সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা
আমিত্বের দিনে
একটি পালক কতদূর নির্ভার বলে তুমি ভাবো?
কবিতা লেখার যন্ত্রণা আসলে কী?
স্বপ্নের ভিতরে কেন চেপে ধরতে চাও
তরোয়ালের ভাঙা হাতল?
রক্ত ঠিক কীভাবে চারিয়ে যায় লতায়-পাতায়?
ব্লেড হাতে বারবার কেন তুমি নিজেকে বুঝিয়ে চলো
আত্মহত্যা মহাপাপ?
গুটিয়ে থাকা একটা কেন্নো তুমি
চিন্তা-ভাবনার এক বিধ্বস্ত কুয়ো
আমিত্বের দিনে মূল্যবোধ মানে হচ্ছে
আলতো টোকায় সবকিছু ঝেড়ে ফেলা, জেগে ঘুমোনো
তাহলে কেন তুমি ভাবছ
তোমার একলা হয়ে যাওয়া মায়ের কথা?
বিশেষত তোমার বউ যখন তা পছন্দ করছে না।
ঘুণপোকা
একজন কয়লাকাটা মানুষের পাশে বসে কথা বলছি
কথা বলছি নৌ-বাহিনীর রং-রুটের সঙ্গে
ট্রেনের জানালায় মুখ রেখে শুনতে পাচ্ছি অন্ধ ভিখারির গান
আমার চোখের সামনে অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ল বখে যাওয়া ছেলে
ইয়ার্কি-বাজ মহল্লার হো-হো হাসি আমাকে ছুঁয়ে পাথর হয়ে যাচ্ছে
গল্পগ্রন্থের পাতায় আমি আমার মুখ গুঁজে রেখেছি
মাখিয়ে নিয়েছি ঈশ্বরের গুঁড়ো গুঁড়ো ভাব আমার মাথায়
আমি একই সঙ্গে লোভী আর সাধু, স্বার্থপর আর দাতা কর্ণ
জ্যোতিষচর্চার পাশাপাশি অমলিন আমার নক্ষত্র জিজ্ঞাসা
ছোটলোকের ছেলে বলে আমার দারুণ অহঙ্কার
যে কোনওভাবে বড়লোক হতে চাই বলে আমার কি লজ্জা
আমার আমি ও না-আমির মধ্যে এক করুণ টানাপোড়েন
একটি ঘুণপোকার হাতে আমি নিজেকে ছেড়ে দিতে চাই
কিন্তু কোথায় সেই ঘুণপোকা?
জন্ম
আমি মদ খাই বলে সবার খুব অসন্তোষ
ব্যক্তিগত মৈথুন ছাড়া
আজ পর্যন্ত আমি আর কিছুই লিখিনি বলে
কি ঘেন্না, কি ঘেন্না
ঘেন্নার নদীতে আমি সাঁতার কাটছি
ঘেন্না খাচ্ছি, শুয়ে পড়ছি ঘেন্নার ভিতরে
ঘেন্নার তুলিতে আঁকছি ভড়ং-এর ছবি
আপনাদের এই পরিত্যক্ত ঘেন্নাভূমিতে
আমাকে রোজ জন্ম দিচ্ছে
আমার মা
নতুন করে
ডান হাত
বাঁ হাতের কথা জানে
আরেকজন বাঁ হাত
শুধু তাদের আঁতাত ভেঙে দেওয়ার জন্য
একটি ডান হাতের প্রয়োজন হয় বলে
পোড়া ঘর আকাশের রঙ সিঁদুরে রাঙিয়ে দেয়
বারবার…
আমি এমনভাবে হেঁটে যাচ্ছি
যে কোনও মোড়েই থাকতে পারে
অথচ আমি এমনভাবে হেঁটে যাচ্ছি
যেন আমার সামনে কোনও ভয় নেই
পিছনে নেই কোনও অন্ধকার
ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব ইচ্ছের মধ্যে
আমার ঘরবাড়ি, চাহিদা-যোগানের
ভারসাম্য-ভাঙচুর, ইত্যাদি… ইত্যাদি
অথচ আমাকে দেখে বোঝাই যাবে না।
কোথায় কতটুকু শীত আছে, আগুনই বা কতটুকু
যে কোনও তুলকালাম কাণ্ড যে কোনও দিন
বেঁধে যেতে পারে— গেরস্তের শান্ত বউ যদি
হঠাৎ স্বৈরিণী হয়ে ওঠে কিংবা ওয়াগন ভেঙে
ভেঙে পোক্ত ছেলেটি কাটা দেহে শুয়ে থাকে
রেললাইনের ধারে; তুমি, আমি কি-ই বা বলতে পারি
শুধু কিছু আনাগোনা, পরিচয় নিয়ে দলাদলি ছাড়া
অন্য কোনও হেলদোল থাকে না কোথাও, না থাকারই তো কথা
কেন না অভাবী পেট উপোস মানে না
তবু যে কোনও সময় সহ্যের বাঁধ ভেঙে যেতে পারে
ভেবে আপাত বৈরাগ্যের নামাবলী চাপিয়েছি গায়ে
তাই আমাকে দেখে বোঝাও যাবে না
আপাতত সাধু ও সরল সেজে আছি।
আমিষপ্রধান চুল্লির পাশ থেকে
তুমি এখন কোথায়?
