পূর্ণা চৌধুরী
ধেড়ে মেয়ে
পাঠক, দুটি উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করি। প্রথমটি শ্রী ললিত চন্দ্র মিত্রর ১৯০৯-এ লেখা ‘দীনবন্ধুর জীবনী’ থেকে, যাতে তিনি বঙ্কিম চন্দ্রর দীনবন্ধু মিত্রর নায়িকা চরিত্রের কিছু সমালোচনা উদ্ধৃত করেছেন এবং খণ্ডন করেছেন। দ্বিতীয়টি বঙ্কিম চন্দ্রের ‘ইন্দিরা’ উপন্যাসে ইন্দিরার কথা।
১) “লীলাবতী বা কামিনীর শ্রেণীর নায়িকার সম্বন্ধে তাঁহার (দীনবন্ধুর) কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। হিন্দু ঘরে ধেড়ে মেয়ে, কোর্টসিপের পাত্ৰী হইয়া, যিনি কোর্ট করিতেছেন, তাহাকে প্ৰাণ মন সমৰ্পণ করিয়া বসিয়া আছে, এমন মেয়ে বাঙ্গালী সমাজে ছিল না কেবল আজ কাল নাকি দুই একটা হইতেছে শুনিতেছি।….. দীনবন্ধু ইংরেজি ও সংস্কৃত নাটক পড়িয়া এই ভ্ৰমে পড়িয়াছিলেন যে, বাঙ্গালা কাব্যের নায়ক নায়িকাকেও সেই ছাঁচে ঢালা চাই।” দীনবন্ধু প্ৰাচীন সংস্কৃত ছাঁচে কিংবা হালের ইংরাজী ছাঁচে লীলাবতী ঢালিয়াছিলেন কি না, বিচার করিয়া দেখিব। যাহা “আজকাল না কি দু একটা হইতেছে” বলিয়া বঙ্কিমবাবু কেবল দূর হইতে শুনিয়াছিলেন, তাহা যে ঠিক বঙ্কিমবাবুর নিকট ঐ অস্বাভাবিক জনশ্রুতি পহুছিবার দিন কি তৎপূর্ব দিন ঘটিয়াছিল, তাহা নয়। এ দেশের অনেক লোক যে স্ত্রীশিক্ষা ও একটু বেশী বয়সে মেয়ের বিবাহ দিবার জন্য অনেক পূৰ্ব্ব হইতেই উদ্যোগ ও সংকল্প করিয়া আসিতেছিলেন, দীনবন্ধুর পূৰ্ব্ববৰ্ত্তী “পুরাণ দলের শেষ কবি” ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তও তাহা জানিতেন। গুপ্ত কবি তাঁহার অবজ্ঞার জিনিসটা একটা দূরে শোনা কথা বলিয়া উড়াইয়া দেন নাই; তিনি তাহার বিরুদ্ধে কলম ধরিয়া পরিহাস কয়িয়া লিখিয়াছিলেন,– “আগে মেয়েগুলো ছিল ভাল ব্ৰত ধৰ্ম্ম করত সবে; একা বেথুন এসে শেষ করেছে, আর কি তাদের তেমন পাবে? যত ছুড়িগুলো তুড়ি মেরে কেতাব হাতে নিচ্চে যবে, তখন এ, বি, শিখে বিবি সেজে বিলাতী বোল কবেই কবে।
২) অতএব ইন্দিরা বলে-– তা, তোমরা পাঁচ রকমের পাঁচ জন মেয়ে আছ, পুরুষ পাঠকদিগের কথা আমি ধরি না– তাহারা এ শাস্ত্রের কথা কি বুঝিবে-– তোমাদের আসল কথাটা বুঝাইয়া বলি। ইনি আমার স্বামী-– পতিসেবাতেই আমার আনন্দ-– তাই, কৃত্রিম নহে– সমস্ত অন্তঃকরণের সহিত, আমি তাহা করিতেছিলাম।… যে বুদ্ধি কেবল কালেজের পরীক্ষা দিলেই সীমাপ্রান্তে পৌঁছে, ওকালতিতে দশ টাকা আনিতে পারিলেই বিশ্ব-বিজয়িনী প্রতিভা বলিয়া স্বীকৃত হয়, যাহার অভাবই রাজদ্বারে সম্মানিত, সে বুদ্ধির ভিতর পতিভক্তিতত্ত্ব প্রবেশ করান যাইতে পারে না। যাহারা বলে বিধবার বিবাহ দাও, ধেড়ে মেয়ে নইলে বিবাহ দিও না, মেয়েকে পুরুষ মানুষের মত নানা শাস্ত্রে পণ্ডিত কর, তাহারা পতিভক্তিতত্ত্ব বুঝিবে কি?… আমাদিগের পতিভক্তি আমাদের গুণ; আমাদিগকে যে হাসি চাহনির কদয্য কলঙ্কে কলঙ্কিত হইতে হয়, সে তোমাদের দোষ।
