প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত
Citizen or robot; democracy or tyranny— the choice is ours.
দৃশ্য ১
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। নর্থ ব্লক, দিল্লি। রাজ্যের তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলার অবনতির অভিযোগ এনে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং-এর কাছে অভিযোগ জানাতে এসেছেন বঙ্গ বিজেপির শীর্ষ প্রতিনিধি দল। মন্ত্রকের বাইরে অপেক্ষারত মিডিয়া প্রতিনিধিদের মধ্যে একজন এগিয়ে গেলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা ও রাজ্য পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের দিকে। সবার সামনে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন তিনি। পোড়খাওয়া বিজেপি নেতা তার পিঠ চাপড়ে, হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে ঢুকে গেলেন মন্ত্রকে। যেতে যেতে অন্য সংবাদমাধ্যম প্রতিনিধিদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন, মুচকি হাসলেন। সেই দলে অন্য সবার মতই দাঁড়িয়ে থাকা আমি, তখন লজ্জায়, ঘৃণায় গলে গলে মাটিতে মিশে যাচ্ছি।
দৃশ্য ২
লালকৃষ্ণ আদবানির সংসদীয় কক্ষ। কয়েকশো মানুষ দেখা করতে এসেছেন ‘লৌহপুরুষে’র সঙ্গে। সৌজন্যতাপূর্বক সাক্ষাৎ শেষে প্রণাম করছেন, পায়ে হাত দিয়ে। ‘অন ডিউটি’-তে থাকা হিন্দি বলয়ের মিডিয়ার প্রতিনিধিরাও শ্রদ্ধা ভরে তার পাদুকাস্পর্শ করছেন। কক্ষে উপস্থিত এক সাংবাদিক দোনামোনা করছেন দেখে তাকে মৃদু ভর্ৎসনা করা হল স্তাবকবৃন্দের তরফে। জনৈক সাংবাদিক এগিয়ে গিয়ে জানালেন, তিনি ‘অন ডিউটি’তে আছেন। কাউকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা তার নীতিবিরুদ্ধ। সরাসরি এহেন প্রত্যাখ্যানে চমকে উঠেছিলেন আদবানি। হাসি মুখে তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেছিলেন।
বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ভারতীয় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ রূপে বিবেচ্য গণমাধ্যম বা মিডিয়ার ভূমিকা কী তা লিখতে বসে এই দুটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল পার্লামেন্ট চলাকালীন সংসদের করিডরে দাঁড়িয়ে এক প্রবীণ বাম সাংসদ খানিকটা ক্ষোভ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলেন, “তোমাদের সঙ্গে (মানে সাংবাদিক) আর কথা বলতে ভালো লাগে না। মিডিয়ার এখন চরিত্র বলতে কিছু নেই। সে অনেকটা বাজারের রক্ষিতার মতন হয়ে গেছে। তাকে যে যেরকম টাকা দেয়, সে তার হয়েই বশ্যতা করে, তারই মুখ হয়ে প্রচার করে। নিজস্বতা বা আঙুল তুলে পাল্টা প্রশ্ন করার ক্ষমতা তারা যেন হারিয়ে ফেলেছে। এ দেশে সবই বিক্রয়যোগ্য। মিডিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়।”
মিথ্যে বলব না, সেদিন কথাগুলো শুনে মনে মনে আঘাত পেয়েছিলাম। কিন্তু একই সঙ্গে এ প্রশ্নও উসকে দিয়েছিল মনে— মিডিয়া কি সত্যি একার্থে চরিত্রহীন? মিডিয়ার কি আদৌ কোনও সুনির্দিষ্ট চরিত্র হয়? হলেও তা নির্ধারণ করে কে? আমরা সাংবাদিকরা নাকি মুনাফাবাদী মালিকশ্রেণির দলদাস মাত্র? আমাদের ব্যক্তিগত, আদর্শগত অবস্থান বলে কি কিছুই নেই? সেদিন কিন্তু বুঝেছিলাম যে, এতসব কিছুর পরেও এই সমাজ, সামাজিক ব্যবস্থা, ধর্মীয়করণ ও আর্থসামাজিক টানাপোড়েনের মুখে দাঁড়িয়ে মিডিয়ার চরিত্র ও ভূমিকা অনেকাংশে নির্ভর করে কার ‘মেরুদণ্ড’ কতটা নমনীয় বা কঠিন তার উপর। আমরা তা মানি বা না মানি, এটাই সত্যি।
