“চলচ্চিত্র উৎসবগুলিতে এত মূলস্রোতের ছবির ভিড় কেন”

আদুর গোপালকৃষ্ণান

 

২০শে নভেম্বর থেকে গোয়ায় ভারতের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয়েছে। বর্ষীয়ান চলচ্চিত্রকার আদুর গোপালকৃষ্ণানের মনে প্রশ্ন, চলচ্চিত্র উৎসবগুলিকে কি নিজেদের লক্ষ্য থেকে দূরে স্রিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? কারণ, তিনি এখনও মনে করেন মতামতের বিবিধতাটাই আমাদের গণতন্ত্রের ভিত্তি। সাংবাদিক গৌতম ভি এস-এর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এল এই প্রসঙ্গটাই। সাক্ষাৎকারটি ২০শে নভেম্বর ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর পাঠকদের জন্য রইল তার বঙ্গানুবাদ। অনুবাদ: সত্যব্রত ঘোষ

সরকারি উদ্যোগে চলচ্চিত্র উৎসব পরিচালনার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হল ইনডিপেন্ডেন্ট সিনেমা দেখানোর পরিসর তৈরি করা। আপনার কি মনে হচ্ছে ফেস্টিভ্যালগুলি এই উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে বাণিজ্যসফল ছবিগুলি দেখানোতেই গুরুত্ব দিচ্ছে?

চলচ্চিত্র উৎসবে তো শুধু আমাদের দেশে বানানো ছবির উৎকর্ষ তুলে ধরা হয় না। তার সঙ্গে সমকালের সেরা বিশ্ব সিনেমা এবং রেট্রোস্পেক্টিভগুলিও দর্শকদের জন্য আনা হয়। এখানে দর্শক বলতে প্রধানত চলচ্চিত্রকর্মী, চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ ও চলচ্চিত্রে উৎসাহী ছাত্রছাত্রী এবং বৃহত্তর দর্শকসমাজকেও বোঝানো হচ্ছে। ইন্ডিয়ান প্যানোরামা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এই কারণে যে এই বিভাগটিতে প্রতি বছর ভারতের সেরা কাজগুলিকে দেখানো হয়। মৌলিক এবং আপসহীন ছবিগুলির জন্য মূলত ইন্ডিয়ান প্যানোরামা বিভাগটি তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু ইদানিং এর গুরুত্বে জল ঢেলে দেওয়ার মতো করে বাজারচলতি ফিল্মগুলি যোগ করা হচ্ছে। ইন্ডিয়ান প্যানোরামায় মোট ২৬টি ছবির মধ্যে ১২টা বাণিজ্যিক মূলস্রোতের ছবি আর বাকি ১৪টি অফবিট। জানি না কেন এতগুলি বাণিজ্যিক ছবি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ঢোকানো হয়েছে। বিশ্বের সামনে ভারতের সেরা কাজগুলি তুলে ধরবার ভাবনাটির বিরুদ্ধে যাচ্ছি আমরা। আন্তর্জাতিক স্তরে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্র এবং পত্রিকায় ছবিগুলি নিয়ে আলোচনা হবে, বিভিন্ন ফেস্টিভ্যালের কর্তৃপক্ষ ছবিগুলি বেছে নেবেন— এই অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়েই তো আন্তর্জাতিক ফোরামগুলিতে আমাদের সিনেমা জায়গা পাবে।

