আমার মরিসন

টোনি মরিসন | সাহিত্যিক

পূর্ণা চৌধুরী

 

সারা লাদিপো মানিয়েকা নাইজেরিয়ার মেয়ে। সারা লাদিপো মানিয়েকাকে আমি হিংসে করি। কারণ, সে হাডসন নদীর ধারের একটা বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকে পড়েছিল। সে বাড়ির গিন্নির নাম টোনি মরিসন। আফ্রিকান মার্কিন সাহিত্যের সম্রাজ্ঞী। দেবীদর্শন নিয়ে আমার তেমন মাতামাতি নেই। ঈর্ষার কারণ সেটা নয়। কারণটা হল এই, বাড়ির মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে সারা পৌঁছে গিয়েছিল অতিথিদের বাথরুমে। সেখানে বিশ্বসাহিত্যের দিকপালদের দেওয়ালজোড়া ছবি: Soyinka, Marquez, Baldwin। ঠিক বেসিনের ওপরে, যেখানে আমাদের মতো মানুষরা একটা আয়না ঝুলিয়ে দেয় সেখানে, সারা দেখেছিল, ঝোলানো আছে মরিসনের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির ঐতিহাসিক চিঠি আর ঠিক উল্টোদিকে, টয়লেট সিট-এর ঠিক ওপরে টেক্সাস জেলে তাঁর Paradise  বইটির  বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ‘Public Denial Notification’-এএকখানি ছবি। কারণটাও বলা ছিল সেই চিঠিতে। ওরকম বই পড়লে নাকি কয়েদিদের বিদ্রোহ করার সমূহ সম্ভাবনা।

“Here is the House.” The Bluest Eye (1970)

আশ্চর্যের কথা হল এই, সারা বলেছে, “বাড়ির তেমন কিছু বিশেষভাবে আমার মনে নেই, যদিও দেখার মতো জিনিস আরও অনেক কিছুই ছিল বাড়িতে।” বাড়ির মধ্যে ওই খাপছাড়া বাথরুমটাই একটা রূপক হয়ে দাঁড়িয়েছিল সারার চোখে। ওকে এই কারণেই হিংসে করি আমি। কত সহজে ধরে ফেলেছিল মরিসনের আসল চরিত্রটা! ওইভাবেই মানুষটাকে বুঝে নিয়েছিল সে। নানা ধরনের বৈপরীত্যর মধ্যবর্তী অবস্থানে নির্দ্বিধায় কাটিয়েছেন জীবনের মতোই, নাইজেরিয়ান হয়েও আফ্রিকান না। ঘরে থেকেও ঘরণী না, সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েও দ্রোহের আসামি, আর কী আশ্চর্য, বারাক ওবামা যে তাঁর কানে ফিসফিস করে বলেছিলেন, “আমি আপনাকে ভালোবাসি”, সে কথাও বেমালুম লুকিয়েছিলেন তিনি: “কী যেন বলছিলেন, সব কথা কি আর মনে থাকে!” কিছুতেই কিছু আসে যায় না তাঁর। অথচ, কী ব্যাপ্তি। বর্ণনার অতীত হয়ে প্রতিবাদে, প্রতিশোধে, ভালোবাসা আর প্রার্থনায় অবাধে ঘুরে বেড়িয়েছেন মানুষটা। বুঝ জন যে জান সন্ধান।

Chloe Ardelia Wofford। বারো বছর বয়েসে নিজের ইচ্ছেয়  ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। নাম বেছেছিলেন Anthony, তার থেকে ছোট করে Toni!

১৯৭০ The Bluest Eye; ১৯৭৩ Sula; ১৯৭৭ Song of Solomon; ১৯৮১ Tar Baby; ১৯৮৭ Beloved; ১৯৯২ Jazz ; ১৯৯৭ Paradise; ২০০৩ Love; ২০০৮ A Mercy; ২০১২ Home; ২০১৫ God Help the Child.  এছাড়াও আছে অজস্র গল্প, প্রবন্ধ, বক্তৃতা।

