রাজা সরকার
স্মরণকালের মধ্যে দেখতে পাই না বাঙালি কখনও ‘বাঙালি’— এই বিষয়টি নিয়ে অন্তত ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়াস চালিয়েছে। ইতিহাসে দেখা যায় বঙ্গভঙ্গের সময় বাঙালির এমন এক প্রচেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সেটা তৎকালীন বাঙালি সমাজের একটি মাত্র অংশে ঘটেছিল। সেই সূত্রে বঙ্গভঙ্গ রদও হয়েছিল একসময়, কিন্তু ব্রিটিশ ভারতের রাজধানীটি কলকাতা থেকে উঠে দিল্লি চলে গিয়েছিল। বাঙালি ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে সেদিন হারিয়েছিল কৌলীন্য। বলা বাহুল্য, ভারতীয় জাতিপুঞ্জগুলোর মধ্যে এই কৌলীন্যপ্রথা ছিল। ব্রিটিশ রাজশক্তির সান্নিধ্য-সাপেক্ষে ঠিক হত এই কৌলীন্য। ভারতবর্ষের রাজধানী হারানোর মাধ্যমে তখন থেকেই বাঙালির হারানোর পালার শুরু বলা যায়। বস্তুত, ভারতীয় প্রেক্ষাপটে সেই সময় থেকে বাঙালি ‘বাঙালি’ এই জাতি-ধারণাটির থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল ও ক্রমশ এক ধরনের ভারতীয়তার দিকে ঝুঁকে পড়ছিল। বাংলার মাটি, বাংলার জল— এই সকল পদগুলো তখন থেকেই শিশুতোষ হিসেবে গণ্য হতে লাগল। ফলে বঙ্গভঙ্গ-পূর্ব বাঙালির তৈরি ‘বাঙালি’ ধারণাটি ক্রমে দুর্বল হতে হতে ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময় দেশের পূর্বাংশে তার একটি দুঃসহ, ভগ্ন রূপ চোখে পড়ল। বাঙালি নিজেই নিজের ভিতর বিভক্ত হতে লাগল। ধর্মে, জাতপাতে, কৌলীন্যে, অকুলীনে, ইত্যাদি বহুভাগে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এই বিভক্তিকরণ নেহাতই চলে আসা সামাজিক গঠন বিন্যাসের সহজাত চলন ছিল না, বরং এই বিভক্তি ছিল পেরেক ঠুকে স্থায়ীকরণের এক অবিমৃষ্যকারিতা। যার সূত্রে বাঙালি পেতে লাগল দেশভাগের নামে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হওয়ার এক পরিণতি।
তবে আজ এই দুঃসময়ে সামান্য হলেও আশার কথা যে, এনআরসি-কে ঘিরে আজ দেখা যাচ্ছে বাঙালি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এক সঙ্গে পথ চলার একটা প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
আজকের এনআরসি ১৯৪৭-এর দেশভাগেরই একটি উপজাত ফসল। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। উড়ে এসে হঠাৎ জুড়ে বসার মতো বিষয় নয় এনআরসি। মূলত উদ্বাস্তু বাঙালির জন্য এই ফসলের আবাদ হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। ঘরপোড়া গরুর মত বাঙালি সিঁদুরে মেঘ দেখেও আঁচ করতে পারেনি যে তার জন্য ধেয়ে আসা ভবিষ্যৎ কীরকম হতে পারে। এনআরসি নিয়ে হয়তো কেউ কেউ ভাবছেন যে আমার কী? আমার চৌদ্দপুরুষ এই ভারতভূখণ্ডের বাংলার অধিবাসী। এনআরসি আমার কেন হবে? এনআরসি হবে যারা পূর্ববঙ্গ থেকে ১৯৪৭-এর পর থেকে খেপে খেপে এসেছে তাদের। সে প্রাণের দায়েই আসা হোক বা পেটের দায়েই আসা হোক, কাউকে কোনও ছাড় নেই। মাঝখানে শুধু হিন্দুদের জন্য ‘হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থানে’র পাতা থেকে কৌশলে রটানো হয়েছে হিন্দুদের ভয় নেই। তার ফল এখন দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে সেই প্রতারণার ফলে ভরা ১৯ লক্ষ মানুষের জীবন আজ কতখানি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তো প্রশ্নটা এখন আর পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গ নয়। প্রশ্নটা হিন্দু মুসলমানও নয়। প্রশ্নটা এখন বাঙালির। প্রশ্নটা বাঙালি তার ‘বাঙালি’কে বিসর্জন দেবে, না রাখবে, সেই নিয়ে। ‘বাঙালি’র আগে ধর্ম বসিয়ে আবার ভাগাভাগির খেলা খেলবে কিনা সেই নিয়ে। বিসর্জন দেওয়াই যায়। পৃথিবীতে এখন বিশ্বায়নের যুগ। গ্লোবাল ভিলেজের যুগ। বিশ্বনাগরিকতার যুগ। বিগত শতকগুলোর ইতিহাসে দেখা যায় ভাষা, জাতি, সংস্কৃতি নিয়ে যুদ্ধবিগ্রহগুলোর দ্বারা উত্থাপিত অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো সবসময়ই একচ্ছত্র শাসন বিস্তারের জন্য বাধা হয়ে দেখা দিয়েছে। আজ এই একীভূত এক নব্য পৃথিবীর ভাবনাটা সেই সমস্যাটির সমাধান করতে পারে বলে বিশ্বায়নের উকিলরা মনে করেন। যার একটি দেশীয় সংস্করণের পাঁয়তারা আমরা এখন এইসময় দেখতে পাচ্ছি। তারা বলে থাকেন ভাষা নিজের শক্তিতে টিকে থাকবে অথবা মারা যাবে। জোর করে রাখা যাবে না। তারা বলেন বাঙালি আবার কী জিনিস! সত্যিই তো ভাষা না থাকলে বাঙালি আবার কী জিনিস? হয়তো আরও পরে বলবেন ভারতীয় আবার কী জিনিস! সত্যিই তো জাতি, ভাষা, ধর্মের বৈচিত্র্য না থাকলে ভারতীয় আবার কী জিনিস?
