স্টেশন মাস্টার
…ইহারই উলটাদিকে, বিজ্ঞানীদের এ-হেন সাবধানবাণীতে কর্ণপাতমাত্র না-করিয়া ব্রাজিলে আমাজন অববাহিকার বর্ষণবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটাইয়া অরণ্য সাফ করিবার মহাযজ্ঞ চলিয়াছে সে-দেশের দক্ষিণপন্থী সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে, মেরু-অঞ্চলে বরফ গলিয়া যাইবার খবরে মার্কিনদেশের কর্ণধার উৎসাহিত হইয়া বলিয়াই ফেলিয়াছেন, তবে আর কী, এইবার সে স্থলে সমুদ্রবক্ষে জাহাজ চালানো হউক, ঘুরপথে বাণিজ্যের খরচ কমিবে। এমত পরিস্থিতিতে, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম ওয়েব-পত্রিকার তরফে আমরা আরও একবার অনুধাবন করিতে চাহিয়াছি বিপদের সম্ভাব্য চেহারা ও চরিত্রকে।… আশা রাখি, রচনাগুলি পাঠ করিয়া পাঠকচিত্তে কিঞ্চিৎ ভয়ের উদ্রেক হইবে। বস্তুত আমরা চাই, পাঠক ভয় পান, কারণ ভীতিকর পরিণতির কথা জানিয়াও ভয় না-পাওয়া মূঢ়তা ও জড়বুদ্ধিতার লক্ষণ।
দেশ জুড়িয়া প্রকৃতির খামখেয়ালিপনা দিন-দিন বাড়িয়া চলিয়াছে। শুধু দেশের কথা কেন, বস্তুত গত দুই দশক ধরিয়া গোটা পৃথিবীব্যাপী আবহাওয়া ক্রমে পালটাইয়া যাইতেছে, সে-বিষয়ে বিভিন্ন মহলে যথেষ্ট আলোচনাও শুরু হইয়াছে। প্রকৃতির এ-হেন বিমাতৃসুলভ আচরণের পশ্চাতে উষ্ণায়ণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব সম্পর্কে পরিবেশবিদরা বিগত কয়েক দশক ধরিয়া ক্রমাগত চেতাবনি দিয়া আসিতেছিলেন, কিন্তু সময় যত গড়াইয়াছে সেই সাবধানবাণী আর কেবল আশঙ্কার পর্যায়ে সীমায়িত না-থাকিয়া ক্রমান্বয়ে ঘোরতর বাস্তবে পরিণত হইয়াছে। এক্ষণে ইহা আর কেবল আশঙ্কার স্তরেই সীমাবদ্ধ নাই, সংবাদমাধ্যমে প্রতিনিয়ত জলবায়ু পরিবর্তনের বিষময় ফল আমরা প্রত্যক্ষ করিতেছি।
গত মাসকয়েক ধরিয়া দেশের আবহাওয়া দফতর বলিয়া আসিতেছিলেন, এই বৎসর যথেষ্ট বৃষ্টির সম্ভাবনা নাই, ফলত কৃষিক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়িবার আশঙ্কা দেখা দিয়াছিল। গত কয়েক বৎসর ধরিয়া দেশের কৃষকেরা অনাবৃষ্টির আশঙ্কা মাথায় লইয়া চাষবাস করিয়াছেন, ধারকর্জ করিয়া ক্ষেতে সেচ দিয়াছেন, কিন্তু ফসলের যথাযথ দর না-পাইয়া কষ্টের লগ্নি মাঠেই ফেলিয়া বিপুল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হইয়াছেন, দাদনের টাকা মহাজনকে মিটাইতে না-পারার পরিণামে তাঁহাদের অনেকেই আত্মঘাতী হইয়াছেন। নূতন সরকারের ক্ষমতায় আসিবার পর প্রথম কেন্দ্রীয় বাজেট তৈয়ার করিতে বসিয়া নীতিপ্রণেতাগণ তাই সম্ভাব্য খরার প্রস্তুতি লইতে শুরু করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহার পর মাস ঘুরিতে না-ঘুরিতেই প্রকৃতি তাহার ভোল সম্পূর্ণ বদলাইয়া ফেলিল। দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অতিবর্ষণ ও তৎপ্রভাবে অভূতপূর্ব বন্যার কবলে পড়িল। একমাস আগেও যে কৃষক জলাভাবে বীজতলা বানাইতে পারিতেছিলেন না, তাঁহারই চক্ষের সম্মুখে শস্যচারা জলে ডুবিয়া নষ্ট হইতে লাগিল। শুরু হইয়াছিল নমনি অসম ও উত্তর বিহারে, তৎপরে