দেবব্রত শ্যামরায়
‘এই লেখাটা যখন লিখছি, ঠিক এই মুহূর্তে পুরুলিয়া জেলার নদিয়াড়া গ্রামের সাড়ে তিন বছরের ছোট্ট মেয়েটি হয়তো ঘুমিয়ে আছে এস এস কে এম হাসপাতালের একটি ঘরে। দু’দিন আগেই অস্ত্রোপচার করে পাকস্থলী লিভার ইত্যাদি আভ্যন্তরীণ অঙ্গ থেকে সাতটি সূচ বের করে ফেলেছেন চিকিৎসকরা। আশা করি, খুব ধীরে হলেও সেরে উঠবে শরীরের ক্ষত। বাচ্চা মেয়েটির মনে যে গভীর ছাপ পড়ল তা কবে সারবে, সেটা অবশ্য আমরা জানি না। এই মুহূর্তে হয়তো মেয়েটির পাশে চুপচাপ শুয়ে আছেন তার মা। মেয়েটির ছোট্ট আঙুল প্রাণপণ আঁকড়ে ধরে আছে মায়ের হাত।’
এইভাবে, একটা আশা নিয়ে শুরু করেছিলাম লেখাটা। কিন্তু লেখাটা শেষ করে আজ সকালে দপ্তরে জমা দেবার মুহূর্তেই খবরটা এল।
মেয়েটি মারা গেছে।
মর্মান্তিক! চুপ করে বসে রইলাম অল্প কিছুক্ষণ। তারপর গলার কাছে একটা দলা নিয়ে ফের লিখতে শুরু করলাম।
পুলিশ হয়তো সকালে ইতিমধ্যে আরও একপ্রস্থ জিজ্ঞাসাবাদ করে ফেলেছে ভদ্রমহিলাকে। মেয়েটি মারা যাবার পর আরও চড়া হয়েছে জেরার সুর। আরও গুটিয়ে যাচ্ছেন ভদ্রমহিলা। কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। এত বড় শহর, এত লোকজন, খবরের কাগজের লোক, ডাক্তার, পুলিশ…. এসব কিছুর সঙ্গে তিনি অভ্যস্ত নন। তিনি ভাবেননি এমন কিছুর মুখোমুখি হতে হবে তাকে। ঠিক যেমন ভাবতে পারেননি তার মেয়েটি এতটা অসুস্থ হয়ে পড়বে। মারা যাবে। সনাতন ঠাকুর আশ্বাস দিয়েছিলেন তার মেয়ের কোনও ক্ষতি হবে না। ঠাকুরের তন্ত্রশক্তির ওপর ভরসা ছিল তার।
ভরসা ছিল। তাই নিজের সন্তানের ওপর নিগ্রহের ঘটনা জেনেও প্রতিবাদ করেননি একজন মা। ডাক্তারের সামনেও প্রথমে মুখ খোলেননি। এই ক’দিনে এমন সব তথ্যই ঘুরে ফিরে এসেছে বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনে। সাধারণভাবে এমন ঘটনা তখনই ঘটতে পারে, যখন আক্রান্ত অত্যাচারীকে অত্যাচারী হিসেবে দেখে না, এক ধরনের আস্থা থাকে যে যা হচ্ছে তাতে আখেরে ভালো হবে। এটা তখনই সম্ভব যখন আক্রান্তের বোধবুদ্ধির ওপর একটা শক্তপোক্ত ঠুলি পরিয়ে রাখা যায়।
এক্ষেত্রে ঠুলি পরানোর কাজটা করেছে ঝাঁড়ফুক ও তন্ত্রমন্ত্রের ওপর মানুষের অগাধ বিশ্বাস। শুধু পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম নয়, এই রাজ্যের গ্রাম শহর মফস্বল এমনকি কলকাতার গলিঘুঁজিতেও কান পাতলে শোনা যাবে ধর্মীয় আরও হাজারটা উপাদানের পাশাপাশি তন্ত্রমন্ত্রের প্রতি মানুষের নতমস্তক সম্ভ্রমের গল্প। ‘তন্ত্র বিষয়টা সবাই ঠিকঠাক জানে না, কিন্তু কেউ যদি ভাল করে শিখে নেয়, তবে অসাধ্যসাধন করা যায়, বুঝলেন কী না!’– সাধারণভাবে বিশ্বাসটা এইরকম। পশ্চিমবঙ্গে সম্ভবত এমন কোনও রেলস্টেশন নেই, যেখানকার অন্ধকার বই-গুমটিতে অন্ততপক্ষে এক কপি ‘ইন্দ্রজাল রহস্য ও বৃহৎ তন্ত্রসার’ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভারতবর্ষের মতো এক ব্যর্থ জনগণতান্ত্রিক দেশে পুরুলিয়ার মতো ঘটনা তাই অস্বাভাবিক কিছু নয়।
বরং ঘটনাটাকে নিতান্ত স্বাভাবিক এবং আরও বড় কোন রাষ্ট্রীয় ‘বিপ্লব’-এর অংশ বলে মনে হবে, যদি আমরা আরও একটা-দু’টো খবরের দিকে তাকাই।
