স্বাতী ভট্টাচার্য
টিভিতে খবর পড়ে তিনি পেয়েছেন ম্যাগসেসে পুরস্কার। তার কদিন পরে কলকাতায় এসে রবীশ কুমার সোজা বলে দিলেন, ‘টিভি দেখনা ছোড় দিজিয়ে।’ কেন? কারণ বক্তব্য বা বাচনভঙ্গি যা-ই হোক, টিভির খবরের মূল সুরটি হল ‘অ্যায় চোপ।’ এই স্বর পিতৃতন্ত্রের, একে কি ঘরে স্থান দেওয়া চলে? ‘যে দিন ভারতে গণতন্ত্র খতম হবে, সে দিন তার দায় তাঁদেরও নিতে হবে, যাঁরা টিভি দেখেন।’
‘গণতন্ত্রে মিডিয়ার ভূমিকা’ নিয়ে কেতাবি বক্তব্যে যে সব কথা পাওয়া যায়, রবীশ তার উল্টো কথা বলেন। ভারতে মিডিয়ার কদর্য চেহারাটা সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। বলা উচিত, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। যে দিন কলকাতার বসুশ্রী সিনেমা হলে তিনি ষষ্ঠ ঋতুপর্ণ ঘোষ স্মারক বক্তৃতা (অক্টোবর ১৯) দিচ্ছেন, সে দিন কলকাতারই একটা পাঁচতারা হোটেলে আয়োজন করা হয়েছিল অর্ণব গোস্বামীর বক্তৃতার। এটা স্রেফ সমাপতন, নাকি গেরুয়া শিবিরের শেষ মুহূর্তে সামাল দেওয়ার চেষ্টা (কোনও প্রচার ছিল না, প্রায় রাতারাতি অর্ণবের মুখ-দেওয়া কটা হোর্ডিং পড়েছিল) বলা মুশকিল। তবে রবীশের বক্তৃতা শোনার জন্য হল-ছাপানো ভিড় দেখে মালুম হল যে অন্য পক্ষের নার্ভাস হওয়ার কারণ আছে। যে হাততালি, হর্ষধ্বনি রবীশকে স্বাগত জানাল, তা শাহরুখ-সৌরভদের মেলে। এ সবই সংবাদ সম্পর্কে নিভু-নিভু আশাকে উস্কে দেয়।
স্টার সাংবাদিকটি কিন্তু শ্রোতাদের প্রায় আক্রমণ করলেন— ‘কেন সংবাদের অ্যাঙ্করের কথা শোনেন? সে কী তদন্ত করেছে? কোনও রিপোর্টিং-ই তো সে করছে না।’ রবীশ নিজে উত্তরপ্রদেশ, বিহার-সহ বিভিন্ন রাজ্যের ছোট ছোট শহরের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমন পড়াশোনা হচ্ছে, তার উপর রিপোর্টের একটা সিরিজ় তৈরি করেছেন। দেখিয়েছেন কী ভাবে উচ্চশিক্ষার নামে স্রেফ ডিগ্রি বিক্রি করা হচ্ছে (এক একটি কলেজে দশ হাজার ছাত্র, আর পনেরো-বিশজন শিক্ষক)। আর একটি সিরিজ়ে দেখিয়েছেন, একের পর এক চাকরির পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে নানা রাজ্যে, অথচ ফল বার হচ্ছে না, বার হলেও নিয়োগের চিঠি যাচ্ছে না। পরীক্ষা দিয়ে বসে থাকা তরুণদের সংখ্যা অন্তত এক কোটি। এ সব খবর আলোড়ন ফেলেছে।
কিন্তু এভাবে মানুষের কাছে গিয়ে কথা বলে, তাদের সুবিধে-অসুবিধে নিয়ে খবর করা এখন প্রায় উঠে গিয়েছে। ‘কণ্ঠহীনকে কণ্ঠ দেওয়ার জন্য’ ম্যাগসেসে পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। তা গ্রহণ করেও মিডিয়ার প্রতি তিক্ততা উগরে দেন রবীশ। বলেন, ‘ভারতীয় মূলস্রোতের মিডিয়া রাত দিন কাজ করছে, যাতে নাগরিকদের উত্তর-নিরক্ষর (post-illiterate) করে তোলা যায়। তাদের সিলেবাসে রয়েছে কেবল চিন্তাশূন্য জাতীয়তাবাদ আর সাম্প্রদায়িকতা।’
