সোমেন বসু
ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক এবং সাংবাদিক আতিশ তাসিরের ওসিআই বা ওভারসিজ সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া স্ট্যাটাস প্রত্যাহার করে তাঁকে কার্যত নির্বাসন দিল ভারত সরকার। আতিশের বক্তব্য অনুযায়ী চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক থেকে তাঁর কাছে একটি চিঠি আসে, যেটি তাঁর মা সাংবাদিক তভলীন সিং তাঁকে হোয়াটস্যাপ করে পাঠান। চিঠিতে তাঁকে ২১ দিন সময় দেওয়া হয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের উত্তর দেওয়ার জন্য। অভিযোগটি হল, আতিশের বাবা সলমন তাসির একজন পাকিস্তানি রাজনীতিক, যিনি পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের গভর্নর থাকাকালীন ২০১১ সালে নিহত হন, এই তথ্যটি আতিশ গোপন করেছিলেন, এবং যেহেতু কোনও পাকিস্তানির সন্তান-সন্ততিকে ভারত সরকার ওসিআই স্ট্যাটাস দেয় না, তাই আতিশের উক্ত স্ট্যাটাসও প্রত্যাহার করে নেওয়া হচ্ছে। এই অভিযোগ আতিশ অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, বাবার সম্পর্কে কোনও তথ্যই তিনি কখনওই গোপান করেননি, বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক প্রায় ছিলই না বললে চলে, তাঁর জন্ম ব্রিটেনে এবং বড় হয়ে ওঠা পুরোটাই দিল্লিতে, তাঁর মায়ের একক তত্ত্বাবধানে। যাই হোক, আতিশের দাবি অনুযায়ী চিঠিটি তিনি পান জবাব দেওয়ার জন্য নির্ধারিত একুশ দিনের মধ্যে কুড়ি দিনের মাথায়। ওই একদিনের মধ্যেই তিনি তড়িঘড়ি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে ইমেইল করে নিজের বক্তব্য জানান। তারপরে গত ৭ই নভেম্বর ‘প্রিন্ট’-এ খবর বেরোয় যে আতিশের ওসিআই স্ট্যাটাস রিভিউ করা হচ্ছে। এর পরেই ভারত সরকার টুইটার মারফত ঘোষণা করে যে স্ট্যাটাসটি প্রত্যাহৃত হয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে, আতিশ নিজেও এই প্রশ্ন তুলেছেন, যে জন্মের পর থেকে প্রায় পুরো বেড়ে ওঠাটাই ভারতে কাটিয়েছেন তিনি, ২০০৯-এ তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘স্ট্রেঞ্জার ইন হিস্ট্রি’ প্রকাসিত হওয়ার সময়েও তিনি ভারতেই ছিলেন, প্রথম থেকেই সাংবাদিক তভলীন সিং একজন সিঙ্গল মাদার হিসেবেই তাঁর ছেলেকে বড় করে তোলেন, কখনওই তাঁর পিতৃপরিচয় নিয়ে তাঁকে কোনও বিড়ম্বনা বা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়নি। তাহলে হঠাৎ আজ এটি সামনে আসা এবং সে নিয়ে তাঁকে নির্বাসন দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটার কারণ কী?
এই কারণ জানতে বা বুঝতে গেলে আমাদের কয়েক মাস পেছোতে হবে। গত লোকসভা নির্বাচনের আগেই ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে ‘ইন্ডিয়া’স ডিভাইডার ইন চিফ’ শিরোনামে আতিশের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যাতে তিনি মোদি সরকারের সমালোচনা করে প্রশ্ন তোলেন “বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের কি আরও পাঁচ বছর মোদি সরকারকে সহ্য করবার ক্ষমতা রয়েছে?” এই নিবন্ধ বেরোনোর পরেই তাঁকে সোশ্যাল মিডিয়ায় যথেচ্ছ আক্রমণ করা হয়, যার মধ্যে বেশ কিছু খুনের হুমকিও ছিল। আতিশকে পাকিস্তানি বানানোর প্রক্রিয়াটিরও সেই সময়েই সূত্রপাত। নিবন্ধটি প্রকাশের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বিজেপি মুখপাত্র সম্বিত পাত্র একটি সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, “নিবন্ধকার পাকিস্তানি, এবং একজন পাকিস্তানির থেকে এর বেশি কিছু আশা করা যায় না।” মোদি নিজেও বলেন “টাইম ম্যাগাজিন বিদেশি, এবং লেখকও এক পাকিস্তানি রাজনৈতিক পরিবার থেকে এসেছেন। লেখকের যোগ্যতা সম্পর্কে এটাই যথেষ্ট তথ্য নয় কি?”
আতিশের মা তভলীন সিং গত শনিবার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে লিখেছেন, তিনি বুঝেছিলেন আতিশের নিবন্ধটি প্রকাশের সময়টা ঠিক ছিল না, ফলে তাঁরা একটা প্রত্যাঘাতের আশঙ্কা করেছিলেন, কিন্তু সেটা যে এইরকম হবে, তা ভাবেননি। এখন বুঝছেন, যে সেই নিবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার দিন থেকেই তাঁর ছেলেকে নির্বাসন দেওয়ার পরিকল্পনা ছকা হয়ে গিয়েছিল।
আতিশের প্রতি এই আচরণের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা। অরুন্ধতী রায় বলেছেন “ভয়ানক!” বলেছেন, “সরকার মিডিয়াকে তাঁবে রাখার জন্য আন্তর্জাতিক মিডিয়ার বিদেশি সাংবাদিকদের ভিসা দিচ্ছে না, ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্কলার এবং জার্নালিস্টদের ভিসা দিচ্ছে না, আর এখন এর সঙ্গে সঙ্গে এটাও শুরু করে দিল।” কবি জিৎ থাইল বলেছেন, “এটি অত্যন্ত প্রতিহিংসামূলক এবং দুর্ভাগ্যজনক পদক্ষেপ।” শশী থারুর লিখেছেন, “সরকার তাহলে এতটাই দুর্বল যে একজন সাংবাদিককেও ভয় পাচ্ছে!” সুইডেনের উপসালা ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল স্টাডির অধ্যাপক অশোক সোয়েন টুইট করেছেন— যেটি রিটুইট করেছেন অমিতাভ ঘোষ— “যদি তুমি মোদির বিরুদ্ধে লেখো, তবে তুমি ভারতীয় থাকার অধিকার হারালে!” এছাড়াও প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেবদত্ত পট্টনায়েক, অঙ্কুর ভরদ্বাজ, মনু জোশেফ। এর আগেই যখন বিজেপি-র বিজয় চৌথাইওয়ালে আতিশকে ‘হিংস্র ঐশ্লামিক’ বলে আক্রমণ করেছিলেন রামচন্দ্র গুহ টুইট করে বলেছিলেন: “তিন ধরনের লোক আতিশ তাসিরকে ‘হিংস্র ঐশ্লামিক’ বলতে পারে— ক) যে লেখাপড়া জানে না; খ) যে আতিশ তাসিরের লেখা একটি শব্দও পড়েনি; বা গ) যে মনে করে কেবলমাত্র একজন হিংস্র ঐশ্লামিকই নরেন্দ্র মোদির কথা বা কাজের সমালোচনা করতে পারে।”
এই সরকার বিরোধী কণ্ঠস্বর দমনের অনেক নজির ইতিমধ্যেই রেখেছে। আতিশ তাসিরের ঘটনা তাতে আরও একটি সংযোজন। দেশের গণতন্ত্র আজ আক্ষরিক অর্থেই বড় পরীক্ষার মুখে।