চার নম্বর নিউজডেস্ক
ভাষা যোগাযোগের মাধ্যম। প্রাইমেটদের যূথ থেকে মানুষী সমাজে উত্তরণের মাধ্যম ছিল ভাষা। এই নব নব উদ্ভাবনশীল, অতি নমনীয় মাধ্যমটি না আবিষ্কৃত হলে প্রজাতি হিসেবে মানুষের গোটা বিশ্ব জুড়ে এহেন আধিপত্য কায়েম করা সম্ভব হত না।
কিন্তু ভাষা আবার বিভাজনও ঘটায়। ওল্ড টেস্টামেন্টে টাওয়ার অফ ব্যাবেলের কাহিনী ভাষার এই বিভাজক সত্তা সম্পর্কে সচেতন করতে চায়। যখন ভাষার বলে বলীয়ান মানুষ বিরাট উঁচু এক মিনার বানিয়ে স্বর্গ ছুঁয়ে ফেলেছে প্রায়, তখন ঈর্ষাপরায়ণ ঈশ্বর শুধু সেই মিনারকেই ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হলেন না– স্পর্ধার শাস্তি হিসেবে, এবং ভবিষ্যতে স্বর্গকে মানুষের থেকে সুরক্ষিত রাখতে, মানুষজাতিকে টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিলেন মরুবিশ্ব জুড়ে। একসময় ভাষার বন্ধন যাদের এক করে রেখেছিল, ভাষার ছুরি চালিয়েই তাদের ভাগ করলেন তিনি।
আমাদের দেশে টাওয়ার অফ ব্যাবেলের গল্প খুব প্রাসঙ্গিক। ট্রেনে চেপে যে কোনও দিকে এক রাতের সফর করলেই এ দেশে একাধিক ভাষা সীমানা পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব। সংবিধান আমাদের দিয়েছে দেশের যে কোনও জায়গায় যাওয়ার, কাজকর্ম খোঁজার ও বসবাস করার স্বাধীনতা, কিন্তু ভাষার ভিন্নতা এই স্বাধীনতাকে সীমিত করে। কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে গেলে তেমন সমস্যা হয় না, কারণ পর্যটকদের স্থানীয় ভাষা না জানলেও চলে। দোকানে, হোটেলে দিব্যি হিন্দি বা ইংরেজি দিয়ে কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। হোয়াইট কলার জব নিয়ে যারা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বড় শহরে, তাঁদেরও বিশেষ সমস্যা হয় না ওই লিঙ্ক-ল্যাঙ্গুয়েজের কল্যাণে। কিন্তু যখন অল্পশিক্ষিত, শুধু নিজের রাজ্যের ভাষায় কথা বলতে পারা মানুষজন পেটের তাগিদে অন্য রাজ্যে আসতে বাধ্য হন, তখন ভাষা বিভাজনের প্রাচীর মাথা চাড়া দেয়। বিশেষত এই সমস্ত কর্মীদের ছেলেমেয়েদের জন্য। নতুন রাজ্যে স্কুলে ভর্তি হয়েও তারা এগোতে পারে না বেশি দূর, পড়াশুনো ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় অনেক ক্ষেত্রেই। এই সব শিশুদের অনেকেই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া হওয়ায় তাদের পরিবারও খুব বেশি মাথা ঘামায় না তাদের স্কুলছুট হওয়া নিয়ে।
দেশের যে সব রাজ্যে এই সমস্যাটা প্রকট তার অন্যতম হল কেরল। সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের ২০১৮-র এক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৩ সাল অবধি রাজ্যটি চব্বিশ লক্ষ ভূমিপুত্রকে বিদেশে পাঠিয়েছে। এই অনাবাসী জনসংখ্যার কল্যাণে প্রচুর অর্থ আসে বটে, কিন্তু একই সঙ্গে স্থানীয় অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে কেরলকে অনেকটাই নির্ভর করতে হয় অন্য রাজ্য থেকে আসা কর্মীদের ওপর। যেসব রাজ্য থেকে কেরলে কর্মী আসে তাদের মাঝে প্রায় কুড়ি শতাংশ কর্মীর যোগান দিয়ে প্রথম স্থানে আছে পশ্চিমবঙ্গ। তারপর বিহার, আসাম ও উত্তরপ্রদেশ। ফলত বর্তমানে কেরলের জনসংখ্যার দশ শতাংশের কাছাকাছি ভিন রাজ্য থেকে আসা এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ভাষাগোষ্ঠীর মানুষ। কর্মীদের অনেকেই সপরিবার আসেন। ছেলেমেয়েরা ভর্তি হয় স্থানীয় স্কুলে, কিন্তু কিছুদিন পর এইসব ছেলেমেয়েদের একটা ভালো অংশ স্কুল ছেড়ে দেয়। এতে তাদের ভবিষ্যৎ যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা তো পরিষ্কার। আর স্কুলছুট হওয়ার এই প্রবণতার পেছনে একটা বড় কারণ হিসেবে কাজ করে মালয়ালম শেখার অসুবিধা। বাংলা, হিন্দি বা অহমীয়ার সঙ্গে যে ভাষাটার কোনও মিলই নেই প্রায়!
