দেবব্রত শ্যামরায়
কোশ কোশ পর বদলে পানি
আউর চার কোশ পর বাণী
প্রতি ক্রোশ পথ পেরোলে জলের স্বাদ বদলে যায়, আর চার ক্রোশ পেরোলে বদলে যেতে থাকে ভাষার চেহারা। এটি লোকমুখে পরম্পরাগতভাবে বয়ে চলা একটা হিন্দি কাঁহাবত।
মজার ব্যাপার, এই হিন্দি জনশ্রুতি যদি আমরা সত্যি বলে ধরে নিই, তাহলে এই বাক্যে খোদ ‘হিন্দি’ শব্দটিকে বেশ খানিকটা সন্দেহের চোখে দেখতে হয়। প্রতি চার ক্রোশে যদি ভাষার চরিত্র বদলে যায়, তাহলে গঙ্গা-যমুনার পলিবিধৌত হাজার হাজার ক্রোশ বিস্তৃত সুবিশাল যে উত্তর ভারত, তার প্রতিনিধিত্বমূলক ভাষা মাত্র একটি (যা কিনা হিন্দি) হয় কী করে? এই জনশ্রুতি কথিত তত্ত্বটি যদি ‘হিন্দি’-র ক্ষেত্রে প্রয়োগ করি, তাহলে গোটা আর্যাবর্ত জুড়ে হিন্দির রং-রস-রূপ-চরিত্র কি এক ও অভিন্ন? মোটেই তা নয়। বরং যে হিন্দি-র মাধ্যমে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ দেশকে একসূত্রে বাঁধার নিদান দিলেন, যে হিন্দি-তে কেন্দ্রীয় সরকারের নথিপত্র লিখিত হয়, সেই ‘উচ্চ’ ও ‘শুদ্ধ’ হিন্দি একটি প্রায়-কৃত্রিম ভাষা, যে ভাষায় দেশের পাঁচ শতাংশ মানুষ কথা বলেন কিনা সন্দেহ।
অদ্ভুত শোনাচ্ছে, তাই তো? কারণ মিডিয়ার কল্যাণে আমরা জেনে গেছি, যে ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী দেশের ৫২ কোটি অর্থাৎ প্রায় ৪৩.৬৩% মানুষ হিন্দিতে কথা বলেন। ঠিক তাই! এই দুই তথ্যের মধ্যে কোনও আপাত-বিরোধ নেই, শুধু একটি বেশ বড়সড় মাত্রার অতিসরলীকরণ আছে। ‘হিন্দি’র আগ্রাসনে গিলে নিয়েছে গোটা আর্যাবর্ত (বিহার, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়ানা, দিল্লি, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড) জুড়ে সাধারণ্যে চালু থাকা বৈচিত্রময় ভাষাসম্ভারকে। ব্রজবুলি, খাড়ি বোলি, হরিয়ানভি, বুন্দেলি, আওধি, ভোজপুরি, বাঘেলি, কনৌজি, ছত্তিশগড়ি সহ অগণিত ঐতিহ্যময় জীবন্ত ভাষা ম্লান হয়ে গেছে, শুধুমাত্র উপভাষা বা ডায়লেক্টে অন্তর্হিত হয়ে গেছে রাজনৈতিকভাবে বানিয়ে-তোলা, আমলাতান্ত্রিক, এই ‘শুদ্ধ হিন্দি’-র আড়ালে৷ এ কথার যাথার্থ্য প্রমাণ হয়, যখন আমরা জানতে পারি স্কুলের ‘হিন্দি’ উত্তর ভারতের ছাত্রছাত্রীদের কাছেই কতটা ভীতিকর। ‘হিন্দি বলয়ের স্কুলগুলিতে হিন্দিতে ফেল করা ছাত্র-ছাত্রীদের বিপুল সংখ্যাই এই সত্যের ভয়াবহ সাক্ষ্য বহন করে যে ‘হিন্দি’ তাঁদের কাছ থেকে তাঁদের মাতৃভাষা কেড়ে নিয়েছে!’ (হিন্দি ন্যাশনালিজম: ট্র্যাকস ফর দ্য টাইমস— অলোক রাই)। আমাদের পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের সেই আদিবাসী বালকটির কথা, যে স্কুলে পড়তে এসেছে বটে, তার বাবা বা মা ভর্তির সময় ফর্মে মাতৃভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকার করে গেছেন ঠিকই, কিন্তু বেঞ্চে বসা ইস্তক তার নজর বাইরে-দূরের ঐ সবুজ মাঠে খেলে-বেড়ানো স্কুলছুট বন্ধুদের দিকে; কারণ স্কুলের শিক্ষক কলকাতার এই বাঙালি ছোকরাটি সকাল থেকে হাত নেড়ে কী সব বলে চলেছে, সে তার কিছুই বুঝতে পারছে না৷