বর্তমান ভারত নির্মাণে গণমাধ্যমের গুরুত্ব ও ভূমিকা যে অপরিসীম, সেই কথা অনস্বীকার্য। স্বাধীনোত্তর ভারতে প্রিন্ট মিডিয়া যে নজির স্থাপন করেছিল, আট ও নয়ের দশকে তাকেই এগিয়ে নিয়ে গেছিল বৈদ্যুতিন মাধ্যম। শূন্যের দশকে সোশ্যাল মিডিয়ায় তথ্যের আদানপ্রদানে যে বিপ্লব দেখা গেছিল তা সেই বর্ণময় অতীতের প্রতিফলন মাত্র। এরপর একবিংশ শতাব্দীর শেষে বারবার মিডিয়ার কর্মকাণ্ড ও মূল্যায়ন নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। উঠে এসেছে মিডিয়া বা সংবাদমাধ্যমের একাংশের ভূমিকা, অবদান ও মূল্যায়ন নিয়ে তর্কবিতর্কও। ‘স্বচ্ছতা’ এবং ‘নিরপেক্ষতা’ নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। এমনকি, আদর্শের ঠান্ডা লড়াই ছড়িয়ে পড়েছে সংবাদ-মাধ্যমের অভ্যন্তরে। মাহমুদ শাহ মামদানির লেখা ‘গুড মুসলিম, ব্যাড মুসলিম’-এর তত্ত্ব মেনেই যেন গুড জার্নালিস্ট ও ব্যাড জার্নালিস্ট-এর তত্ত্ব খাড়া করা সম্ভব। বর্তমান সময়ে মিডিয়ার অপেশাদারিত্ব নিয়ে মিডিয়ার একাংশে উঠেছে সমালোচনার ঝড়। মিডিয়াকে তার নীতিপঙ্গুতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন রামন ম্যাগসেসে সম্মানপ্রাপ্ত প্রবীণ সাংবাদিক রবীশ কুমার। রীতিমত কড়া সমালোচনা করে বলেছেন—
News channels have worked tirelessly to kill India’s democratic ideals, with the result that vast numbers of the Indian people follow channels that ask no questions to the government. These channels have trained their viewers to watch only a particular kind of TV where nothing is demanded of them, except a willing and complete suspension of belief. And absolute amorality. Elected representatives can garland killers, ministers can lie, news anchors can read out government press releases as news. It bothers no one enough.
শাসক দলের ধর্মই বশ্যতালোভ, স্বজনপোষণ ও আনুগত্যপ্রবণতা। সেখানে কোন রং দেখা হয় না, দেখা হয় না আদর্শবাদ। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে একাধিকবার মিডিয়ার গুরুত্ব লুণ্ঠিত হতে দেখা যায়। স্বচ্ছতা ও সত্যতার ঊর্ধ্বে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মুনাফাবাদী হীন মানসিকতা। সেখানে সত্য মিথ্যায় ও মিথ্যা সত্যে পরিণত হয়। তথ্য ও তত্ত্বহীন আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে সংবাদমাধ্যমের দিগদর্শন। নীতিহীনতাই তখন নীতিমালা হয়ে ওঠে। এরপর অবধারিতভাবে খুন হন গৌরী লঙ্কেশ, রাজীব রঞ্জনের মত সৎ, একরোখা, আপসহীন সাংবাদিকেরা। জাতীয় ইনডেক্স জানায়, সাংবাদিকদের জন্য জীবনের ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে এই বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ। যেখানে সাংবাদিকদের বা সংবাদমাধ্যমের অস্তিত্ব নিয়ে টানাপোড়েন চলে, সেখানে সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে যে দরকষাকষি চলবে না, সেটাই ত আশ্চর্যের।