হাঁসের গলা মুচড়ে, ডানা দুমড়ে কারা যেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাস্তা৷ ফোঁটা ফোঁটা রক্তে ও কান্নায় ভরে উঠেছে আমাদের বাতাস, ভেসে যাচ্ছে নদীর দিকে, আর নদীও পাথর হয়ে উঠছে খুব— কী বধিরই না আমাদের কান!
শহরের নির্জনতর বারান্দা আর গলিপথও আজ ভরে গেছে রক্ত ভেজা পালকে। সেই পালক দুপায়ে মাড়াতে মাড়াতে ফিরে আসছি ঘরে— আমিষপ্রধান চুল্লির ওমকে ঘিরেই আমাদের যাবতীয় আহ্লাদ।
তুমি কোথায়, গৌতম, কোন উদ্যানে?
একদল ছাই রঙের হাঁস খুঁজে বেড়াচ্ছে তোমাকে…
নুন
নুনের গল্প তো কখনও ফুরোবার নয়, অরুণাভ। তোর মনে আছে সেই রাত্তিরে, শীতে হি-হি করে কাঁপতে কাঁপতে, ভাঁড়ার থেকে চুরি করেছিলাম নুন; আলুপোড়ার সঙ্গে জমে ভালো। তার কদিন পরেই ইতিহাসের ক্লাসে ডান্ডি অভিযান মনে পড়ছে অরুণাভ— সমুদ্রের জল থেকে যে নুন হয় এই জ্ঞান সেই তো প্রথম। তারপর থেকেই মায়ের নজর এড়িয়ে নুন চুরি করতে যাওয়ার সময় কেমন গান্ধি গান্ধি বলে মনে হত নিজেদের। একদিন ধরা পড়ে বাবার হাতের কানমলা৷ গরীবের হাতে এত জোর আসে কী করে আজও তা বুঝে উঠিনি সম্যকভাবে। তবে নুনও যে অর্থনীতির বিষয় সে কথা বুঝেছি আরও পরে। এখন আমি রোজ নেমে যাই কয়লা-খাদে, কয়লা কাটি যতক্ষণ পর্যন্ত না শরীরে ঘাম জমতে জমতে নুন ফুটে ওঠে— অরুণাভ, সেই নুন দিয়ে আলুপোড়া কখনও খাওয়া হয়নি আমার। তবু বাজার থেকে কিনে আনতেই হয় আয়োডিন ভরা নুন আর সেই নুন খেয়ে আমার ছেলে তার বাবাকে ‘ড্যাড’ বলে ডাকে।
জাদু বৃত্তান্ত
হ্যাঁ, আমার কোনও জাদুকাঠি নেই। থাকলেই বা কী এসে যেত। আমি তো আর জাদুগর নই। যদিও বেশ কিছু জাদুগরের খেলা আমাকে রোজই দেখতে শুনতে হয়। দেখতে দেখতে এক সময় মনে হয়, হ্যাঁ, আমিও পারি। কিন্তু বদলে দেবার খেলাটা তো আসলে জাদু নয়। তাই জাদুগরেরা সব সময়েই কোনও না কোনও আরও বড় জাদুগরের অধীনেই থেকে যায় সারা জীবন। কিন্তু সেইসব বড় বড় জাদুগরেরও বড় জাদুগর নিশ্চয়ই আছেন, তিনিই এই বাণিজ্য সবচাইতে ভালো বোঝেন৷ আর বোঝেন বলেই একহাতে যখন জাদু বিলোন, চকচকে সব জাদু, অন্যহাতে তখন কুচিকুচি করেন আমাদের। ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেন হাওয়ায়। উড়তে উড়তেও হাততালি দিয়ে উঠি আমরা, লিখে ফেলি গাদাগুচ্ছের সচিত্র হানিমুন, ভ্রমণ ইত্যাদি ব্যক্তিগত— এও সেই জাদুরই জের যার জোরে অন্ধকার ভারতবর্ষ আরও অন্ধকার করে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় আরও একটি লছমনটোলা বাথে— এলোমেলো হিম, বন্দুকের শব্দ, সকালের খবর— ব্রেকফাস্টের মাখনের মতো নিরুপদ্রব, মোলায়েম আর জাদুচ্ছন্ন হাতে তখনও আমরা লিখে চলি সতত সফল জাদু কবিতা।