বাংলা আঞ্চলিক ক্ষেত্রে অনেকসময় যা করে, হিন্দি সর্বভারতীয় স্তরে বহুদিন ধরে সেই একই দাদাগিরি চালিয়ে এসেছে। আর্যাবর্তের আঞ্চলিক ভাষাগুলিকে গ্রাস করার পর হিন্দি বেরিয়েছিল ভারতজয়ে। অর্থাৎ এই ভাষা-আগ্রাসনের ইতিহাস আজকের নয়৷ স্বাধীনতার আগে থেকেই ঔপনিবেশিক ইংরেজি ও ইসলাম-সংলগ্ন অভিজাত উর্দু-র প্রতিপক্ষ এবং হিন্দু ভারতীয়দের প্রতিনিধি ভাষা হিসেবে এক সমসত্ত্ব হিন্দি-কে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা প্রথম শুরু হয়৷ এই নতুন হিন্দির ধারক ও বাহক হয়ে ওঠেন গোষ্ঠীরাজনীতি বা সম্প্রদায়ভাবনার কারবারিরা। জাতপাতের ক্ষেত্রেও যেমন নানা সমীকরণের রাজনীতি থাকে, উত্তর ভারতের ক্ষুদ্র ভাষাসত্তাগুলি ‘জাতে ওঠা’-র তাগিদে আপস করল, হিন্দির আনুগত্য স্বীকার করে নিল। স্বাভাবিকভাবেই, ৪৭ সালে উচ্চবর্ণ হিন্দুরা যখন ভারত রাষ্ট্রের শাসনভার দখল করলেন, তাঁদের অনেকগুলি লক্ষ্যের মধ্যে একটা ছিল দেশজুড়ে হিন্দির একাধিপত্য।
হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকেই হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা দেখে আসছেন, নানা কারণে, প্রতিবাদে, মূলত দাক্ষিণাত্যের কট্টর ও রক্তক্ষয়ী বিরোধিতায় তা কোনওদিন সফল হতে পারেনি। বরং সংবিধানের অষ্টম তফসিলে এ দেশের ২২টি ভাষাকে সমমর্যাদায় স্বীকৃতি জানানো হয়েছে। এই ভাষাগুলি হল, অসমিয়া, বাংলা, গুজরাতি, হিন্দি, কন্নড়, কাশ্মিরি, মালয়ালম, মারাঠি, ওড়িয়া, পঞ্জাবি, সংস্কৃত, তামিল, তেলেগু, উর্দু, সিন্ধি, কোঙ্কনি, মণিপুরি, নেপালি, ডোগরি, বোড়ো, মৈথিলী এবং সাঁওতালি। এরা মর্যাদায় কেউ কারও চেয়ে ছোট নয়, অপ্রধান নয়। তাই আজ ১৪ই সেপ্টেম্বরকে কেন্দ্রীয় সরকারের উৎসাহে হিন্দি দিবস হিসেবে পালন করা হলে, বছরের অন্য একুশটি দিন অন্য ভাষাগুলিকে আলাদা আলাদাভাবে উদযাপনের দাবি কেন উঠবে না? পাশাপাশি, পুনরুক্তির জন্যে ক্লিশে শোনালেও, এই কথাটি এই সময়ে দাঁড়িয়ে বারবার চিৎকার করে বলা উচিত— ভারতবর্ষের কোনও রাষ্ট্রভাষা নেই, কোনওদিন ছিলও না। তাই হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা কিনা এই অবান্তর প্রশ্নের অবকাশ নেই। (মামলা— সুরেশ কাছাড়িয়া বনাম রাষ্ট্র, মামলা নং ২৮৯৫/২০০৯, গুজরাট হাইকোর্ট-এ রায়দানের তারিখ ১৩/১/২০১০)। বড়জোর বলা যেতে পারে, হিন্দি কেন্দ্রীয় সরকারের দাপ্তরিক ভাষা, দেশজুড়ে মাত্র দু’কোটির কিছু বেশির কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও তাদের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে কাজকর্ম চালানোর জন্য যা ব্যবহৃত হয়। এ কাজে অবশ্য সে একা নয়। অনেক চাপানউতোরের পর, অহিন্দি রাজ্যগুলির সঙ্গে সমন্বয়সাধনের কথা মাথায় রেখে ইংরেজিকেও ভারতের দাপ্তরিক ভাষার জায়গা দেওয়া হয়েছে।
তবে সফল হতে না পারলে স্বপ্ন দেখা কি স্থগিত থাকে? স্বপ্ন তো আর বাতিল হয়ে যেতে পারে না। বিশেষত, তা যদি জাতীয়তাবাদের স্বপ্ন হয়৷ তাই ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর ভারতীয় জনতা পার্টি নামক স্বঘোষিত দক্ষিণপন্থী ও সাংস্কৃতিক আধিপত্যকামী দলটি হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের লক্ষ্যে কাজ শুরু করে দেয়৷ ১৪ই সেপ্টেম্বর দিনটিকে মহাসমারোহে পালন করা শুরু হয়। এতদিন পর্যন্ত যে উদযাপন নিতান্ত কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তরগুলির একান্ত আভ্যন্তরীণ বিষয় ছিল, সেগুলিকে প্রচারে-প্রসারে-পৃষ্ঠপোষকতায় রীতিমতো পাবলিক ইভেন্ট-এ পরিণত করা হল৷ ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের পর সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে পরিস্থিতি আরও অনুকূল। সামান্য কিছুদিন আগে, জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়ায় সারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় হিন্দিকে বাধ্যতামূলক করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল সরকার, অবশ্য প্রবল বিরোধিতার মুখে পড়ে সে খসড়া প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এতদিন যা ঠারেঠোরে বলার চেষ্টা হচ্ছিল, নতুন সরকারের নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী অমিত শাহ এ বছর ১৪ই সেপ্টেম্বর সে আড়ালটুকু রাখাও আর জরুরি মনে করলেন না। টুইট করে শ্রী শাহ জানালেন, ‘যদি কোনও একটি ভাষার দেশকে ঐক্যবদ্ধ করে রাখার ক্ষমতা থাকে, তাহলে সেটি হিন্দি, কারণ সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ এই ভাষা ব্যবহার করেন।’ অর্থাৎ একথা স্পষ্ট, তিনি হিন্দিকে ভারতের জাতীয় ভাষা ঘোষণা করতে চান।
এগুলি আসলে কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ নিজেদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক গঠনকাঠামো অনুযায়ী আশপাশকে সাজিয়ে তোলা একটি চুড়ান্ত ফ্যাসিবাদী প্রবণতা। ‘অপর’-এর ধারণা সেখানে ব্রাত্য৷ ফলত, শাসক দল বিজেপি এক দেশে একটি অখণ্ড জাতিসত্তা চায়, যে অখণ্ডতার ভিত্তি বৈচিত্র নয়, তা হল সংখ্যাগুরুর সংস্কৃতির প্রতি আনুগত্য ও সমর্পণ। অর্থাৎ, যেহেতু এক দেশ, সেই হেতু দেশজুড়ে একই ধর্মের (সংখ্যাগুরু ধর্মের, আরও নির্দিষ্ট করে বললে ব্রাহ্মণ্যবাদের) আধিপত্য হওয়া প্রয়োজন। যেহেতু এক দেশ, তাই একই রকমের খাদ্যভাস (মূলত নিরামিষ খ্যাদাভ্যাস, নিতান্ত আমিষাশী হলে হিন্দুর জন্য যা বর্জনীয় তা কদাচ ভক্ষ্য নয়।) অভিপ্রেত। যেহেতু এক দেশ, সেহেতু যোগাযোগরক্ষাকারী ভাষাও হবে একটি, যা মূলত শাসকের ভাষা (শাসকের ঔদ্ধত্য দেখুন, অমিত শাহ সেদিন এমন কথাও বলেছেন, ‘ভবিষ্যতে উত্তর পূর্ব ভারতের সব কিশোর পড়া শিখবে হিন্দিতে’)। যে বৈচিত্র যে বহুত্ববাদ সারা বিশ্বের কাছে ভারতবর্ষের সম্মানের জায়গা ছিল, নিজেদের সঙ্কীর্ণ উদ্দেশ্যসাধনের জন্য সেগুলিকে ক্রমশ ফাটলে পরিণত করে তুলছে এই সরকার। ফাটল ছড়িয়ে পড়ছে নানা দিকে। এ দেশের সংখ্যাগুরু জনগণের ভোট তার পকেটে রয়েছে, এই আত্মতুষ্টিতে বলীয়ান সরকার নিজের সমস্ত অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত, তা সে কাশ্মিরের অবরোধই হোক অথবা অসমের দানবিক এনআরসি, চাপিয়ে দিচ্ছে জনসাধারণের ওপর৷ হিন্দিকে জাতীয় ভাষা ঘোষণার ইচ্ছাপ্রকাশ সেই ফ্যাসিস্ট সিদ্ধান্তগুলির অনেকগুলোর মধ্যে একটি। এমন দিন হয়তো খুব দূরে নেই, যেদিন শাসককে বলতে শুনব— এক দেশ, এক ধর্ম, এক ভাষা, এখন এমন একজন একনায়ক চাই, যে দেশটাকে এক সুতোয় বাঁধতে পারে! শাসককে কোনওক্রমেই এ কথা বলতে দেওয়া চলবে না। যদিও সীমাবদ্ধতায় পরিপূর্ণ এই গণতন্ত্র, তবু বহু লড়াইয়ের ফসল আমাদের এই অর্জনকে চোখের মণির মতো রক্ষা করার জন্য গলা তুলতে হবে আমাদেরই, প্রয়োজনে নামতেও হবে রাস্তায়।
হিন্দি নয়, হিন্দুত্ব নয়, আমাদের সচেতন সম্মানজনক বিভিন্নতা আর বৈচিত্রই এই ভারতবর্ষকে বাঁধুক।
লেখককে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই…