আশীষ লাহিড়ী
বাবরি মসজিদ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের প্রসঙ্গে সংক্ষেপে আমার প্রতিক্রিয়া হল, আমাদের মধ্যযুগে ফিরে যাওয়ার রাস্তা প্রশস্ত হল এবং হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের দিকে একটা সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হল।
আমাদের গণতন্ত্রে সবকিছু ভাঙাচোরা হলেও আইনব্যবস্থাটার ওপর অনেকের তবু একটু ভরসা ছিল, যে এখানে হয়তো কিছু বুদ্ধিমান ও একইসঙ্গে বিবেকবান লোকজন আছেন; কিন্তু দেখা গেল সে-ভরসাও নেই। সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের ‘সর্বসম্মত’ (এই কথাটার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে) রায়ে যেসব যুক্তি দিয়েছেন, আমি আইনের লোক না হয়েও আমার সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে তা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। সুপ্রিম কোর্ট বলছেন, হিন্দুরা মনে করে এটা রামের জন্মভূমি এবং এই ধরনের বিশ্বাসী হিন্দুর সংখ্যা অনেক— সেটা জজসাহেবদের কাছে যথেষ্ট গ্রাহ্য একটা যুক্তি। আইনের কাছে বিশ্বাসটা আদৌ কী করে যুক্তি বলে মনে হতে পারে? দ্বিতীয়ত, বিচারপতি অশোক গাঙ্গুলি আইনজ্ঞ হিসেবে টেকনিকালি একটা কথা বললেন যা আগে কখনও আমার মাথায় আসেনি। উনি বললেন, সংবিধানে বলা আছে, যে-স্থানে বেশ কিছুদিন ধরে নামাজ পড়া হয় সেটাকে মসজিদ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে৷ এবার, আমাদের সংবিধান সরকারিভাবে গৃহীত হয়েছে ১৯৫০ সালে। ১৯৫০ সালের পরে ওই জায়গায় দীর্ঘদিন নামাজ পড়া হয়েছে৷ ফলে, সংবিধান অনুযায়ী ওই স্থানটিকে আমরা মসজিদ বলে গ্রাহ্য করতে বাধ্য। এবার যে বিচারপতিরা মামলার রায় দিলেন, তাঁরা ইতিহাস খুঁড়লেন। তিনশো বছর আগে ওখানে কী ছিল, অথবা পাঁচশো বছর আগে ওখানে কী ছিল, তার ভিত্তিতে ওখানে মন্দির ছিল নাকি মসজিদ, কাঠামোর তলায় কী ছিল, এই প্রশ্নটাই এখানে একেবারেই প্রাসঙ্গিক নয়। অশোকবাবুর মতে এই মামলার বিচারে তিনশো বা পাঁচশো বছর আগের ইতিহাস বিচারের এক্তিয়ার সুপ্রিম কোর্টের নেই। অর্থাৎ কোর্টের এই বিচার সরাসরিভাবে ধর্মস্থানের সংবিধান স্বীকৃত সংজ্ঞার বিরুদ্ধে গেল। এটা একটা টাইট্ল ডিড-এর মামলা, অর্থাৎ জমির মালিকানাটা কার। এবং আইন অনুযায়ী, সেখানে যদি দীর্ঘদিন নামাজ পড়া হয়ে থাকে, তাহলে আইনত জমিটা মসজিদেরই।
এছাড়াও, দ্য হিন্দু-তে প্রকাশিত একটা লেখায় রোমিলা থাপার ইতিহাসের দিক থেকে বিচার করে একটা কথা বলেছেন, যেটা সাধারণভাবে আমাদের সকলেরই মনের কথা। শীর্ষ আদালত নাকি আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্টের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর্কিওলজিকাল সার্ভে বলছেন, এই মসজিদের তলায় নাকি একটি ‘অন্-ইসলামিক স্থাপত্য’র কাঠামো পাওয়া গেছে। অন্-ইসলামিক স্থাপত্য মানেটা কী? তা কোনও মন্দিরও হতে পারে, বৌদ্ধস্তূপও হতে পারে, অন্য যেকোনও কিছু হতে পারে। আদৌ কোনও ধর্মস্থান না-ও হতে পারে। তাহলে কী করে এই অমীমাংসিত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিচারপতিরা ওখানে একটি হিন্দু মন্দির স্থাপনের রায়টি দিলেন?