ধেড়ে মেয়েদের যে পেরে ওঠা ভার এই বিবেচনাটি স্ত্রী শিক্ষার লেজ ধরে বঙ্গসমাজে ঢুকে পড়ল। ধেড়ে মেয়েদের যে লাজ লজ্জার বালাই নেই সে কথা খুব পরিষ্কার করে দেখা গেল বঙ্কিমী বুলিতে। এনারা পুরুষ জাতি দেখলে লতার মতো গুটিয়ে যান না, এবং মেয়ে ইস্কুল আর নব্য বাবুদের যন্ত্রণায় দেখা গেল তাঁদের মধ্যে দুটি একটি কলম বাগিয়ে দু তিন কথা লিখেও ফেলতে পারেন। সর্বনাশের শেষ ধাপ হল ছাপার অক্ষরে প্রকাশ হওয়া। এই সকল প্রকাশবিনষ্ট মেয়েদের যে খুব ভালো চোখে দেখা হত না সে বোঝা যায় তাঁদের নিজেদের কথাতেই। মানকুমারী বসু ১৮৮৪ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর প্রিয়প্রসঙ্গ বা হারানো প্রণয় বইটি ছাপান। নিজের নামটি পর্যন্ত তিনি দেননি। আখ্যানপাত্রে তিনি ‘কোনো বঙ্গবালা’।
মানকুমারী বসু তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার অতীত জীবনে’ লিখলেন–
পুস্তকে আমার নাম এবং পরিচয় দিতে নিষেধ করি। এই কাজ খুব গোপনে করিয়াছিলাম। এখন আমার মনে হয়, তখন আমার যে রকম লজ্জা সংকোচাদি ছিল, তাহাতে যদি আমার মন সেরূপ অপ্রকৃতিস্থ না হইতো, তবে আমি প্রিয় প্রসঙ্গ ছাপাইতে পারিতাম না। যাহা হউক, প্রিয় প্রসঙ্গ মুদ্রিত ও প্রকাশিত হইলে, আমার আত্মগোপনের বহু চেষ্টা সত্ত্বেও অনেকে বুঝিতে পারিলেন আমিই উহার রচয়িত্রী। তখন অনেক হিংসা, দ্বেষ, লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা আমাকে সহিতে হইয়াছিল।
পাঠক! মেয়েমানুষের প্রকাশদোষের লজ্জা বড় বালাই। বড় বড় মেমসায়েব সে অস্ত্রে ঘায়েল হয়েছিলেন, বঙ্গবালা তো কোন ছার! ১৮৩১-এ ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের Preface-এ যখন মেরি শেলি আত্মপ্রকাশ করেন, তখন তিনি লিখছেন–
The Publishers of the Standard Novels, in selecting “Frankenstein” for one of their series, expressed a wish that I should furnish them with some account of the origin of the story. I am the more willing to comply, because I shall thus give a general answer to the question, so frequently asked me— “How I, then a young girl, came to think of, and to dilate upon, so very hideous an idea?” It is true that I am very averse to bringing myself forward in print; but as my account will only appear as an appendage to a former production, and as it will be confined to such topics as have connection with my authorship alone, I can scarcely accuse myself of a personal intrusion.
