পূর্ণা চৌধুরী
১ রমেশদার কথা
“অধুনা নিন্দিতা পল্লীবাসিনী (তথাকথিত নিষিদ্ধ পল্লী বা বেশ্যা পাড়া) পাথুরিয়াঘাটা বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের কন্যা কমলা দেবী, ইতালির (এন্টালি) মুখার্জী পরিবারের কন্যা জুনিয়র কেমব্রিজ পরীক্ষোত্তীর্ণা অতুলনীয়া সুন্দরী সুকৃতি দেবী, খড়দহের গোস্বামী পরিবারের কন্যা সরযূ দেবী, বড়িশা চৌধুরী পরিবারের বধূ সরলা দেবী, বেহালার হালদার পরিবারের কন্যা দেববালা, অনিলা ও সুনীল দেবী, শ্যামবাজারে সেনশর্মা পরিবারের কন্যা কুমারী গৌরী দেবী, বাগবাজারের সাহিত্যিক পন্ডিতের স্ত্রী মনোরমা ও কন্যা পরিমল, তারকেশ্বরের বালবিধবা কৃষ্ণভামিনী, ভবানীপুরের ব্যারিস্টার ঘোষ বর্মা পরিবারের কন্যা প্রভৃতি বহু সম্ভ্রান্ত মহিলাদের কুলের বাহির করিয়াও যাহারা অর্থের জোরে সম্মান আদায় করিতেছে তাহাদের পরিচয় গ্রহণ করিয়া পাষণ্ডদিগকে সমাজ হইতে তাড়াইয়া দিবার জন্য বদ্ধপরিকর হওয়া যে অবশ্য কর্তব্য, সমাজহিতৈষীগণকে তাহা হৃদয়ঙ্গম করাইবার জন্যই এই গ্রন্থ প্রকাশ করিতে সাহসী হইলাম।
বইটিতে পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারের কন্যার একটি ছবি আছে। চেয়ার উপবিষ্ট বাবুটির শ্রীমুখ সম্পর্কে পরিচিতিতে বলা আছে “পুরুষটির পরিচয় দিতে অসমর্থ বলিয়া মুখে চুন কালি লেপন করিয়া দেওয়া হইলো, ইনি কে তাহা পাঠক বুঝিতে পারিবেন।”
এই পূর্বাভাস দিয়ে যে লেখাটি শুরু, তার লেখক শ্রী রমেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নাম: রমেশদা‘র চাপান উতোর। বইটি প্রকাশিত হয় শিক্ষিত পতিতার আত্মচরিত (১৯২৯) প্রকাশের কিছু পরেই এবং পরবর্তী কালে দুটি বই একই সঙ্গে একই বৃন্তে দুটি ফলের ন্যায় সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয়; মূল্য এক টাকা বারো আনা। আমি হাতে পেয়েছি পঞ্চম সংস্করণ, ফলে এই বই যে সাতিশয় সমাদৃত হয়েছিল সে বলার অপেক্ষা রাখে না। আখ্যানকার ‘রমেশদা’ এক candid ভদ্র বাবু, যিনি পরিষ্কার বলেই দিচ্ছেন যে তিনি মাস্টার অফ আর্টস ছাড়াও, মাস্টার অফ এডাল্টারী হিসেবেও বেশ কৃতকার্য। রমেশদা নামটি লেখককে অনুপ্রাণিত করে মানদা দেবীর আত্মচরিত পড়ার পর, সেকথা উনি পরিষ্কার বলছেন।
