তুহিন দাস
শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যত। তাদের ভালবাসতে ও সম্মান জানাতে শিশু দিবস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময় পালিত হয়ে থাকে। শিশু দিবসটি প্রথমবার তুরস্কে পালিত হয়েছিল সাল ১৯২০র এপ্রিল ২৩ তারিখে। ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মদিন, সে দিনটিকে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে শিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। তারপর থেকে নিয়মিত শিশু দিবস পালিত হয়ে আসছে। মাঝে বিএনপি-জামাত সরকারের সময় তা কিছুটা স্থগিত থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারের দুটি শাসনামলে এ দিবসটি যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে। গরীবদের খাবার ও পোষাক বিতরণ, রক্তদান কর্মসূচি ও অন্যান্য জনকল্যাণমূলক কাজও হয়। দেশব্যাপী শিশুদের নিয়ে নানারকম অনুষ্ঠান স্থানীয় সরকারের উদ্যোগে পালিত হয়। তার মাঝে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা উল্লেখযোগ্য। আর শিশুদের চিত্রাঙ্কনের বিষয় নির্ধারণ করে দেয়া হয় ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ প্রভৃতি।
বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত এমন এক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় গত ১৭ মার্চ শিশুদের দু’টি ছবি প্রথম পুরস্কার, দ্বিতীয় পুরস্কার অর্জন করে। প্রথম পুরুস্কারটি অর্জন করে গেরিলা যুদ্ধের একটি চিত্র, অন্যটি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি।
২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে স্থানীয় জেলা প্রশাসন তাদের আয়োজিত অনুষ্ঠানমালার সূচিকার্ডে সে দু’টি ছবি দিয়ে আমন্ত্রণপত্র তৈরি করে। উল্লেখ্য যে শিশুদের আাঁকা ছবি দু’টি দেখলে বোঝা যায় কাঁচা হাতে আঁকা। আর এ আমন্ত্রণপত্রটি নিয়ে গত ৭ জুন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তারিক সালমানের বিরুদ্ধে মামলা করে বসেন বরিশালের জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট ওবায়েদ উল্লাহ সাজু। তিনি বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদকও। সে মামলায় এ আমলা গ্রেফতার হন ও দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে তাকে আপাতত মুক্তিও দেয়া হয়। এ মামলার নেপথ্যে নানা রকম স্বার্থদ্বন্দ্বের কথা উঠে আসছে, অনেকে শিল্পমূল্য সহ অন্যান্য বিচার বিশ্লেষণ করছে। কিন্তু তা আমার আলোচনার বিষয় নয়।
যে দু’টি ইসলামী উগ্রবাদী ধারা বাংলাদেশে আছে তাদের একটি হল জঙ্গী, যারা এখনি শরিয়া আইন বাস্তবায়ন করতে চায়। আর অন্য দলটি হল তারা ক্ষমতাসীন সরকারগুলোকে নানাভাবে বেকায়দায় ফেলে আস্তে আস্তে রাজনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করতে চায়। বাংলাদেশে এ দ্বিতীয় শ্রেণীর ইসলামী উগ্রবাদীরা বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলোর কাছে দাবী জানিয়ে আসছিল যে ধর্মের খারাপ দিকগুলোর সমালোচনা রুখতে ব্লাসফেমি আইন করতে হবে। অবশেষে বিএনপি-জামাত সরকারের আমলে তথ্যপ্রযুক্তি আইন নামে তা পাশ হয়। এবং ৫৭ ধারাটিকে বাংলাদেশে বাক স্বাধীনতাকে রুখতে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়। ৫৭ ধারায় কাউকে মানহানি করা হলে জামিন না দিয়ে বিচারক দোষীকে জেলে ভরে রাখতে পারেন বলে ভিন্নমত দমনে এ ধারাটির তুমুল ব্যবহার হচ্ছে এখন বাংলাদেশে। বাংলাদেশে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ‘ইসলাম বিতর্ক’ গ্রন্থটির লেখক এখনও কারাবন্দী আছেন। এ ছাড়া এ ধারায় বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে শত শত মানুষের নামে মামলা দেয়া হয়েছে, নাজেহাল করা হয়েছে, সরকারের সমালোচনা রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।
‘কটূক্তি করা হয়েছে’ বাংলাদেশে এখন বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করতে বড় হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। গত দশ বছরে বাংলাদেশে কয়েকশ হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক কর্মীরা তো আছেনই। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে ‘ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করা হয়েছে’ বলে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করা স্বার্থান্বেষী মহলকে। এর নেপথ্যে আছে চাকরীচ্যুত করা, জমি দখল প্রভৃতি। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের হিন্দু সম্প্রদায়ের বিজ্ঞান শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এমনটি বারবার ঘটছে, বিশেষ করে যারা বিবর্তনবাদ পড়াচ্ছেন তাদের অনেককে জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।