অমন বাঘিনী যদি প্রকাশবিনষ্ট হতে ভয় পান তাহলে বঙ্গবালার আর দোষ কি? তবে বঙ্গবালাদের ক্ষেত্রে এই ভয়টি সাগরপার থেকে ইংরিজি প্রিন্ট কালচার বাহিত হয়ে তাঁদের ভর করেছিল, না এ মনুসংহিতার সহস্র বছরের ছোঁয়াচ, এ বিষয় নিয়ে অনেক ভেবেছি, কোনও কুলকিনারা পাইনি।
ধেড়ে মেয়েদের আস্পদ্দার একটি নমুনা কোনও এক বঙ্গবালার ‘আমি কে’ কবিতাটি–
স্বামীর কর্ণমূল তক বাক্যসীমা যার
কার্য প্রসংশা (প্রশংসা) সীমা যাহার রন্ধনে
বুদ্ধি সীমা যার গৃহ রলে পরিষ্কার,
ভ্রমণের সীমা যার গৃহের প্রাঙ্গনে,
সভ্যতার সীমা যার পরি অলংকার
চিত্রবিদ্যা সীমা পিঁড়া চিত্রি আলিপনে,
ধর্মসীমা যাহার ব্রতের অনাহার,
বিদ্যাশিক্ষা সীমা শুদ্ধ গ্রন্থ অধ্যয়নে,
সেই অভাগিনী আজি বঙ্গ কুলনারী
বিশেষিয়া পরিচয় আর দিতে নারি।
‘কোনো এক বঙ্গবালা’র কপালে লেখার দৌলতে কী পুরস্কার জুটেছিল বলতে পারি না কিন্তু ঠাকুরবাবুদের বাড়ির মেয়ে স্বর্ণকুমারী দেবীও যে তাঁর দীপ নির্বাণ বইয়ে ‘প্রকাশ’ হননি, সে তথ্য যেমন আমরা জানি, তেমন এও জানি যে তাঁর সহোদর বাবু সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তস্য ভ্রাতা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখক সন্দেহ করে তাঁর লেখায় লিখেছিলেন: “জ্যোতির জ্যোতি কি প্রচ্ছন্ন থাকিতে পারে?” বস্তুতঃ মেয়েমানুষের যাহা কোনওমতেই প্রচ্ছন্ন থাকিতে পারে না, তাহা পুরুষের কল্পনাশক্তি এবং লেখনীর বিক্রমে প্রতিভাত হয়; আমরা হাঁ করিয়া অবলোকন করি এবং সমৃদ্ধ হই। ১৮৭২ সনে কোনও এক হরিশ চন্দ্র মিত্র একখানি নাটক লেখেন ‘ধেড়ে মেয়ে’ বিষয়ক। নাটকটির নাম ছিল: অনূঢ়া যুবতী‘। এই আশ্চর্য বিষয়টি নিয়ে লেখার কালে বাবু একটি ছদ্মনাম নিয়েছিলেন; সেটি হল: ‘নিতম্বিনী দেবী’।
বিনয়াবনতা নবীনকালী দেবী
মোর তনুময় উছলে হৃদয় বাঁধনহারা,
অধীরতা তারি মিলনে তোমারি হোক-না সারা।
ধেড়ে মেয়ে বিষয়ে বঙ্কিমবাবু, বা তাঁর বকলমে ইন্দিরা যা বললেন, তাতে দুরাচারের বিষয়টির আভাস থাকলেও, যা বলা হল না সেটি হল, সকল দোষের মধ্যে বড় দোষ, ধেড়ে মেয়েদের, শরীরে সাড় হুঁশ আছে এবং তাঁদের দেহবল্লরীর ভাষাটি তাঁরা বিলক্ষণ বোঝেন। সর্বোপরি তিনি যদি অনূঢ়া হন, এবং শিক্ষিত হইয়া পুরুষ সমাজে গতায়াত করেন, তাহা হইলে পুরুষকুলের বিপদ সুনিশ্চিত। ‘অনূঢ়া যুবতী’ প্রহসনে সেটি মোটা মোটা করে বলা হল। যে শিক্ষিত পতিতার আত্মচরিত নিয়ে আগে আলোচনা হয়েছে, তাতেও বলা হয়েছে “প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে চতুর্দশের সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েদের প্রবৃত্তি জাগরিত হয়।”
