রুখসানা কাজল
ইনবক্স জুড়ে হাহাকার। পত্রপত্রিকা, এদেশ সেদেশের সবখানে উৎকণ্ঠা। অবশ্য চরমপন্থী কেউ কেউ গলা খুলে বলে দিচ্ছে, যা ভাগ। পালা তোরা। শালারা এসেছিস তো ওপার থেকে। কাংলা দেশের বাঙাল হালার পুত! যা আবার বাংলাদেশে ফিরে যা।
এদেরকে যারা পালটি দিচ্ছে, তারা এই গালিবাজ তাড়ানেওয়ালাদের উদ্দেশ্যে আবার তিক্ত সুরে গালি দিচ্ছে।
মাঝখানে কিছু মানুষ কেঁদে ককাচ্ছে। এরা মানবতাকে যতই দৃশ্যমান করে কার্যকর করার চেষ্টা করুক না কেন দিল্লি সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, আর কোনও অনুপ্রবেশকারীদের জায়গা নেই ভারতে। স্টপ অনুপ্রবেশ।
ভারত! মহাভারত! আমার বাপি বলতেন, সংসারের ঝামেলা মিটলেই ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পড়বেন। এক জোড়া খড়ম, দু জোড়া খদ্দরের জামা পাজামা, দুটো খদ্দরের চাদর, কয়েকটা নিমের ডাল আর একটা লোটা।
আমার তিন নম্বর বড় বোন আপুলি জানতে চাইত, আর কিছু না?
স্মিত মুখে বাপি বলত, আর কী চাই মা! ভারতের পথে পথে সব পাওয়া যায়। দু মুঠো অন্ন, পথশালা, অবারিত নদীজল, মসজিদ, মন্দির, গুরুদুয়ারা— মানুষ— আহা মানুষ—
বেঁচে থাকলে আমি ঠিক এখন খোঁচাতাম, ডার্লিং বাপ, দেখো তোমার ভারত। তখন বৃটিশদের চুতিয়া বলে গাল দিয়েছ। এখন? ভাগ ভাগ, চলে যা, এটা তোদের দেশ না। যেখানকার মাল, সেখানে যা— ভারত জুড়ে এখন মহা নিনাদ। পথে পথে ঘৃণা, উদ্বেগ, নদীতে নদীতে গুলে যাচ্ছে ধর্ম, অনিশ্চয়তার কাড়া নাকাড়া—
অবশ্য ল্যাঙ্গুয়েজ ঠিক করে নিতাম। আমাদের বাড়িতে ভদ্র ভাষার চর্চা হয়। শুদ্ধ ভাষা না জানায় বড় বোনদের কয়েকটা বিয়ের প্রোপোজাল বাদ দিয়ে দিয়েছিল বাপি মা। আমি রকবাজ। শার্ট, প্যান্ট, গেঞ্জি, পকেটে মার্বেল, হাতে গুলতি, মুখে ডাস্টবিন— আমি আবার মেয়ে হলাম কবে?
কিন্তু প্রকৃতি আমার নারীসত্তাকে জাগিয়ে দিয়েছে। সময় দিয়েছে মাতৃত্ব। আমি অসমের চার পুরুষ আগে থিতু এক পরিবারের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন দেশছাড়া হওয়ার খবরে কাঁদছি। ওদের ছেলেমেয়েরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে চাকরি করছে, কেউ কেউ পড়াশুনা করছে। কেউ বা আবার বিদেশে। ভাই নাগরিক তো বোন অনুপ্রবেশকারী, বোন নাগরিক তো বাপ মা ভাই আউট। সে এক হট্টগোলের হাট্টিমা টিম অবস্থা অসমে। কী হবে এদের মাতৃভূমির পরিচয়? কী বলবে এরা জাতীয়তার প্রশ্নে?
দেশ তো মা। জননী। স্বর্গসম। প্রাপ্তি ও প্রেরকের মন উচ্ছল ঠিকানা। অম্লান গৃহ আবাস। কোমল উষ্ণ মায়াময়কোল। যত্র তত্র যেথা সেথা ঘুরে ফিরে অলজ্জিত মুখে বার বার সটান ফিরে আসার ঘর। দেশ তো জনম জনমের আশ্রয়। নিজের আমি, আমার আমির প্রিয় মাটি, প্রিয়তম স্বদেশ!