উপরোক্ত যে সামাজিক ছবিখানি তিনি দিলেন তারই নানা নিধি ব্যাখ্যান তাঁর এই লেখা, যার কেন্দ্র চরিত্র রমেশদা। কৈশোর কাল থেকে প্রতি পর্যায়েই তিনি নানা মেয়ের সর্বনাশ করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন এবং রতি সুখ অনুভব করেছেন। যৌবনাবস্থায় লীলাময়ী নাম্নী কোনও অধ্যাপক কন্যাকে সিডিউস করার প্রয়াস পান। মাছ যখন চার খাবার জন্যে একেবারে বঁড়শির নিকটে এসে পড়েছে তখন বাবুটি ভুলক্রমে তারে রবিবাবুর ‘মানসসুন্দরী’ থেকে দুই চার কলি আবৃত্তি করে প্রেম নিবেদন করেন এবং খ্যাদা খান। সপ্তদশী প্রেমিকাটি, যে কিনা তার পায়ে সর্বস্ব দিতে রাজি ছিল তিনি কবিতাটি শ্রবণ করে যারপরনাই ক্রোধ প্রকাশ করেন এবং রমেশদা কে শাসান যে তিনি বাবাকে বলে দেবেন। যেহেতু রবিবাবুর কবিতা অসংখ্য, একটি নাম পাতে ফেললেই পাঠকরা তা ধরে ফেলবেন, সে আশা না করাই ভালো তাই যেটুকু রমেশ লীলাময়ীকে শুনিয়েছিলেন, সেটুকু তুলে দিলাম–
বীণা ফেলে দিয়ে এসো, মানসসুন্দরী–
দুটি রিক্ত হস্ত শুধু আলিঙ্গনে ভরি
কণ্ঠে জড়াইয়া দাও…
অয়ি প্রিয়া,
চুম্বন মাগিব যবে, ঈষৎ হাসিয়া
বাঁকায়ো না গ্রীবাখানি, ফিরায়ো না মুখ,
উজ্জ্বল রক্তিমবর্ণ সুধাপূর্ণ সুখ
রেখো ওষ্ঠাধরপুটে, ভক্ত ভৃঙ্গ তরে
সম্পূর্ণ চুম্বন এক(…)
এইরকম প্রকাশ্যে চুম্বন কামনা ব্রাহ্ম বালাটি সর্প জ্ঞান করেন এবং সকাল সকাল এই চুম্বন লালায়িত আপদ বিদায় করে নিজের এবং পরিবারের মুখে চুন-কালি লেপনের পথটি বন্ধ করেন। দেখা যাচ্ছে এই প্রতিনায়কটি রবিবাবুর কবিতা ও গানে সমান দক্ষ কারণ dishonorably dismissed হওয়ার কিছু আগে লীলাময়ীর জন্মদিনের পার্টিতে তাঁকে দেখা যাচ্ছে লীলাময়ীকে অর্গান বাজিয়ে এই গানটি শোনাতে–
“তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা
মম শূণ্য গগন বিহারী
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা–
তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম অসীমগগন বিহারী।।”
এর কিছু পরেই উষাদেবী নাম্নী লীলাময়ীর এক সখী ওই একই অনুষ্ঠানে অর্গান বাজিয়ে রবিবাবুর এই গানটি গাচ্ছেন–
তোমার প্রণয় যুগে যুগে মোর লাগিয়া
জগতে জগতে ফিরিতেছিল কি জাগিয়া,
এ কি সত্য?
আমার বচনে নয়নে অধরে অলকে
চির জনমের বিরাম লভিলে পলকে
এ কি সত্য?
মোর সুকুমার ললাটফলকে লেখা অসীমের তত্ত্ব
হে আমার চিরভক্ত
এ কি সত্য?
