শুভাশিস মৈত্র
প্রথমে যে কথাটা বলে শুরু করতে চাই, সেটা হল, এই প্রতিবেদনটি গৌরী লঙ্কেশের স্মৃতিতে নিবেদিত। উদ্দেশ্য খুব সামান্য। নামটা আরও একবার বলা। যাতে ভুলে না যাই।
সংবাদপত্র বা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে রাজনীতির, বিশেষ করে শাসকদলের রাজনীতির একটা প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকে। সেটাই স্বাভাবিক। যদিও ক্ষমতার বিচারে ক্ষমতার রাজনীতি সংবাদমাধ্যমের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। উভয়ই উভয়কে ব্যবহার বা প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। সেই যুদ্ধে, অন্তত এই মুহূর্তে, মনে হচ্ছে আমাদের দেশে সংবাদমাধ্যম অনেকটাই পরাজিত। এটা সাময়িক না দীর্ঘস্থায়ী তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। যাঁদের এক সময়ে নিচু হতে বলায় হামাগুড়ি দিতে দেখা গিয়েছিল, তাঁদের অনেকে এখন বলছেন, হামাগুড়িটাই তো আসলে হাঁটা। মানুষ দাঁড়াতে শিখেছিল বলেই মেরুদণ্ড সোজা হয়েছিল, এসব কথা এখন জোরে জোরে বলা বারণ।
সাংবাদিক, সাংবাদিকতা এবং মালিক বা মালিক-সম্পাদক, এই সবগুলো এক নয়। সাংবাদিকদের বড় অংশ এখনও তাঁদের পেশায় আগের মতোই আন্তরিক। কিন্তু তাদের সামনে যে বাধাগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, সেই বাধাগুলোর উপর সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণ প্রায় নেই। এখনও সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে সমান ঝক্কির সামনে পড়েন একজন সাংবাদিক, যেমন আগেও পড়তেন। একটু পুরনো কথা বলে নেওয়া ভালো। ১৯৫৩ সালের ২২ জুলাই কলকাতা ময়দানে কয়েক জন সাংবাদিককে কয়েক জন সাদা পোশাকের পুলিশ মারধর করে। আবার দেখা যাচ্ছে প্রায় একই রকমের ঘটনা, ১৯৬৫ সালে। বামপন্থীদের ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলন কভার করতে গিয়ে বেশ কয়েক জন সাংবাদিক পুলিশের লাঠিতে আহত হন। তখন রাজ্য সরকার বিচারপতি পি বি মুখার্জির নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল। কমিশনের সেই রিপোর্টে বিচারপতি বলেছিলেন, ১৯৫৩ এবং ১৯৬৫, দুটি ঘটনাতেই সাংবাদিকরাই দোষী। পুলিশ নির্দোষ। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরে বহু সাংবাদিক বিভিন্ন সময়ে আক্রান্ত হয়েছে। কখনও পুলিশের হাতে, কখনও ক্যাডারদের হাতে। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের এবং পার্টির বক্তব্য ছিল, সাংবাদিকরাই দোষী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় এর কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহুবার অভিযোগ করেছেন, সংবাদপত্র তাঁর বিরুদ্ধে লিখছে। বাস্তব কথা হল, কোনও রকম সমালোচনা, অস্বস্তিকর প্রশ্নের জবাব এই সময়ে সাংবাদিকরা পান না। প্রশ্ন করার সুযোগ আগের থেকে অনেক কমেছে। বিধান রায়কেও খুব একটা প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল না বলে শুনেছি। তবে তিনি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগও করতেন না। সাংবাদিক শঙ্কর ঘোষ আঁর ‘হস্তান্তর’ বইয়ে এই নিয়ে দু-একটি ঘটনার উল্লেখও করেছেন। জ্যোতি বসুকে মহাকরণে লিফটের সামনে আমরা নিয়মিত যে কোনও ধরনের