ধর্মকে কটূক্তি করা ছাড়াও আরেকটি অস্ত্র আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে আছে, তা হল স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে কটূক্তি করা হয়েছে। আমি এসব নিয়ে বেশি উদাহরণ দেব না—
–বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি : ৫৭ ধারায় মামলা (চট্টগ্রাম প্রতিদিন, ০৮/০৭/২০১৭)
–বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি, শাবি শিক্ষকের কক্ষ ভাঙচুর (সিলেট ভিউ টুয়েন্টি ফোর ডট কম, ১৭/০৭/২০১৭)
–বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি : মানিকগঞ্জে কলেজ অধ্যক্ষ বাসুদেব শিকদার বরখাস্ত (লন্ডন টাইমস নিউজ ডট কম, ০২/০৭/২০১৭)
–বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তি : জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আক্তার হোসেনের বিরুদ্ধে ঢাকায় মামলা (চাঁদপুর রিপোর্ট, ১৭/০৯/২০১৬)
অনুসন্ধানী পাঠক ‘বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তি করায় গ্রেফতার’ কথাটি লিখে গুগল সার্চ করুন। অসংখ্য লিঙ্ক চলে আসবে। তবে প্রসঙ্গত বলে রাখি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কোনও ধরনের কটূক্তি করলে বা তাতে মদদ দিলে তা সাইবার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, এর শাস্তি সর্বোচ্চ ১৪ বছরের জেল অথবা ১ কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
দলতোষণ এমন স্থানে গিয়ে পৌঁছেছে যে শেখ মুজিবকে বাংলাদেশে নবী হিসেবে চিত্রায়িত করার চেষ্টা হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ইসলাম তোষণ শেখ মুজিব করেছিলেন, তাদের নানারকম সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও একজন মানবিক মানুষ হিসেবে ইসলামের যে কোনও নবীর থেকে শেখ মুজিবের নীতি-নৈতিকতা ভালো ছিল। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে তরান্বিত করেছিলেন। আর ধর্মীয় নবীরা মানুষকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করেছে, ধর্মের নামে মানুষকে হত্যা করেছে, যুদ্ধ করেছে, ধর্মগ্রন্থে এমন কিছু ঘৃণাবাক্য ছড়িয়ে রেখেছে যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষকে মুখোমুখি করছে সংঘাতে-যুদ্ধে-মৃত্যুতে।
শেখ মুজিবকে নবী দাবী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ফেসবুক ভেরিফাইড থেকে করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রমাণ এখানে রাখছি যেখানে তাকে বাংলার নবী বলা হয়েছে–
আবার গত বছর বাংলাদেশ পুলিশপ্রধান বলেছিলেন এ কথা—
আবার অতি আওয়ামী লীগার কেউ বলেছেন এমন কথাও—
জনৈক ‘লেখক, গবেষক ও সংস্কারক’ হায়দার আলী চৌধুরী তার প্রকাশিত গ্রন্থ ‘পবিত্র কোরান হাদিসের আলোকে খলিফাতুল মোসলেমীন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ নামক গ্রন্থের ‘ভূমিকা’য় ১০ সেপ্টেম্বর ২০১০ সালে লিখেছেন, ‘‘…সিয়াম সাধনার মাস রমজানে অজুর সাথে এ বইটি রচিত হয়েছে। যে কোন পাঠক নিয়মিত এই বইটির কিছু কিছু অংশ পাঠ করলে তার যে কোন মুসকিল আসান হবে, ইনশায়াল্লাহ। এটি পরীক্ষিত।
মনে রাখতে হবে…. মনে রাখতে হবে, বইটি একটি মহাপুরুষের জীবনী। নিয়মিত পাঠকারীর বিপদ-আপদ, বালা-মসিবত, আসমানী বালা-জমিনী বালা, যাদু-বান-টোনা, নজর-আছর, শত্রূর শত্রূতামি, দুশমনের দুশমনী, হিংসুকের হিংসা, প্রতারকের প্রতারণা, রাহুর-দশা-ফাঁড়া, অভাব-অনটন, দুঃখ-দুর্দশা, বাত-ব্যাধি, ব্যথা-বেদনা, রোগ-শোক দূর হবে, ইনশায়াল্লাহ। পরিবারের সুখ শান্তি ও আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে আসবে। এটি পরীক্ষিত।’’
গ্রন্থটির প্রচ্ছদ ও ভূমিকা—
পৃথিবীর রাষ্ট্রনায়কদের নিয়ে অসংখ্য কার্টুন, লেখা প্রকাশিত হয়। সেসবের মাঝে সিংহভাগ কার্টুন করা, লেখা হয় সমালোচনার জন্য। সভ্য দেশে এসব নিয়ে মাথাব্যথা হয় না কারও। বরঞ্চ লোকে তা উপভোগ করে, নতুন নতুন অবলোকনে রাষ্ট্রনায়কদের বিবেচনা করে, ইতিহাসের মূল্যায়নে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা এগিয়ে চলেন, বহমান হন। কিন্তু বাংলাদেশে ‘শেখ মুজিবকে কটূক্তি করা হয়েছে’ কথাটি এখন মানুষ নির্যাতন, বাকস্বাধীনতা রুদ্ধ করা ও ভিন্ন মত দমনের হাতিয়ার। এ নির্যাতন থেকে মানুষের মুক্তি মিলবে কবে?