পতিত চরিতে রবীন্দ্র কাব্যের স্থান বিষয়ে থীসিস রচনা আমাদের লক্ষ্য নয়, তবে একটি বিশেষ কারণে এই তিনখানি রাবীন্দ্রিক বাচন তুলে ধরা হ’ল। পাঠক, দুটি বিবেচ্য বিষয় আছে: রুচি ও কাল দুইই বদলাচ্ছে এবং খেমটা টপ্পার বদলে রবিবাবুর গান বিনোদনের উপায় হিসেবে নির্ধারিত হচ্ছে; বাবুরা উচ্চাশিক্ষিত, ইংরেজি ও বাংলায় সমান পারদর্শী এবং সবচেয়ে বড় কথা সাতিশয় আলোকপ্রাপ্ত যেহেতু রবিবাবুকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা যোগ্যতর মনে করেন। আর একটি বিবেচ্য বিষয় হল, তাঁরা ‘থেটার’ বা হাড়কাটা গলির প্রতি নজর না দিয়ে সচ্ছল ভদ্রমহলে শিক্ষিতা রমণীর খোঁজে আসেন এবং অর্গান বাজিয়ে মনোরঞ্জন পর্ব সারা হলে যা বিধেয় তাই করেন। লীলাময়ীরা বিপদ বুঝে নিজেদের সংবরণ করেন, উষাদেবীরা ব’য়ে যান। এই উষাদেবীদের সামাজিক পরিচয় রমেশবাবু দিয়েছেন, বস্তুতঃ তাঁদের ছবিও আছেই এই বইয়ে। এই হতভাগিনীরা ছিলেন আলোকপ্রাপ্তা শিক্ষিতা বেশ্যা।
২ সন্দীপের কথা
“আমি কিছুদিন আগে আজকালকার দিনের একখানি ইংরেজি বই পড়ছিলুম, তাতে স্ত্রীপুরুষের মিলননীতি সম্বন্ধে খুব স্পষ্ট-স্পষ্ট বাস্তব কথা আছে। সেইটে আমি ওদের বৈঠকখানায় ফেলে গিয়েছিলুম। একদিন দুপুরবেলায় আমি কী জন্যে সেই ঘরে ঢুকেই দেখি মক্ষিরাণী সেই বইটা হাতে করে নিয়ে পড়ছে, পায়ের শব্দ পেয়েই তাড়াতাড়ি সেটার উপর আর-একটা বই চাপা দিয়ে উঠে পড়ল। যে বইটা চাপা দিল সেটা লংফেলোর কবিতা।
আমি বললুম, দেখুন আপনারা কবিতার বই পড়তে লজ্জা পান কেন আমি কিছুই বুঝতে পারি নে। লজ্জা পাবার কথা পুরুষের; কেননা, আমরা কেউ বা অ্যাটর্নি, কেউ বা এঞ্জিনিয়ার। আমাদের যদি কবিতা পড়তেই হয় তা হলে অর্ধেক রাত্রে দরজা বন্ধ করে পড়া উচিত। কবিতার সঙ্গেই তো আপনাদের আগাগোড়া মিল। যে বিধাতা আপনাদের সৃষ্টি করেছেন তিনি যে গীতিকবি, জয়দেব তাঁরই পায়ের কাছে বসে “ললিত লবঙ্গলতা’য় হাত পাকিয়েছেন।
মক্ষিরাণী কোনো জবাব না দিয়ে হেসে লাল হয়ে চলে যাবার উদ্যোগ করতেই আমি বললুম, না, সে হবে না, আপনি বসে বসে পড়ুন। আমি একখানা বই ফেলে গিয়েছিলুম, সেটা নিয়েই দৌড় দিচ্ছি।
আমার বইখানা টেবিল থেকে তুলে নিলুম। বললুম, ভাগ্যে এ বই আপনার হাতে পড়ে নি, তা হলে আপনি হয়তো আমাকে মারতে আসতেন।
মক্ষি বললে, কেন?