সৌভাগ্যক্রমে কেরল সরকার ভিনরাজ্য থেকে আসা কর্মী-শ্রমিকদের সম্পর্কে উদাসীন নয়। এদের সামাজিক মূলস্রোতে টেনে আনার জন্য একাধিক কর্মসূচি আছে, যেমন ‘আপনা ঘর’ বা ‘আওয়াজ’। এই তালিকায় নবতম সংযোজন হল ‘রোশনি’, যার লক্ষ্য ভিনরাজ্য থেকে আসা শিশুদের মালয়ালম শিখতে সাহায্য করা। এর্নাকুলাম জেলায় চালু হওয়ার পর মাত্র দু বছরে ‘রোশনি’ স্কুলছুট ছাত্রের পরিমাণ কমিয়ে এনেছে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ।
ভালো খবর এটাই যে ‘রোশনি’ ওপর থেকে চালু করা কোনও প্রকল্প নয়, তার গোড়াতে আছে কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। প্রকল্পটি ওপর থেকে নেমে আসেনি, বরং নীচ থেকে একটু একটু করে ওপরে উঠছে, যেমন করে বড় হয় সজীব সব কিছুই।
‘রোশনি’র শুরু হয় ২০১৪ সালে এর্নাকুলাম জেলার বিনানিপুরমের এক প্রাইমারি স্কুল থেকে। ঐ স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেওয়ার পর জয়শ্রী (বর্তমানে ‘রোশনি’র অ্যাকাডেমিক কো-অর্ডিনেটর) দেখেন যে স্কুলের অর্ধেক ছাত্রই ভিনরাজ্য থেকে আসা। স্কুলের মাধ্যম মালয়ালম, এদিকে মালয়ালমে এই সব ছাত্ররা সাবলীল নয় একদমই। ফলত তারা পড়াশুনায় পিছিয়ে পড়ছে। ২০০৮ থেকে এরকম স্কুলগুলোতে সর্বশিক্ষা অভিযানের তরফে স্বেচ্ছাসেবী কর্মী নিয়োগ করা হলেও তাতে খুব বেশি লাভ হচ্ছিল না। অতএব ২০১৫-র সেপ্টেম্বরে জয়শ্রী সহ আরও কয়েকজন শিক্ষিকা ও স্বেচ্ছাসেবী মিলে একটা পাইলট প্রোজেক্ট চালু করেন। প্রথম ধাপে মাত্র এগারো জন (যাদের বেশিরভাগই হিন্দিভাষী) ছাত্রকে নিয়ে। এই শিক্ষকরা উপলব্ধি করেন যে সরাসরি বর্ণপরিচয়ের মাধ্যমে মালয়ালম শেখানোর পদ্ধতি এইসব বাচ্চার ওপর খাটবে না। তাই দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে এঁরা গড়ে তুলতে থাকেন এক নতুন ধরনের কৌশল যেখানে গান, ছবিতে গল্প ইত্যাদি ব্যবহার করে মালয়ালম শেখানো যাবে। এই শিক্ষাপদ্ধতি তৈরি করতে এদের সাহায্য করেন ভাষাবিদ কে আনন্দন। শুরু করার মাত্র তিন মাসের মধ্যেই বোঝা যায় নতুন পদ্ধতি বেশ কার্যকর হয়েছে; মালয়ালম ভাষায় ব্যবহৃত ছাপ্পান্নটি ফোনিমের মধ্যে ষোলটি বেশ রপ্ত করে ফেলেছে ছাত্ররা।
এরপর ২০১৭ সালে এই পাইলট প্রোজেক্টের কথা জানতে পারেন এর্নাকুলমের তৎকালীন জেলাশাসক মহম্মদ সফিরুল্লা, এবং জেলাপ্রশাসনের উদ্যোগে বিনানিপুরম সহ চারটি স্কুলে শুরু হয় প্রোজেক্ট রোশনি-র প্রথম দফার কাজ। যেহেতু রোশনি-র অন্তর্গত ছাত্ররা বাকিদের থেকে দেড়ঘণ্টা আগে স্কুল শুরু করে, তাই তাদের জন্য ব্যবস্থা হয় জলখাবারের। খরচ বহন করতে জেলা প্রশাসনের পাশে দাঁড়ায় ভারত পেট্রোলিয়াম। পরবর্তী বছরে ‘রোশনি’ ছড়িয়ে পড়ে আরও ষোলটি স্কুলে। বর্তমান শিক্ষাবর্ষে জেলার আটত্রিশটি স্কুলকে এর আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।
রোশনি-র সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হলেন কিছু স্বেচ্ছাসেবী কর্মী, যারা ভিনরাজ্য থেকে আসা ছাত্রদের ভাষাটা জানেন। যেমন ওড়িশার সুপ্রিয়া দেবনাথ বা পশ্চিমবঙ্গের হাসিনা খাতুন, যারা বিয়ের পর বরের সঙ্গে কেরলে এসেছিলেন। মালয়ালম শিখে নিয়ে এরা এখন প্রাথমিক স্তরের ছাত্রদের সাহায্য করার কাজে জড়িয়েছেন। আটত্রিশটা স্কুলে মোট চল্লিশ জন এরকম স্বেচ্ছাসেবী আছেন।
প্রোজেক্ট রোশনি একটি আশা জাগানোর মত কর্মসূচি। আমাদের দেশে প্রান্তিক মানুষদের কথা কমই ভাবা হয়। সেই প্রেক্ষাপটে এর্নাকুলম প্রশাসন ও স্থানীয় শিক্ষকদের এই উদ্যোগের জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। ভাষাব্যবধানের প্রাচীর ভাঙতে একদিন গোটা কেরালা জুড়েই ‘রোশনি’ ছড়িয়ে পড়বে, এবং বাকি ভারতের কাছেও এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে এই আশা রাখি।