প্রশ্ন করে এসেছি। এবং জ্যোতিবাবু দাঁড়িয়ে সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে লিফটে উঠতেন। আরও একটা ব্যাপার ছিল, জ্যোতিবাবু বাড়িতে থাকলে প্রায়ই নিজে ফোন ধরতেন। প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হলে তার জবাবও দিতেন। সেই রিপোর্টার কোনও ছোট কাগজের না বড় কাগজের সেটা দেখে উত্তর দিতেন না। সংবাদপত্রের মালিক বা সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করে পরিস্থিতি ম্যানেজ করার ঘটনা বিধান রায়ের সময়ও ঘটত। বিভিন্ন সাংবাদিকের লেখায় এমন তথ্য পাওয়া যায়। সিপিএমের জমানায় একটা জিনিস শুরু হল, সংবাদমাধ্যমের মালিক বা সম্পাদকের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ করে সাংবাদিকের হাত বেঁধে দেওয়া। এই কাজে জ্যোতি বসুর কোনও ভূমিকা ছিল না। এটা করতেন দলের কয়েক জন প্রভাবশালী নেতা। সেই সঙ্গে আর একটা কথাও অবশ্যই বলা উচিত, বিক্রি বাড়াতে প্রধান শাসকদল সিপিএমের সম্পর্কে বানানো খবরও যে কোনও কোনও কাগজে মাঝেমধ্যেই লেখা হত, সেটাও ঠিক। জ্যোতিবাবুর পুত্রের দুর্নীতি নিয়ে একসময় যারা লক্ষ লক্ষ শব্দ খরচ করেছেন, আজ কিন্তু তারা আর ওই বিষয়ে একটি কথাও বলেন না। বা বউবাজার বিষ্ফোরণে গ্রেফতার হওয়া রশিদের পুলিশের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তি প্রকাশিত হয়ে গেল সিপিএমের এক বন্ধু কাগজে। সেই রিপোর্টে বেশ কয়েক জন কংগ্রেস নেতা এবং সিপিএম সহ বাম শীর্ষনেতাদের নাম ছিল। যদিও পুলিশের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তির আদালতে কোনও মূল্য নেই, তবু খবর হিসেবে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেখা গেল সিপিএমের ওই বন্ধু কাগজ ওই পুলিশ রিপোর্টে উল্লেখিত রশিদবন্ধু কয়েক জন কংগ্রেস নেতাদের নাম ছাপল, এক ছোটখাটো বাম নেত্রীর নামও প্রকাশ করল, কিন্তু সর্বোচ্চ নেতৃত্বকে টাকা দেওয়ার কথাগুলো চেপে গেল। অতীতেও এমন ঘটনা ঘটত। তার বেশ কয়েকটি উদ্বেগজনক তথ্য আমরা পেয়েছি শঙ্কর ঘোষের বইয়ে। কিন্তু এটা ছিল সাংবাদিকতার একটা ছোট দিক। সবটা তো নয়ই, বেশিরভাগটাও নয়। যে পরিবেশটা বাম আমলে বদলাতে শুরু করেছিল, মমতা বন্দ্যোপাথ্যায়ের আমলে তা খোলামেলা হয়ে গেল। প্রকাশ্যে চলে এল। এই রাজ্যে। আর গোটা দেশের ছবিটা আরও লজ্জাজনক। সেখানে, একটা ছোট অংশ বাদে বাকিরা সব কেন্দ্রের ভক্ত-সংবাদমাধ্যম। এমন আগে কখনও ঘটেনি। টেলিগ্রাফ, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বা হিন্দুর মতো কাগজ বা প্রণয় রায়ের চ্যানেল এনডিটিভি, ব্যক্তি হিসেবে রবীশ কুমার বা বিনোদ দুয়ারা ব্যতিক্রম। এমনই ব্যতিক্রম দ্য ওয়্যার-এর মতো কয়েকটি ওয়েবসাইট। জরুরি অবস্থায় একটা সাংবিধানিক আড়াল ছিল, এখানে তার কোনও দরকারই হয়নি। অপছন্দের সাংবাদিকের চাকরি যাওয়ার ঘটনা সারা দেশে এই সময়ে এতটাই ঘটেছে, যার কোনও নজির নেই অতীতে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যত দিন বিরোধী নেত্রী ছিলেন, সাংবাদিকদের ‘বন্ধু’ ছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে, কয়েক জন পছন্দের সাংবাদিকের কথা বাদ দিলে, তিনি কার্যত সাংবাদিকদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। বাম