অশোক মুখোপাধ্যায়
আমাকে যদি কেউ জিগ্যেস করেন, আমি বলব, গত ৯ নভেম্বর ২০১৯ সুপ্রিম কোর্ট মন্দির মসজিদ বিসম্বাদের নিষ্পত্তি কল্পে যে রায় দিয়েছে, তা এই সময়ে সম্ভাব্য সবচাইতে কম খারাপ রায়। হিন্দুত্ববাদীরা গুন্ডামি করে যা চেয়েছিল, আরও গুন্ডামির আশঙ্কায় আদালত তাদের সেই চাহিদা পূরণ করে দিয়েছে। আবার মুসলিম সম্প্রদায়ের তরফে মসজিদ দাবিদারদেরও একেবারে নিরাশ করেনি। গরুটা নিয়ে নিলেও দুপাটি চপ্পল দান করেছে। জন্মলগ্ন থেকে ছদ্ম-সেকুলার প্রচ্ছন্ন-হিন্দু ভারত রাষ্ট্রের বিবর্তনের বর্তমান পর্যায়ে, উদ্বায়ু গণতন্ত্র ও প্রসারমান ফ্যাসিতন্ত্র নির্মাতা উগ্র হিন্দুত্বের অক্টোপাশ বন্দি বিচারব্যবস্থার পক্ষে এর চাইতে বেশি কিছু করা সম্ভব ছিল বলে আমার তো মনে হয় না। যদি কেউ আরও বেশি কিছু প্রাপ্তির আশা করে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে, তিনি হয়ত ঈশ্বরের কৃপায় কিংবা কালাজাদুতে বিশ্বাসী।
আমি অন্তত এটা আশা করিনি যে সর্বোচ্চ আদালত মসজিদ দখলের এবং ভেঙে ফেলার সাত দশক ব্যাপী সঙ্ঘীদের সেই প্রোমোটার রাজকে নিন্দা করবে এবং বে-আইনি বলে আখ্যা দেবে। একটা বৈধ রায়ে সঙ্ঘ পরিবারের পদ্মপন্থী নেতারা যে এই দগ্ধভূষণ পেল, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ লিখিত নথি হিসাবে ইতিহাসে চিরস্থায়ী সনদ পেয়ে গেল। আমার কিন্তু চিন্তাতেই আসেনি যে এই আদালত সুচারু বর্ণমালায় মেনে নেবে, বর্তমান বিবাদিত অযোধ্যায় রামচন্দ্রের জন্মস্থানের বিশ্বাস ব্যতীত কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ যোগ্য নথি নেই। এবং বাবরের বা তাঁর সৈন্যদলের হাতে মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণেরও কোনও প্রমাণ কেউ দিতে পারেনি। শুধু মাত্র এই তিনটি স্বীকৃতির জন্যই এই রায়ও আইনের খাতায় ভবিষ্যতের জন্য পুনর্পর্যালোচনাযোগ্য হয়ে রইল।
রাম মন্দির নির্মাণের অনুমতি পাওয়ার খুশিতে ডগমগ হয়ে লাড্ডু বা জিলিপি খেতে খেতেও বুঝদার পদ্ম নেতারা অনুভব করতে থাকবে, মিঠাইগুলোর খাঁজে খাঁজে অনেকটা মেথি ঢুকে গেছে।
অর্থাৎ, হিন্দুত্ববাদী প্রোমোটাররা মন্দির নির্মাণের জন্য জমি এবং অনুমতি পেলেও যে প্রক্রিয়ায় এই জমি তারা দখল নিতে পারল, তাকে জনগণের সামনে আদালতের ছাপ লাগিয়ে বৈধ করে তুলতে পারল না। শেষ পর্যন্ত এর মধ্যে গায়ের জোরের ছাপ্পাটা লেগেই গেল! এবং অশোক স্তম্ভ শোভিত সেই ছাপ্পাটা এল সুপ্রিল কোর্টের বিচারপতিদের দিক থেকেই। ফলে একে বামপন্থীদের চক্রান্ত, সেকুমাকুদের চাপ, ইত্যাদি বলার সুযোগ আর রইল না। অবশ্য, তাদের সান্ত্বনা এইটুকুই যে সত্তর বছরের গুন্ডামির ইতিবৃত্ত সম্পূর্ণ লিপিবদ্ধ করেও সেই গুন্ডাদের শাস্তি প্রদানের রায় লিখতে গিয়ে, রামজির কৃপায়, বিচারকদের কলমে কালি ঠিক সময়মতো ফুরিয়ে গিয়েছিল।
