চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
“কবিতা অজস্র লিখেছি। কবিতা অনেকটা জায়গা নেয়। মনে অনেকটা জায়গা নেয়। খাতায় কম নেয়। গদ্য লিখতে শারীরিক পরিশ্রম যায়। এতবছর শুধুই গদ্য লিখেছি তা তো নয়। মনে-মনে আর খাতার পাতাতেও অজস্র পদ্য লিখেছি সেগুলি বই হয়ে বেরোয়নি। গদ্য একবারে লেখা যায়, শুরু করলে শেষ হয়। আমার কবিতা আধাখ্যাঁচড়া হয়ে মাসের পর মাস পড়ে থাকে। ২০০৫য়ে লিখতে শুরু-করা কবিতাও আমি ২০০৯য়ে শেষ করেছি। কবিতা মাথার মধ্যে ঘোরে। গদ্যও ঘোরে। কিন্তু গদ্য তো একবার লেখা শুরু করলে শেষ করে ফেলতেই হয়। গদ্য যেমন আমার কথা শোনে, কবিতা কিন্তু আমার কথা শোনে না। আমি কবিতার কথা শুনে চলি। গদ্য অনেকসময় ফরমায়েশি লেখা হয়ে যায়। কবিতা ফরমায়েশি লিখতে গেলে কেলেঙ্কারি। সেখানে আমি নাচার। লিখিত কবিতা হাতে না থাকলে আমি ফরমাশমতো দিতে পারি না। ১৯৫৯য়ে প্রথম কবিতার বই বেরোল। তারপর ‘৭১য়ে। তারপর, প্রথম কবিতাবইয়ের পঞ্চাশবছর পর আমার একটা কবিতার বই বেরোল: তুমি মনস্থির কর।”
এ কথাগুলো আমাকে বলছিলেন কবিতা, কৌতূককাহিনি, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, ভ্রমণকাহিনি, নাটক, অনুবাদসাহিত্য থেকে রূপকথার অলীক রাজ্য, সর্বত্রই স্বচ্ছন্দ বিচরণকারিণী নবনীতা দেবসেন।
তিনতলার ঘরে, প্রায় তাঁর কোলের কাছে বসে, চা ও টা সহযোগে বাদানুবাদ সহকারে কথা হচ্ছিল। উনি আস্তে-আস্তে আনফোল্ড করছিলেন নিজেকে।
”১৪ বছর বয়সে, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে, ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি যখন, কলেজ ম্যাগাজিনে কবিতা লিখেছিলাম একটা। মনে আছে আমার বন্ধু আরতি ছুটতে ছুটতে এসে আমাকে বলল, তার বাড়ির লোকজন নাকি কবিতাটা পড়ে বলেছেন, ‘রাধারাণী দেবী-র ছন্দের ঝঙ্কার শুনতে পাচ্ছি।’ তারপর থেকেই পরিচয়টা খারাপ লাগত। তারপর আমি সচেষ্ট হয়ে লেখার ঢং বদলে ফেললাম। আধুনিক কবিতা মন দিয়ে পড়তে শুরু করলাম। এটা আমার কনশাস চয়েস ছিল। মা-বাবার মতো লিখব না। অন্যরকম লিখব।”
মাঝেমাঝেই অভ্যাসমতো আমি বকবক করতে গেলেই হাত নাড়ছিলেন।
–তুইই তো সব বলে দিলি, আমি আর কী বলব!
”রবীন্দ্রনাথের দেয়া নাম আমার কোনওদিন ভালো লাগত না। কারণ আমার কোনও বন্ধুরই এই নাম ছিল না। লোকে ভুল করে আমাকে নিবেদিতা, নন্দিতা, নমিতা এবং অবনিকা বলে ডাকত। নবনীতা নামটার মধ্যে আমি কোনও ছবি পাই না। ছন্দও পাই না!”
জীবন, কবিতা সব যেন এক্কাদোক্কা খেলছিল তাঁর কথার সঙ্গে সঙ্গে।
”আরেকটা কী জানিস তো, এটা বুদ্ধদেব বসু শিখিয়ে গেছেন আমাকে, তা হল, যখন নিজে লিখতে পারি না, তখন কবিতা অনুবাদ করি। মাঝেমাঝে খুব চেষ্টা করলেও কবিতা আসে না। কবিতার বিরহে খুব কষ্ট হয়। সেই সময়টা অনুবাদের সময়। দুটি মেয়ের কবিতা অনুবাদ করে আমি মুগ্ধ। একজন রাশিয়ার মেয়ে। মারিয়া ৎশ্বেতায়েভা। আরেকজন ইনর্গ্রিভ ইয়ঙ্কার। সাউথ আফ্রিকার মেয়ে। আফ্রিকান ভাষার লেখিকা।”
আর সবকিছুর মতোই নতুন প্রজন্মের কথাও স্বাভাবিকভাবেই গড়িয়ে গড়িয়ে এল…
”দেখছি কী জানিস, কিছু ছেলেমেয়ে ক্রিয়েটিভ রাইটিং-য়ে বিশেষ উৎসাহী। কিন্তু সেটা ইংরেজিতে। এতদিন যে উৎসাহ আমরা দেখেছি শুধু বাংলায়, লিটল ম্যাগাজিন করায়, এখন সেটা ছড়িয়ে পড়েছে ইংরেজি সাহিত্য সৃষ্টিতে। এখন সবই ‘সাউথ এশিয়ান ইংলিশ’ বলে চলে যায়। ইংরেজিতে লেখা একটা জুয়োখেলার মতো। ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ স্টাইলে। ঠিক ঠিক ফর্মুলা জোগাড় করে একটা লেখা দাঁড় করাতে পারলে বলা যায় না, ছপ্পর ফাড়কে কুবেরের আশীর্বাদ ঝরতে পারে। বাংলায় লিখে পয়সা হয় না।এরা গ্লোবাল হতে চায়।
আমরা ছোটবেলায় কী ভাবতাম? বাড়ি ভাবতে বসলেই, চোখ বুজে প্রথমে ৭২ হিন্দুস্থান পার্ক… বালিগঞ্জ… কোলকাতা…পশ্চিমবঙ্গ… ভারত… এশিয়া… এরকমভাবে বৃত্তগুলো ছড়াত। কিন্তু এখন? কোলকাতার পরেই পৃথিবী। মাঝখানে কিছু নেই। এটা কখনওই ভালো হতে পারে না। স্তরে স্তরে চেতনার উন্মেষ ঘটাতে হয়। আমি যা দেখতে পাচ্ছি, হয়তো অন্যের মনে হবে বাড়াবাড়ি। কিন্তু সংস্কার ও আবিষ্কারের মধ্যে তো টানাপোড়েন থাকেই…”
এরপর যে কী হল! আমি আরেক রাউন্ড চায়ে গেলাম। নবনীতাদি গেলেন ছায়াপথে।
ফিরে এলেন না।