জমানায় যে কোনও সভায় জ্যোতি বসু নিয়ম করে তাঁর বক্তৃতায় সাংবাদিকদের গালমন্দ করতেন। তখন বেজায় হাততালিও পড়ত। তার পর আবার সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠতেন, ওদের বলে কী হবে, ওরা তো চাকরি করেন। তবে জ্যোতিবাবুর কাছে পছন্দের সাংবাদিক, অপছন্দের সাংবাদিক বলে কিছু ছিল না। প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হলে তিনি কথা বলতেন। পছন্দের সাংবাদিকের কোটারি চালু হল বুদ্ধদেববাবুর আমল থেকে। যার চূড়ান্ত রূপ আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি। বুদ্ধদেববাবু পুলিশমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই, সংবাদমাধ্যমের মালিক এবং সম্পাদকদের বড় অংশের সঙ্গে ছিল তাঁর ‘বন্ধুত্ব’। বুদ্ধজীবী শব্দের জন্ম ওই সময়ে। ওই ধরনের সরকারি বুদ্ধিজীবী বাহিনী অবশ্য এখনও আছে। এখন আরও প্রকাশ্যে। যাই হোক, সেই বুদ্ধবাবুর জমানায় অনেক খবর সেই সময় সাংবাদিকরা লিখতে পারতেন না। লিখলেও হয় বেরোত না, বা এমন জায়গায় ছাপা হত, চোখেই পড়ত না। আমরা বলতাম কুঁচকিতে ছাপা হয়েছে। বুদ্ধবাবু এমনিতে ছিলেন বেশ প্রচারবিমুখ, সৎ মানুষ। লেখাপড়া, সিনেমা এই সব নিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন। তিনি যে নিজে উদ্যোগী হয়ে মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিলেন তেমন নয় ঘটনা। কিন্তু কিছু মালিক, সম্পাদক আগবাড়িয়ে দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু সংক্রান্ত খবর নিয়ন্ত্রণে। বুদ্ধবাবু সেটা বুঝতেন, নিশ্চয়ই উপভোগও করতেন। এই স্তাবকতাই বুদ্ধবাবুকে বুঝতে দেয়নি, পায়ের তলায় মাটি নেই। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরই অনেকে আবার বর্তমান শাসকদলের নেতা-নেত্রীদের জন্য একই সার্ভিস দিয়ে চলেছেন। ফলে সেই সব প্রতিষ্ঠানের কর্মী সাংবাদিকদের ঢেকে-ঢুকে খবর লিখতে হয়। আমাদের পেশায় এই সমস্যা বাড়ছে। বেড়েই চলেছে। যা জানি, বুঝি তা লিখতে না-পারা।
তবে এটা ঠিক, কাগজের অবস্থান যা-ই হোক, সিপিএমের অনেক নেতার সঙ্গেই সাংবাদিকদের একটা কাজ চালানো গোছের সম্পর্ক ছিল। এটা হয়তো ছিল সিপিএমের রাজনৈতিক কৌশল, কিন্তু মানতেই হবে ভাল কৌশল। দু-একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। সম্ভবত সেটা ২০০ সাল, আমরা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএম অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে অনিল বিশ্বাসের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎ মমতা সম্পর্কে অনিল বিশ্বাস বলে বসলেন, ‘উনি তো যমেরও অরুচি।’ আমরা চুপ। তার পর তিনি কথা ঘুরিয়ে দিলেন। যেহেতু আড্ডায় বলেছেন, আমরা কেউ সেটা আর লিখিনি। কিন্তু একটি কাগজ লিখে দিল। তাই নিয়ে হই হই। আমি তখন সবে টেলিভিশনে এসেছি। দুপুরে অনিল বিশ্বাসের ফোন। আমাকে অনুরোধ করলেন, ক্যামেরা নিয়ে যেতে, কিছু বলতে চান। গেলাম ক্যামেরা নিয়ে, ক্যামেরার সামনে মমতার কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন। সেই খবর টেলিকাস্টও হয়েছিল। তখনও প্রতিটি নির্বাচনেই নিয়ম করে মারধর করা হত সাংবাদিকদের। বিশেষ করে কেউ যদি ছাপ্পা ভোট বা ভোট কারচুপির খবর করার, বা ছবি তোলার চেষ্টা করত। ১৯৯০ সালে প্রথম আমরা দেখলাম কলকাতা পুরসভার ভোটে গুলি বন্দুক বোমার দাপট। সেই ছবি কাগজে বেরোল। জ্যোতি বসুর কাছে আমরা যখন এই নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলাম, তিনি বললেন ওসব সাংবাদিকদের সাজানো ছবি। সেই সময়ও বাংলা সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা ছিল খুবই যথাযথ।
