অনির্বাণ ভট্টাচার্য
এ বড় আঁধার এক। ঠিক কাব্যিক প্রেক্ষিতে নয়। বাস্তব। কঠিন, বড় কঠিন এক রিয়েল ওয়ার্ল্ড। লেখক অমিতাভ ঘোষের কথা মনে পড়ছে। তাঁর ভাষায়, পশ্চিমের দেশগুলির অর্থনীতির পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ওপর। অর্থাৎ পুরোটাই পরিবেশগত আত্মহত্যা। এনভায়রনমেন্টাল সুইসাইড। রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারেল বান কি মুন ২০১১-র বিশ্ব ইকোনমিক ফোরামে ঠিক এই শব্দবন্ধই বলেছিলেন। অমিতাভর কথায় সায় দিয়ে। তাঁর ভাষায়, আমাদের একটা বিপ্লব দরকার, দরকার একটা স্থিতিশীল ইকনমিক মডেল, যার ভিত্তি হোক কৃষি।
ঠিক কিসের ওপর দাঁড়িয়ে আজকের অর্থনীতি। প্রাকৃতিক শক্তির তুমুল ব্যবহার, বৃক্ষচ্ছেদন। আর অনুষঙ্গ হিসেবে মাটির উর্বরাশক্তির ক্রমশ কমে যাওয়া, আবহাওয়াজনিত এক বিরাট প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্ম, একের পর এক শুকনো অ্যাকুইফার, জল সঙ্কট, ডেসার্টিফিকেশন অথবা ঠিক বিপরীতে বন্যার প্রকোপ হয়ত একই গোলার্ধ কিংবা একই দেশের দূরের কোনও কোনও এলাকায়। আয়রনি। ব্রাজিল। আমাজন অরণ্য। প্রেসিডেন্ট জোসে বোলসানারোর নেতৃত্বে নির্লজ্জ সন্ত্রাস। হয়ত সর্বকালের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ম্যানমেড ফরেস্ট ফায়ার। সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট। হাত মেলানো। ক্রমশ ক্ষয়ীভূত পৃথিবীর ফুসফুস। ভারতবর্ষেও পরিবেশ বিপর্যয়ের অবস্থাটা খুব স্বতন্ত্র কি? সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার রিপোর্টের সমীক্ষা অনুযায়ী আগামী বছরের মধ্যে পাঞ্জাব, হরিয়ানা সম্পূর্ণ মরুভূমিতে রূপান্তরিত হবে, যদি বর্তমান হারে বৃক্ষচ্ছেদন এবং জলের অপচয় চলতে থাকে।
এই অবস্থায় কৃষি সম্বল। অথচ পরিস্থিতি? কৃষি থেকে ক্রমাগত অন্য পেশায় মানুষের মাস-এক্সোডাস। ২০২২-এর মধ্যে কৃষক আয় দ্বিগুণ করার লক্ষ্য। অথচ বাস্তব দিক থেকে বেশ কিছুটা ধোঁয়াশা। শহরে সস্তার শ্রমিক নিয়োগের কাজে কৃষকেরা ক্রমাগত নিজেদের ঠেলে নিচ্ছেন। অন্তত এই অভ্যেস বন্ধ হওয়া দরকার। কৃষি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে গ্রামীণ আর্থসামাজিক পরিস্থিতিকে প্রথমে মজবুত করতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতি সজীব হলে এই মাইগ্রেশন থেকে বাঁচবে শহর, স্বাভাবিকভাবেই শহরের চাকরির সম্ভাবনার এতটা ক্রাইসিস থাকবে না, এটা মনে করাই যেতে পারে। নীতি আয়োগের একটি সাম্প্রতিক সমাবেশে ঘোষিত হয়েছে কৃষিতে বড়সড় পরিবর্তনের জন্য একটি উচ্চ-পর্যায়ের টাস্ক ফোর্স গঠনের কথা। বলা হয়েছে ২০২৪-এর মধ্যে সারা দেশব্যাপী এগ্রিকালচারাল ট্রান্সফরমেশনের কথা।