আমি বললুম, কেননা এ কবিতার বই নয়। এতে যা আছে সে একেবারে মানুষের মোটা কথা, খুব মোটা করেই বলা, কোনোরকম চাতুরী নেই।”
রমেশবাবুর পরে ঘরে বাইরের সন্দীপবাবু। দুজনেই “মাস্টার ইন এডাল্টারী”। দুই বাবুই সদ্বংশজাত এবং উচ্চশিক্ষিত মেয়ে ভোলানোর শিল্পী। বিভিন্ন পর্যায়ে এই শিল্পকলার অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়: যথার্থ অভিসন্ধিতে আসার আগে পূর্বরাগের আবহ সৃষ্টি, কিছু উচ্চমার্গর আলোচনা (শিকার যে আলোকপ্রাপ্তা সে কথা ভুললে চলবে না), কিছু মধুর বাক্যর সংমিশ্রন, কিছু সঙ্গীতাদি পরিবেশন এবং শ্রবণ। কিছু অর্ধব্যক্ত ভীরু প্রণয় সম্ভাষণের সুফলও এই পর্যায়ে দৃষ্ট হয়। নায়িকারা আধচোখে অস্ফুট ওষ্ঠে পেশাদারি প্রণয়ীর সঙ্গ উপভোগ করেন, তাঁদের হাত পা খুলে খুলে আসে। এরপর সম্ভাষণে কিছু আদর্শভিত্তিক বাণী যদি গুঁজে দেওয়া যায় তাহলে শিক্ষিতা নারী পপাত চ মমার চ। এ সকল অধ্যায় শেষ হলে শিকারী বেড়াল ধীরে ধীরে অগ্রসর হ’ন এবং শিকারকে অধিকার করেন। পাঠক, সন্দীপবাবুর আর্টটি উপরোক্ত কথোপকথনে ভালো করে লক্ষ করুন। বলাই বাহুল্য, এই হল শিকার ধরার সেই পরম ক্ষণ।
মক্ষি লংফেলোর আড়ালে যা পড়ছেন তা একটি স্ত্রীপুরুষের যৌনবিধি প্রাইমার, এবং সেটি সন্দীপবাবু ইচ্ছাকৃতভাবেই বৈঠকখানায় ফেলে রেখে গেছেন কারণ বারুদে আগুন লাগার লগ্ন এসেছে তা তিনি বিলক্ষণ বুঝেছেন; আগুনের পূর্বাভাস উপন্যাসেই আছে। যৌন প্রসঙ্গের বই ফেলে যাওয়া সুতরাং প্রাক্ অন্তিম পর্যায়। এরপর আর কোনও রাখঢাক ছলাকলার প্রয়োজন নেই, সকলই জলবত্তরলম। যেটুকু বাকি রইল সেটুকু সন্দীপবাবু গীতগোবিন্দর আভাস দিয়ে সারলেন–
“ললিত লবঙ্গলতায় হাত পাকানো” কথাটি খুবই অর্থবহ, কারণ মক্ষি তা শুনে লজ্জায় লাল হ’ন।
এটি জয়দেবের গীতগোবিন্দর প্রথম সর্গর শ্লোকের অন্তর্গত। এ স্তবকটির বাংলা সংস্করণ–
আজ শ্ৰীরাধিকে বনে বনে কত প্রকারেই না শ্ৰীমাধবের অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছেন। কন্দৰ্প-জ্বর-জনিত চিন্তা অত্যন্ত আকুল করিয়া তুলিয়াছে আর মিলন পিপাসা অতিশয় প্ৰবল হইয়াছে। এই অবস্থায় শ্ৰীরাধিকাকে তাহার কোনও সখী সরস বাক্যে বলিতে লাগিলেন, সখি! দেখ দেখ মৃদু মন্দ মলয় সমীরণ ললিত লবঙ্গলতা সংসর্গে কতই সৌগন্ধ বিস্তার করিতেছে। ফুলে ফুলে কুঞ্জ কুটির ভরিয়া উঠিয়াছে। গুঞ্জন্মত্ত মধুৱতের ঝঙ্কার ধ্বনির সহিত মিলিত হইয়া কোকিল কাকলী চারিদিক মুখরিত করিয়া তুলিয়াছে। বিরহীর পক্ষে অতি দুরন্ত এই সরস বসন্তে হরি বুঝি কোন যুবতী জনের সঙ্গে বিহার করিতেছেন।