কিন্তু এই সর্বজনগ্রাহ্য সত্যটি পুরুষরা যেভাবে প্রকাশ করলেন, তা সে রবিবাবুই হোন বা রমেশবাবুই হোন, ধেড়ে মেয়েরা তেমন পারলেন না। কারণটি বোঝা শক্ত নয়। সতীলক্ষ্মীদের লিখিত কাব্য কবিতায় নারীজন্ম নিয়ে হাহুতাশ আছে, কিছু কিছু লেখায় হালকা কটূভাষও পাওয়া যায়, কিন্তু, ওই রবিবাবু যাকে বললেন নারী তনুর অধীরতা, সে সকল অনাছিষ্টি বিষয়ে লেখার জন্যে পুরুষরা রইলেন, এবং যা লেখার লিখলেন।
১৮৭০-এ কামিনী কলঙ্ক নামক একখানি ‘গদ্য পদ্যে বিরচিত করুণাদি রসাত্মক কাব্য’ প্রকাশিত হয়। পাঠক, এই কাব্যটি মূলতঃ আদিরসাত্মক। লেখিকা: নবীনকালী দেবী। এটি পতিতা লিখিত প্রথম কথা সাহিত্য, যাতে লেখিকার ‘আমি’ সংক্রান্ত কলঙ্ক কথা নায়িকার তনু হিল্লোল বৃত্তান্তের সঙ্গে মিশে গেছে। মূল গল্পটি খুব সাদামাটা গতে বাঁধা: এক ব্রাহ্মণের ঘরে বিনোদ নামক এক মাকাল ফল জন্মায় এবং কালক্রমে সে দেশভ্রমণে বেরিয়ে একটি নগরে উপনীত হয়। সে নগরের স্বর্গতঃ অধিপতির একমাত্র জীবিত কন্যা সর্বসুন্দরী বিনোদিনীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হয় এবং উভয়েই ভেসে যান এবং এ বাবদ তাঁদের পরবর্তীকালে কোনও পরিতাপ রিলক্ষিত হয় না। এই কাহিনীতে বৃন্দে দূতী চরিত্রে আছেন বিনোদিনীর সাক্ষী জ্ঞানোদিনী। কাহিনী বিবাহ বর্জিত এবং একটি অবৈধ কন্যার জন্ম সম্বলিত। কিন্তু এতে কিছুই বলা হল না, কারণ বঙ্গীয় ব্রাহ্মণের বয়ে যাওয়া মেয়ে নবীনকালী দেবী কাব্য পারদর্শিনী। পয়ার ছন্দে তাঁর রীতিমতো দখল, এবং বৈষ্ণব পদাবলী তিনি গুলে খেয়েছেন। একথা বলার কারণ এই যে, এই কাব্যটিতে চণ্ডীদাস আদি পদকর্তাদের প্রভাব স্পষ্ট। তবে কিনা, লেখায় পদাবলীর কায়াটি আছে আত্মাটি নেই। ওই যে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বলেছিলেন, “আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা তারে কই কাম, কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম’, নবীনকালীর কাব্যে আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছাই সদম্ভে নিজেকে জাহির করছে–