মনে হচ্ছে সেই তো ভাল ছিল। সেই সীমানাহীন আদিম পৃথিবী। কেন আমরা রাষ্ট্র তৈরি করলাম! এই রাষ্ট্র! হুমকিদাতা। শাহ ফরমানে রাতের ঘুম দিনের শান্তি কেড়ে নেওয়া জুজু রাষ্ট্র! বন্ধু জানাল, ভারত জুড়ে বন্দিশালা তৈরি হবে। পশ্চিমবঙ্গেও নাগরিক ঝাড়াই মাড়াই নিড়ানি শেষে আসলি বাছাই হবে। সরকারের তরফে জানান দেওয়া হয়ে গেছে। এখন প্রতিদিন উদ্বেগ। প্রতিদিন ভাগ তোরা ভাগ। যা চলে যা-র মহাভৈরব। না যদি যাস তবে থাক পড়ে অই বন্দিশালায় কাংলা দেশের বাঙাল হালার পুতরা।
…কেউ একজন বলছিল, পশ্চিমবঙ্গে হাত দিলেই খেল শুরু হয়ে যাবে। কেউ কেউ হেসেছিল, আর খেল! হিন্দিতে হান্দাইয়া বাঙ্গালী হিংগালি হয়ে গেছে। ওরা কি পারবে আমাদের নূর হোসেনের মত খোলা বুকে “স্টপ এনআরসি” লিখে অন্যায়ের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে?…
খুঁজেপেতে মনে পড়ল রাষ্ট্রের সংজ্ঞা। ম্যাক্স ওয়েবারের মতে, আধুনিক রাষ্ট্র নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের ভেতর বলপ্রয়োগের সব মাধ্যমের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে।
এই নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের ভেতর রয়েছে নাগরিক সম্প্রদায়। স্থায়ী নাগরিক ছাড়াও রাষ্ট্রের আরও কিছু পদ্ধতি রয়েছে নাগরিকতা অর্জন করার। সে ক্ষেত্রে বসবাসের সময়সীমা, সম্পত্তি ক্রয়, বিবাহ ছাড়াও জন্মনীতি, জন্মস্থাননীতিও রয়েছে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্র নাগরিকতা অর্জনের পদ্ধতিগুলো মেনেই নাগরিকপঞ্জিতে তাদের নাগরিকদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে।
এবার আসি বলপ্রয়োগ এবং একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম প্রসঙ্গে। বিশ্বের কোনও রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে বলপ্রয়োগ বা একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত বা কায়েম করতে পারে না। কার উপর করবে? অবশ্যই নাগরিকদের উপর। নাগরিক কারা? যারা রাষ্ট্রের স্থায়ী অধিবাসী তারা। আবার যারা নাগরিকতা অর্জন করেছে তারাও। এই নাগরিকদের সম্মতির উপরই রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয় সরকার। সে গণতান্ত্রিক হয়েও একনায়কতান্ত্রিক হতে পারে। আবার একনায়কতান্ত্রিক হয়েও গণতান্ত্রিক হতে কোনও অসুবিধার ধার নাও ধারতে পারে।
উল্লেখ করার মত বিষয় হলো সরকার। একমাত্র সরকারই পারে রাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ করে গড়ে তুলতে। আবার হয়ত রাষ্ট্র নিরপেক্ষ নয় কিন্তু সরকার উদারনৈতিক নীতিতেও বিশ্বাসী হতে পারে। বর্তমান পৃথিবীতে বিশ শতকের শেষভাগে এসে রাজনীতি আর অর্থনীতি এক হয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে বিশ্বায়নের প্রভাব, শ্রম ও মূলধনের প্রবাহ এবং আন্তর্জাতিক নানাবিধ প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কোনও কোনও রাষ্ট্র রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ধর্মকে যুক্ত করে নিয়েছে। জ্বলছে প্যালেস্টাইন। প্রতিনিয়ত দেশ ছাড়ছে বা ভাগছে প্যালেস্টাইনিরা। আফ্রিকার কিছু কিছু রাষ্ট্রের চিত্র তথৈবচ। এবার ভারত।