সারা পৃথিবীতে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলি পুরোদস্তুর পেশাদারেরাই পরিচালনা করেন। সমালোচক এবং নির্বাচকেরা এদেশে বাণিজ্যিক ছবি দেখতে আসেন না। তাঁরা চান কোনও আপস না করে বানানো মৌলিক ভারতীয় ছবি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বস্তাপচা ছবির প্রযোজকদের খুশি করবার জন্য আমরা বোকার মতন এমন পদক্ষেপ নিয়েছি। এতে এই ছবিগুলি যারা বানিয়েছেন, তাঁরা মনে করছেন যে গুণী চলচ্চিত্রকারদের যে সম্মান দেওয়া হয় তা তাঁদেরও দেওয়া হবে। এই কদর্য ছবিগুলির ভারে তলিয়ে যাওয়া ইন্ডিয়ান প্যানোরামার গুরুত্ব কমছে। আন্তর্জাতিক উৎসব মূলত এমন মানুষদের জন্য যারা ভালো সিনেমার কদর দিতে পারেন। উৎসবগুলিতে ছবিগুলি দেখে তাঁরা বুঝতে চান ছবি বানানোর দক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রশিল্পের নিরিখে কোন জায়গাটিতে তাঁরা অবস্থান করেন। প্রত্যেকটি মৌলিক ছবি দেখবার পর সিনেমার ভাষা এবং প্রযুক্তিতে কিছু না কিছু বদলে যায়। আমার মনে হয় ইন্ডিয়ান প্যানোরামায় বাজারি ছবির ভিড় বাড়ানোটা শুধু অন্যায়ই না, অপচয়ও বটে। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ইন্ডিয়ান প্যানোরামাকে অন্তর্ভুক্ত করবার চিন্তা তো সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা আমাদের মতো চলচ্চিত্রকার এবং সমালোচকদের মাথা থেকেই তো জন্ম নিয়েছিল।

ফিল্ম ফেস্টিভ্যালগুলির মাধ্যমে প্রযুক্তি কেমনভাবে বদলাচ্ছে, তা নিয়ে একটু বলবেন?

১৯৭৭ সালে সরকার আমাদের দাবি মেনে নেন। ১৯৭৮ সালে মাদ্রাজে (অধুনা চেন্নাই)-তে প্রথম ইন্ডিয়ান প্যানোরামা অনুষ্ঠিত হয়। আমার ‘কোডিয়াট্টাম’ ছবিটি তাতে ছিল। সেসময় প্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না। তাই সাবটাইটেল ছাড়াই ছবিগুলি দেখাই আমরা। যখন আমি পরের ছবিটি বানাচ্ছি তখন তার সাবটাইটেল তৈরি হচ্ছে হিটিং প্রসেসে (লিনোটাইপে ছাপানো প্লেটগুলিকে এমন তাপমাত্রা অবধি গরম করে ফিল্মের নেগেটিভের প্রয়োজনীয় অংশে প্যারাফিন মাখিয়ে ছোঁয়ানো হতো, যাতে তা ফিল্মের ইমালশনকে না গলিয়ে ছাপ ফেলবে, কিন্তু নেগেটিভকে আর আলাদা করে প্রসেসিং করতে হবে না।) ব্যাপারটি মোটেই পেশাদারদের মতো করা হয়নি। মনে আছে ‘কোডিয়াট্টাম’-এর সংলাপ ইংরেজিতে অনুবাদ করে ব্লক বানিয়ে নেগেটিভে ছাপা হচ্ছিল, যেভাবে ট্রেডল মেশিনে করা হয়।

পরবর্তীকালে সাবটাইটেল করা হত রাসায়নিক পদ্ধতিতে। আমরা ছবি বানিয়ে মূলত সুইটজারল্যান্ডে পাঠাতাম। ওখানে ব্যাপারটা করা হত। তারপরে এনএফডিসি প্রয়োজনীয় যন্ত্র আমদানি করবার পর এখানেই নিয়মিত সাবটাইটেলিং শুরু হয়। সাম্প্রতিকতম ছিল লেসার সাবটাইটেলিং (লেসার দিয়ে ফিল্মের ইমালসশনের নির্দিষ্ট অংশ পুড়িয়ে অথবা বাষ্পীভূত করে ছাপানো। ১৯৮৮ সাল থেকে বাণিজ্যিক স্তরে ব্যবহার করা হত)। এখন ডিজিটাল ফিল্ম এসে যাওয়ার পর সবকিছু একটু কম জটিল হয়ে গেছে। নিত্যনতুন ছবিকরিয়েরা কাজ করছে ডিজিটাল মাধ্যমে। তাঁদের মধ্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরাও আছেন, আবার স্বশিক্ষিতরাও আছেন। এদের মধ্যে অনেকে যথেষ্ট ভালো ছবি বানাচ্ছেন। কিন্তু বাণিজ্যিক জগৎ তাঁদের ছবিগুলি চালাতে চাইছে না। সৌভাগ্যবশত, বড় বড় স্টার বা বিশাল বাজেট ছাড়াই কিছু মালয়ালাম ছবি তফাৎটা দেখিয়ে দিচ্ছে। চারপাশটা বদলাচ্ছে তো বটেই।

