বিকাশ এস জয়নাবাদ
সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের জন্ম ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দে, কুমারহট্ট গ্রামে বাংলার ১১২৯ সালে, বৈদ্য বংশে। কবির জন্মের সময় বাংলা শাসন করছেন মুর্শিদকুলি খাঁ, যিনি দিল্লির মুঘল সম্রাটদেরকে এক বিশাল খাজনা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলার দেওয়ান হয়েছিলেন। জ্ঞানীজন বলেন, ভারতবর্ষের ইতিহাসে অষ্টাদশ শতক চরম অরাজকতার শতক। আওরঙ্গজেবের শাসনের শেষদিকে ভারতবর্ষ জুড়ে বিদ্রোহ। কেন্দ্রীয় সরকার তা দমনের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতে বাধ্য হচ্ছেন। অসহায় আওরঙ্গজেব মুর্শিদকুলি খাঁকে ১৭০০ সালে সুবা বাংলার দেওয়ান যখন নিযুক্ত করেন তখন বাংলার রাজদরবারে নিযুক্ত মুঘল শাহজাদা আজীম-উস-শান (১৬৯৭-১৭১২)। সেই নিয়োগের মাধ্যমে দিল্লির নবাব চেয়েছিলেন নিরবচ্ছিন্ন রাজস্বের যোগান। তখন অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলা ছিল এক অন্যতম সমৃদ্ধিশালী প্রদেশ (জিন্নাতুল বিলাদ)। সোনার বাংলা।
সেই সময় সারা পৃথিবী জুড়ে অস্থিরতা। সহজ সরল মানুষদের উপর বিদেশি বণিকদের আগ্রাসন। মুর্শিদকুলি খাঁ ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সম্রাটের অনুমতি নিয়ে মুকসুদাবাদে (মুরশিদাবাদ) বাংলার সদর স্থাপন করেন। ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলি খাঁ ভূমি-রাজস্ব বন্দোবস্তে (revenue settlement) বাংলার মোট ভূমি-রাজস্ব আদায় করেছিলেন এক কোটি বিয়াল্লিশ লক্ষ অষ্টাশি হাজার টাকা। রাজস্ব এক লাফে বেড়ে গিয়েছিলেন ১৩.৫ শতাংশ।
বাংলার কৃষি অর্থনীতির উপর মুর্শিদকুলি খাঁর ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থা গভীর প্রভাব ফেলেছিল। ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতা কর্তৃপক্ষ লিখছেন: “টাকার জন্য মুর্শিদকুলি দেশটাকে ছিঁড়ে টুকরো করছে।”
এছাড়া মুর্শিদকুলি খাঁ একখাতে (ওয়াজাসাৎ খাসনবিশী) ২,৫৮,৮৫৭ টাকা আবওয়াব ধার্য করেছিলেন। পলাশি যুদ্ধের পরে ইংরেজরা এই ব্যবস্থার সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়ে বজায় রেখেছিলেন বাংলার আমজনতার উপর শোষণ। মুর্শিদকুলি খাঁ অকৃষি জমিকে কৃষি জমিতে রূপান্তরিত করতে জোর দিয়েছিলেন। চাষাবাদ বাড়লেও কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পায়নি। প্রতি বছর মুর্শিদকুলি খাঁ দিল্লির সম্রাটের প্রাপ্য রাজস্ব (Imperial Tribute) নগদ মুদ্রায় এক কোটি টাকা পাঠাতেন। বাজারে নগদ টাকার জোগানে টান পড়ত। নবাব কঠোরভাবে রাজস্ব আদায় করতেন। সোনার খোঁজে সোনার বাংলায় ভিনদেশি বণিকদের বাড়বাড়ন্ত। বাণিজ্যের ফলে কৃষক ও কারিগরদের উদ্বৃত্ত উৎপাদন রাজকোষে জমা দিতে বাধ্য করা হত। মুর্শিদকুলির সময় থেকে বাংলার আর্থিক জীবনে নতুন ধারার সূচনা হয়েছিল। সলিমুল্লাহ-র ‘তারিখ-ই-বাঙ্গলা’য় জানা যায় যে তিনি বলছেন সেই সময় অবাঙালি মুসলিম রাজস্ব আদায়কারীদের কাছ থেকে তছরূপ হওয়া সরকারি অর্থ আদায় করা প্রায় অসম্ভব ছিল। বাঙালি হিন্দুরা ছিল শান্ত, নিরীহ ও ভীরু। মুর্শিদকুলি খাঁয়ের উপরে ওঠার কোনও সম্ভাবনা ছিল না সেই জন্যই মুর্শিদকুলির আমলে বাংলার রাজস্ব বিভাগে বাঙালি অবাঙালি হিন্দু তোষণ অন্যদিকে বাঙালি হিন্দু বিদ্বেষ! মুর্শিদকুলি খাঁর মৃত্যুর পর বাংলার নবাব হয়েছিলেন সুজাউদ্দিন খাঁ (১৭২৭-৩৯)। তিনি কোনও ব্যতিক্রমী নবাব ছিলেন না, তবে অন্য নবাবদের তুলনায় একটু উদার ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর বাংলার সফররাজ (১৭৩৯-৪০)। এই নবাবকে জঘন্যভাবে হত্যা করেন আলিবর্দী। এই প্রসঙ্গে নিখিলনাথ রায় তাঁর ‘মুর্শিদাবাদ কাহিনী’ বইতে বলেছেন, “নবাব আলিবর্দী খান সিংহাসনের লোভে তাঁর পরম উপকারী প্রভুপুত্রকে চক্রান্তের সাহায্যে হত্যা করে যে বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, তারই পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পাই তাঁরই নাতি সিরাজদৌল্লার জীবনে। সিরাজদৌল্লা ঐ একই চক্রান্তের শিকার হন। সুতরাং বলা যেতে পারে যে পলাশির যুদ্ধ হল গিরিয়ার যুদ্ধের ফলশ্রুতি।”
১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে রামপ্রসাদ সেন সদ্য যুবক। ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার বুকে মারাঠাদের তাণ্ডব চলে। বিদেশি শক্তির তাণ্ডবে দিল্লি সম্রাট একদিকে আলিবর্দীকে ফরমান দিচ্ছেন, অন্যদিকে মারাঠাদেরকে বাংলা থেকে চৌথ আদায়ের অনুরোধ করছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতায় পরপর দুই বছর বাংলার রাজস্ব দিল্লির রাজকোষে জমা পড়েনি। মহারাষ্ট্র তখন বাংলার রাজস্বের ২৫ শতাংশ পেত। ফলস্বরূপ বাংলার বর্গি আক্রমণ। সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের কবিতায় এই আক্রমণ সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে কোনও শব্দ পাওয়া যায় না। অথচ তাঁর সমসাময়িক কবি ভারতচন্দ্র লিখছেন:
স্বপ্ন দেখি বর্গী রাজা হইল ক্রোধিত
পাঠাইয়া রঘুরাজ ভাস্কর পন্ডিত।–অন্নদা মঙ্গল
বর্গি আক্রমনের বিবরণ গঙ্গারামের মহারাষ্ট্র পুরাণে যে ভাবে পাওয়া যায় তা হয়ত অন্য কোথাও তেমনভাবে পাওয়া যায় না। ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে মারাঠারা দিল্লির বাদশাহের নিকট সেই চৌথ দাবি করে পাঠায় তখন তিনি তাঁর নিজের অক্ষমতা প্রকাশ করে বাংলা থেকে চৌথ আদায় করে নিতে বলেন। গঙ্গারাম লিখেছেন:
চাকর হইয়া মারিলে সুবারে।
জবর হইল লালবন্দি না দেয় মোরে।
লোকলস্কর তবে নাই আমার স্থানে।
হেন কোনজন নাই তারে গিয়ে আনে।
বাঙ্গালা মুলুক সেই ভুঞ্জে পরম সুখে।
দুই বৎসর হইল লালবন্দি না দেয় এ মোকে।
জবর হইয়া সেই আছে বাঙ্গালতে।
চৌথের কারণে লোক পাঠায় তথাতে।–মহারাষ্ট্র পুরাণ