সৌগত রায় যত দিন কংগ্রেসে ছিলেন, প্রতি বছর বিধানসভায় একটি প্রশ্ন করতেন। প্রশ্নটা হল, বামফ্রন্ট সরকার কোন কাগজকে কত টাকার বিজ্ঞাপন দিয়েছে। প্রতি বছরই বাম সরকারের উত্তরটা ছিল এক। উত্তরে প্রতি বছরই দেখা যেত, সার্কুলেশন বেশি হওয়া সত্ত্বেও সরকারের কঠোর সমালোচক একটি কাগজ কম বিজ্ঞাপন পাচ্ছে। আর সরকারের সমালোচনা করে না এমন কাগজগুলি তুলনায় বেশি বিজ্ঞাপন পাচ্ছে। বেশি বিজ্ঞাপন পাচ্ছে দলের মুখপত্রও। আগে সমালোচক কাগজ কম বিজ্ঞাপন পেত। এখন সমালোচনা করলে বিজ্ঞাপন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। শিল্পে মন্দা-আক্রান্ত পশ্চিমবঙ্গে মোট বিজ্ঞাপনের বাজার টাকার অঙ্কে খুবই ছোট। সেখানে সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিলে কাগজ বেশ সঙ্কটে পড়ে। এটা একটা অন্যতম পথ সংবাদমাধ্যমকে বশ মানানোর।
পুরনো কিছু জরুরি কথায় ফিরে যাই। আমার প্রায় চল্লিশ বছরের সাংবাদিক জীবনে ১৩-১৪টি সংবাদ প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। যখন বোফোর্স ইস্যুকে সামনে এনে ভি পি সিং সরকার হল দিল্লিতে তখনকার একটা কথা বলি। আমি তখন যে দৈনিকে কাজ করি তারা ভিপি সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক। এই সময়ে একটা খবর পেলাম। খবরটা হল এই। ভারত যুগস্লাভিয়াকে কামানের যন্ত্রাংশ বিক্রি করবে। এই ব্যবসায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রাষ্ট্রীয় সংস্থা এইচএমটি ২ শতাংশ কমিশন নেবে। ভিপি সিংরা এত দিন বলছিলেন, ভারতে যা নিয়মকানুন, তাতে কোনও রকম কমিশন দেওয়াই বেআইনি। তাহলে কী করে এইচএমটি কমিশন নেবে? অর্ডন্যান্স ফ্যাকটরি বোর্ডের চেয়ারম্যানের প্রতিক্রিয়া সহ কপি ফাইল করলাম। সেদিনটা আমার নাইট ডিউটি ছিল। দেখলাম আট কলম লিড হচ্ছে প্রথম পাতায়। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে, রাত তখন ১১টা হবে। ঘণ্টাখানেক পরে দেখলাম কপিটা তুলে নেওয়া হল। প্রশ্ন করে জানতে পারলাম, সম্পাদকের নির্দেশেই এটা করা হয়েছে। মন খারাপ হয়ে গেল একটা ন্যাশনাল এক্সক্লুসিভের এই হাল দেখে। বিস্ময়ের তখনও বাকি ছিল। পরের দিন লেখাটা বেরোল সান্ধ্য দৈনিকের ৩-এর পাতায়। যেখানে সিনেমার খবর লেখা হয়। সেদিনের সেই সান্ধ্য পত্রিকার কপি এখনও আমি স্মারক হিসেবে রেখে দিয়েছি। আমাদের কীরকম সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয় এটা তার একটা দৃষ্টান্ত। সব সাংবাদিকের জীবনেই এমন একাধিক গল্প রয়েছে।