মহারাষ্ট্রের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, ও কর্ণাটক অতিবর্ষণে প্লাবিত হইয়া পড়িল। মুম্বই শহর বর্ষার জলে ফি-বৎসরই ডুবে, কিন্তু এইবার সেইখানে যে বন্যা ঘটিল, তাহা সর্বার্থেই অভূতপূর্ব। একই চিত্র তামিলনাড়ু, কেরল, অন্ধ্র ও মধ্যপ্রদেশের কিয়দংশেও। অথচ কিমাশ্চর্যম্– দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণে যখন বর্ষণবাহুল্য, এমনকী উত্তরবঙ্গেও যখন অতিবৃষ্টি, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন ঝাড়খণ্ড সেই সময় প্রায় শুখাই রহিয়া গেল। প্রকৃতিবিদরা বলিলেন, মৌসুমি বায়ুর এই বিচিত্র আচরণের পশ্চাতে রহিয়াছে বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট এল নিনো এফেক্ট— অর্থাৎ এককথায়, দেশের বর্ষণ-মানচিত্রের এই আচমকা পরিবর্তন বিশ্ব উষ্ণায়নেরই পরোক্ষ ফল। আমরা ভাবিতেছিলাম, ফি-বৎসরের ন্যায় এ-যাত্রাও খরায় ব্যাঙের বিবাহ দিয়া ও বৃষ্টিতে নেবুপাতায় করমচা-গীত গাহিয়া সামাল দেওয়া যাইবে; কিন্তু পরিবেশবিদগণ বলিলেন, সুখের সে দিন গিয়াছে, এইবার আরও বড় ও দীর্ঘমেয়াদি বিপদের জন্য প্রস্তুত হইবার পালা।
শুধু অনাবৃষ্টি বা অতিবর্ষণ নহে, আবহবিদ ও পরিবেশবেত্তাগণের দাবি,পালটাইতেছে বিশ্বব্যাপী বায়ুপ্রবাহের নির্দিষ্ট ছকও। গত কয়েক বৎসরে সারা পৃথিবীতেই আঘাত হানিয়াছে একের পর এক প্রলয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় ও সাইক্লোন। আমাদিগের ওড়িশা এবং অন্ধ্র উপকূল হইতে শুরু করিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব ও পশ্চিম উপকূল— সর্বত্রই চিত্রটি একইরকম। বিজ্ঞানীরা বলিতেছেন, অসময়ের এই তুফানের পশ্চাতেও কার্যকর উষ্ণায়নের অতি জটিল ও বহুস্তর প্রভাব। তৎসহ উত্তর মেরু-অঞ্চলে অত্যধিক হারে বরফ গলিতে থাকায় প্রকৃতির ভারসাম্য বিপজ্জনকভাবে নষ্ট হইতেছে। তাঁহাদের দাবি, সময় আর বেশি বাকি নাই— আর অর্ধ-শতকের মধ্যেই আমরা পৌঁছাইব ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’-এ— সে এমন এক বিন্দু, যেখান হইতে ফিরিবার আর পথ থাকিবে না। এবং শুধু বৃষ্টিপাত বা বায়ুপ্রবাহের উপরই নহে, প্রকৃতির এই ভারসাম্য-বিনষ্টির ফলে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে প্রাণী ও জীবকুল। ইহারই উলটাদিকে, বিজ্ঞানীদের এ-হেন সাবধানবাণীতে কর্ণপাতমাত্র না-করিয়া ব্রাজিলে আমাজন অববাহিকার বর্ষণবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটাইয়া অরণ্য সাফ করিবার মহাযজ্ঞ চলিয়াছে সে-দেশের দক্ষিণপন্থী সরকারের প্রত্যক্ষ মদতে, মেরু-অঞ্চলে বরফ গলিয়া যাইবার খবরে মার্কিনদেশের কর্ণধার উৎসাহিত হইয়া বলিয়াই ফেলিয়াছেন, তবে আর কী, এইবার সে স্থলে সমুদ্রবক্ষে জাহাজ চালানো হউক, ঘুরপথে বাণিজ্যের খরচ কমিবে।