তবুও আশাবাদী হই, আজও এ দেশে দিনান্তের গড্ডালিকা প্রবাহ পেরিয়ে কিছু কিছু উন্মুক্ত স্বর গণমাধ্যমের আব্রু রক্ষা করে। তাদের একরোখা আপসহীনতা মিডিয়া যা কিনা ক্রমশ ‘অধমে’ পরিণত, তাকে ‘উত্তম’-মাধ্যমে পর্যবসিত করার হিম্মত রাখে। তাদের কাছে শাসকের রক্তচক্ষু বা প্রলোভন বা আক্রমণ নয়, সংবিধানই শেষ কথা বলে। অন্ধকার, ক্লেদজ বাজার রাজনীতি বা মুনাফাবাদী অন্ধত্ব থেকে দূরে কলম বা নির্মোক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়াই তাদের লক্ষ্য। এই ‘চ্যালেঞ্জ’, এই মুক্তমনা মাথাঝাড়া আজও এই ১৩০ কোটি দেশের মানুষকে গণমাধ্যমের উপর আস্থা তথা বিশ্বাস রাখতে শেখায়। ঘরে বাইরে তুমুল বিতর্ক আক্রমণ জীবিকাহীনতার কালোছায়া উপেক্ষা করেই চলতে থাকে মানুষের স্বার্থে, খবর ও তথ্য তথা সত্যের স্বার্থে আপসহীন সংগ্রাম। মজার ব্যাপার, সেই খবর প্রকাশিত হয় না কোনও পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যমে। কারণ সেই লড়াই নিজের আদর্শের লড়াই। তাই ‘বেছে’ নিতে হয়। ক্লীবতা নাকি চোখে চোখ রাখা, হেটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ নাকি ভেঙে পড়তে পড়তে শাসক বা স্বৈরতন্ত্রের চোখে চোখ রেখে বলতে শেখা— ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’ আর এখানেই, এভাবেই প্রতিনিয়ত অনেকটা হারতে হারতে ‘একটু’ হলেও জিতে যাওয়া। রবীশ কুমারের ভাষাতেই বলতে হয়—
Truth be told, if you say you are not an objector, you are ranged against democracy. If you have a different point of view, say you are a dissenter. Post ten things on Facebook daily and say openly, ‘Yes, I have a difference of opinion.’ Being an objector is no crime.
প্রতিবাদ করলেই তা বিরুদ্ধাচারণ হয়না। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে মিডিয়ার ধর্ম নিরূপণে বারবার যেন এই মন্ত্রই ধ্বনিত হয়। সত্যকথন ও আপসহীনতাই সেখানে শেষ সম্বল। তাই রাষ্ট্র যতই সেখানে সংবাদমাধ্যমকে কোনঠাসা করুক না কেন, শক্ত হাতে কলম ধরে ঘুরে দাঁড়ানোই মিডিয়ার ভূমিকা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। জানি, দিনান্তে কোথাও না কোথাও আমরা সব সরলরৈখিকতা ও সরলীকরণে বিশ্বাসী। একজন সাংবাদিক না চাইতেও তাকে তার অন্তর্ভুক্ত হতে হয়। তার লেখা নিয়েও চলে কাঁটাছেড়া, মালিকগোষ্ঠীর মন ও সুবিধে মাফিক। সেখানে দুয়ে দুয়ে চার নয়, পাঁচ এমন সাপের সাত পা দেখাও আশ্চর্যের নয়। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে তবে মিডিয়ার ভূমিকা কি শুধুই উপরমহলের উপরেই ন্যস্ত? কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাই জরুরি পদাপসরণ। কিন্তু তা কোনও কলমচির ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারে না। পারে না তার স্বাধীনচেতা ও উন্মুখতা রুখে দিতে। কারণ তার সেই অধিকার সংবিধান স্বীকৃত। তাই দেশজুড়ে ঘটে চলা একের পর এক কৃষক আত্মহত্যা, জীবিকাহীনতা বা আর্থিক পরিকাঠামোর রুগ্ন, হতশ্রী রূপের কারণ জানতে সরকারের সামনে একঘেয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। ঠিক যেমন ততটাই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জম্মু কাশ্মির নিয়ে সরব হওয়া বা শাসক দলের একাধিক ভ্রান্ত অজুহাত ও প্রতিশ্রুতিকে তার সাধ্যমত জনতার দরবারে পৌছে দেয়া।
দিনের শেষে, একটাই কথা উঠে আসে সেটা হল, সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলার যে ঐতিহ্য সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, তা বহাল রাখতে কিন্তু উদ্যোগী হতে হবে আমাদেরই। শাসক দলের আগ্রাসন অপেক্ষা সেখানে উঠে আসবে ১৩০ কোটির দৈনন্দিন সংগ্রামের ইতিকথা। বর্তমান ভারতে মিডিয়ার গুরুত্ব তখনই স্বমহিমায় বিরাজমান হবে। দিনের শেষে এইটুকু আশাই হোক দেশীয় গণমাধ্যমের পাথেয়।