বর্গিদের নেতা ভাস্কর পণ্ডিতের চল্লিশ হাজার মারাঠা সৈন্য সাতারা থেকে বিজাপুর নাগপুর পঞ্চকোট হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ১৭৩৮ ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে খরার কারণে ও ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে অন্যায়ভাবে বাংলার নবাবকে হত্যা করে বাংলার সিংহাসন দখলকারী আলিবর্দী দিল্লির দরবারে প্রয়োজনীয় রাজস্ব পাঠাতে পারেননি। বর্ধমানে পৌঁছে ভাস্কর নবাবকে জানাল— ‘চৌথাই না দিবে জবে/ রাজ্য নষ্ট হবে তবে তার সনে করিব আমি রন’। (মহারাষ্ট্র পুরাণ)
বাংলার নবাব দিল্লিতে রাজস্ব পাঠাতে পারেননি বলে বাংলার আমজনতার উপর সন্ত্রাস নেমে আসে। সন্ত্রাস এলে তা হিন্দু মুসলমান কাউকে ছাড়ে না।
তবে সব বরগী গ্রাম লুটিতে লাগিল।
যত গ্রামের লোক সব পালাইল।
ব্রাম্ভণ পন্ডিত পলাএ দোকান লইয়া জত।
তামা পিতল লিয়া কাঁসারি পলাএ কত।
কামার কুমার পলাএ লিয়া চাক নড়ি।
জাউলা মাউলা পলাএ লইয়া জাল দড়ি।
কাএস্ত বৈদ্য জত গ্রামে ছিল।
বরগীর নাম সুইন্যা সব পলাইল।
ভাল মানুষের স্তীলোক জত হাটে নাই পথে।
বরগীর পলানে পেটারি লইয়া মাথে।
গোশাঞি মোহান্ত জত চোপালাএ চড়িয়া।
বোচকা বুকি লয় জব বাহুকে করিয়া।
সেক সৈয়দ মোগল পাঠান জত গ্রামে ছিল।
বরগীর নাম সুইন্যা সব পলাইল।–মহারাষ্ট্র পুরাণ
মানুষ এমনি এমনি বাপ চোদ্দপুরুষের ভিটে ছেড়ে পালায়? নিজের ঘর গাছপালা গাই বাছুর জোত জমি সব ফেলে পালায়? বাঙালিকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল অপ্রত্যক্ষভাবে দিল্লির সিংহাসনে অধিষ্ঠিত মহাপ্রভুরা। রাঢ় বাংলার মানুষ পালিয়েছিল ভয়ে।
সারা বাংলা বর্গিদের ভয়ে কম্পমান। রাঢ় বাংলার মানুষ প্রায় বারো বছর বর্গিদের বিচরণ ক্ষেত্রে অসহায়। রেশমের জন্য পলু চাষের খেত বর্গিদের ঘোড়ার খুড়ে তছনছ। অর্থনীতি পঙ্গু—
চাউল কালাই মটর মুষরি খেসারি।
তেল ঘি আটা চিনি লবণ একসের করি।
টাকা সের হৈল আনাজ কিন্তে নাই পাএ।
ক্ষুদ্র কাঙাল জত মইরা মইরা জাএ।
মানুষের সুখদুঃখের অনুভূতি কোনও বাক্যে প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ থাকলে কাব্যসমালোচকরা অনেক সময় সেই কাব্যকে কাব্য বলে স্বীকার করতে চান না। সেইসব তথাকথিত সমালোচকরা প্রত্যক্ষ এবং অপ্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের খুব কাছের লোক।
কবি রামপ্রসাদের কুমারহট্ট গ্রামের কাছেই কাউগাছি। ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দের বৈশাখ মাসে বর্গি আক্রমণ শুরু হলে বর্ধমানের মহারাজ চিত্রসেন পালিয়ে আসেন ‘বিশালা নগরী’তে। সেই বিশালা নগরীই কাউগাছি নামে পরিচিত। ২৪ পরগনার শ্যামনগর স্টেশনের পূর্বদিকে এই গোরের ধ্বংসাবশেষ বিংশ শতকের শেষপাদেও দেখা যেত। ১৩৩৮ সালে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা (৩য় সংখ্যা, ১৩৭ নম্বর পৃষ্ঠা) লিখেছেন, ’৭০ বৎসর আগেও সেখানে বড় বড় ফটক ছিল এবং তার মধ্য দিয়ে হাতী চলে যেতে পারত। এখান থেকেই চিত্রসেন বর্গী প্রতিরোধ করতেন।’ বর্ধমানের মহারাজরা বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এই কাউগাছিতেই সেযুগের ত্রিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের আগে বাংলা পণ্ডিত সমাজের একচ্ছত্র নেতা বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার ‘চিত্রচম্পূ’ (১৭৪৪ খ্রিঃ) লেখেন।
