হারুণ রশিদ
অমূলক
বিকেলটা হাসছিল। চাহিবামাত্র রিকশা পেয়ে যাওয়ায় নীতুও। রোদ কমে গেছে। হেমন্তের সূর্যে তাপ নেই।
রিকশাটা গলিতে ঢুকতেই চেইনটা পড়ে গেল। রাস্তার একপাশে থেমে গেল। পেছনে গিয়ে চেইন টানাটানি করছে রিকশাওয়ালা। জায়গাটা নির্জন। এঁদো গলি। কোন বাসাবাড়ি নেই এদিকে। দুপাশে আধভাঙা দেয়াল।
নীতু বুঝে ফেলেছে কেন চেইনটা পড়ে গেল হঠাৎ। যে কোনও সময় একটা সিএনজি ট্যাক্সি এসে দাঁড়াবে পাশে। পিস্তল/চাপাতি/ ক্ষুর হাতে তিন-চার যুবক নেমে দাঁড়াবে দুপাশে। হাতব্যাগ আর গলার কানের চেইন-দুল টানাটানি করবে।
এরকমই হবার কথা। রাস্তায় কোনও লোকজন থাকে না এরকম সময়ে। থাকলেও কেউ ফিরে তাকায় না।
রিকশাওয়ালা তখনও চেইন টানাটানি করছে। নীতু জানে এসব অহেতুক সময়ক্ষেপণ। ঠিক সময়ে ওরা এসে হাজির হবে। হাতের ব্যাগটা আগেভাগেই আলগা করে ধরে রাখে যাতে বিনা আয়াসেই নিয়ে যেতে পারে। কেবল ওড়নাটা ঠিক করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে চুপচাপ বসে থাকে জড়োসড়ো। শীত লাগছে অথচ ঘাম দিচ্ছে।
নন্দনকাননের দিক থেকে সবুজ সিএনজিটা এগিয়ে আসতে দেখল। ভেতরে তিনজন তরুণ। কাছাকাছি এসে থেমে গেল সিএনজি। ঠিক যেরকম হবার কথা। মাথা নীচু করে বসে আছে ব্যাগের উপর হাতটা আলগা করে। ব্যাগ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত সে, তবু ধমকে দেবে ওরা, ‘চুপ্! কথা বললে লাশ ফেলে দেব।’
সিএনজি থেকে গলা বের করে একজন বললো, ‘অ্যাই!’
ওদিকে তাকাতে ভরসা পাচ্ছে না সে।
সেই গলা আবারও হাঁক দিল, ‘অ্যাই রিক্সা, কী হইছে?’
রিকশাওয়ালা বলে, ‘চেইন পইড়া গেছে, লাগাইতে পারতেছি না।’
ওই গলাটা আবারও বলে, ‘চেন লাগবে না, হাতে টেনে চলে যা, এই জায়গা ভালো না।’
বলেই সিএনজিটা সাঁই টান দিয়ে চলে গেল।
রিকশাওয়ালা চেইন ছেড়ে হ্যান্ডেল ধরে টেনে চালাতে থাকে দ্রুত। গলি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে এখুনি।
এতক্ষণ চেপে রাখা নিশ্বাসটা ফেলল নীতু।
প্রবৃত্তি
…….রুমে ঢুকতেই ওদের দুজনের ঘনিষ্ঠতম অবস্থান দেখা গেল। ত আর ম। দুজনেই আমার চোখের সামনে। কিন্তু নিজেদের দিকে এত বেশি মনোযোগী যে আমি একটা মানুষ পাত্তাই দিচ্ছে না। আমিও ব্যক্তিত্ব প্রচারে বিশ্বাসী না বলে চুপ করে থাকলাম। গলাখাকারি দিতেও ইচ্ছে করছে না পাছে রণে ভঙ্গ দেয়। আদতে সামান্য গলাখাকারিতে ভঙ্গ দিত কিনা সন্দেহ। নিজেদের নিয়ে এতটা মগ্ন।
আসলে সবাই নিজেদের প্রয়োজনেই মগ্ন থাকে। নিজেদের স্বার্থেই ডুবে থাকে। জগতের সকল প্রাণীর জন্য এই নিয়ম। এই নিয়মের ব্যতিক্রম কেউ হলে তাদের আমরা বিশেষায়িত করি। এই দুজন সেই কাতারে পড়ে না। এদের কাণ্ডকীর্তি মহান হবার প্রশ্নই ওঠে না।