আলোচনায় আসে জল সংরক্ষণের কথা। ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতির নতুন করে ক্ষমতাবৃদ্ধি, এবং কম খরচে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। যার আর এককথায় নাম ওয়াটার ইন্টেন্সিভ এগ্রিকালচার। ড্রিপ ও স্প্রিঙ্কলার পদ্ধতির সেচ ব্যবস্থার ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কৃষিজ দ্রব্যের স্থানীয় উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, বাজারীকরণ এবং কেনাবেচার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন নীতিতে। মার্কিন ও ইওরোপীয় কৃষি পদ্ধতির অনুলিপি না, ভারতীয় কৃষিবিজ্ঞানীদের সহায়তায় দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী বসানো হয়েছে পূর্ব উল্লেখিত টাস্ক ফোর্স। কৃষিজ পণ্যের বাণিজ্যের ওপর, এবং আমদানি রপ্তানির পর্যাপ্ত ফার্ম মার্কেট তৈরি এবং তার আধুনিকীকরণের ব্যাপারে ভাবা হচ্ছে, যা অবশ্যই আশাপ্রদ।
প্রসঙ্গক্রমে চলে আসে ডিরেক্ট ইনকাম সাপোর্টের কথা। গত ফেব্রুয়ারির অন্তর্বর্তী বাজেটে ছোট চাষিদের প্রত্যেককে ৬০০০ টাকা করে ডিরেক্ট ইনকামের কথা বলা হয়েছে, যা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলে উৎসাহিত হবেন কৃষিতে সবেচেয়ে বেশি সমস্যাভুক্ত ছোট চাষি ও ভাগচাষিরা। অর্থাৎ ক্রমশ আয়ের দিকে ঝুঁকেছে ভারতীয় কৃষি ভাবনার গতিপথ। পিএম কিষান, পিএম কিষান মানধন যোজনা ইত্যাদির প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত কমিশন ফোর এগ্রিকালচারাল কস্ট অ্যান্ড প্রাইসেসের টার্গেট হিসেবে মাসিক কৃষিজ আয় সব ধরনের কৃষক পরিবারের ক্ষেত্রে গড়ে বলা হয়েছে ১৮০০০ টাকা। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার দেশের প্রায় অর্ধেক অংশের অর্থাৎ ১৭টি রাজ্যের কৃষকদের বর্তমান গড় আয় ২০০০০ টাকা। না, মাসে নয়, বছরে। অর্থাৎ ডিরেক্ট ইনকাম সাপোর্ট, আদৌ যদি ফলপ্রসূ হয়, ফল হবে সাঙ্ঘাতিক। এক লাফে বেড়ে যাবে কৃষি অর্থনীতির গ্রাফ। এবং এ প্রসঙ্গেই ২০০৭ থেকে ২০১৭-র মধ্যে জিডিপির ০.৪ শতাংশ পাবলিক সেক্টর ইনভেস্টমেন্টের সাম্প্রতিক পরিমাণ থেকে সেই ২০০০০ টাকা বার্ষিক আয়ের বর্তমান দৈন্যতাকেই প্রকট করে, যা এই নবতম পলিসি অনেকটা হলেই চাঙ্গা করতে পারবে বলে আশা করা যেতেই পারে।
এই অর্থনৈতিক পটপরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন আরও বেশ কিছু বিষয়। সমস্ত কিষান মান্ডিগুলিতে এপিএমসি নিয়ন্ত্রিত মার্কেটগুলিকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন এমএসপি ডেলিভারি ব্যবস্থার আশু রদবদল। এবং পাশাপাশি খাদ্যশস্যের গুদাম, স্টোরেজ ইত্যাদির আধুনিকীকরণের প্রসঙ্গও খুব স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে।
সব মিলিয়ে কৃষি দেশের অর্থনীতিকে সজীব করতে এবং পরিবেশধ্বংসকারী শক্তির আত্মঘাতী ধামাধারী না হয়ে স্থিতিশীল এক অর্থনৈতিক মডেল হতে পারে যদি এই সব বিষয়গুলি একত্রিত করা যায়। কৃষির সঙ্গে জড়িত ৬০০ মিলিয়নের ভাতকাপড়ের বন্দোবস্ত করার জন্য এই আশাবার্তায় ভরসা দিতে পারে সঠিক পলিসি গ্রহণ, যা সরকারের বর্তমান কিছু পদক্ষেপে দেখা গেছে। আবহাওয়াজনিত ভারসাম্যহীনতার বিরুদ্ধে এই মডেল হতে পারে পাথেয় এবং সাস্টেনেবল। আয়ের মুখ দেখে কৃষকরাও ক্রমশ পূর্বকথিত মাস-মাইগ্রেশনের উল্টোপথে হাঁটবেন। গ্রাম ঘিরে থাকবে শহর। গ্রামীণ অর্থনীতি পরিপূরক হবে শহরের। মানুষ, মাঠ আর ফসলের দিকে তাকিয়ে থাকা মানুষ আলো দেখুক। এগোক কৃষিপ্রধান ভারতবর্ষ।