ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য
উন্মীলিত হলো যেই শিবের প্রসন্ন চোখদুটি
পুবাকাশে আলো ফুটিফুটি…
ডুবে গেল খন্ডচাঁদ যোগীর জটায়…
ধ্যান-ভাঙা দুচোখের একাগ্র ছটায়
জ্বলে উঠলো সূর্যের প্রতিভা।
স্বামীর মুণ্ডমালার শোভায় আপ্লুত হয়ে পার্বতী জিজ্ঞাসা করলেন– স্বামী, আপনার এই মুণ্ডমালা ধারণের হেতু কী? প্রশ্রয়ী আশুতোষ উত্তর দিলেন– প্রিয়ে, প্রতিটি মৃত্যুর পরে যতবার তোমার জন্ম হয়, ততবার আমি এই মালায় একটি করে মুণ্ড গাঁথি। তোমার এক-একটি মৃত্যু এভাবেই আমার মালিকার শোভা বাড়িয়ে তোলে।
পার্বতীর কৌতূহল তবু মেটে না। প্রবীণা প্রকৃতি যোগীর দিকে অপলক ফের জানতে চান– আপনি অমর, প্রভু, অথচ আপনার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে আমাকে বারবার মৃত্যুর মুখ দেখতে হয় কেন?
প্রেয়সীর প্রশ্নে বিচলিত ভূদেব আলস্য ও নেশার আরাম ত্যাগ করে তাঁকে নিয়ে পথ চলতে শুরু করলেন। এই রহস্যের সন্ধান প্রিয়েকে দিতে মন চাইল তাঁর। এমন কোথাও যেতে হবে, যেখানে এই দৈব রহস্যের কথা আর কারও কানে পৌঁছবে না। পথ চলতে চলতে পহলগাঁওয়ে ছেড়ে দিলেন নন্দীকে। চন্দনওয়াড়ি এলে চন্দ্রমৌলি জটা থেকে নামিয়ে রাখলেন চন্দ্র। শেষনাগ হ্রদের তীরে ছেড়ে এলেন তাঁর সর্পকুল। মহাগণেশ পর্বতে রেখে এলেন পুত্র গণেশকে। সব শেষে পঞ্জতরনিতে পঞ্চতত্ত্ব ত্যাগ করে পার্বতীকে সঙ্গে করে আশ্রয় নিলেন পাহাড়ের ভিতরে একটি গুহায়। এই গুহার নাম আমরা দিলাম অমরেশ্বরের গুহা।
আকাশে বাতাসে বাজলো উদার যোগীয়া…
শিউরে উঠল প্রকৃতির তনুলোমে লজ্জিত মুকুল…
দুলে উঠল দিঘিজল, ভীরু শাপলা ফুল…
দৈবী রহস্য অনাবৃত করতে হলে তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা আবশ্যক। গুহার চারধারে জীবন্ত যা কিছু ছিল, মহাদেব তা ভস্ম করলেন কালাগ্নি দিয়ে, যাতে তাঁর রহস্যের কথা অন্য কারও কানে না যায়। পরিপার্শ্ব শুদ্ধ করে হরিণচর্মখানি বিছিয়ে তার ওপর সমাধিস্থ হলেন দেবাদিদেব। শুরু হল অমরত্বরহস্যের বর্ণনা।
চন্দনওয়াড়ির দিকটা জঙ্গল। পঞ্জতরনি থেকে কিছুটা এগিয়ে বাঁদিকে ওই জঙ্গলের পথে না গিয়ে ডানদিকে বরং অনেকটা জায়গা খালি। ভেড়া চরানোর উপযুক্ত। স্থানীয় মুসলমান মেষপালক বুটা মালিক একদিন ঘুরতে ঘুরতে ওই পথে এসে দেখতে পায় একটা গুহা। কাছে এসে দেখে– গুহার মধ্যে এক আশ্চর্য তুষারস্তূপ। তার সামনে ধ্যানরত এক সাধু। বুটাকে কাছে ডেকে সাধু তাঁকে আশির্বাদসহ দেন একটি কয়লার বস্তা। বুটা বাড়ি ফিরে সেই কয়লা ঢালতে গিয়ে পায় সোনা। অনেক সোনা।
বুটার থেকে এই গল্প শুনে একদল পুরোহিত সেই স্থান আর তুষারাবৃত শিবলিঙ্গ দর্শন করেন, এবং নিশ্চিত হন যে এই স্থান, এই গুহা মহাদেবের থান ছাড়া আর কিছুই নয়। হতে পারে না। ওই সাধু নিশ্চয়ই ছদ্মবেশী মহাদেব ছাড়া আর কেউ নন।
