সত্যব্রত ঘোষ
আজকে নয়, ২০১৭ সালে ব্রাজিলের আদি জনগোষ্ঠীর মাথারা সাবধান করে দিয়েছিলেন উত্তরের দূর গ্রাম আমাপা-য় স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে খনিশ্রমিকদের লড়াইয়ে রক্তের বন্যা আসন্ন। তাঁদের সেই আশঙ্কাই সত্যি হল গত সপ্তাহে। দলভারি শ্রমিকরা সৈন্যপোশাকে সেজে আমাপা-য় হানা দিলে জনগোষ্ঠীর নেতারা রুখে দাঁড়ায়। সেই অপরাধে এক বর্ষীয়ান নেতাকে খনিশ্রমিকেরা ছুরি মেরে হত্যা করে চলে যায়।
সংরক্ষিত এলাকায় অবাধে খনিশ্রমিক এবং কাঠুরেদের সশস্ত্র হয়ে প্রবেশ করে তুলকালাম করবার এই স্পর্ধার নেপথ্যে ব্রাজিলের অতি-ডানপন্থী রাষ্ট্রপতি জেয়ার বোলসেনারো-র শুধু প্রশ্রয় নয়, প্রত্যক্ষ মদত রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার আদি জনগোষ্ঠীগুলিকে নিশ্চিহ্ন করবার জন্য তাঁর যে পরিকল্পনা, আগামীদিনে তা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন অনেকে।
বোলসেনারো বলছেন আদি জনগোষ্ঠীর মানুষরা যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজেদের অধিকারে রেখেছে, তা সর্বসাধারণের জন্য মুক্ত করে দিলে শিল্পোদ্যোগীরা সেই জায়গাগুলি ব্যবহার করে মুনাফা লুঠতে পারেন। এমন দ্ব্যর্থহীন ভাষার সরকারি আমন্ত্রণ এলে আদি জনগোষ্ঠীদের জমিগুলি দখল করবার উৎসাহ যে বাড়বেই, তা তো জানা কথা। এবং সেই মানুষগুলিকে নিয়মিত হুমকি দেওয়ার কাজে খনিশ্রমিক, কাঠুরে এবং অবস্থাপন্ন কৃষকেরা ক্রমশ দাঁত-নখ বার করে আঘাত হানবে তা স্বাভাবিক। তবুও গোষ্ঠীনেতাকে সবার সামনে হত্যা করবার মতো পরিস্থিতি যে এত তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে যাবে, তা কেউই ভাবতে পারেননি।
অবশ্য ওয়াজাপি গোষ্ঠীর নেতারা বারবার আবেদন জানিয়েছিলেন সরকারের কাছে যে ব্রাজিলের উত্তরে আমাপা জেলার গ্রামগুলিতে খনিশ্রমিকেরা রক্তবন্যা ঘটাতে চাইছে। শুধু রাইফেল নয়, ওদের কাছে আরও সব প্রাণঘাতী অস্ত্র রয়েছে। ব্রাজিলের এক সেনেটরের কাছে জাওয়ারুওয়া ওয়াইআপি নামের নেতাটির পাঠানো ভয়েস মেসেজটির মধ্যেই তো রয়েছে তেমন আকুতি, “আমরা বড় বিপদে পড়েছি। আপনি সত্বর সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে আমাদের উদ্ধার করুন।”
দুর্গম এলাকায় হত্যাটি কখন সংঘটিত হয়েছে, তা সঠিক জানা যায়নি। রডলফে রডরিগস নামে সেনেটরটি শুধু সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এটুকুই জানিয়েছেন যে গত শনিবার আক্রমণকারীরা হামলা করলে গ্রামবাসীরা পালিয়ে যায়। এবং জনগোষ্ঠীর সদস্যরা গ্রামে ফিরে নিজেদের অধিকার দখলের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাবে, সেটাই ভয়ের কথা। এই সংঘর্ষে আগামী দিনে প্রাণহানি বাড়তেই থাকবে কারণ ইন্ডিয়ানরা ছেড়ে কথা বলবে না।
বিরোধী দলের সদস্য হিসেবে রডরিগস নামে এই সেনেটরটি স্পষ্ট জানিয়েছেন যে বোলসেনারো যে নির্মম দৃষ্টি নিয়ে জনগোষ্ঠীর জমি এবং সেই জমির উপর তাঁদের অধিকারের বিষয়টি দেখছেন তাতে ব্রাজিলে বসবাসকারী এই আদি ভূমিসন্তানদের জীবনে চুড়ান্ত বিপদ নেমে আসবে। এদের প্রাণহানির জন্য দায়ী হবেন স্বয়ং রাষ্ট্রপতি। অবশ্য বোলসেনারো-র তরফ থেকে এমন আরোপের কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি।
রডরিগস-এর থেকে জানা গেছে মৃত গোষ্ঠীপতির নাম এমাইরা ওয়াজাপি। খনিশ্রমিকেরা ছুরির আঘাতে তাঁকে হত্যা করে মৃত শরীরটাকে ছুঁড়ে দিয়েছিল নদীতে।
গত শনিবার উচ্চপদস্থ এক পুলিশের দল এলাকাটিতে যান। দ্য ন্যাশনাল ইন্ডিয়ান ফাউন্ডেশন নামে যে ফেডারেল এজেন্সিটি জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছে, তার প্রতিনিধিও এলাকাটিতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সংগ্রহ করছে।
বহু শতাব্দী ধরে এই ওয়াজাপি গোষ্ঠী যে এলাকায় বসবাস করে এসেছে তা উত্তর ব্রাজিল আর ফ্রেঞ্চ গিয়ানা-র মাঝখানে অবস্থিত এক ভূভাগ। ১৯৭০ অবধি এই গোষ্ঠীর সঙ্গে আধুনিক জগতের কোনও সম্পর্ক ছিল না। ব্রাজিল সরকার এই এলাকায় রাস্তা বানানোর পর খনিশ্রমিক এবং বহিরাগতরা এখান পৌঁছে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে।
১৯৯৬ সালে এলাকাটিকে সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করা হয়, ১৯৮৮ সালে রচিত ব্রাজিলের সংবিধান অনুসারে। সেই ঘোষণা একুশ বছরের সামরিক শাসনের পর লাগু করা হয়। আদি জনগোষ্ঠীর উপর প্রায় ১৪০০ থেকে চলে আসা ইউরোপীয়দের নির্মমতাকে শুধরানোর লক্ষেই অবশ্য নেওয়া হয়েছিল সরকারি এই প্রয়াস।
কিন্তু আপাতত সে সব অতীত। আমরা এক নির্মম ফ্যাসিবাদী পরিকল্পনা প্রত্যক্ষ করতে চলেছি। যেখানে নিপীড়িত শ্রেণিদেরই পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায়। লাগানো হচ্ছে একান্তভাবেই পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষার তাগিদে।
ব্রাজিল থেকে ভারত— এ গল্প একই!