শেষ উপন্যাস God Help the Child পড়া হয়ে ওঠেনি এখনও। বেশ দেরিতে জেনেছিলাম ওঁর কথা। তখন ইউনিভার্সিটিতে। এমএ ক্লাসের ছাত্রী। ব্রিটিশ সাহিত্য পড়ে পড়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি। হঠাৎই এক বন্ধুর বাড়িতে দেখি, টেবিলের ওপর পড়ে আছে একটা বই। নামটা অদ্ভুত Song of Solomon বাইবেলের গল্প ভেবে সরিয়ে রাখতে রাখতে, কী ভেবে পাতা উল্টালাম। সেই শুরু। গদ্য এরকম হয়! প্রতিটি পাতায় কবিতার ঝঙ্কার। অথচ সুন্দর নয় কোনওমতেই। ঠিক যেন ক্ষত থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে, আর সেই চুঁইয়ে পড়া রক্ত দিয়ে তৈরি হচ্ছে এক একটা ছবি। কালো মানুষের সুখ দুঃখ বঞ্চনা বিশ্বাস আর বিশ্বাসভঙ্গের কবিতা অথবা গান। ভালোবাসার কথাও আছে। কিন্তু সে ভালোবাসা গভীরতর ক্ষত। “Love is divine and difficult always. If you think it is easy you are a fool.” (Paradise) এসবই টুকরো টুকরো কথা। কাব্যের মাধুর্য দিয়ে কালো মানুষদের জীবনের ছেঁড়াখোঁড়া তমসুক, অথবা মহাকাব্য। এক একটা পরিচ্ছেদ যেন এক একটা স্তবক। আর সমস্ত লেখাটা স্তবকে গাঁথা গদ্যকাব্য: তাতে সব আছে— চিত্রকল্প, রূপক, ছন্দ, ধ্রুবপদ, পুনরাবৃত্তি— বিনি সুতোয় গাঁথা, বারবার খুব সচেতনভাবে ফিরে ফিরে আসছে গানের অনুষঙ্গ: “misery colored by the greens and blues in my mother’s voice took all of the grief out of the words and left me with the conviction that pain was not only endurable but sweet… But without song those Saturdays sat on my head like a coal scuttle.”

তাঁর চতুর্থ উপন্যাস Tar Baby বিষয়ে তিনি নিজেই বলেছেন কালো আমেরিকা আসলে একট গ্রামীণ গাথা: “The singing woman . . . had wrapped herself up in an old quilt instead of a winter coat. Her head cocked to one side, her eyes fixed on Mr. Robert Smith, she sang in a powerful contralto.” গরীব কালো মানুষের কথামালা, বিশেষ করে যেসব কথা সাদা পৃথিবীর মানুষরা কখনও শুনতেই পায়নি, সে সব বোবা দুঃখ তিনি গানের ভাষায় শুনিয়েছেন। কখনও সেই গাথায় এসে পড়েছে gospel, কখনও লোকগীতি, কখনও Blues। চরিত্ররা নাচে গায়, কখনও সুরে কখনও বেসুরে। পাপবোধও গান: “Guilt and Impotence rose in a bilious duet”। আর যাঁরা সেই গান শোনেন, তাঁরা তার তালে তালে নাচেন অথবা পাথর হয়ে যান। যেমন আমি। যেমন আমার মতো আরও অনেকে। কখনও কখনও মনে হয়েছে এত গভীর দুঃখের গান না শোনালেই পারতেন তিনি। মনে হয়েছে এত তীব্রতা ভালো না। আর একটু কম সুরেলা হওয়া উচিত এই বিষণ্ণতার। কিন্তু এ তো কালো মানুষের গান, খোলা গলায় গাওয়া! নাগরিক শীতাতপনিয়ন্ত্রিত নন্দন নয়। অতএব পড়ে চলি, পড়ে চলতে হয়।

দুটি মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছিলেন মরিসন, একজন ঠাকুমা আর একজন মা। ঠাকুমা সাত-সাতটি ছেলেমেয়ে আর পকেটে তিরিশ ডলার নিয়ে পালিয়েছিলেন আমেরিকার দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে, বড় হয়ে ওঠা মেয়েকে সাদা পুরুষদের আক্রমণ থেকে বাঁচাতে। মা একের পর এক ‘ছোট’ কাজ করে গেছেন কলেজে পড়া মেয়েকে টাকা পাঠানোর জন্যে। যাতে তাঁর মেধাবী মেয়ের তাঁর মতো ঘেন্নার জীবন না হয়। এইসব গভীর ক্ষতর বোধ শান দিয়েছে তাঁর কলমকে।