নেটফ্লিক্স বা অ্যামাজনের মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলি এসে যাওয়ায় দর্শকদের প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে সিনেমা দেখবার সংস্কৃতিটা কি মার খাচ্ছে বলে আপনার মনে হয়?

নেটফ্লিক্স বা অন্যরা ভালো ছবি কেনে না। আর কিনলেও বিশেষ দাম দেয় না। আঞ্চলিক ছবির ক্ষেত্রে বড় জোর লাখ তিরিশেক পাওয়া যায়। তাতে আর কটটুকুই বা ওঠে। এই বিপদ তখনই কাটবে যখন নতুন প্রজন্মের দর্শকদের ভালো ছবি দেখবার স্বাদ পূরণ করতে পারব আমরা। একটা আলাদা জায়গা চাই যেখানে অন্য ধরনের ছবিগুলি দেখানো হবে। কোথায় পাবে মানুষ? কেরলে সরকারি মালিকানায় প্রেক্ষাগৃহের একটা চেন থাকবার ফলে আমরা কিছুটা সুবিধা পাই।

ডেলিগেটের সংখ্যা দিয়ে কি একটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সাফল্য মাপা যায়?

হ্যাঁ। মানুষের কাছে পৌঁছানোটা দরকার, কারণ ফেস্টিভ্যাল আয়োজনে যথেষ্ট খরচ করা হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের দল বেঁধে এই ছবিগুলি দেখা জরুরি। তবে সমস্যা হল, এদের হাবভাবে এবং কথাবার্তা শুনে মনে হয় না এরা বিশেষ চিন্তাভাবনা করছে। আমরা প্রায়শই লক্ষ করি, সুড়সুড়ি দেয় না এমন ছবি দেখতে বসে এরা উসখুস করছে। সিনেমা চলাকালীন উঠে বাইরে চলে যাওয়ার দৃশ্যটাও হামেশাই দেখতে পাই। এই দর্শকরা পরিণত নয়, চলচ্চিত্র শিল্পে দীক্ষিতও নয়। আমার মনে হয়, দর্শকদের ধৈর্য বাড়াতে আর রুচি বানাতে আমাদের সাহায্য করা উচিৎ। কারণ, পৃথিবীর সেরা ছবিগুলি বাণিজ্যিক ছবির মতো সুড়সুড়ি নাও দিতে পারে। আমাদের দর্শকদের বুঝতে হবে যে তাঁরা প্রেক্ষাগৃহে এসেছেন সিরিয়াস সিনেমা দেখতে, মনোরঞ্জনের জন্য নয়। উৎসবে ছবি দেখাটাকে এক ধরনের বিদ্যাভ্যাস বলে মেনে নেওয়াটা জরুরি।

ফেস্টিভ্যালে ভালো ছবি দেখবার জন্য একটা ভিড় হয়। কিন্তু সেই ছবিগুলি যখন প্রেক্ষাগৃহে বাণিজ্যিকভাবে মুক্তি পায়, তখন দর্শকদের প্রতিক্রিয়ায় তেমন উষ্ণতা দেখা যায় না। এই অসঙ্গতিটি কি আপনি লক্ষ্য করেছেন?

বরাবরই এমনটা ছিল। আপনি বইমেলাগুলি দেখুন। সেখানে যত বই বিক্রি হয়, বইয়ের দোকানে সারা বছরে তত বই বিক্রি হয় না। মানুষ এক জায়গায় জড়ো হয়ে একসঙ্গে ছবি দেখবে আর শুধুমাত্র বিভিন্ন ছবি নিয়ে আলোচনা করবে— এর জন্যই তো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...