এমত পরিস্থিতিতে, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম ওয়েব-পত্রিকার তরফে আমরা আরও একবার অনুধাবন করিতে চাহিয়াছি বিপদের সম্ভাব্য চেহারা ও চরিত্রকে। এই সংখ্যার রিজার্ভড বগি-তে বিষয়গুলিকে আমরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হইতে দেখিতে যেমন চাহিয়াছি, তেমনই চাহিয়াছি, যেন, আলোচনাগুলি পাঠ করিয়া আমরা আর একটু বেশি সচেতন হই— অন্তত আপনার হাতে আপনাদিগের ভবিষ্যৎকে বরবাদ করিবার খেলায় মাতিয়া উঠিবার পূর্বে যেন স্মরণে রাখি, অন্য কাহারও হস্তে নহে, খাল কাটা হইয়াছিল আমাদিগের অপরিসীম লোভ ও অর্থলালসার হস্তেই। আপন মৃত্যু আপনারাই ডাকিয়া আনিয়া, এই সুপরিকল্পিত হত্যাদৃশ্য সংঘটিত করিয়াছিলাম নিজেরাই।
এই সংখ্যার রিজার্ভড বগি-তে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য-বিনাশ ও তাহার সম্ভাব্য ফলাফলের বিভিন্ন দিক লইয়া লিখিয়াছেন সফিউল, দীপঙ্কর দে, পড়গুম্মি সাইনাথ, মেধা কালে, তানিয়া লস্কর, অপরাজিতা সেনগুপ্ত এবং সত্যব্রত ঘোষ। আশা রাখি, রচনাগুলি পাঠ করিয়া পাঠকচিত্তে কিঞ্চিৎ ভয়ের উদ্রেক হইবে। বস্তুত আমরা চাই, পাঠক ভয় পান, কারণ ভীতিকর পরিণতির কথা জানিয়াও ভয় না-পাওয়া মূঢ়তা ও জড়বুদ্ধিতার লক্ষণ।
রিজার্ভড বগি ব্যতীত আর দুইটি বিষয় আপনাদিগকে সবিশেষ জানাইবার। প্রথমত, গত সংখ্যায় ‘অন্য ভ্রমণ’ বিষয়ে প্রচ্ছদকাহিনির পরিকল্পনা পাঠকদিগের পছন্দ হওয়ায়, এই সংখ্যা হইতে ‘ডিসট্যান্ট সিগন্যাল’ নামক নূতন নিয়মিত বিভাগে আমরা ভ্রমণ-বিষয়ক রচনা প্রকাশের সিদ্ধান্ত লইলাম। গত সংখ্যায় আমরা নীলাঞ্জন হাজরার সুদীর্ঘ ভ্রমণবৃত্তান্ত ‘মুসাফির এ মন’-এর প্রথম অংশ প্রকাশ করিয়াছিলাম, এই সংখ্যায় রহিল সেই রচনারই দ্বিতীয় পর্ব। দ্বিতীয়ত, পীযূষ ভট্টাচার্য মহাশয়ের ধারাবাহিক উপন্যাস ‘অন্তেবাসী’-র প্রকাশ লেখকের অসুস্থতাজনিত কারণে গত কয়েকমাস স্থগিত ছিল, এই সংখ্যা হইতে তাহা পুনরায় নিয়মিত প্রকাশিত হইবে।
সদ্যোপ্রয়াত মার্কিন ঔপন্যাসিক টোনি মরিসন ও কোচবিহারের সাইটোল-শিল্পী ফুলতি গিদালিকে লইয়া দুইটি মূল্যবান প্রবন্ধ রহিল এই সংখ্যার স্মরণ বিভাগে। রহিল প্রয়াত শিল্পী রথীন মিত্র ও তাঁহার কাজ লইয়া একটি স্মরণমূলক রচনা। একইসঙ্গে, শতবর্ষে আমরা স্মরণ করিলাম এভারেস্ট-বিজয়ী এডমান্ড হিলারিকে।
এতদ্ব্যতীত গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, অন্যগদ্য, ধারাবাহিক রচনা ও অন্যান্য সমস্ত বিভাগ, এবং শেষপাতে ভাল খবর-সহ সকলই যথাযথ রহিল।
পরিশেষে নিবেদন, আপনারা যাঁহারা সারা মাস ধরিয়া পত্রিকাটির অপেক্ষায় থাকেন, মাস-পহেলায় তাঁহাদিগের হস্তে কাগজটি তুলিয়া দিতে মাঝেমধ্যে সামান্য বিলম্ব হইয়া যায়। এই সংখ্যায় যেমন এক তারিখের পরিবর্তে এইবার কাগজ বাহির হইল দুই তারিখে। কারণ হিসেবে জানাই, অন্যান্য সব কাগজের মতোই আমরাও কিছু লেখা একেবারে শেষ মুহূর্তে পাই, তৎসহিত সাইটের আপগ্রেডেশন-জনিত কিছু কাজকর্ম সারিতে কিঞ্চিৎ সময় লাগে। আমাদিগের লোকবল ও ‘ব্যান্ড-উইড্থ’ উভয়ই সীমিত, অপিচ উচ্চাশা প্রবল, সর্বোপরি আপনাদিগের প্রশ্রয় পাইয়া ধারণা হইয়াছে যে, কাগজ-প্রকাশে সামান্য দেরি হইলেও আপনারা নিজগুণে ক্ষমা করিয়া দিবেন।
নমস্কার জানিবেন। ভাল থাকিবেন।