এ হল গীতগোবিন্দর প্রথম সর্গের অন্তর্গত একটি চার্জড্ এরোটিক মোমেন্ট বা রসঘন মুহূর্ত, যার মধ্যে ‘ললিত লবঙ্গলতা’র গন্ধ রাধার কামোত্তেজনার এক অনুষঙ্গ মাত্র। মক্ষি লাল হবেন বৈকি। যিনি ললিত লবঙ্গলতায় ‘হাত পাকিয়েছেন’, তিনিও জানেন বিমলা ইঙ্গিতটি ভালোই বুঝেছেন, শিক্ষিতা কিনা। জয়দেব পড়েছেন। এবং তাঁরও সেই একই রাধা ভাব। সুতরাং নিরীহ ‘লবঙ্গলতা’ শব্দটি লক্ষ্যভেদ করল। আমরা একে বলি the art of seduction। এ স্তরটি সাফল্যমণ্ডিত হলে ‘মোটা কথা মোটা করে’ বললে কোনও ক্ষতি নেই। রমেশবাবুর কপাল মন্দ, মোটা কথায় পৌঁছনোর আগেই ‘চুম্বন’ শব্দটি রবিবাবুর বকলমে বলে ফেললেন এবং তাঁর মানস সুন্দরী তাঁরে ঘাড় ধাক্কা দিলেন। তবে তাতে তাঁর যে পরবর্তীকালে কিছু এল গেল তা বলা যাবে না। সন্দীপবাবুও ঘাড় ধাক্কার উপান্তে পৌঁছেছিলেন এবং সে জোগাড়টি করেছিলেন মেজ বৌঠান। ‘হাতবিধবা’ পরিচ্ছেদে এনাকে নিয়ে দুই একটি কথা বলেছিলাম, পাঠক সে কথা স্মরণ করুন। রাইয়ের যে ‘চিটে চিনি জ্ঞান নেই’ সে কথা বুঝেই তিনি নানকু বেহারাকে দিয়ে সন্দীপবাবুর অন্দরে আসা ঠেকানোর ব্যবস্থা করেছিলেন; তাঁর অতি আলাভোলা দেওরের কারণে সে বন্দোবস্ত কার্যকরী হয়নি।
একটি ক্লাসিক, বাংলা সাহিত্যের আকরগ্রন্থ, অন্যটি অতি অখদ্যে অবদ্যে সামাজিক খেউড়, কিন্তু দুটিতেই দুই বাবুর মধ্যে আমরা কিছু সামঞ্জস্য খুঁজে পেলাম। তার মধ্যে যে সামঞ্জস্যটি আলোচনা হয়নি, সেটি হ’ল দুজনেই স্বদেশী আন্দোলনে সামিল ছিলেন।
৩ মানদার কথা
মানদার উদ্ধারাশ্রম পর্বের কথা বলেছি। সেই পর্বে রাজবালার কথাও উঠেছিল। এইবার তাঁর গল্পটি মানদার বয়ানে শোনাই–
“রাজবালা সোনার বেনের মেয়ে। বাপের বাড়ি কলকাতায়, অল্পবয়সে তার বিবাহ হইয়াছিল। পিতা ও শ্বশুর উভয়েই সংগতিপন্ন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ বিবাহের এক বৎসর পরেই হতভাগিনী বিধবা হয়। তৎপরে পিতার প্রতিবেশী এক পূর্ববঙ্গবাসী কায়স্থ যুবকের সহিত তাহার গুপ্ত প্রণয় জন্মে। রাজবালার এক জ্যেষ্ঠা ভ্রাতৃবধূ এই ব্যাপারে তাহাকে গোপনে সাহায্য করিত। যুবকটি স্বদেশী আন্দোলনের সময় খুব ‘বন্দেমাতরম’ করিয়া বেড়াইত। তিন বৎসর ধরিয়া এই গুপ্ত প্রেমলীলা চলিতে থাকে। অবশেষে রাজবালার সন্তান সম্ভাবনা হওয়ায় প্রেমিক যুবক পলায়ন করে। রাজবালা ঝিয়ের সহিত গঙ্গাস্নানের অছিলায় বাড়ির বাহির হইয়া আসে, আর সে ফিরিয়া যায় নাই। তারপর নানা দুর্দশার আবর্তে ঘুরপাক খাইতে খাইতে এই উদ্ধার আশ্রমে উপস্থিত হইয়াছে।”