সত্য সম্পর্কে
ধরুন, আপনার নষ্ট করার মত প্রচুর খাবার আছে, আপনি নিশ্চয় রুটি নিয়ে ভাববেন না। ধরুন, কাপড় ও ঘরের অভাব যখন নেই তখন আপনি কেন ওসব নিয়ে চিন্তিত হতে যাবেন? ধরুন চুমু খাওয়ার জন্য মেয়েছেলের অভাবও আপনার নেই, চুমু খাওয়াটা আপনার কাছে একঘেয়ে হয়ে উঠতেই পারে৷ তাহলে, আপনি এখন কী নিয়ে ভাববেন? ধরুন, আপনি মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে ভাবতে পারেন, প্লেটোনিক লাভ অথবা বিশুদ্ধ কবিতার কথা ভাবতে পারেন, অথবা বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠবার তাগিদে স্টক-এক্সচেঞ্জের হালফিলের খবর নিয়ে মাতামাতিও করতে পারেন কিংবা অভিরুচি অনুযায়ী স্রেফ খেয়ে, ঘুমিয়ে, গায়ে-গতরে গত্তি লাগিয়ে ঘুরেও বেড়াতে পারেন। কিন্তু ধরুন যাকে রুটির জন্য রোজ মাথা নীচু করতে হয়, মাথা গুঁজবার ঠাঁই যার নেই, যাকে পোকায় কাটা জীবন বয়ে বেড়াতে হয় কী করে তার বাকচর্চা আপনার বাকচর্চার সঙ্গে মিলতে পারে? আসলে অবস্থানই ঠিক করে দেয় কে কীভাবে জীবনকে দেখবে৷ তাই আপনি যখন বিশ্ব দেশ ও বিশুদ্ধতার খোঁজে বেরোবেন তখনও আমাদের এই লোকটি রোটি কাপড়া আউর মকানের জন্যই নিজেকে ক্ষইয়ে ফেলবে৷ হ্যাঁ, আমরা সবাই সবসময়েই নিজের সুবিধামতই চিরন্তন সত্যের কথা বলে চলেছি।
রাগী যুবকের অভিমানী স্বর— সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা
কুন্তল মুখোপাধ্যায়
সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়। জন্ম ১৯৬৮। পেশায় কয়লা অঞ্চলের কারিগরি কর্মী। নয়ের দশক। কিন্তু নয়ের দশক বলতে এখনও যাঁদের চেনা যায়, বা যেসব নাম এখনও এসে যায় প্রবন্ধে প্রবন্ধে বা আলোচনায় তাদের তালিকায় কখনও এই নামটি দেখা যায় না। যায়নি আজ পর্যন্ত। তার অনেক কারণ। সে যাই হোক। তবে সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়ও কবিতা লিখেছিলেন। এবং সেইসব কবিতা পড়লে বাংলা কবিতার আদিগন্ত পাঠকের অপকার কিছু হবে না। বরং অসাধারণ এক কবিতার জগতে প্রবেশ করা যাবে।
ফরসা টলটলে এক বিষণ্ণ যুবক যেন সুপ্রিয়-র কবিতা। বিষাদে আচ্ছন্ন। কখনও রাগী। আর কোনও কোনও চেহারায় রাগ যেমন মানায় না, সুপ্রিয়র কবিতা তেমনই এক ব্যক্তিত্ত্ব নিয়ে আমাদের সামনে এসে যায়। সে ক্রুদ্ধ হয়, অপশব্দ ব্যবহার করে, কিন্তু সেইসব শব্দ তাঁর কবিতাব্যক্তিত্বে বড়ই বেমানান। অভিমানভরা এক যুবকের ভালোবাসার, আড়ালে কেঁদে ফেলার কষ্ট নিয়ে আসে সুপ্রিয়র কবিতা।
গল্প বলে কি? আজকাল গল্প বলে কবিতা লেখা অন্যতম ঝোঁক, অন্যদিকে বিমূর্তের ঝোঁকও আছে সাম্প্রতিক কবিতায়। কিন্তু সমরেখপনায় কি লেখা কখনও অতিতরল হয়ে যাচ্ছে না? অথবা বিমূর্ত লেখাগুলো কি মনে হচ্ছে না অতিদূরের? আরও ভাবলে দেখি যে গল্পের বাইরে কিছুই নয়, এমনকী জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতাও তো গল্পই বলে একখানা। তবে অতিআত্মজৈবনিক কবিতা ক্রমশ নিজেকে প্রাধান্য দিতে দিতে প্রাসঙ্গকিতা হারায়। তাহলে এইসব কিছু রেখেও তাকে অতিক্রম করে যায় না? তা যে যায়, গল্প বলার মাধ্যমে কিছুটা এগিয়ে যে আবার কবিতার আত্মার কাছে ফিরতে পারা যায়, বিমূর্ত বিষয় লিখতে লিখতে তাকেও যে ভেঙে ফেলা যায়, তার এক আশ্চর্য নমুনা সুপ্রিয়র কবিতা।
নব্বইয়ের প্রতিষ্ঠানবিরোধী ইমেজ ভেঙে ফেলা, তার ক্রোধ, তার স্যাটায়ার আমরা পড়েছি সে দশকের খ্যাতনামা ও স্বল্পখ্যাত কবিদের লেখায়, কিন্তু উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে কি নিবিড় বিষণ্ণতায় কথা বলছেন না কয়েকজন? সেই অভিমানভরা একটি স্বর এইসব কবিতায় পাওয়া যাবে।
এই কবিতাগুলো কি নতুন? না। চিত্রকল্প চমকে দেওয়ার মতো? না। কিন্তু সমসময়ের সমস্ত স্টিরিওটাইপ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে ক্রমশ হয়ে উঠবে পাঠকের কাছের মানুষ। তাই পবিত্র যা ব্যক্তিগত— এই আপ্তবাক্য পাঠককে কবির ব্যক্তিত্বের কাছাকাছি নিয়ে যাবে, কিন্তু তা হবে এতই ব্যক্তিকেন্দ্রিক যে সে লেখা ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেবে বেশি বেশি। বরং সে নিজের হয়ে উঠবে, সে হয়ে উঠবে আপন।
সত্য, আমিত্ব অথবা নিষ্ঠুর বাস্তব— যা নিয়েই লিখুন কবি কিন্তু কী এক জাদুস্পর্শ দিয়ে তাকে অতিজীবিত করে তুলতে পারেন। প্রতিমার চোখ এঁকে মন্ত্র দিয়ে তার মধ্যে প্রাণ সংস্থাপন করতে পারেন। আর সেইসব করতে করতে মনে মনে হয়ত বলেন হে দেবী তুমিই আমাকে এনেছ এই পৃথিবীতে, অথচ দেখ আজ আমিই তোমার দেহকে শরীর দিচ্ছি, প্রাণপ্রতিষ্ঠা করছি তোমার। বস্তুত কবিতা কবিকে না কবিই কবিতা— কে কাকে লেখে সে ঠিক বোঝা যায় না। শুধু অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে সঠিক ল্যাম্পপোস্ট জড়িয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে, যে ল্যাম্পপোস্ট একদিন আলো দিয়েছিল, যে এখন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে, অভিমানাহত, কাঁদে কি?
লেখায় ফিরে এসো, রাজুদা।