তা যায় বৈকি! সেই পুরাকালে চার্লি চ্যাপলিনের এক সিনেমার নায়ক কী বলেছিল মনে আছে? দুচারটে লোক মারলে তুমি খুনি বট; কিন্তু দুচার হাজার লোক মারতে পারলে তুমি নায়ক বটিবে! এখানেও তাই। পাড়ায় ছোটখাট কিছু ভাঙলে আপনাকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে, কেস্ দেবে। ফাটকে পুরবে। কিন্তু একটা সাত-আটশ বছরের পুরনো মসজিদ ভাঙলে— মানে, ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারলে, অহো, কী বীর কী বীর! দুহাজার লোক হত্যা করবার নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা করতে পারলে শুধু একটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নয়, আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রীও হতে পারেন।
[২]
সাত আটশো বছর মানে? ১৫২৭-২৮ সাল বলে একটা সময়কাল ঘুরে বেড়াচ্ছে না? বাবরি মসজিদ নির্মাণের কাল হিসাবে? সেক্ষেত্রে তো পাঁচশ বছরও হয়নি।
হ্যাঁ, ঘুরছে।
ইংরেজ শাসকদের তৈরি ক্যালেন্ডার এটা। স্রেফ আন্দাজে। কিংবা মতলববাজির খাতিরে এই তারিখটা দেওয়া হয়েছিল সিপাহি বিদ্রোহ উত্তর ১৮৬০-এর দশকে। বাস্তবে, আরও দুতিনশো বছর আগে থেকেই এই মসজিদ ছিল। সুলতানি আমলে ওই (জৌনপুর) এলাকার শার্কি শাসকদের কারও উদ্যোগে। পরে আকবর বা শাহজাহানের আমলে কিছু মেরামতির সময়ে সম্ভবত এর গায়ে বাবরের নাম বসে যায়। বাবরের রাজত্বকাল খুব স্বল্প সময়ের। তিনি অযোধ্যায় এসেছিলেন যুদ্ধের তদ্বির করতে, ছিলেন তিন চার দিন। সেই অবস্থায় অত অল্প সময়ে কোনও মসজিদ নির্মাণ বা উদ্বোধন অবকাশের বিলাসিতা করার মতো সুযোগ তাঁর ছিল বলে মনে হয় না।
অনেকেই শুনেছেন, “একটা” নাকি শিলালিপি পাওয়া গেছে, যাতে সাল তারিখ ভাঙাভাঙি সব কিছু লেখা আছে, থুরি ছিল। ইতিহাসের দিব্যি কেটে বলছি, যদি সত্যিই তা থাকত, তাহলে সঙ্ঘ পরিবারের গুন্ডারা এই কাঠামো ভাঙবার জন্য ব্যস্ত হত না। আদালতে তারা অনায়াসে ক্লিন চিট পেয়ে যেত! সত্যটা হল, শিলালিপি পাওয়া গেছে একটা নয়, তিনটে। তিন বিভিন্ন সময়ে, তিন জন বিভিন্ন প্রত্নতত্ত্ববিদের কাজের মাধ্যমে। সেই শিলালিপিগুলির বয়ান আবার আলাদা আলাদা, একটার সঙ্গে একটা মেলে না। তারও কোনওটাতেই বাবরের দ্বারা মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণের কোনো তথ্য নেই। আসলে সিপাহি বিদ্রোহের আগে কেউ সেই সব শিলালিপি বয়ান পাঠ করে মন্দির ভেঙে মসজিদের হদিশ পাননি। খুঁজবার কথা মাথায়ও আসেনি।
পরে যিনি পেলেন, তিনি এক বিশাল মনীষী(?)। আন্নেত্তি সুসান্না বেভারিজ। বাবরনামার ইংরেজি অনুবাদক। বিজেপি-র এখনকার বিভিন্ন নেতাদের মতোই তাঁর ছিল বিস্ময়কর আবিষ্কার প্রতিভা। তিনি শেষ শিলালিপিতে প্রাপ্ত পাঠের স্রেফ দুটো পার্শি শব্দ— “সাদাত-এ-নিশান”— পড়েই বুঝে গেলেন, এই মসজিদটি বাবরের সেনাপতি মীর বাঁকি একটা হিন্দু মন্দির ভেঙে সেই জায়গায় তৈরি করিয়ে বাবরের নামে উৎসর্গ করেছিলেন।
বিশ্বাস করছেন না? “সহৃদয়তার চিহ্ন”— এইটুকু মাত্র তথ্য থেকে কীভাবে এত কিছু বলা সম্ভব?
সম্ভব যদি আপনি দিলীপ ঘোষ বা বিপ্লব দেব প্রমুখর প্রতিভার দীপ্তি লাভ করেন। সেই ভদ্রমহিলাও সেরকম দীপ্তির অধিকারী ছিলেন। তর্কশাস্ত্রে ছিল তাঁর অসাধারণ দক্ষতা। সুকুমার রায় না পড়েও তিনি বোধ হয় রুমাল পেলে তা থেকে বেড়াল বানাতে ভীষণ রকম পারদর্শী ছিলেন। আলোচ্য বিষয়ে কিছু নমুনা দিই। একটি পাদটীকায় কী চমৎকার যুক্তি করে করে তিনি এগিয়েছিলেন দেখে নিন (পারলে শিখেও রাখুন)।
সহৃদয়তার চিহ্ন। বেশ বেশ। কে কাকে অমন হৃদ্যতা দেখালেন?
কেন, শাহানশাহ বাবর।
কাকে দেখালেন?
আরে বাবা, কাকে আবার, সেনাপতি মীর বাঁকিকে।
কীভাবে দেখালেন?
খুব সহজে। সম্রাট বাবর অযোধ্যায় এসে তাঁর দক্ষিণ হস্ত মীর বাঁকিকে রামের নামাঙ্কিত সেই হিন্দু মন্দির ভাঙতে বললেন। তারপর সেখানে একটা মসজিদ বানাতে নির্দেশ দিলেন।
কিন্তু কই, তা তো পাথরের ফলকের গায়ে কোথাও লেখা নেই? কী করে বুঝলেন? সেই ফলকে শুনেছি শুধু মাত্র সেনাপতি মীর বাঁকির নামটাই আছে।
আরে মশাই ধ্যাৎ! নামেই হবে। পার্শিতে অত সব লিখে রাখে না। অনেক কথাই বুঝে নিতে হয়।
বুঝে নিতে হবে? কীভাবে বুঝব?
বুঝুন এইভাবে। ধরুন, একজন মুসলিম শাসক তাঁর সেনাপতিকে সহৃদয়তা দেখাতে চাইছেন, তিনি তখন কী করবেন? কিসে একজন মুসলিম সবচাইতে খুশি হয়?
কিসে?
এই মরেছে? সেটাও জানেন না? একজন কাফেরকে ইসলামিত করতে পারলে, এবং একটা পুতুল মূর্তি সম্বলিত মন্দির ভাঙতে পারলে। মুসলিমরা কত কট্টর হয় জানেন তো? তাদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে উগ্রতা কত বেশি তাও নিশ্চয়ই জানেন এবং মানেন। মহম্মদের কট্টর অনুরাগী হিসাবে বাবর তাঁর সেনাপতিকে সহৃদয়তা দেখিয়ে মন্দিরটি ভাঙতে হুকুম দেবেন, এটাই খুব স্বাভাবিক, তাই না? বুঝতে পারছেন, এতে কতটা সহৃদয়তা ব্যক্ত হয়?