মরিসনের পৃথিবী এইসব মা মেয়েদের। দুর্ভাগ্যের বোঝা বইতে বইতেও তারা নাচে, গায়, ভালোবাসে। তাদের কথাই বেজেছে তাঁর গল্পে উপন্যাসে। Belovedএ যেমন  Baby Suggs আর Sethe। শাশুড়ি আর বউ। “Those white things have taken all I had or dreamed,” she (Baby Suggs) said, “and broke my heartstrings too. There is no bad luck in the world but whitefolks.” সেই ভাঙাচোরা শরীর আর মন নিয়েই গান গায় Baby Suggs। সাদা মানুষের অত্যাচার তার শরীর, তার কোমর হাত পা সব বেঁকিয়ে ভেঙে দিয়েছে। তার সাত-সাতটা ছেলে মেয়ে কেড়ে নিয়েছে। তাদের মুখও মনে করতে পারে না সে আর। তাও সে “তিনঠেঙে কুকুরের মতো” নাচে আর ভাঙা গলায় গান গায়: সাদা মানুষদের অত্যাচার, কালো মানুষদের জ্বালা যন্ত্রণা এইসব নিয়ে। আর তাদের উত্তরণের গান গাইতে শেখায়। তার ছেলের বৌ Sethe সেই গান শিখতে পারে না। তার স্বামী কোথায়, সে জানে না। সাদা মানুষের আক্রোশ আর নিজের স্ত্রীর ধর্ষণ দেখে সে নাকি পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু Sethe তা বিশ্বাস করে না। তার দুধের মেয়েটাকে সে কুপিয়ে মেরেছে দাসব্যবসায়ীদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে। তাকে যখন জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তার বুক তখন দুধ আর রক্তে ভেজা। এমনি সব মেয়েরা হাতধরাধরি করে থাকে মরিসনের পৃথিবীতে আর পিষে যাওয়া কালো মেয়েদের বাঁচার গান শেখায়।

এইভাবেই আমি দেখি মরিসনকে। আমার মরিসন। সবকিছু ছাপিয়ে মেয়েদের দুঃখ ভালোবাসার বৃন্দগান। কষ্ট চেনায়, ভালোবাসতে শেখায়। জড়িয়ে মড়িয়ে থাকতে শেখায়: “[Hagar] needed what most colored girls needed: a chorus of mammas, grandmammas, aunts, cousins, sisters, neighbors, Sunday school teachers, best girlfriends, and what all…” (Song of Solomon).

তারপর, সেটা আস্তে আস্তে হয়ে যায় কামেরিকার কালো মানুষদের গাথা। সেই গানে মিশে যায় আফ্রিকা, প্রকৃতি, শরীর, ঈশ্বর। তারপর তাতে দল বেঁধে আসে পুরুষেরা, শিশু, বৃদ্ধ মাঝবয়সী, সবাই। তারাও মেয়েদের সঙ্গে গলা মেলায়, নাচে। “Women stopped crying and danced; men sat down and cried; children danced, women laughed, children cried until, exhausted and riven, all and each lay about the Clearing damp and gasping for breath. In the silence that followed, Baby Suggs, holy, offered up to them her great big heart.” (Beloved)

মরিসনের সব উপন্যাস পড়তে পড়তেই মনে হয়েছে আমি দাঁড়িয়ে আছি আমেরিকার কোনও কালো মানুষদের চার্চে। অর্গানের গম্ভীর আওয়াজের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ভরাট সুন্দর কালো মেয়ে পুরুষদের গলা। “You wanna fly, you got to give up the shit that  weighs you down.” ধ্রুবপদে ফিরে ফিরে আসছে আফ্রিকা, আটলান্টিক, বঞ্চনা, প্রেম ভালোবাসা আর উত্তরণের প্রার্থনা।

এভাবেই বুঝেছি মরিসনকে। এভাবেই বুঝিয়ে যাব আমার ছাত্রছাত্রীদের, যারা দুই চোখ বড় বড় করে শুনবে আর পড়ানো শেষ হয়ে গেলে খুব নিচু গলায় বলবে, “এমন লেখা আগে কখনও পড়িনি। যা লিখেছেন সব সত্যি?” আমি বলব, “হ্যাঁ, সব। কিন্তু গানটা ভুলো না। কথার সঙ্গে গানটা শোনাও জরুরি”।

Amen

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...