প্রথম খবরটা মাত্র দিন পাঁচেক আগের। কেন্দ্রীয় সরকার অতি সম্প্রতি একটি উনিশ সদস্যের প্যানেল তৈরি করেছেন, যে প্যানেলের কাজ হবে শুধু পঞ্চগব্যের অর্থাৎ পাঁচটি গোজাত বস্তু বিশেষ করে গরুর মল ও মূত্রের উপকারিতার ওপর উচ্চমানের রিসার্চ করা। প্যানেলটির পৌরোহিত্য করছেন কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী হর্ষবর্ধন। উনি ছাড়াও কমিটিতে আছেন আইআইটি দিল্লীর কয়েকজন বৈজ্ঞানিক, কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রক, বায়োটেকনোলজি, ও অচিরাচরিত শক্তি বিভাগের আমলারা। বস্তুত, গবেষণা শব্দটির আক্ষরিক অর্থের প্রতি এতখানি দায়বদ্ধতা অন্য কোনও সরকার দেখাতে পেরেছে বলে মনে হয় না। বলাই বাহুল্য, এই প্যানেলের বেশিরভাগ সদস্যরাই ভারতীয় জনতা পার্টি ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সঙ্গে যুক্ত। পঞ্চগব্য নিয়ে গবেষণায় কী চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসবে আমরা জানি না, সেই তথ্য আদৌ বিজ্ঞানসম্মত হবে কী না তাও জানি না, তবে এটুকু জানি বিজেপি শাসিত রাজ্য রাজস্থানের শিক্ষামন্ত্রী বাসুদেব দেবনানী ক’দিন আগেই ঘোষণা করেছেন, গরুই বিশ্বের একমাত্র আশ্চর্য প্রাণী যে প্রশ্বাসে অক্সিজেন নেয়, আবার নিঃশ্বাসের সঙ্গে অক্সিজেনই ছাড়ে।
দ্বিতীয় খবরটা একটু পুরনো। ২০১৫ সালের জানুয়ারী মাসে মুম্বইয়ে আয়োজিত ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের ১০২তম অধিবেশনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পেপারটি ছিল— ‘প্রাচীন ভারতে বিমান প্রযুক্তি’। পেপারের সারকথা ছিল– আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে ঋষি ভরদ্বাজ ও ঋষি অগস্ত্য দু’জনে মিলেই বিমান নির্মাণ কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন। বিমান তৈরীতে ব্যবহৃত এক সংকর ধাতুর কথা বলাও ছিল যা তৈরীতে ঘোড়া ও গাধার মূত্র উপকরণ হিসেবে কাজে লাগানো হত।
অর্থাৎ, গত কয়েক বছর ধরে গরু, গাধা ও ঘোড়ার মূত্রের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে আমাদের সরকারি বিজ্ঞানচেতনা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই বলেছেন, গণেশের কাঁধে হাতির মাথা ভারতের প্রথম প্লাস্টিক সার্জারির নিদর্শন, অর্থাৎ এর থেকে প্রমাণ হয় প্রাচীন ভারতের প্রযুক্তি আধুনিক যুগের সমকক্ষ ছিল।
মা টেরেসার ছবি থেকে মনিকা বেসরার দুরারোগ্য টিউমার এক রাতের মধ্যে নিরাময় হয়েছিল। টেরেসার সেন্টহুডপ্রাপ্তি প্রক্রিয়ার আরম্ভ পুরোপুরি এই বুজরুকির ওপর দাঁড়িয়ে। তা হোক। ধর্মের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য বুজরুকি খুবই জরুরি। কিন্তু যা নির্দিষ্টভাবে একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আওতায় ছিল, আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর ভ্যাটিকান ভ্রমণ ও রাজ্যে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তোপধ্বনি সহকারে টেরেসার সেন্টহুড উদযাপন সেই অশ্লীল প্রতারণার ওপর সরকারি সিলমোহর লাগিয়ে দিল।
জাতীয় স্তরে, প্রশাসনিক নীতির সর্বোচ্চ পর্যায়েই যদি এমন মধ্যমেধার জয়যাত্রা, পিছিয়ে পড়া পুরুলিয়ার দরিদ্র অশিক্ষিত মাকে তন্ত্রের ওপর বিশ্বাস রাখার জন্য আমরা দোষ দিই কীভাবে?