এই স্থানের মাহাত্ম্য সাধারণ্যে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে মহাদেবের আশিসাকাঙ্ক্ষীরা দলে দলে ভীড় জমাতে লাগলে একটা পরিচালন-ব্যবস্থার প্রয়োজন অনুভূত হল। বুটার পরিবার, সন্তানসন্ততিরা বংশানুক্রমে পুরোহিতদের সঙ্গেই নিয়োজিত হল তীর্থযাত্রীদের সুখসুবিধা দেখবার জন্য। শ্রাইন বোর্ড তৈরী হবার অনেক আগের কথা এইসব। বুটার পরিবার হকদার হয় তীর্থযাত্রীদের দান করা অর্থের একটা অংশের। স্থানীয়ের প্রতি বহিরাগতের করুণার ধারা বয়ে চলে পাহাড়ি নদীর বাঁকে-পাথরে।
শ্রাইন বোর্ড তৈরী হল ১৯৯৬-এর প্রাকৃতিক দুর্যোগে বহু তীর্থযাত্রীর মৃত্যুর পর। এতদিন যে মালিকানা ছিল স্থানীয় মহান্ত, বুটা পরিবার ও আশপাশের মানুষের, তার জায়গায় তৈরী হল বোর্ড, যাঁর মাথায় রইলেন রাজ্যপাল, আর অঙ্গে দশ সদস্যের কমিটি যার সকলেই হিন্দু ধর্মের মানুষ। মহাদেবের আশির্বাদ বুটার জন্য আর রইল না। তীর্থসূত্রে ধনযোগের একমাত্র ভাগীদার হলেন বোর্ড। মহাদেবের আশির্বাদ গেলেও বুটাদের জন্য রইল মোটের ওপর ফাইফরমাশ খাটার কাজ। সরকারও কিছু কম পরাক্রমশালী নন! ইতিহাসের এই মাইলফলকটি দেবভূমির বুকে প্রোথিত হওয়ার পর অবস্থার কোনও পরিবর্তন যে ঘটেনি তা নয়, তবে সেই পরিবর্তন একই খাতে বয়েছে।
২০০০, ২০০১, ২০০২ আর হালের ঘটনা (যদিও এ হানার আসল লক্ষ্য ছিলেন নাকি নিরাপত্তারক্ষীরা)– এ নিয়ে অমরনাথে জঙ্গীহানার ঘটনা নতুন নয়। তবু আতঙ্ক তো বরাবর নতুন। একই রূপে এসে বারংবার সে মানুষকে উদভ্রান্ত করে তোলে। তুলতে পারে। অমরত্বলীলা বর্ণনার স্থানে অপঘাতে মৃত্যু কেই বা চায়? সহ্য করে?
কারা এই জঙ্গী? কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ? পাকিস্তানের মদতপুষ্ট অপরাধী? মাঝের পনেরো বছর তারা কোথায় ছিল?
প্রশ্ন অনেক। উত্তর নেই…
এই অসহ্য সময়টাকেই কাঁদতে দে…
শিবের হরিণচর্মের নিচে একটি পায়রার ডিম নাকি কালাগ্নির হাত থেকে বেঁচে যায়। কালক্রমে সেই ডিমের থেকে জন্ম নেয় একজোড়া পায়রা যারা ওই অগ্নিরোষ থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে মহাদেবের বচন শুনে ফেলে এবং অমরত্ব প্রাপ্ত হয়। অমর তাদের দেখা নাকি আজও মেলে অমরনাথের গুহার আশপাশে। বহু সমরাস্ত্র আর তীর্থযাত্রীর ভীড় সহ্য করে আজও তারা বেঁচে আছে। আগুন থেকে বেঁচে ফেরা, পরিজন-হারানো পায়রা কি শান্তির গান গায়? মহাদেবের মালিকা সেজে ওঠে। আরও।
নীলমত পুরাণ নাকি বলেন– কাশ্মীর উমার মূর্তরূপ।
(এই লেখায় ব্যবহৃত কাব্যাংশ কবি শোভন ভট্টাচার্যের ‘ধ্বংসে লেখা ধ্রুপদ’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘যোগীয়া’ কবিতার থেকে নেওয়া। কবির অনুমতি নেওয়া হল না। তাই নামটুকু কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করলাম। কবির ও তাঁর সৃষ্টির। বানান অপরিবর্তিত। প্রশ্ন অনেক… কবীর সুমনের একটি গানের অংশ।)