রবীশকে যত লড়তে হয়েছে সরকারের সঙ্গে, ততটাই সরকার-ঘনিষ্ঠ মিডিয়ার সঙ্গে— সেই মিডিয়া, যা সরকারের প্রচারকে ‘তথ্য’ বলে গ্রহণ করে। নরেন্দ্র মোদির শাসনে ‘গোদি-মিডিয়া’-তে (ক্ষমতার কোলে-বসা মিডিয়া) সামিল না হওয়ার জন্য রবীশের উপর এবং এনডিটিভি-র উপর বারবার আঘাত নেমে এসেছে। পাঠানকোটে আক্রমণের সংবাদ করার জন্য তাঁর চ্যানেল ‘এনডিটিভি ইন্ডিয়া’-র সম্প্রচার এক দিনের জন্য নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল কেন্দ্র, বিপুল সমালোচনার ঝড়ে তা হয়নি। গত বছর রবীশের ‘প্রাইম টাইম’কে নস্যাৎ করে ‘জ়ি হিন্দুস্তান’ চ্যানেল দিল্লির মোড়ে মোড়ে হোর্ডিং দিয়েছিল, ‘রবীশ কি টাইম, অব নহি রহা প্রাইম।’ রবীশও তাঁর শো-কে ব্যবহার করে যেমন সরকারের প্রতি, তেমন অন্য টিভি চ্যানেলের উদ্দেশ্যেও বার্তা দিয়ে গিয়েছেন। পুলওয়ামা আক্রমণের পর তিনি অন্য টিভি অ্যাঙ্করদের সংযত হতে অনুরোধ করেছিলেন। মনে করিয়েছিলেন, এই সেনাবাহিনির বহু ন্যায্য দাবি (যেমন ওয়ান র্যাঙ্ক ওয়ান পে) কেন্দ্র দীর্ঘ দিন ধরে উপেক্ষা করে আসছে। তাতে কাজ অবশ্যই হয়নি। অর্ণব গোস্বামী, নভিকা কুমার প্রমুখ অ্যাঙ্কাররা ‘বদলা’ চেয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রায় যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছিলেন। পুলওয়ামা বা বালাকোটে কেন্দ্রের, সেনার ভূমিকা নিয়ে বহু প্রশ্ন অনুচ্চারিত, উত্তরহীন থেকে গিয়েছে। প্রশাসনকে প্রশ্ন করার অভ্যাস বন্ধ হওয়া দরকার, এমন কথাও একবার বলেছিলেন এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তার উত্তরে দুই মূকাভিনয়ের শিল্পীকে নিয়ে রবীশ কুমার প্রাইম টাইমে একটি ‘শো’ করেছিলেন। বোঝার চেষ্টা ছিল, কী প্রশ্ন করা যেতে পারে সরকারকে। বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেই অনুষ্ঠানটি।
যে সাংবাদিক সরকারের কোলে না বসে তার মুখোমুখি দাঁড়ায়, তার বিপদ বাড়ছে সারা দুনিয়ায়। সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমস কাগজের প্রকাশক এ জি সুলজ়বার্গার একটি বক্তৃতায় যা বলেছেন, তাতে মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়। তিনি বলছেন, মিডিয়ার উপর সরকার চটবে, তা নতুন কিছু নয়। তা সত্ত্বেও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা যে মূল্যবান, এবং কর্মরত সাংবাদিকরা বিপদে পড়ল তাদের সহায়তা করা সরকারের কর্তব্য, এটা ধরে নেয়। ব্যতিক্রম ঘটছে এখন, ট্রাম্পের জমানায়।