রোমিলা থাপার আরেকটি প্রশ্ন তুলেছেন। একজন বিচারক নাকি এই রায়ে বয়ান দিয়েছেন, যে তাঁরা ইতিহাসের খুঁটিনাটির মধ্যে যাচ্ছেন না। ইতিহাসের প্রশ্ন তুলছেন, অথচ ইতিহাসের খুঁটিনাটির মধ্যে যাচ্ছেন না, কেবল আর্কিওলজিক্যাল সার্ভের দেওয়া একটি প্রতিবেদনের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখছেন, এদিকে তিনশো বা পাঁচশো বছর আগে ওখানে কী ঘটেছিল, তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, এটা কী ধরনের সোনার পাথরবাটি?
এখন, যাঁরা এই রায় দিয়েছেন, তাঁরা কেউ নির্বোধ লোক নন, তাঁরা প্রত্যেকেই যথেষ্ট পড়াশুনো-জানা মানুষ, বুদ্ধিমান মানুষ, তাই যখন তাঁরা জেনেশুনে যুক্তির ধোপে টেকে না এমন একটা রায় দেন, তখন বুঝতে হবে তাঁদের অন্য কোনও বাধ্যবাধকতা আছে। এবং তা খুব পরিষ্কারভাবেই রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা৷ এই রায়ের পর মোদিজি এরকম একটা কথা বলেছেন যে এক সোনালি যুগের সূচনা হল ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ ওঁরা জানিয়ে দিলেন, রায়টা ওঁদের অনুকূলে গেল। অবশ্য অনেকে বলছেন, কেন এই ব্যবস্থাটা তো বেশ ভালই হল, মন্দিরও হল, আবার মসজিদ করারও একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া হল। এটা কিন্তু সুবিধাবাদী কথা। কেননা প্রশ্নটা ছিল টাইট্ল ডিড-এর। সেই টাইট্ল ডিড-এর মীমাংসাটা কিন্তু হল না৷ যে ভিত্তিতে মীমাংসার কথা বলা হল তা আইনের দিক থেকেও গ্রহণযোগ্য নয়, ইতিহাসের দিক থেকেও নয়।
আর তার থেকেও বড় কথা, এই মামলাটা আদপে উঠেছিল কেন? মামলা উঠল তার কারণ বাবরি মসজিদ ভাঙা হয়েছিল। এটা যে আইনের দিক থেকে একটা অপরাধ হয়েছিল, তা মানতে তো কারও দ্বিধা নেই। অর্থাৎ যে অপরাধের ভিত্তিতে মামলাটা উঠে এল সেই অপরাধটার কোনও ন্যায়বিচার হল না, কিন্তু আমি সেই বিষয় সংক্রান্ত একটি রায় দিয়ে দিলাম, এটাই বা কেমন আশ্চর্য কথা!
অনেকেই বলছেন এই রায়টি হাস্যকর। কিন্তু আমি একে হাস্যকর বলতে রাজি নই৷ এটি চূড়ান্ত সিনিকাল একটি ঘটনা। এটা পুরোপুরি জেনেবুঝে ঘটানো হয়েছে। এর পেছনে একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে, এবং যাঁরা এটা করালেন তাঁদের স্বরূপও খুব পরিষ্কার। হয়তো এই হাজার পাতার রায়ে কী লেখা হবে তা অনেক আগে থেকেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। যাঁরা এখন আমাদের দেশকে শাসন করছেন, তাঁদের মূল অ্যাজেন্ডা হল শেষ পর্যন্ত এ দেশে একটা হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সেটা তো রাতারাতি হবে না, তার জন্য একটা একটা করে ধাপ অতিক্রম করতে হবে। একটা ধাপ আজকে এগোনো গেল। পাঁচশো বছরের পুরোনো বাবরি মসজিদ ভেঙে দিয়ে সেখানে একটা হিন্দু মন্দির তুলে দেওয়া গেল। তার মানে এটা করা যায়। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর একটি দক্ষিণপন্থী, ধর্মীয় আধিপত্যবাদী মতাদর্শে বিশ্বাসী গুণ্ডাবাহিনী যে অপকর্মটি করেছিল, ২০১৯-এর ৯ নভেম্বরে এসে রাষ্ট্র স্বয়ং তাকে মান্যতা দিল।
এই প্রসঙ্গে আমার এক বন্ধু, প্রবীর মুখোপাধ্যায়, যিনি আইনের খুঁটিনাটি অনেক ভালো জানেন, আমাকে বললেন, এই রায়ে এমন কথা কোথাও বলা নেই যে রায়টিকে ‘প্রিসিডেন্স’ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না৷ অর্থাৎ এই রায় ভবিষ্যতে আরও এই ধরনের অনেক কাণ্ড করার জমি তৈরি করে রেখে দিল। অমুক স্থাপত্যের নিচে হিন্দু মন্দির আছে, অতএব একে ভেঙে মন্দির বানিয়ে দিতে হবে, এ দাবি ওঠা সময়ের অপেক্ষা৷ হয়তো তাজমহলের কথাও উঠবে৷ সত্যিই তো, এখনকার বহু স্ট্রাকচারের তলায় অন্য কিছু আছে, এখন রাম মন্দিরকে প্রিসিডেন্স ধরে নিয়ে যদি এগোনো যায়, তাহলে এর শেষটা কোথায়? অর্থাৎ এটা বোঝাই যাচ্ছে, এঁরা নিয়মকানুন, বুদ্ধিশুদ্ধি, বিজ্ঞান সমস্ত কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে শুধুমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ‘ওয়ান-পয়েন্ট অ্যাজেন্ডা’ নিয়ে এগোচ্ছেন, এবং তার জন্য যা দরকার তাই করবেন৷
পাশাপাশি এতে আরও যেটা হল, মানুষকে এই দিকটা নিয়ে একটু ব্যস্ত রেখে দেওয়া গেল, ফলে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে অন্য নানা সমস্যা কিছুটা আড়ালে চলে গেল। যেমন পেঁয়াজের দাম একশো টাকা, আলুর দাম পঁচিশ টাকা, এরকম দিনের পর দিন চলছে, অথচ এই নিয়ে কোনও আন্দোলন নেই। আগে সামান্য মূল্যবৃদ্ধি হলে লোকে রাস্তায় নামত, কৈফিয়ৎ চাইত, যে কেন এমনটা হল। এখন কিন্তু মানুষ প্রতিবাদে সেভাবে মুখর নন, এমনকি যাঁরা খুব বিশেষভাবে ভুক্তভোগী তাঁরাও নন। আসলে ধর্মীয় বিভাজনের ব্যাপারটা, আমরা-ওরা-র ব্যাপারটা; এটা আমাদের, ওটা ওদের; এটা হিন্দুদের সমস্যা, ওটা মুসলমাননের— এগুলো এত বেশি করে মানুষের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া গেছে, যে আসল সমস্যাগুলো মানুষকে আর সেভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে পারছে না। এই সুযোগে দেশটাকে কার্যত বেচে দেওয়া হচ্ছে। দেশের সম্পদ, দেশীয় সংস্থাগুলোকে বহুজাতিক কোম্পানির কাছে প্রায় জলের দরে বিকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এক্ষেত্রে একজন দক্ষ সেলসম্যানের কাজ করছেন৷ অমুক জায়গায় একটা ভালো দাঁও পাওয়া গেছে, তিনি সেটার খোঁজ পেয়ে একটা ভালো কোম্পানির কাছে বেচে দিলেন, কোম্পানিটি অত্যন্ত কম দামে তা পেয়ে গেল। সমস্ত দেশটার যে এইভাবে সবর্নাশ করে দেওয়া হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে কিন্তু কোনও উল্লেখযোগ্য প্রতিবাদ নেই। কার্যত বিনা প্রতিরোধে এগুলো হয়ে চলেছে। অন্তত তেমন কোনও প্রকাশ্য প্রতিবাদ নেই৷ শাসক যে প্রায় মাখনের মধ্যে ছুরি চালানোর মতো করে তাদের সমস্ত লক্ষ্য পূর্ণ করে চলেছে সেটাই একটা দেখবার মতো জিনিস। ধর্ম ধর্ম করে মানুষকে এত সেনসিটাইজ করে রাখা হয়েছে যে মানুষ ভাবছে যে কোনটা মন্দির কোনটা মসজিদ এটাই বুঝি তার মরণবাঁচন সমস্যা, অথচ আসল মরণবাঁচনের সমস্যাগুলির দিকে তাকাচ্ছে না, অন্তত যতটা গুরুত্বের সঙ্গে তাকানো দরকার, ততটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। অতএব, সুপ্রিম কোর্টের এই রায় আদৌ বিচারপতিদের তরফে কোনও নির্বুদ্ধিতার পরিচয় বলে মনে করি না, বরং এর পেছনে সুদূরপ্রসারী কুশলী চাল রয়েছে। বিচারব্যবস্থাকে যেভাবে কুক্ষিগত করা গেল, তাতে বলতে দ্বিধা নেই, একটি মনোলিথিক ফ্যাসিস্ট হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় একটি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ।