া আমি এসব ভাবতে ভাবতে হেসে উঠি। ঘাড় কোথায় গেল খুঁজতে থাকি, কেননা বেঁকিয়ে না-দেখা পর্যন্ত কিছুতেই শান্তি পাব না, তুমি জানো… (অশান্তি)”
ঠিক তাই। বেঁকিয়ে না তুললে যেমন আজকাল ঘি ওঠে না কিছুতেই,তেমনি আমাদের দেখাটিতেও এসে মিশেছে খাদ। কিছুতেই সহজভাবে ধরা দেয় না দৃশ্য। দৃষ্টি কিছুতেই সহজ হতে পারে না আজকাল। আমরা কী প্রতি মূহুর্তে নিজেই নিজেকে সন্দেহপ্রবণ করে তুলছি না? আমরা কী নতুন কিছু দেখার, ভাবার মতো দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেছি? আর এই নিঃস্ব, নিঃসঙ্গ জীবনের পথচারী হতে হতে নিজের মধ্যেই জন্ম দিচ্ছি অশান্তির। কিছুতেই স্থির নই যেন! কিছুতেই কিছু নয় যেন! এই রহস্য রোমাঞ্চহীন যুগে শিখে যাই মানিয়ে নিতে… ঠিক যেন জলজ আকার আমাদের… জলজ জীবন…
“পেরেছি মানিয়ে নিতে। আর কিচ্ছু না বলা উচিৎ।
জগতের সব তর্ক স্থির হল এখানে, এখন
শুধু কবিতার দিকে জোর করে ঠেলে দেওয়া মন
বিকলাঙ্গ কথাবার্তা, হাসি-ঠাট্টা, একাকিত্বে ভয় –
তোমার সিদ্ধান্তে মুখ বুজে নয়,
ভেবেচিন্তে হ্যাঁ…
বাকিটা হলে কী হত, তা ভেবেও কাটানো কঠিন
শয়তান খুঁড়ে যাচ্ছে – ‘আমাকে সন্তান দিন
আমাকে সন্তান এনে দিন…’
আর আমি, অতুলনীয়, কেঁদেছি শয়তানের পা’য় –
তোমাকে বলে না বসে
আমি অব্দি এসে যেন
ব্যালেন্স হারিয়ে সারাজীবন খাদেই পড়ে যায়! “
তন্ময় ভট্টাচার্য-এর কবিতা পড়তে পড়তে এইসব দৃশ্যের মুখোমুখি হতেই হয় আমাদের। কবি খুব শান্ত, মৃদুস্বরে সেই দৃশ্যটিকে, অবস্থানটিকে তুলে আনেন আমাদের কাছে। যেন সব হারানোর পরেও নিঃস্ব হওয়ার একটা পুলক খেলা করে তাঁর কবিতার মধ্যে। শব্দের মধ্যে। আর তাই শান্ত হই। যেমন–
“যার কেউ নেই, তার তুমি তো আছোই
না না ঈশ্বর নও, অত ক্ষুদ্র ভাবি না তোমায়
যেন উৎসব, যেন মেলায় বেড়াতে এসে কেউ
চোদ্দপ্রদীপ কিনে ফিরে গেল, সারাটা জীবন
শাড়ির বিধবা পাড় ছিঁড়ে ছিঁড়ে সলতে বানাবে”
তাঁর কবিতায় নতুন এক ভাষার সন্ধান পাই। পাই আলো আঁধারি মেশা এক রহস্যময়ের পথের। আর সেই পথে এসে মেশে প্রেম, নিরাশা— বিক্ষুব্ধ পৃথিবীর অসহায় আত্মসমর্পণও। আর সেই শব্দ আর অর্থের চিরপরিচিত গণ্ডি থেকে বেরিয়ে তিনি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন অন্য এক মানে। অন্য এক সময়। সলতে দিয়ে নিজের হাতে জ্বালিয়ে দেওয়া সেই আলো। সেই আধার এবং আঁধারের খেলা।
আর তখনই প্রজ্ঞা এবং প্রাজ্ঞজনের কথা ভুলে কবিতার কাছে চেয়ে বসি, পরমার্থ লোভ। নিজেকে বিলিয়ে, কবি তন্ময় ভট্টাচার্য-এর শব্দে উচ্চারণ করে বসি…
“এইসব অনাকাঙ্ক্ষা, প্রিয়বোধ
জীবনের যত শুদ্ধ অনাচার
সব আজ ঘিরে এল
দ্যাখো মৃত্যু, দ্যাখো শোধ
অসমাপ্ত নদীটিকে কীভাবে ফিরিয়ে দিচ্ছে… “