কী ঘটছে? বছর দুয়েক আগে জানা যায়, নিউ ইয়র্ক টাইমসের জন্য কর্মরত এক আইরিশ সাংবাদিককে মিশরের পুলিশ গ্রেফতার করতে চলেছে। খবরটি দেন মিশরে কর্মরত এক মার্কিন অফিসার। সাধারণত দূতাবাসের আধিকারিকরাই এমন খবর দেন, কিন্তু এ ক্ষেত্রে একটা পার্থক্য ছিল। ওই অফিসার জানান, ট্রাম্প সরকারকে গোপন করে তিনি কাগজের কর্তাদের খবরটা দিচ্ছেন, কারণ তাঁর ধারণা, খবরটা জানলে ট্রাম্প সরকার তা চেপে দেবে, গ্রেফতার হতে দেবে সাংবাদিককে। কাগজের কর্তারা তাই শুনে মিশরের আয়ার্ল্যান্ড দূতাবাসকে যোগাযোগ করেন। আইরিশ রাষ্ট্রদূত ওই সাংবাদিককে উদ্ধার করে। এর আঠারো মাস পরে মিশরে আর এক মার্কিন সাংবাদিককে গ্রেফতার করেছিল সে দেশের পুলিশ, সরকার-বিরোধী খবর করার ‘অপরাধে।’ মার্কিন দূতাবাসের এক কর্তা বলেছিলেন, ‘কী প্রত্যাশা করেন? ওর রিপোর্টের জন্য সরকার বিব্রত হয়েছে, গ্রেফতার তো করবেই।’
কী করা উচিত এই পরিস্থিতিতে? সুলজ়বার্গার বলছেন, ‘ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে দাঁড়িয়ে সংবাদমাধ্যমকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে হবে উৎকৃষ্ট সাংবাদিকতার মূল্যবোধগুলিকে— ন্যায্যতা, তথ্যনিষ্ঠা, স্বাতন্ত্র্য— এবং সেই সঙ্গে নিজেদের আরও উন্মুক্ত করা চাই, যাতে সাধারণ মানুষ আমাদের কাজ, আর সমাজে তার প্রয়োজনকে আরও বেশি বুঝতে পারে। টুইটারে কী ট্রেন্ড করছে, তা ভুলে গিয়ে আমাদের সেই সব খবর ধাওয়া করতে হবে যেগুলো অর্থপূর্ণ। কারও বিরোধী, কিংবা কারও গলা-ফাটানো সমর্থক হয়ে ওঠার প্রলোভনে পা দেওয়া চলবে না। আমাদের আনুগত্য থাকতে হবে তথ্যের প্রতি, কোনও দল বা নেতার প্রতি নয়। সত্য যেখানে নিয়ে যায় সেখানেই আমাদের যেতে হবে, ভয়শূন্য এবং প্রত্যাশাশূন্য হয়ে।’’
নেতার প্রতি আনুগত্যহীন সাংবাদিকতা, শুনলে এ দেশের সাংবাদিকরা বাঁকা হাসবেন। কলকাতার একটি চ্যানেলে কর্মরত এক বন্ধু ক’দিন আগে বলছিলেন, কোনও ঘটনার ক্লিপিং বা কারও উক্তি আগে তাঁরা কয়েকবার আলগোছে চালিয়ে দেখেন, দিল্লি থেকে বা নবান্ন থেকে কোনও আপত্তি এল কিনা। যদি না আসে, তবেই তা নিয়ে খবর তৈরি হয়, যা পাঠ করেন অ্যাঙ্কর। আপত্তি এলে ‘ড্রপ’ হয়ে যায় ক্লিপিংটি। অর্থাৎ সরকারের আপত্তিহীনতা খবর তৈরির প্রধান শর্ত। এই পরিস্থিতিতে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রকাশকের ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ ধাঁচের কথা স্রেফ নীতিবাক্য মনে হয়। আর তখনই টের পাওয়া যায় কেন ম্যাগসেসে পুরস্কার গ্রহণ করতে গিয়ে রবীশ বলেছেন, ‘গণতন্ত্রের আত্মা আক্রান্ত।’