এই কামে তত্বহীন মত্ত ত্রিলোচন।
কত কান্ড করেছেন, কে করে বর্ণন।।
যে ভাব ধরেন তিনি মোহিনীর তরে।
কহিতে লাজের কথা বাণী নাহি সরে।।
…
এই কামে শচীপতি দেব পুরন্দর।
দিবসে কাটিলো সিঁধ গৌতমের ঘর।।
দুর্দশার শেষ করে তাঁরে তপোধন।
ক্ষিতিতে রহিল খ্যাতি সহস্র লোচন।।
কি বলিব কাম তোরে বলিহারি যাই।
অনন্ত মহিমা তবে অন্ত নাহি পাই।।
এই হল নায়িকা বিনোদিনীর গাথা। ‘প্রেম’ শব্দটি যখন উচ্চারিত হল, তখন সেও কামেরই নামান্তর, তাতে কোনও দিব্যভাব বা কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা আমার চোখে ধরা পড়ল না। প্রথম থেকে চতুর্থ সর্গ চলল সর্বনাশের প্রস্তুতি। সর্বনাশের যেহেতু শেষ রাখতে নেই, ইন্দ্রিয় বর্ণনাটি যখন চরমে উঠল এবং পরিণতি পেল, তখন পরিষ্কার দেখা গেল, বিনোদিনীর বিনয়ের তরে হাহাকার শুধুমাত্র প্রাণনাথ সন্দর্শনের তরে নয়কো; কামিনী কলঙ্কে এই আত্মেন্দ্রিয় প্রীতিটি কিছু উগ্র এবং বিলাতি মতে বেশ গ্রাফিক–
আবেশে অবশ ধনী, পড়িল শয়নে
স্খলিত হইল বাস ঘন আলিঙ্গনে।।
বুক ফাটে তবু লাজে বদন না ফুটে।
কই করো বলিয়া নাথে শিহরিয়া উঠে।।
না জানি রস ষোড়শী কিবা রূপ হয়।
কামনা হইবে পার, মনে লাগে ভয়।।
শুনেছি তরুণী নাকি তুফান ধমকে।
তরঙ্গবাড়ীতে পুড়ে ঝলক ঝলকে।।
সেই ভয়ে রসনা নিরস রসময়।
দুরু দুরু কাঁপে উরু দ্যাখো মহাশয়।।
শুনিয়া নাগর মনে করিল সিদ্ধান্ত।
আবেশে জড়িত ধনী হয়েছে নিতান্ত।।
সে আবেশ যে কোনও দিব্যভাবের নয়, নবীনকালী সেকথা নানাভাবে বুঝিয়ে দিলেন–
রতিরঙ্গ হলে শেষ, যুবতী পরয়ে বেশ,
শ্লেষছলে নাগরেরে কয়।
বুঝিলাম গুণমণি, তুমি নটচূড়ামনি
এ কর্ম উচিত তবে নয়।।
নাহি করো ভয় লাজ, সাধিতে আপন কাজ,
শোভে সব পুরুষ বলিয়ে।
না বলা না কয়ে আগে, মাতিলে মদনজাগে
অবলারে বিরলে পাইয়ে।।
কেন প্রাণে দাগা দিলে, অনুরাগ বাড়াইলে,
ছি ছি নাথ ছাড়ো রসরঙ্গ।
না বুঝিয়ে প্রেমতত্ত্ব, আবেশে হইয়ে মত্ত,
মিছে কেন জ্বালাইলে অঙ্গ।।
পাঠক, “শোভে সব পুরুষ বলিয়ে” কথাটি খেয়াল করবেন। এ সকল আবেগপ্রকাশ যে স্ত্রীলোকের সাজে না, সে জ্ঞান যে তাঁর আছে এ তিনি অকপটে পঞ্চম সর্গেই জানিয়েছেন–
বলিছে নবীনকালী করিলি লো হাড়কালী
ছি! ছি! জ্ঞানে অবাক হোইনু।