অসমে এনআরসি নিয়ে উদ্যোগ অনেক আগেই নেওয়া হয়েছিল। বলা বাহুল্য, মূল টার্গেট ছিল দেশান্তরী উদ্বাস্তু বাংলাভাষীরাই। এই বাংলাভাষীদের জন্য অন্যান্য প্রদেশের বাঙালিদের অনুভূতি কেমন ছিল? কিংবা আদৌ ছিল কি? না ছিল না। না থাকার কারণ কী ছিল? মূল কারণটা ছিল বাঙালির নিজেকে ‘বাঙালি’ হিসেবে ভাবতে না পারার অক্ষমতা। আর এই অক্ষমতাটার কারণেই খুব সহজে কিছু ধর্মীয় মৌলবাদী ও কিছু বাঙালি বিদ্বেষী শক্তি মিলে সেদিন বাংলা-ভাগ করতে পেরেছিল। এই ভাগের ফলশ্রুতিতে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিটেমাটি হারাবে, খুন হবে, ধর্ষিত হবে, তার আন্দাজ কি কেউ করেনি তখন? অবশ্যই করেছিল। বাঙালির অক্ষমতার জায়গাটা চিনে নিয়ে তারা এর জন্য কোনও রক্ষাকবচের কথা ভেবে সময় নষ্ট করেনি। কারণ পেছনে তখন ভারত পাকিস্তানের মতো নবগঠিত দুই রাষ্ট্রের দু-দুটো সিংহাসন প্রস্তুত। তাৎক্ষণিকভাবে কয়েক লক্ষ মানুষের ভিটেমাটি হারানোর দুর্দশার কথা ভেবে সময় নষ্ট করার সময় ছিল না। কে কার আগে সিংহাসনের দখল নেবে এটাই ছিল তখন আসল কথা। অথচ বাঙালি সেদিন কত নানা রঙের রাজনীতি, কত নানা রঙের দল উপদল গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে নিজেদের মত করে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। প্রাণ দিয়েছে। অথচ সেই বাঙালিকে আবার ভাগ করা হয়েছে। ভাগ করার প্রেক্ষাপট বানানো হয়েছে ১৯৪৬-এর কলকাতা ও নোয়াখালি দুটো ভয়াবহ দাঙ্গা দিয়ে। সেদিন স্বাধীনতাকামী সেই বিপ্লবী বাঙালিরা তখন কোথায় ছিলেন? যারা ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন তারা? কিছু ধর্মীয় মৌলবাদীর বিরুদ্ধে সেদিন কেউ কেন দাঁড়াতে পারেনি সেই প্রশ্ন তো আজও অমীমাংসিত। এমন অমীমাংসিত প্রশ্নের মুখে বাঙালিকে আবারও দাঁড়াতে হবে যতদিন না বাঙালির জন্য বাঙালি তার পাশে দাঁড়াতে পারে, সেটা অসম হোক অথবা বাংলা।
ইতিহাসের কিছু বিচার থাকে। নির্মম হলেও সেই বিচারের সম্মুখীন একদিন সবাইকেই হতে হয়। বিগত প্রায় একশো বছরের বাঙালির স্বার্থপর ব্রাহ্মণ্যবাদী চরিত্রের উপর গড়ে উঠেছে তার বিভিন্ন রঙের রাজনৈতিক মননবিশ্বটি। ঔপনিবেশিকতার অন্ধ অনুকরণ ছিল তার প্রগতি-ধারণার ভাঁজে ভাঁজে। সেই ধারণার বশবর্তী হয়ে সে ক্রমশ হারাতে শুরু করেছিল সর্বাগ্রে নিজেকে। ফলে আর্থিক, সামাজিক বা রাজনৈতিক, এসব দিক দিয়েই সে আজ বিসর্জনের ঘাটে চলে এসেছে। কারণ ব্রাহ্মণ্যবাদ দিয়ে আর যাই হোক জাতিসত্তা রক্ষা করা যায় না। আজ আবার এই এনআরসি ও তার সহযোগী বিবিধ চুক্তি/প্রস্তাবগুলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে খোলা-চোখ ও মুক্তমন নিয়ে ভাবতে হবে। ভাবতে হবে ফেলে আসা ইতিহাসের ভুলগুলোর যাতে আর পুনরাবৃত্তি না হয়।