এই কাব্যটিতে বর্ধমানের মহারাজ চিত্রসেনের সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দৈনন্দিন জীবন যাত্রার বর্ণনা আছে। রাজার আশ্রয়ে থাকা সত্ত্বেও বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের অভাব অনটন ছিল। কয়েকজন নিজের বাড়ি গুপ্তিপাড়া কাটিয়ে ফিরে এলে রাজা কুশল জিজ্ঞাসা করলে বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার উত্তর দিয়েছিলেন:
লজ্জা মানসুতা মমাদ্য বনিতা ভিক্ষাপহরা দৈনজা
তাতৈশ্বর্যবিগর্বিতা বলবতী ভিক্ষা প্রগলভাহভরৎ।
সা লজ্জা নিহতা তয়ই তনয়া শোকেন মনোমৃতো
ভিক্ষা দৈন্যসুতা চিরাৎ পতিরতানাদ্যাপি মাং মুঞ্চতি।
বাংলা পণ্ডিত সমাজের একচ্ছত্র নেতা বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের সংসারে অভাব অনটন! সোনার বাংলার আমজনতার আর্থিক অবস্থা এর চাইতে বেশি ভালো হতে পারে না। ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানের মহারাজ চিত্রসেনের মৃত্যু হলে বাণেশ্বর পুনরায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় যোগ দেন। বাংলার প্রকৃত সব গুণীজনরা কখনওই সচ্ছলতা পাননি। পান না। সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের এক গানে যেন সেই কথারই সুর:
পড়ে শুন বিদ্যারত্ন, ভিক্ষারত্ন উপজীবী।
তোমার জ্ঞানরত্ন যে অযত্ন, নিত্যরত্ন কিসে পাবি।।
কালীপদ সুধাহৃদে সুধাপানে শুদ্ধ হবি।
রামপ্রসাদ বলে মৃত্যুকালে মুক্তি-পদে মিশাইবি।।
অষ্টাদশ শতকের আর্থিক সম্পদের প্রধান উৎস ছিল কৃষি এবং শিল্প। বাংলার প্রায় প্রত্যেক ঘরে তাঁতের কাজ হত। বাংলার তাঁতের জন্য পৃথিবীর সব দেশের বণিকের চোখ ছিল বাংলা। ‘বিস্তীর্ণ অঞ্চল ধরে বিক্ষিপ্ত অত্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুটির শিল্প’ যাদের মূলধনের যোগান আসত ফড়ে, পাইকার, দালালদের কাছ থেকে। দাদন ব্যবস্থা থাকার জন্য তাঁতিদের লাভের গুড় পিঁপড়েতে খেত। এইসব পরিবারের প্রায় সকলেই তাঁত শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকত। তাঁত ছাড়া অন্যান্য শিল্পও ছিল।
নদীধৌত বাংলার বিশাল সমতলভূমি গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও তাদের শাখানদী উপনদীর জলধারায় পুষ্ট। স্কটল্যান্ডবাসী আলেকজান্ডার ডাও বাংলা সম্পর্কে লিখেছেন “প্রকৃতি যেন নিজহাতে বাংলাকে কৃষি ও কৃষি কাজের জন্য প্রস্তুত করেছেন। কৃষি উপযোগী সব কিছু বাংলায় আছে।” তিনি বাংলার বাণিজ্যের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখছেন, “বাংলার নরম জলবায়ু, জমির উর্বরাশক্তি ও হিন্দুদের প্রকৃতিগত ঐতিহ্য বাণিজ্যের সহায়ক।”
যেখানে যত ধন তত বণিকদের আধিপত্য! মুর্শিদাবাদের পতনের সময়, উপনিবেশ স্থাপনের সময় বাংলার রাজধানী শহরে প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার মণ চালের ব্যবসা হত এবং এই বিপুল পরিমাণ চালের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত মাত্র চারটি বণিকগোষ্ঠী। বাঙালির রাজধানীর ভোজবাজ, এক বিখ্যাত গোলদার, বছরে ১ লক্ষ মণ ধান নিয়ে ব্যবসা করতেন। তাদের সঙ্গে মাঝিমাল্লাদের এক গভীর যোগাযোগ ছিল। বাংলার অন্যতম প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল নৌপরিবহন। পণ্য সরবরাহে এদের প্রত্যক্ষ সরবরাহ কাম্য ছিল। রাজধানীর সেই চার বণিকগোষ্ঠীর একাধিপত্যের কাছে মাঝে মাঝেই বাংলার নবাব ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে মাথা নোয়াতে হত।