তা হলে উপায়? সুলজ়বার্গার বলছেন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব কেবল সংবাদ সংস্থাগুলির নয়। বাণিজ্যিক সংস্থা, নন-প্রফিট সংস্থা এবং গবেষণা-শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা, যাঁরা নিজের কাজের জন্য নির্ভরযোগ্য সংবাদের উপর নির্ভরশীল, তাঁদেরও এই প্রচার-আন্দোলনে সামিল হওয়ার দায়িত্ব রয়েছে। দানবাকার প্রযুক্তি সংস্থাগুলির কাছে আবেদন করে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রকাশক বলছেন, ‘সরকারের মোকাবিলা করার ব্যাপারে ফেসবুক, টুইটার, গুগল এবং অ্যাপলের মতো সংস্থাদের ইতিহাস খুব সুবিধের নয়। তারা প্রায়ই ভ্রান্ত প্রচারের প্রতি চোখ বুজে থেকেছে, কখনও কখনও সৎ সাংবাদিকতা দমনে সায় দিয়েছে।’
সাংবাদিক, সাংবাদিকতাকে বরাবর বাঁচিয়ে এসেছে সংবাদপত্রের মালিক-সম্পাদক। ভারতে ইমার্জেন্সির সময়ে ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মোকাবিলায় ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ যথেষ্ট চাপে পড়েছিল। কিন্তু আদালত ছাড়া আর কারও দ্বারস্থ হতে হয়নি। আজ কিন্তু বড় বড় সংবাদ সংস্থাও বড় বাণিজ্যিক সংস্থার কাছে আবেদন করছে, সংবাদকে বাঁচান। সাংবাদিকতাকে বাঁচিয়ে রাখুন।
আবেদন করছেন রবীশ কুমারও, তবে বাণিজ্যিক সংস্থা বা অসরকারি সংস্থার কাছে নয়। সরাসরি নাগরিকের কাছে। যথাযথ তথ্য না থাকলে গণতন্ত্রই থাকে না, তাই সে কাজটা সাংবাদিক না করলে নাগরিককেই করতে হবে, এই হল তাঁর অবস্থান। যাঁরা মিছিল করতে করতে তার ভিডিও তুলছেন, যাঁরা ইউটিউব-এ কোনও ঘটনার বিবরণ পোস্ট করছেন, যে সব কৌতুকশিল্পী সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে সরকারকে বিদ্রুপ-বিদ্ধ করছেন, তাঁরা ‘সিটিজ়ন জার্নালিস্ট’ বা নাগরিক-সাংবাদিক। রবীশ বলছেন, আমরা এমন মহাসঙ্কটে বাস করছি, যখন তথ্যের অনুসন্ধানকেই জাতীয়তাবাদ-বিরোধিতা মনে করা হচ্ছে, মতের ভিন্নতাকে মনে করা হচ্ছে দেশদ্রোহিতা। পেশাদার সাংবাদিকরা জেনে-বুঝেই এই ঝুঁকির অনেকটা সরিয়ে দিচ্ছেন নাগরিকদের ঘাড়ে। ‘মিডিয়া যখন নাগরিকের বিরুদ্ধে কাজ করে, তখন নাগরিককে মিডিয়ার ভূমিকা নিতে হয়। এই দায়িত্ব নিতে হবে এটা জেনেই, যে যখন রাষ্ট্র নিয়ত নজরদারি করছে এবং নির্মম হয়ে উঠছে, তখন সাফল্যের সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ,’ ম্যানিলায় বলেছিলেন রবীশ।
বসুশ্রীর শ্রোতাদের বললেন, ‘আমাকে অনেকে বলেন, তুমি এত হিম্মত পাও কোত্থেকে? এটা হিম্মতের কথা নয়, সরলতার কথা। সত্য বললে বিরোধ হবে, তার মোকাবিলা করে যেতে হবে। আমরা সত্য বলি না, কারণ আমাদের বাড়িতে শেখানো হয়, চুপ করে থাকো। পাবলিক স্পেসে বেশি কথা বোলো না। আপনারা নেতাদের বরং প্রশ্ন করুন, এত মিথ্যে কথা বলার হিম্মত তোমাদের হয় কী করে?’ রবীশ বারবার টেনে আনলেন গান্ধির প্রসঙ্গ, যিনি প্রবল ক্ষমতার সামনে প্রায় একা দাঁড়িয়ে সত্য বলতে কখনও দ্বিধা করেননি। তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতার সবটাই ছিল ‘নাগরিক’-কে লক্ষ করে। স্বার্থহীন, ভয়হীন, বিবেকবান, ভিন্নমত-সহিষ্ণু, বৈচিত্রপ্রিয়, সদাজাগ্রত, সক্রিয় এক নাগরিকের ভাবমূর্তি গড়তে চাইলেন রবীশ। এমন নাগরিক সমাজ, যা অসার ও বিপজ্জনক রাজনীতির সামনে দাঁড়িয়ে জনস্বার্থকে প্রতিষ্ঠা করবে।