পাঠককে কি মনে করিয়ে দিতে হবে যে রবিবাবুর ঘরে বাইরে (১৯১৬) স্বদেশী আন্দোলনের একটি ঐতিহাসিক দলিল? মানদার বইয়ে এই বন্দেমাতরম বাবু প্রজাতির ছড়াছড়ি। কাব্য দর্শন সাহিত্য ছাড়াও এঁদের তূণীরে আছে ‘দেশাত্মবোধ’ নামক শব্দভেদী বাণ। গৃহস্থ অন্দরমহলে তাঁদের জন্য অবারিত দ্বার, গরানহাটা সোনাগাছিতে তাঁরা ঈশ্বরের নামান্তর। অন্য ইতিহাসে এঁদের ঘোরাফেরা দেখি ১৯০৫ থেকে ১৯২০র আশপাশ পর্যন্ত–
“আমি জানি কয়েকটি ভদ্র গৃহস্থের বধূ অসহযোগ আন্দোলনে প্রচারের কার্য করতে আসিয়াছিলেন, তাঁহারা আর তাঁহাদের স্বামীদের নিকট ফিরিয়া যান নাই। কেহ কোনো কার্য আরম্ভ করিয়াছেন, কেহ বা কোনো দেশকর্মীর সহিত অবৈধ প্রণয়ে আসক্ত হইয়াছেন, কেহ কেহ বা স্বামী স্ত্রী ভাবে বাস করিতেছেন। এইসকল দেশকর্মীর আচরণ সকলেই জানে, অথচ তাহারা ভোট দিয়া এইপ্রকার সাধুবেশী লম্পটস্বভাব ব্যক্তিদিগেই কর্পোরেশন, কাউন্সিল-এ প্রেরণ করে। সমাজের অন্ধতা এতদূর গভীর।”
রমেশদা’র চাপান উতোরে যারে বলা হয়েছে “ছাইকোলোজি”, পতিতা মেয়েদের ক্ষেত্রে সে বড় অদ্ভুত, তা এই আত্মচরিত পরে বুঝলাম। দেখলাম কি নিপুণভাবে বাবুদের ‘কন্টামিনেশন তত্ত্ব’টি তাঁরা আপন করে নেন। এই যে দেশপ্রেমী যুবকদের কথা তিনি বললেন, তাঁদের অধঃপতনের জন্যে যে পতিতারা, সে শিক্ষিতাই হোক বা অশিক্ষিতাই হোক, দায়ী, সে বিষয়ে তাঁর কোনও সন্দেহ দেখলাম না–
“যে সকল কর্মী যুবকের চরিত্রবল এমন ছিল যে একটা সিগারেট পর্যন্ত কখনো খায় নাই, তাহারা কেহ কেহ এই অসহযোগ আন্দোলনের কর্মক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে মিশিয়া মদ্যপান পর্যন্ত শিখিয়াছে। যে সকল যুবক এমন পবিত্র চিত্ত ছিল যে স্ত্রীলোকের সহিত কথা কহিবার সময় মাথা তুলিত না-– তাহারা আমাদের সংসর্গে আসিয়া এখন বেশ্যা দূরে থাক, কুলবধূর সহিত নির্লজ্জের মতো কুৎসিত হাস্য পরিহাস করিতে অনেকে লজ্জিত হয় না। পতিতা নারীদের একটা প্রধান স্বভাব এই যে তাহারা সচ্চরিত্র ও সংযমী পুরুষ দেখিলে তাহাকে হস্তগত করিতে বিশেষ চেষ্টা করে এবং তাহার সংযম ও পবিত্রতাকে বিনষ্ট করা একটা বীরত্বের কার্য বলিয়া মনে করে।”