কিন্তু মন্দির যে ছিলই, তা ভাঙা যে হলই, তার সম্পর্কে কোনও কথাই তো বলা নেই!
বলতে হবে না। আপনি তুর্কি পার্শি— এই সব ভাষা জানেন? আমি “বাবরনামা” তুর্কি থেকে অনুবাদ করতে গিয়ে বুঝেছি, “সাদাত-এ-নিশান” লেখা আছে মানে হল, মন্দির ভেঙে মসজিদ বানানোর হুকুম প্রদান জনিত সহৃদয়তার চিহ্ন। বাকি শব্দগুলো থাকার দরকারই নেই। আপনাকে বুঝে নিতে হবে!
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সংশ্লিষ্ট পঞ্চ ন্যায়াধীশ নিশ্চয়ই শ্রীমতি বেভারেজ-এর লেখা সেই বিখ্যাত পাদটীকা পড়েছেন। যেখানে বহু পদ লুপ্ত কর্মধারয় সমাসের একটা ভয়ঙ্কর প্রয়োগ ছিল।
আচ্ছা, তা না হয় হল। কিন্তু বাবরই যে কাজটা করতে বলেছিলেন, এবং তা অযোধ্যা সফরের সময়, ১৫২৭-২৮ সালে, সেটা কীভাবে জানা গেল?
হ্যাঁ, তার জন্য বেভারিজ আরও একটা সাঙ্ঘাতিক প্রমাণ হাজির করেছিলেন। বাবরনামার কয়েক দিনের ডায়েরি। আসলে তার মধ্যে কয়েকটা হারিয়ে যাওয়া ছেঁড়া পাতা।
হারিয়ে যাওয়া পৃষ্ঠা কখনও প্রমাণ হয়? হারিয়ে গেছে মানে তো কেউ পড়তে পারেনি।
তাতে কী হয়েছে? বেভারিজ বলেছেন, হারিয়ে যাওয়া পৃষ্ঠাগুলিতে কী ছিল অনুমান করে নিন।
কী অনুমান করব?
কেন, ওই মন্দিরটি ভেঙে মসজিদ গড়ার নির্দেশ দেবার কথাবার্তা? খুব স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, এরকম নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন।
যে পাতাগুলো পড়াই গেল না, তাতে কী লেখা ছিল, স্পষ্ট বোঝা গেল?
গেল মশাই গেল, নইলে “সাদাত-এ-নিশান” শব্দবন্ধের মানেই হয় না। সম্রাট যে সেনাপতিকে সহৃদয়তা দেখালেন, সেটা একমাত্র দেখাতে পারতেন এইভাবেই। এবং তা তাঁর অযোধ্যায় ভ্রমণকালে। আর খুব স্বাভাবিক যে তিনি তাঁর দিনলিপিতে সেই ঘটনার বিবরণ লিখে রাখবেন। সেই পৃষ্ঠাগুলি যদি কোনও দিন পাওয়া যায়, দেখবেন এরকমই লেখা আছে! জলের মতো পরিষ্কার!
সরকার ও আদালতের কাছে মন্দিরওয়ালারা এইরকম সব প্রমাণপত্র দাখিল করেছিল। আদালত বুঝেছে, বিচারপতিগণ বুঝেছেন, এই যাদের যুক্তি তথ্যের হালচাল, তারাই আবার বর্তমানে সরকারি ভারি সমস্ত পদে বসে আছে। এদের কোনওভাবে খানিকটা খুশি করতে না পারলে দেশে দাঙ্গাহাঙ্গামা চলতেই থাকবে। তার চাইতে বাপু, যা চাইছে দিয়ে দাও, সঙ্গে সাবধান করে দাও, কাজগুলো তোমরা কিন্তুক ভালো করোনি।
[৩]
আর অন্য দিকে মুসলমানরা দুর্বল পক্ষ। আশ্রিত নাগরিক। পশ্চাত-পংক্তির। আমাদের গর্বের প্রচ্ছন্ন হিন্দু রাষ্ট্রে বরাবরই তাদের কিছু দেওয়া হয়েছে ছুঁড়ে ছুঁড়ে। মনে মনে গজগজ করলেও তারা জানে, কিছু করার নেই। তারা দেখে এসেছে, সেই দুর্দান্ত সেকুলার নেহরুর আমলে, বিশ্বের ভারিতম ও বৃহত্তম সংবিধান নামক গ্রন্থ প্রকাশের ঠিক এক মাস আগে, ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে, যখন আরএসএস-এর তরফে চোরাগোপ্তা কায়দায় মসজিদে রাম সীতার মূর্তি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সে তো স্থায়ীভাবে সেখানে থেকেই গেল। তখনও এলাহাবাদ উচ্চ আদালত বলেছিল, কাঠামোর মূল দরজায় তালা থাকবে, খিড়কি দুয়ার দিয়ে রামের পুজো হবে, কিন্তু মুসলমানরা নামাজ পড়তে মসজিদের ভেতরে যেতে পারবে না। খুবই নিরপেক্ষ(!) ছিল সেই রায়। কার্যত সেদিনই মসজিদকে মন্দির বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। কংগ্রেস তবুও নাকি মুসলিম তোষণ করেছে, মুসলিমদেরই স্বার্থ দেখেছে। আর তা দেখতে দেখতেই জওহরলালের নাতি রাজীব গান্ধি আবার সামনের দরজার সেই পুরনো মরচে পড়া তালা ভাঙার আয়োজন করেছেন। ১৯৮৬ সালে। এই পর্যায়ের রাম মন্দির আন্দোলনের সেই তো শুরু। ফলে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি-র মতোই— অনেক আগে থেকেই— কংগ্রেসও তাদের সঙ্গে খুলে-আম দুশমনি করে এসেছে। বিজেপি তখন শ্যামাপ্রসাদী হিন্দু ছালের উপরে আম মুদ্দার জামা পড়ে মূল সঙ্ঘী লাইন থেকে শান্টিং করে অসাম্প্রদায়িক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক দাবিদাওয়ার আওয়াজ তুলে আসরে নামতে চাইছিল। রাজীব গান্ধি এক পোঁচে তাদের আবার সেই হিন্দু লাইনে তুলে দিলেন! সেই থেকেই …
সবই চলে যেতে বসেছিল। বরং, অন্য জায়গায় হলেও, তার থেকে পাঁচ একর জমি যে এখন পাওয়া গেল (ওদের থেকে অন্তত আয়তনে বেশি), তাতে একটা মসজিদ করে নেওয়া যাবে। পরে অবশ্য আজান দেওয়া নিয়ে লাগবে— তবে সে তখন দেখা যাবে।
ভেবে দেখুন, আদালত গত সত্তর বছরের তুলনায় মুসলিমদের কিছু অন্তত দিতে সক্ষম হয়েছে। আর দিয়েছে তাদের পক্ষে কিছু ঐতিহাসিক তথ্যের স্বীকৃতি। এমনকি সম্রাট বাবর এক ধাক্কায় মন্দির ভাঙার দেড়শো বছরের মিথ্যা অপবাদ থেকে বেকসুর খালাশ! এও তাদের পক্ষে খুব কম পাওনা নয়! আপাতত।
[৪]
না, রাম মন্দিরের সপক্ষে কোনও তথ্য নেই। একটাও নেই। রাম ইতিহাসের চরিত্র না হলেও তার নামে একটা মন্দির হতেই পারত। বর্তমান অযোধ্যাতেও পারত। তাও নেই। প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে তুলসীদাস পর্যন্ত উত্তর ভারতের বিশাল সাহিত্য সম্ভারে এক ছত্রও কেউ লিখে যাননি। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যও কিছুই নেই। মসজিদ ভেঙে ফেলার পর দেখা গেল, তার নীচের স্তরে বড় মন্দির থাকার মতো কোনও নির্মাণ নেই। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে আছে ছাগল ভেড়ার মাংসের হাড়। বৈষ্ণব মন্দিরে যা থাকার কথা নয়। ফলে ওখানে ইদ্গাহ্ বা পশুবলির জায়গা হবার মতো কিছু একটা হয়ত নানা সময়ে ছিল। ঠিক মতো দেখার এবং দেখানোর ব্যবস্থা করলে যে কেউ ওখানে গিয়ে তা নিজের চোখে দেখে আসতে পারেন।
আমরা আমাদের জীবদ্দশায় একটা মিথ্যা দাবিকে গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখলাম। এটা অভিজ্ঞতা হিসাবে কম মূল্যবান নয়। আর এই মিথ্যার প্রশ্নে বিভিন্ন পক্ষকে অনেকদিন ধরে চেনার সুযোগও পেলাম। সেটার মূল্য আরও বেশি। সবচাইতে বড় কথা, যে রাষ্ট্র তার সাংবিধানিক প্রশাসনের আওতায় এই সব ঘটনা এত কাল ধরে ঘটতে দিয়েছে, তার সেই ছদ্ম-সেকুলার মুখোশটাকে সে নিজেই ছিঁড়তে ছিঁড়তে আজ অবশেষে টান মেরে খুলেই ফেলল। যাঁরা এত দিন বোঝেননি, তাঁদের এবার চৈতন্যোদয় হবে নিশ্চয়ই।
২০০৪ সালে প্রকাশিত আমার লেখা “মন্দির মসজিদ বিসম্বাদ: প্রত্নতত্ত্ব ইতিহাস বনাম মৌলবাদী মিথ্যাচার” গ্রন্থে এখানে আলোচিত সমস্ত তথ্যের প্রাথমিক উৎস প্রদত্ত। ৯ নভেম্বর ২০১৯ সকালে লেখা একটি কবিতা এখানে সংযুক্ত করে দিলাম।
চাই অন্য কিছু
বাবরের নামে মসজিদ নাকি রাম নামি মন্দির—
আমার কী বল, ফল যাই হোক বিচারের সন্ধির?
যে শিশু মরেছে পুষ্টি না পেয়ে ক্ষুধা রোগ অনাদরে
দেখেছ কি বাছা খোদা ঈশ্বর— কার ছিল সুনজরে?
যখনই তাকাই, রামের আওয়াজে কাদের জোটে রসদ—
দেখি এক পাল দানব জিতেছে ক্ষমতার মসনদ!
মন্দির হোথা বানাতে যাদের ছিল সোচ্চার সায়,
তাদেরই অনেকে মৃত্যু শিবিরে দিন গোনে আজ হায়!
ব্যাঙ্ক লুট করে বিদেশে পালানো দস্যুরা বেশি করে—
রামের ভক্ত, মন্দির হলে দেয় চাঁদা হাত ভরে।
রামের বেদিতে ফুল দিতে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আমি
দেখছি সে সব দানবের সাথে ঘোরে অন্তর্যামী।
চাষি নিরন্ন মজুর নিঃস্ব দেশ যায় অধোপথে,
যৌবন মরে হাহাকার করে বেকারি বৃদ্ধিরথে।
ভুলে গিয়ে তারে দাঙ্গায় ফাঁসে হিন্দু মুসলমান!
মন্দির নাকি মসজিদ? ওটা শ্মশান কবরস্থান!
বিচারক তুমি রায় যাই দাও, দেখেছ হাসছে কারা?
লুটেরা মালিক দখলদারেরা উৎসবে মাতোয়ারা।
কাশ্মির লুট, অসমে বন্দি কত লাখ রামিয়াল—
তাদের জন্য রাম কোথা আজ? আল্লার কী খেয়াল?
বাবরের নামে মসজিদ নাকি রাম নামি মন্দির—
আমার কী বল, লাভে লোকসানে তোমাদের ফন্দির?
মন্দির নয় মসজিদ নয়, জীবনের অধিকার
সে যদি না পাই, শপথ নিচ্ছি পুরোটা বুঝে নেবার!!
চমৎকার !