রবীশের এই আবেদনের মধ্যে অবশ্যই খানিকটা ‘সরলতা’ রয়েছে। হয়তো সহজ কথার শক্তি বজায় রাখতেই জটিলতা এড়িয়েছেন। কঠিন সত্য এই যে, সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতীয়তাবাদ যে প্রবল আকারে আত্মপ্রকাশ করেছে জাতির জীবনে, তাতে তার বিরোধিতা কেবল নেতার বিরোধিতায় সীমিত থাকবে না। নাগরিকের এক বৃহৎ অংশের সঙ্গেও মোকাবিলা করতে হবে গণতন্ত্র ও ঐক্যকামী নাগরিকদের। সংগঠিত আন্দোলন ছাড়া তা সম্ভব নয়, অথচ প্রবল রাজনৈতিক চাপের মুখে যে কোনও সংগঠন অতি দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। ‘অসম্ভব’ নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু কেবল নৈতিক শক্তি দিয়ে নাগরিকপঞ্জির মতো নির্দিষ্ট কর্মসূচির প্রতিরোধ সম্ভব নয়। বিবেক যতই জাগ্রত হোক, স্ট্র্যাটেজিরও প্রয়োজন আছে। সে কি অমনি হবে? বিশেষত বাংলায়, যেখানে পার্টি পলিটিক্সের দাপটে নাগরিক আন্দোলন মৃতপ্রায়?
ম্যানিলার বক্তৃতায়, এবং কলকাতার তাঁর বক্তব্যের মধ্যেও রবীশ নাগরিকের প্রতিরোধশক্তির সম্ভাবনা বোঝাতে বারবার নিজের অভিজ্ঞতার কথা শুনিয়েছেন। এটা স্বাভাবিক, তার প্রয়োজনও আছে। রবীশ খানিকটা বুঝিয়ে দিতে চাইছেন যে, বিহার থেকে দিল্লি আসা ভোজপুরি ভাষা-সম্বল একটা ছেলে (তাঁর গ্রামে হিন্দিতে কথা বললে নাকি লোকে বলে, ‘বেশি ইংলিশ বোলো না’) যদি আজ ক্ষমতাকে আঘাত করতে পারে, তবে যে কেউ তা পারবে না কেন? ঠিকই তো। তবে এ-ও ঠিক যে, রবীশের সাফল্য যেমন অনেকটা তাঁর সাংবাদিকতার উৎকর্ষের জন্য, তেমনই সময়-সুযোগের গুণে। এনডিটিভি-র প্রণয় রায়-রাধিকা রায় তাঁকে সুযোগ দিয়েছেন। মেঘের ফাঁকে রোদের বিচ্ছুরণের মতো, দুর্যোগের মধ্যে একটা ফাঁক পেয়ে গিয়েছে তাঁর প্রতিভা। স্থান-কালের হেরফেরে তা হয়তো মিলত না। প্রতিভাশালী, প্রতিবাদী বহু সাংবাদিককে আমরা নীরব হয়ে যেতে দেখেছি। কেউ গুলিতে লুটিয়ে পড়েছেন, কেউ ছাঁটাই হয়েছেন, কেউ মানহানির মামলায় কিংবা আয়কর মামলায় বিপর্যস্ত, কারও ‘ফান্ডিং’ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আমরা দেখছি, প্রতিবেশী পাকিস্তানের এক অকুতোভয়, তদন্ত-পারদর্শী, অসি-কলমধারী তরুণ সাংবাদিক সিরিল আলমিডা কেমন নীরবে সরে গেলেন। পাকিস্তানি রাষ্ট্র কীভাবে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলিকে মদত দিচ্ছে, তা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখতেন তিনি। ভারতে সন্ত্রাসবাদী হানার পর এ নিয়ে নওয়াজ শরিফ সরকার এবং সামরিক বাহিনির মধ্যে কেমন সঙ্ঘাত বেধেছিল, ২০১৬ সালে সেই খবর করে সারা বিশ্বে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন এই তরুণ। সরকার সিরিলের নাম তুলে দেয় সেই সব অপরাধীদের তালিকায়, যাদের দেশ ছাড়া বারণ। পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের আগে জেলবন্দি নওয়াজ শরিফের সাক্ষাৎকার নিয়েই হইচই ফেলে দেন সিরিল। কারণ তাতে মুম্বই-হানায় অভিযুক্ত সন্ত্রাসবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করতে তৎকালীন সরকারের ব্যর্থতার কথা উঠে আসে। গোপন খবর ফাঁসের অভিযোগে সিরিলের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল লাহোর হাইকোর্ট।
গত তিন বছর এমন লাগাতার চাপ সত্ত্বেও সিরিল বিপুল ঝুঁকি নিয়ে কাজ চালিয়ে যান। ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট তাঁকে ‘প্রেস ফ্রিডম হিরো’ পুরস্কার দেয় এ বছর এপ্রিলে। তখন ‘আল জাজ়িরা’-কে একটি সাক্ষাৎকারে সিরিল বলেন, ‘সাংবাদিকের উপর চাপ বহু দশকের মধ্যে এখন সবচাইতে খারাপ অবস্থায়, অসামরিক সরকারের শাসনকালে এতটা কখনও দেখা যায়নি। চাপ কমবে, তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।’ ‘ডন’ কাগজটির বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে প্রচার চলেছে সোশ্যাল মিডিয়াতে, সরকার নানাভাবে আর্থিক বিধিনিষেধ আরোপ করে চলেছে।
২০১৬ সালে সিরিল লিখেছিলেন, দেশের নেতা, সামরিক অফিসাররা আসে-যায়, কিন্তু সাংবাদিক থেকে যায়। এই ২০১৯ সালের অক্টোবরে সিরিল যে কেবল ‘ডন’ পত্রিকা থেকে পদত্যাগ করেছেন তা-ই নয়, টুইটারে লিখেছেন যে সাংবাদিকতা থেকেই বিদায় নিচ্ছেন। অক্সফোর্ডের রোডস স্কলার, নির্ভয়, পরিশ্রমী, স্পষ্টবাক সাংবাদিক সিরিল আলমিডা যেভাবে হারিয়ে গেল, যেভাবে স্তব্ধ হয়েছেন গৌরী লঙ্কেশ বা সুজাত বুখারি, রবীশের মতো নির্ভীক কণ্ঠস্বরও একদিন সেভাবে হারিয়ে যেতে পারে বইকি।
কারা থাকল তা হলে? কাদের কথা শুনব খবরে? পাবলিক স্পেস-এ শেষ অবধি কে কথা বলবে, সেটা নাগরিকই ঠিক করেন। শ্রোতার বিচার অনেকটাই নির্ধারণ করে, খবর কী, কার কথা ‘খবর’। টিভি বন্ধ করতে বলে রবীশ সেই অধিকার, সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে বলছেন নাগরিককে। যা তথ্যনিষ্ঠ নয়, তদন্তপ্রাপ্ত নয়, যুক্তিসিদ্ধ নয়, তা সংবাদ নয়। কোনটা সংবাদ, কে সাংবাদিক, সে প্রশ্নের উত্তর এ বার নাগরিককে দিতে হবে। গণতন্ত্র বড় পরিশ্রমের কাজ।
গণতন্ত্র পরিশ্রমের, আবার আয়েসেরও। রভীশ- বক্তৃতা পরবর্তী সোশ্যাল মিডিয়ার চেহারা দেখে এইরকম মনে হয়েছিল।
লেখাটা ভালো লাগলো।