পল গ্রিনো তাঁর পি-এইচ-ডি গবেষণাপত্রে লিখছেন বাংলার সোনা মানেই সোনার ধান। ধান মানেই প্রাণ। ধান মানেই উর্বরাশক্তি। তবুও বাংলার কৃষকেরা অধিকাংশ সময়েই ফসল তোলার সঙ্গেই অভাবে বিক্রি করতে বাধ্য হত। সম্পন্ন চাষিরা বিপুল পরিমাণে লগ্নি করে শতকরা ২৫ শতাংশ লাভ করত। মেহনতি প্রান্তিক চাষিদের কিছুই থাকত না। এই জন্যই বাংলার মানুষ, কবি রামপ্রসাদ সেনের গানে শোনা যায় সেই হাহাকার:
১
অন্নত্রাসে প্রাণে মরি, নানাবিধ কৃষি করি।
২
অন্ন দে গো অন্ন দে গো
অন্ন দে গো অন্ন দে।
জানি মায়ে দেয় ক্ষুধার অন্ন
অপরাধ করিলে পাছে পদে।।
মোক্ষ প্রসাদ দেও অম্বে
এ সূতে অবিলম্বে
জঠরের জ্বালা আর সহে না তারা
কাতরা হইও না প্রসাদে।।
অষ্টাদশ শতকে বাংলায় কৃষির উৎপাদনে কোনওরকম বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায় না। গতানুগতিকতা ছিল। তবে এ সময়ের চাষের বড় বৈশিষ্ট্য ছিল বিস্তৃত চাষ পদ্ধতি। বাংলার প্রধান প্রধান কৃষি পণ্য ছিল ধান, গম, যব, রবিশস্য, আখ, তামাক, তুলা, রেশমের জন্য তুঁতে গাছের চাষ।
বাংলার অর্থনীতিতে কৃষির এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও কৃষকরা অবহেলিত। কৃষকরা যেন মানুষই নয়। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে আসল জমার (Original Rent) অতিরিক্ত সুবাদারি আবওয়ার এবং অন্যান্য খরচ বাবদ কর আদায় হত। দ্বিতীয় ভাগে আসল জমা, আবওয়ার, মাথট, বসুম, জমিদারি খরচাগন্ডা, মাঙ্গন, বাট্টা ছাড়াও বিভিন্ন কারণে কর আদায় করা হত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পলাশির যুদ্ধের পরে মুনাফার প্রধান উৎস ছিল ভূমি রাজস্ব, বাণিজ্য নয়। সর্বোচ্চ পরিমাণ মুনাফার জন্য আবশ্যক ভূমি রাজস্বের সর্বোচ্চীকরণ। বাংলার জমিদারদের উপর নির্মম চাপ, যে নিলামে সর্বোচ্চ ডাক দেবে তাকেই রাজস্ব আদায়ের ভার তুলে দেওয়া হবে এই মানসিকতা। ‘দেওয়ানি জমি’ থেকে রাজস্ব সংগ্রহের প্রকৃত পরিমাণ, ‘নিজামত শাসনে’ ১৭৬২-৬৩ খ্রিস্টাব্দে যা ছিল ৬৪.৩ লক্ষ টাকা সেটাই কোম্পানির ‘দেওয়ানি’র প্রথম বছরেই, ১৭৬৫-৬৬ খ্রিস্টাব্দে হয়েছিল ১৪৭ লক্ষ টাকা। আর এক প্রস্থ সংখ্যাতত্ত্ব অনুসারে ১৭৬৫-৬৬ খ্রিস্টাব্দে এ বাংলার মোট রাজস্ব ২.২৬ কোটি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৭৭৮-৭৯ এ গিয়ে দাঁড়ায় ৩.৭ কোটি টাকা! ১৭৬৯-৭০ এর মন্বন্তরে যখন বাংলার কৃষককূলের তৃতীয়াংশ শেষ হয়ে গেল তখনও রাজস্ব নির্ধারণে কোনও মন্দা ছিল না।