ভালো লোক ঢালাইলি, নারীকুল লজ্জা দিলি,
বিপরীত তোর যে হেরিনু।।
ষষ্ঠ সর্গের মূল ঘটনা আগেই বলেছি, সুতরাং, বিবেকের দংশনে লেখিকা যে পিছিয়ে গেলেন, এমন বোধ হওয়ার কোনও কারণ নেই, বরং সন্দেহ হল পুরুষের যে সকল কাজ শোভে, সে সকল ঢলাঢলি সাহিত্য লিখে তিনি তাবৎ আনন্দ উপভোগ করছেন এবং পুরুষ লেখকদেরই ‘হাড়কালী’ করার প্রয়াস পাচ্ছেন।
কথাটি যে বললাম তার কারণ আছে। এই জাতীয় আদিরসাত্মক কাব্য ধর্মসভার প্রবর্তক, ‘সংবাদ কৌমুদী’ এবং ‘সমাচার’ পত্রিকার সম্পাদক বাবু ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক পূর্ববর্তী যুগেই সমাজ সংস্কার ইচ্ছায় লিখেছিলেন। তার মধ্যে ‘দূতী বিলাস’ (১৮২৫) কাব্যটি পড়ার অনুরোধ জানিয়ে রাখলাম। নবীনকালী এইসব লিখিয়ে বাবুদের টেক্কা দিলেন মেয়েদের শরীরের নিষিদ্ধ আনন্দটিকে পুরুষ লেখকের চত্বর থেকে টেনে বের করে, তার শরীর থেকে শস্তার চটকদারি গয়না খুলে নিয়ে তাকে সাহিত্যিক অলংকার পরিয়ে। ফল কি হল একটু পরে বলছি। ‘লজ্জা ঘেন্না ভয় তিন থাকতে নয়’, এই বচনটির যথার্থ প্রয়োগ দেখলাম এই কাব্যে। নায়িকার অনুতাপ যদিও বা থাকে, তার আট আনাই ধুয়ে যায় রতি সম্ভোগের আনন্দে–
নাগরের হৃদাকাশে করি আরোহণ।
অধরের সুধা পানে জুড়ায় জীবন।।
কখনো শয্যায় শুয়ে নাগরের সনে।
রতিরঙ্গে ভুঞ্জে নিশি আনন্দিত মনে।।
কখন তাম্বুল ধনী দিয়ে কান্ত মুখে।
কৌতুক করিয়ে দোঁহে অতি মনসুখে।।
শীতার্ত হইয়ে ধনী উষ্ণের কারণে।
তড়িতের প্রায় ধরে রমণী রঞ্জনে।।
এইসব ছাই পাঁশ থাকা সত্ত্বেও এই বইখানি মহিলা রচিত প্রথম যৌনসাহিত্য বলতে বাধা আছে। যা আগে বলেছি তা ছাড়াও, ‘কামিনী কলঙ্ক’ যে শুধু ধ্রুপদী গণেশ এবং সরস্বতী বন্দনা দিয়ে শুরু হয় তাই নয়, পরিষ্কার বোঝা গেল এই বিবির বিলিতি কেতাব পড়ার, বোঝার ক্ষমতা আছে। দেখলাম বিবি ইংরিজি সাহিত্যের acrostic নামক অলংকারটি বোঝেন; নবীনকালী এবং তস্য নায়িকা বিনোদিনী দুজনেই নাম স্বাক্ষর করেন কবিতার পংক্তির আদ্যক্ষর দিয়ে–
বিনোদিনী
বি-ন্দু মাত্রাধর সুধা দিয়ে হর জ্বালা।
নো-পস্থিত থাকিলে হে মরিবেক বালা।।
দি-ন দিন তনু ক্ষীণ বিরহে তোমার।
নী-র হীন হয়ে মীনে প্রাণে বাঁচা ভার।।
নবীনকালী
শ্রী কালী যুগল পদ করি আরাধনা
ম ম হৃদি পদ্মে আসি পুরো বাসনা।।
তী ক্ষ্ণ রুপা ক্ষরধারা, নীরদবরণী!