দৃশ্যটাকে আমার কি ঘেন্না করা উচিত? মানবিক দৃষ্টিতে ঘেন্নাই সুলভ। কিন্তু পাশবিক দৃষ্টিতে ঠিক একই দৃশ্যটাকে বলা হয় প্রবৃত্তি।
আমার নির্বিকার দৃষ্টিও এখন কৌতূহলের সীমানা ছাড়িয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত উত্তেজিত। এখানে একটা প্রতিযোগিতা আছে। কে জিতবে? কে হারবে? আমি কার পক্ষে যাব? যে কোনও খেলায় কোনও একটা পক্ষ নিতেই হয়। এখানেও ব্যতিক্রম নেই। তাছাড়া আমি তো রেফারি না, দর্শকমাত্র।
আমি বিজয়ীর পক্ষই নেব, সিদ্ধান্ত নিলাম। যে-ই বিজয়ী হোক আমি তার জয়গান গাইব।
লড়াই চলছে। যুগলবন্দি লড়াই। নিঃশব্দ লড়াই। হারজিতের মাত্রা বোঝা যাচ্ছে না তাই। দুজনেই দুজনকে কাবু করে ফেলেছে মনে হচ্ছে। কার শক্তি বেশি? দুজন দুজনের কঠিন বাঁধনে আটকে আছে। যেন অতিপ্রাকৃতিক কুস্তি।
নিঃশ্বাস আটকে বসে আছি আমি।
অবশেষে একসময় শেষ হল লড়াই খেলা। পরাজিত নেতিয়ে পড়ে আত্মসমর্পণ করল বিজয়ীর বাহুতে। অবাক হয়ে দেখি বিজয়ী মাকড়সাটা বিজিত তেলাপোকাটাকে বগলে নিয়ে ধীরে ধীরে আস্তানার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। তিন বেলার অন্নসংস্থান হয়ে গেল বুঝি তার।
বিজয়ীরাই যুগে যুগে জগতে রাজত্ব করে গেছে, করবে। প্রতিষ্ঠিত এই ধারণাটা আবারও রিভাইস দিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলাম আমি।
এক টুকরো দুপুর
সরু গলিপথ। বাঁয়ে ঘোলা জলের পুকুর। জলের ছাদে কলমিলতার সাজানো বিছানা।
ডানে সারিবদ্ধ ঘুপচি দোকান। একটি সেলুন, একটি লন্ড্রি এবং একটি দর্জিঘর। দর্জিঘরের পাশেই বাঁধানো গেটের ভেতর সাজানো নিঃসঙ্গ কবরখানা। কবরখানার উল্টোদিকে প্রাচীন মসজিদ। মসজিদের পাশে সারি বেঁধে শুয়ে কাজীবাড়ির সাতপুরুষ।
খোদার ঘরের দরোজায় মেহেরবানির প্রতীক্ষায় লুলা ভিখিরির তোবড়ানো বাটি। খিদে পেটে জপছে আল্লা রসুলের নাম।
জুমা শেষ, ফিরছে মুসল্লি। কেউ ছুঁড়ে দিচ্ছে দু পাঁচটাকার দোমরানো নোট। ময়লা নোটের সহজ উপার্জনের দুই ভাগ যায় যথাস্থানে, এক ভাগ নেভায় লুলা ভিখিরির আগ্নেয় খিদে।
পুকুরপাড়ে দাঁড়ানো সৌন্দর্য পিপাসু তরুণ কলমি ছাউনির উপর বসে থাকা মাছরাঙার দিকে তাক করে ক্যানন সুপার জুমের কামান।
লুলা ভিখিরির চোখে ভাসে একদলা ভাপ ওঠা সাদা ভাতের উপর সবুজ শাকের লবণমাখা ঝোল।
ইলেকট্রিকের তারে বসা কাকের পাকস্থলী বর্জ্য মধ্যাকর্ষণের টানে স্পর্শ করল একটি সফেদ পাঞ্জাবির নিষ্কলুষ প্রাঙ্গণ।
তিন স্বাদের তিনটে গল্প। চমৎকার লিখেছেন হারুন ভাই।