রাষ্ট্রকে একচ্ছত্র ক্ষমতা দিয়ে দেওয়ার মানে এই নয় যে রাষ্ট্রের মুখপাত্র হিসেবে সরকার একমেবাদ্বিতীয়ম। বহুত্ববাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একত্ববাদী গোয়ার্তুমিকে উড়িয়ে দিয়েছে। লাস্কি তো পাত্তাই দেননি। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ রূপকথা বলে ব্যঙ্গ করেছেন। কিন্তু না, কল্যাণকামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যকে সপাটে চড় মেরে কিছু কিছু রাষ্ট্র তথা সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে নিজেদের মত করে কুক্ষিগত করে নিয়েছে। ফলে চলছে একচ্ছত্র শাসন। মনভুলানো কর্মসূচির মোহে জনগণ ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচন করেছে। বাদ পড়া এই উনিশ লক্ষ অনুপ্রবেশকারীও ছিল ভোটদাতা। এখন কে আছে এদের বাঁচাতে? বিরোধী দল লালে নীলে শতছিন্ন। পারস্পরিক খেয়োখেয়িতে আম ছালা হাতছাড়া প্রায়। অগত্যা উনিশ লক্ষ মানুষের পেটে পিঠে নয়, সোজা নাগরিকত্বে এবার কিল। চড় ঝ্যাঁটা খেয়ে হাঁটা দাও।
উনিশ লক্ষ খাবি খাওয়া জনগণ অনুপ্রবেশকারী। নাগরিকতা অর্জনের প্রমাণ দিয়েও এরা রাষ্ট্রছাড়া। আরও তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে অসম সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে অনুপ্রবেশকারী তাড়ানোর নামে চলছে বর্তমান সরকারের ধর্মীয় এবং একপেশে মনোভাব। তলে তলে বাঙালি খেদাও কুচক্রও বেশ সক্রিয়। তারা সরকারের হাতে হাত রেখে সমানে তাল দিয়ে যাচ্ছে।
কেউ একজন বলছিল, পশ্চিমবঙ্গে হাত দিলেই খেল শুরু হয়ে যাবে। কেউ কেউ হেসেছিল, আর খেল! হিন্দিতে হান্দাইয়া বাঙ্গালী হিংগালি হয়ে গেছে। ওরা কি পারবে আমাদের নূর হোসেনের মত খোলা বুকে “স্টপ এনআরসি” লিখে অন্যায়ের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে?
কেউ একজন আরও বলেছে, পুশ ব্যাক হবেই। বাংলাদেশও তাই কমবেশি অস্থির। ভাবছে। ভাবতে হচ্ছে। ভাবছিও। ভাবাচ্ছে যে!
ভৌগোলিকভাবে বড় দুর্বল অবস্থান বাংলাদেশের। পলিগঠিত ভাসমান বৃহত্তম বদ্বীপ। ভূবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছে আসছে কয়েক দশক পরের যে কোনও সময়ে প্রায় তরল কাদামাটির তলে তলিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ। অতিরিক্ত জনভারে ভারী বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেলে সুজনেষু প্রতিবেশীরা কি রক্ষা পাবে? পানির ভাঙন থাকে অদৃশ্য। তলে তলে মাটি খেয়ে এগিয়ে আসে পানি। তো বেশ হবে তখন, অই যে কি যেন আছে না, মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ, আমি আছি— ভুড়ুঁশ! জ্জয়ছিরাম। আল্লাহুকবার।
স্বপ্ন দেখতে কার না ভালো লাগে! হয়ত এক সময় মানুষের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে এই পৃথিবীতে কিম্বা আমাদের ভারতবর্ষে। সীমানা বলে কিছু থাকবে না। দুজোড়া জামাকাপড়, সামান্য কিছু জিনিস ঝোলায় ভরে বেরিয়ে পড়ব পথে। বান্ধবী হতাশ হবে, তুই কীরে। পেস্ট ব্রাশ এখানে কিনছিস!
আমি হিহি। ভারত। আহা ভারত। পথে পথে সব পাওয়া যায়। সব! মানুষও!