ন করে নলিনী শোভে, কটিতে কিঙ্কিণী।।
বী ভি হীনে গতি দেহি ত্বম হয় কাত্যায়নী!
ন গেন্দ্র নন্দিনী গিরিসুতা ত্রিনয়নী!
কা ল ভয় বিনাশিনী করাল বদনি!
লী ন হতে তবে পদে, বাসনা জননী!
আত্মা এবং আত্মজার এই গূঢ় সম্পর্ক এমন দাপটের সঙ্গে লেখার এমন উদাহরণ বাংলা সাহিত্যে দুটি পাইনি। বিনোদিনী আর নবীনকালীর আত্মপরিচয় দানের মধ্যে তফাৎ একটিই। প্রথম পরিচয়টি একটি প্রেমপত্রের মাঝে লুক্কায়িত, দ্বিতীয়টি নবীনকালী ‘দাসীর’ কালী স্তব।
The Devil’s Disciple
আসল চমকটি অপেক্ষা করে থাকে অন্তিম (দ্বাদশ) সর্গে। দেখলাম ছাই পাঁশ কাব্য অলংকার পরিত্যাগ করে রতিসুখ প্রসঙ্গে পাপ পুণ্য আদি দার্শনিক প্রশ্ন করছেন জ্ঞানোদিনীকে। নৈয়ায়িক কূটতর্ক, শিক্ষিত চার্বাকের দর্শন এবং, এটির প্রমাণ নেই, তবুও বলি, প্লেটোর ডায়ালগের একটি ছায়া যেন পড়ল এই বিনোদিনী জ্ঞানোদিনী আলাপে–
বিনোদিনী বললেন–
যাহা হউক প্রিয় সহচরী! তুমি মদীয় প্রশ্নটির প্রকৃতরূপ মীমাংসা করিয়া আমার সংশয় দূরীকরণ করো। অর্থাৎ আমাদিগের যাবতীয় কার্যের আমরা আপনাপন করতে অথবা পরম করুণাময় বিশ্বপতি পরমপিতা আমাদিগের এই সমস্ত কার্য্যানুষ্ঠানে প্রবৃত্তি জন্মাইয়া দিতেছেন। কিংবা কুমতি প্রদা বিধাতা কেহ স্বতন্ত্র আছেন?
নবীনকালী দেবী শয়তানের অনুগামিনী ছিলেন কিনা এই বিবেচনা পাঠকের দায়, তবে দেখলাম ত্রয়োদশ সর্গে reformed বিনোদিনী যখন শিবের স্তব করছেন, তখনও সেই প্রথম পুরুষকে তিনি জিজ্ঞাসা করছেন “কুলত্যাগিনী, পরপুরুষগামিনী” ‘আমি’র কিয়দংশ শিবাংশি কিনা।।
কী আস্পদ্দা!
১৮৭৩ সালে এ বই নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়। ওই বছরই ২০শে সেপ্টেম্বর টাউন হলে A Society for The Suppression of Public Obscenity নামে এক প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন হয়। ফলতঃ, বটতলার কিছু প্রকাশক ‘বিদ্যাসুন্দর’ ছাপার অপরাধে গ্রেপ্তার হন। এবং ‘কামিনী কলঙ্ক’ নিয়ে লড়াই বেঁধে যায় ব্রাহ্মদের পত্রিকা ইন্ডিয়ান মিররের সঙ্গে হিন্দু পেট্রিয়টের। ইন্ডিয়ান মিররের বক্তব্য যে ওই রচনা যাতে কিনা এক বেশ্যা তার ‘বিদঘুটে ভঙ্গিতে’ তার জীবনের কথা বলছে তা নিয়ে একটি বিশিষ্ট সংবাদপত্র কেন মাতামাতি করছে?