কাউকে দোষ দিতে হলে একটা আঙুল ঘোরাতে হবে নিজেদের দিকেও। আমরা যারা নিজেদের ‘আলোকিত’ আর বিজ্ঞানমনস্ক বলে ভাবি, দক্ষিণপন্থী শিবির যাদের গালি দেয় মেকলের অবৈধ সন্তান বলে, এইবেলা স্বীকার করে নেওয়া দরকার যে, আমরা প্রকৃতপক্ষে জনবিচ্ছিন্ন, সাধারণ মানুষের পাশে বসে তাদের ভাষায় তাদের সঙ্গে কথা বলার দক্ষতা এতদিনেও রপ্ত হল না আমাদের। নাহলে বাংলার নবজাগরণের বস্তুবাদী চেতনা, তা যতই অসম্পূর্ণ হোক না কেন, এতদিন পরেও একটা মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর বাইরে নিয়ে যাওয়া গেল না কেন?
সুতরাং, নিজেদের ছোট্ট বৃত্তের ভেতরে বসে আমরা অসহায়ের মতো দেখে যাচ্ছি– হাজার হাজার সূচের ভিড়। খাদ্যনালী দিয়ে সূচ নামছে, মস্তিষ্কের আনাচেকানাচে ঢুকে পড়ছে সূচ, সারা শরীরজুড়ে অসংখ্য সূচ।
প্রাচীন ভারতে স্টেম সেল টেকনোলজির অস্তিত্ব ছিল, প্রধানমন্ত্রীর এই সদর্প ঘোষণা পরোক্ষে বৈধতা দেয় সনাতন গোস্বামীর তান্ত্রিক আচারকে। টেরেসার সেন্টহুডের প্রতিটি তোপধ্বনি সূচটাকে আরেকটু আরেকটু জোরে ঠেলে ধরছে বাচ্চা মেয়েটির গলায়।
দেড়শো কোটির ধর্মতান্ত্রিক দেশে এই হাজার সূচের অস্ত্রোপচার করবে কে?
সূত্রনির্দেশ–
http://www.timesnownews.com/…/cow-urine-scientific-be…/66048
http://indianexpress.com/…/rajasthan-education-minister-cl…/
http://mumbaimirror.indiatimes.com/…/articlesh…/45643060.cms?
https://www.theguardian.com/…/indian-prime-minister-genetic…
http://m.hindustantimes.com/…/story-4UFYt5hycBYuzFpl8aC7oJ.…
… মস্তিষ্কের আনাচে কানাচে ঢুকে পড়ছে সূচ, একদম ঠিক কথা!
খুব প্রয়োজনীয় লেখা, তবে প্রাচীন ভারতে স্টেম সেল টেকনোলজি হয়তো ছিলো না, কিন্তু কনসেপ্ট টা যে একেবারেই ছিলো না তা বলতে পারি না….
একটু ডিটেলে বলা যাবে, তিষ্য?
সত্য কিন্তু অর্ধসত্য! ফেমিনিস্ট দৃষ্টিকোণকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করা হয়েছে এই লেখায়। অবিজ্ঞান, কুসংস্কারকে প্রাধান্য দিয়ে পুরুষতন্ত্র ও লিঙ্গবৈষম্যের দিকটা পুরোপুরি আড়াল করা হয়েছে! সনাতন তান্ত্রিক না হলেও ধর্ষন করতো এটা বলা দরকার!
ধর্ষণ ইত্যাদি কি প্রমাণিত, পাজামা?
এটা কী বললেন? যেকোনও নিগ্রহই ধর্ষণ? আর যদি যৌন নিগ্রহ বলেন, তবে সেই প্রশ্নটাই হবে… প্রমাণিত কি?
তা অবশ্য প্রমাণিত নয়। কিন্তু নিগ্রহ আর ধর্ষণে কতটুকু আর তফাত, ক বাবু?