এই কথাগুলো বলছি এটাই বোঝাতে যে, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা খুবই আংশিক। আমরা যেটা পারি সেটা হল, মিথ্যা কথা না লেখা। কিন্তু সব সত্যি কথা লেখার সুযোগ আমাদের নেই। মালিকরা নানা কারণে, ব্যবসার স্বার্থে, ক্ষমতার সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলেন। তার বিরোধিতা করার কোনও সুযোগ সাংবাদিকদের থাকে না। তাহলে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। দু-এক জন সাংবাদিককে জানি, এই নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে সারা জীবনের জন্য লেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মাইনে পেতেন কিন্তু কাজ নেই। কাজ নেই মানে লেখার অনুমতি নেই। এসব পুরনো ঘটনা। তখন কথা কথায় চাকরি যেত না সাংবাদিকদের। এখন এমন ঘটে না, কারণ সাংবাদিক তাড়ানো এখন ঠিকে ঝি তাড়ানোর থেকেও সহজ। আঞ্চলিক সংবাদমাধ্যম, যাদের বাজার খুব ছোট, তারা নানাভাবে সরকারের উপর নির্ভরশীল থাকতে বাধ্য। এই বাধ্যবাধকতা অনেকটাই স্বাধীনতার বিনিময়ে মেনে নিতে হচ্ছে। আগে পশ্চিমবঙ্গেও সাংবাদিকদের ইউনিয়ন ছিল। তাদের কিছু ভূমিকাও ছিল। কিন্তু ক্রমে পরিস্থিতি বদলে যায়। এখন যে কোনও মুহূর্তে যে কোনও সাংবাদিকের চাকরি চলে যেতে পারে। এবং যাচ্ছেও। এইরকম অবস্থায় স্বাধীনতার চর্চা তাদের কাছ থেকে কতটুকু আশা করা যায়! গত তিন চার বছরে চাকরি খুইয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে এমন সাংবাদিকের সংখ্যাটা কত? কারও মতে অন্তত ৩০০, কারও মতে আরও বেশি।
সাংবাদিকের কাজ পাঠক বা সরকারকে খুশি করা নয়। বাংলা সাংবাদিকতায় আমরা তো হরিনাথ মজুমদারের উত্তরসূরি। কৃষকদের পক্ষ নিয়ে লেখার জন্য যাঁকে মারতে লেঠেল পাঠিয়েছিল ঠাকুরবাড়ি, যে লেঠেলের দল গরিবের বন্ধু সংবাদিককে না মেরে, শুধু খবরটা জানিয়ে ফিরে গিয়েছিল। তবে মামলা করে হরিনাথের কাগজ গ্রামবার্তা প্রকাশিকা অনেকবারই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কাগজ এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলার এই কৌশল অবশ্য আজও চালু আছে। অনেক বছর আগে, বয়স তখন খুবই কম, রাজ্যের বাইরে একটা খবর করতে গিয়ে এক স্থানীয় নেতার সাহায্য নিয়েছিলাম। পরে দেখলাম, খবরটা লিখলে ওই নেতারই বিরুদ্ধে যাবে। দোটানায় পড়ে গেলাম। তখন এক বর্ষীয়ান সাংবাদিক বলেছিলেন, যদি সাংবাদিক হতে চাও তো ‘অকৃতজ্ঞ’ হতে শেখ। না হলে কোনও দিনই সাংবাদিক হতে পারবে না। কিন্তু অকৃতজ্ঞ হওয়ার ঝুঁকি অনেক।
খবরের কাগজ এবং টেলিভিশনের পর কয়েক বছর ওয়েবমিডিয়ায় কাজ করেছি। এখানে তুলনায় স্বাধীনতা এখনও বেশি, কিন্তু এর কোনও বিজ্ঞাপনের মডেল আজও তৈরি হল না। কবে হবে জানি না। তবে, একটা ভাল লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বহু ওয়েবমিডিয়া পাঠকের কাছে আবেদন জানাচ্ছে, লেখা পড়ে ভাল লাগলে দান করুন। ১০, ২৫, ১০০, ৫০০টাকা সহ নানা অপশন রাখা হচ্ছে ‘ডোনেশনের’ জন্য। বলা হচ্ছে সৎ, নির্ভীক সাংবাদিকদের লেখা পড়তে হলে পাশে দাঁড়ান। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, পাঠকরা অর্থ সাহায্য করছেন। ভালই করছেন। এই নতুন ‘ফান্ডিং মডেল’ খুবই আশা জাগায়। বাংলায় অনেকগুলি ওয়েব হয়েছে, বেশ ভাল কাজও হচ্ছে তার কয়েকটিতে। আশা করি তাঁরাও ভবিষ্যতে এই ধরনের ফান্ডিং-এর সুযোগ নেবেন। বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান তো থাকবেই। তার পাশাপাশি এমন নতুন নতুন পথ খুঁজে বের করতে না পারলে ল্যাপটপের কি-বোর্ডের তেল-তেলে ভাব সহজে যাবে না।