পবিত্র পতনশীল খোকাবাবুদের কথা থাক, আমরা পতিতায় ফিরি। পবিত্রতার নেশা বড় ভয়ানক। যে বস্তুটি চিরতরে গেছে, তারই কুহকে মেতে তাঁরা নাটকের সতী সাবিত্রী দময়ন্তী সেজে ধন্য হয়েছেন আর সেই একই নেশায় মেতে জাতীয়তাবাদের প্রথম ধাপে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন: রামবাগান, সোনাগাছি, চাঁপাতলা, আহিরীটোলা জোড়াসাঁকো, সিমলা, কেরানিবাগান, ফুলবাগানের এনারা যাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন, তিনি জনৈক মিঃ সি আর দাস। যে টাকা তোলার অভিযানটি এরপর বর্ণিত হবে তা ঘটে ১৯২০তে পূর্ববঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গে ঝড় এবং বন্যার সময়ে। এ হ’ল ইস্ট বেঙ্গল সাইক্লোন ফান্ডের বিবরণ। মানদা লিখছেন–
“জনসাধারণের কাজে এই আমার প্রথম যোগদান। এই সুযোগে আমি মিঃ সি আর দাশকে প্রথম স্পর্শ করিয়াছিলাম। আমরা যখন প্রণাম করিয়া তাঁহার পায়ে টাকার তোড়া রাখিলাম, তখন আনন্দাশ্রুতে তাঁহার বক্ষ প্লাবিত হইল। তিনি আমাদের মস্তক স্পর্শ করিয়া আশীর্বাদ করিলেন। বুঝিলাম তিনি সত্যিই দেশবন্ধু।”
পাঠক: আগের পরিচ্ছেদে বলেছি এই সিগারেট খাওয়া ইংরিজি জানা বেশ্যাটি আমাদের ‘অন্য’ ইতিহাসের বায়োস্কোপ। আসুন, তাঁর চোখ দিয়ে সেই চাঁদা তোলার একটি দৃশ্য দেখি–
“সে এক অপূর্ব দৃশ্য! কলিকাতার অধিবাসীগণ স্তম্ভিত হইয়া গেল। এক এক দলে প্রায় ৫০-৬০ জন পতিতা নারী– তাহাদের পরিধানে গেরুয়া রঙের লালপাড় শাড়ি-– এলোচুল পিঠের ওপর ছড়ানো, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, কণ্ঠে মধুর সংগীত, মনোহর চলনভঙ্গি […] অগ্রে অগ্রে দুইটি নারী একখানি কাপড় ধরিয়াছে তাহাতে দাতাগণ টাকা পয়সা নোট প্রভৃতি ফেলিয়া দিতেছে আর দুইজন স্ত্রীলোক পুরাতন বস্ত্র সংগ্রহ করিতেছে।”
দৃশ্যটি প্রতীকধর্মী। গেরুয়া শাড়ি লাল পাড় জাতীয়তাবাদের মূলস্রোতে মিশে যাওয়ার খেয়ালি পোলাও কি? কোনও কারণে অবনীন্দ্রনাথের ভারতমাতার ছবিটি চোখে ভেসে উঠল। যদিও, অবনীন্দ্রনাথের সে ছবিতে শাড়ির লাল পাড় নেই। আর সিঁথির সিঁদুরের বদলে কপালের সিঁদুরের টিপ শুধুই মাঙ্গলিক না অন্য কিছুর প্রতীক এই প্রশ্ন সেদিন যাঁরা দৃশ্যটি দেখেছিলেন তাঁদের মনে জেগেছিল কিনা কে বলবে। মানদা শুধু জানিয়েছেন পথে লোকের ভীড় ছিল।