এর উত্তরে হিন্দু প্যাট্রিয়টের প্রতিবেদক এই জবাবটি দেন–
“আশা করি (ইন্ডিয়ান মিররের) সমালোচক মহোদয় অবগত আছেন, অশ্লীলতা (obscenity) ও অশোভনতা (Indecency), এই দুইয়ের পার্থক্য সম্বন্ধে। একটি বই অশোভন হতে পারে, কিন্তু অশ্লীল নাও হতে পারে। উল্লেখিত বইটিতে (…) যে সব অশিষ্ট (Indelicate) বর্ণনা আছে, আমরা কোনোমতেই তাকে সমর্থন করছি না। কিন্তু সেসব বর্ণনা কোনো অংশেই পোপের ‘জানুয়ারী এন্ড মে’, বা শেকস্পিয়ারের ‘রোমিও এন্ড জুলিয়েট’, বা বাইরনের ‘ডন জুয়ানে’ বর্ণিত অনুরূপ বিবরণী থেকে খারাপ নয়। কোন নীতিবাদীর মানদন্ডে বিচার করলে ‘কামিনী কলঙ্ক’ কখনোই এইসব সাহিত্য কর্মের সঙ্গে তুলনায় হীন বিবেচিত হবে না। অথচ, কেউই বিচারপতির সামনে পেশ করে এই সব ইংরেজি গ্রন্থগুলির প্রকাশ ও প্রচার বন্ধ করার কথা চিন্তা করেন নি।”
সকল সময়েই মুক্ত চিন্তার মানুষ থাকেন। কিন্তু ঐ এক আঁজলা। তার বেশি নয়।
এরপর কামিনী কলঙ্ক হারিয়ে যায় রহস্যজনকভাবে। এক সমসাময়িক সাহিত্য বিশেষজ্ঞা দেখলাম এই বই বিষয়ে বলছেন যে এটি স্ত্রী ছদ্মনামধারী কোনও লেখকের লেখা হওয়া সম্ভব। তিনি কারণ দর্শাচ্ছেন যে নবীনকালীর লিখনশৈলী একেবারেই ‘পুরুষালি’। ইঙ্গিতটি যৌনতা বিষয়ক। আশ্চর্য হলাম এই দেখে যে ‘কামিনী কলঙ্ক’র সাহিত্য শৈলী অথবা দর্শন বিচার এ সকল প্রসঙ্গ বিশেষজ্ঞার বিশ্লেষণের মধ্যে উহ্য রয়ে গেল। বিবেচনা করলাম কারণটি হল, মেয়েমানুষ-এর indelicacy, obscenity এইসকল লক্ষণ আমাদের চোখে যত পড়ে, তার ভেতরের আগুন, সাহিত্যিক নৈপুণ্য তত নয়।
মহৎ সাহিত্য নির্মাণ তো বটেই, অশ্লীলতাকেও অমর সাহিত্যে রূপ দেবেন পুরুষ লেখকরা, ও কাজ মেয়েমানুষের কস্মিনকালেও নয়। স্পর্ধা বা সাহস যে পৌরুষ লক্ষণ, সে পাঠ আমরা মেয়েরা আজও মনে ধরে রেখেছি।
পরিশিষ্ট
এরপর আর সামান্যই বলার রইল।
নবীনকালী ১৮৭৮-এ আর একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। নাম ‘কিরণমালা’। সে বই পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। নায়িকা কিরণমালা বিনোদিনীর মতো মাতঙ্গিনী নয়। বিনোদিনীর মতো স্বেচ্ছায় নয়, সে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয় পুরুষের অত্যাচারে।
Indelicate নবীনকালী কি লক্ষণ বুঝে সুর বদলে ছিলেন? নাকি একই অঙ্গে দুই রূপ? এ বিষয়টি আমাকে ভাবাচ্ছে।
Featured Image: https://www.cherrytin.com/music-lesson-kalighat-painting.html