বিদেশি বণিকদের বাংলায় ব্যবসা করতে অনুমতি দিয়েছে দিল্লির ক্ষমতাসীন শাসকরা তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থে। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে রামপ্রসাদ সেনের জন্মের ছয় বছর আগে মুঘল সম্রাট ফারুকশিয়ার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নামমাত্র শুল্কের বিনিময়ে বলা যায় প্রায় বিনাশুল্কে বাংলায় বাণিজ্যের অধিকার দিয়েছে। ‘সোনার বাংলায় করে খা’।
বাণিজ্য ছিল কৃষিনির্ভর। শিল্প প্রধানত ছিল কৃষিনির্ভর। ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে রামপ্রসাদ সেনের জন্মের পাঁচ বছর পরে হুগলি বন্দর যা সেই সময়ের সবথেকে বড় বন্দর তা থেকে আমদানি-রপ্তানি যে শুল্ক আদায় হয়েছিল তার পরিমাণ দু লক্ষ বিয়াল্লিশ হাজার ষোল সিক্কা টাকা। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির যুদ্ধের সময়ে কলকাতার লোকসংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ এবং মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণ এক মিলিয়ন পাউন্ড বা এক কোটি টাকা। বিদেশি দেশি বণিকদের নিয়ে রামপ্রসাদের আক্ষেপ অথবা উপেক্ষা, ‘অনিতা ধরনের আশে, ভ্রমিতেছে দেশে দেশে/ ও তোর ঘরে চিন্তামনি নিধি, দেখিসনারে বসে বসে।।’
অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার অভ্যন্তর অবাধ বা মুক্ত ছিল না। পলাশির যুদ্ধের আগে নবাবরা বণিকের জাতধর্ম দেখে শুল্ক আদায় করত, মুসলমান বণিকদের ২.৫ শতাংশ, হিন্দুদের ৫ শতাংশ, আর্মেনীয়দের ৩.৫ শতাংশ, ফরাসি ও ওলন্দাজদের ২.৫ শতাংশ সরকারি শুল্ক (সায়ের Duties) হার ধার্য ছিল এবং মজা এখানেই ইংরেজরা বার্ষিক তিন হাজার টাকা দিয়ে বাংলাদেশে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করত!
অষ্টাদশ শতকের বিদেশিদের নিয়ে কবি ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এ উল্লেখ আছে। রামপ্রসাদ সেনের গানে এইসব বিদেশিদের কথা বললেও বলেছেন একজন প্রকৃত মানুষ হিসাবেই, মানবতার প্রতীক হিসাবেই, জাত ধর্ম বর্ণ ব্যতিরেকে মানুষকে মানুষ হিসাবেই দেখেছেন, ‘জেনেছি জেনেছি তারা/ তুমি জানো ভোজের বাজি/ যে তোমায় যে ভাবে ডাকে/ তাতেই তুমি হও মা রাজি/ মগে বলে ‘ফরাতারা’ ‘গড’ বলে ফিরিঙ্গি যারা মা/ ‘খোদা’ বলে ডাকে তোমায়, মোগল পাঠান সৈয়দ কাজি/ শাক্তে বলে তুমি শক্তি, শিব তুমি শৈবের উক্তি মা/ সৌরী বলে সূর্য তুমি বৈরাগী কয় রাধিকা জি/ গাণপত্য বলে গণেশ, যক্ষ বলে তুমি ধনেশ মা/ শিল্পী বলে বিশ্বকর্মা, বদর বলে নায়ের মাঝি/ শ্রীরামপ্রসাদ বলে, কালী জিনো এ সব জানে/ এক ব্রহ্ম দ্বিধা ভেবে, মন আমার হয়েছে পাজি।’
সারা পৃথিবীর সুযোগসন্ধানী বণিকেরা বাণিজ্য করতে এই বাংলায় এসেছে। বাণিজ্য করতে আসাটা যে কোনও দেশের পক্ষে শুভ ব্যাপার। শতাব্দীর প্রথম ভাগে বাংলার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উদ্বৃত্ত (Balance of Trade) এত ছিল তা বলবার নয়। কেউ বাণিজ্য করতে এসে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে রাজা বনে গেছে। বাংলার অর্থনৈতিক ক্ষমতা হাতের মুঠোয় পুরে বাংলার ভাগ্য নির্ধারণ করছে।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)