আর অল্পই বলা বাকি রইল। অসহযোগ আন্দোলনের যিনি হোতা এবং অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ আদি মহান কর্মকাণ্ডে যিনি ব্যাপৃত ছিলেন, তাঁর অস্পৃশ্যতা-শ্রেণীবিন্যাসে মুচি মেথর চণ্ডাল দুলে বাগদি সকলেরই জায়গা হয়েছিল, হয়নি শুধু এই অস্পৃশ্য মেয়েগুলোর। ১৯২০ থেকে ১৯২৫এর মধ্যে মহাত্মা গান্ধী (তিনি ততদিনে ওই উপাধিটি পেয়ে গেছেন) যখন বরিশালে যান তখন সেখানকার পতিতা নারী সমিতি তাঁর দর্শন প্রার্থী হয়েছিল। বাকিটুকু মানদার বয়ানে–
“মহাত্মা গান্ধী যখন বঙ্গদেশ পরিভ্রমণ করেন, তখন বরিশাল গমন করিলে সেখানকার পতিতা-নারী-সমিতি তাঁহাকে নিমন্ত্রণ করে। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী সেই সভাতে যান নাই। তিনি বলেন, ‘পতিতারা যদি একত্র মিলিত হইয়া সমিতি গঠন করে তবে দেশের চোর ডাকাতরাও সমিতি গঠন করিবে।”
এবং যে দার্শনিক দেশকর্মী এই নিমন্ত্রণটি বয়ে নিয়ে গেছিলেন, জাতির জনক তাঁকেও সমুচিত তিরস্কার করেন বলে মানদা জানিয়েছেন।
এতে বঙ্গীয় তথা দেশীয় পতিতারা যে নীতিশিক্ষাটি পেলেন, তা হ’ল: যতই, দেশসেবা করো আর অসহযোগ আন্দোলনে গা ঢেলে দাও, বেশ্যাপাড়ার বাইরে তোমাদের আবাহন নৈব নৈব চ।
বটেই তো। যে কালে দেশকে মা জ্ঞানে পুজো করা শুরু হয়েছে, এবং দেশমাতৃকার মডেল হচ্ছেন সতী সাবিত্রীরা, সে কালে যাদের গর্ভাধান নিষিদ্ধ, তাদের জায়গা কোথায়?
পরিশিষ্ট:
পতিতার আত্মচরিতের নানা সমালোচনা হওয়া সত্ত্বেও, রমেশদার চাপান উতোর-এর মতো এই বইটিরও গুটিকতক সংস্করণ হয়। বইয়ের পরবর্তী একটি সংস্করণে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্মিলনীর সভাপতি প্রভুপাদ শ্রীযুক্ত অতুলকৃষ্ণ গোস্বামী লিখেছিলেন, “পতিতার আত্মচরিত পাঠ করিলাম […] এই আত্মচরিত হইতেও লইতে পারিলে লইবার মতো অনেক জিনিস আছে; কিন্তু তাহা কি সকলে পারিবে?”
গোস্বামী মহাশয়ের দ্বিধাজড়িত প্রশ্নটি যথার্থ। অন্য ইতিহাসের ঝাঁঝটি একটু বেশি। উহা সকলের পরিপাক নাও হইতে পারে।
(মানদা পর্ব সমাপ্ত)
Featured Image: Bengali Women Google.
Chittaranjan Das: http://www.phila-art.com/product/india-1965-deshbandhu-chittaranjan-das-c-r-das-1v-stamps/
Bharatmata: Abanindranath Tagore, coutesy Oilpainting Factory.com