আন্দোলন স্থল থেকে

জয়দীপ

 

 

বর্ধমান, বীরভূম, মালদা, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণা সহ বিভিন্ন জেলার হাজার হাজার মানুষ আজ সল্টলেকের বিকাশ ভবনের সামনে ধর্নায় এবং অনশনে বসেছেন। পথই তাঁদের ঘরবাড়ি৷ অবস্থান বিক্ষোভ আজ ১৩তম দিনে পড়ল৷ অনশন পড়ল দশম দিনে। এই হাজার হাজার মানুষগুলির একটিই পরিচয়, তাঁরা ‘পার্শ্বশিক্ষক’। এই বাংলার বুকে বহু দিন ধরে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে তারা আন্দোলন চালাচ্ছেন। কিন্তু প্রাথমিক ও উচ্চপ্রাথমিকে কর্মরত এই পার্শ্বশিক্ষকদের দাবি কোনওভাবেই পূরণ হয়নি। তাই আজ তারা এই ঠান্ডার মধ্যে ত্রিপল টাঙিয়ে রাস্তায় অবস্থান এবং অনশন করছেন।

পার্শ্বশিক্ষক কারা? কেন আন্দোলন করছেন? এই প্রশ্নের উত্তরে আন্দোলনকারীরা বলেন, ২০০৪ সালে সমগ্র ভারতে জুড়ে শিক্ষাক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা দেখা দিয়েছিল। স্কুলছুটের সংখ্যা প্রবল পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ভারত সরকার ‘সর্বশিক্ষা মিশন’ প্রকল্প চালু করেন। ২০০৪ সালের পর থেকে স্কুলছুট হওয়া ছাত্রছাত্রীদের আরও বেশি করে স্কুলমুখী করে তোলা এবং আলাদাভাবে ক্লাস নিয়ে তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটনার জন্য বিভিন্ন রাজ্যে পার্শ্বশিক্ষক নিয়োগ করা হয়। বাংলাতে প্রায় ৫৫ হাজার পার্শ্বশিক্ষক নিয়োগ হয়। ভারতে প্রতিটি সরকার শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নতির জন্য বিভিন্ন প্রকল্প রূপায়ণ করার কথা বলেন ঠিকই, কিন্তু পরিকাঠামোর দিকটি একবারও ভেবে দেখেন না। এক্ষেত্রেও তার প্রতিফলন ঘটে। তাঁদের যে উদ্দেশ্যে নিয়োগ করা হয়েছিল তার জন্য স্কুলে স্কুলে সঠিক পরিকাঠামো ছিল না। দিনের শেষে দেখা গেল, প্রাথমিকভাবে সপ্তাহে ষোলোটি ক্লাসের কথা বলা হলেও স্থায়ী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মতোই স্কুলের সমস্ত কাজ আজ তাদের করতে হয়। কিন্তু বেতন পাওয়ার ক্ষেত্রে চলে আসে চরম বৈষম্য।

আন্দোলনকারীদের কথা মতো, পার্শ্বশিক্ষক-শিক্ষিকাদের বেতনের ৪০% দেয় রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকার দেয় ৬০%। এই মুহূর্তে প্রাথমিক পার্শ্বশিক্ষক-শিক্ষিকারা ১০ হাজার এবং উচ্চপ্রাথমিক পার্শ্বশিক্ষক-শিক্ষিকা ১৩ হাজার টাকা পান। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়েই তাঁদের বেতনবৃদ্ধির দায়িত্ব নিন, এমনটাই তাঁরা চাইছেন। কারণ পার্শ্বশিক্ষকদের নিয়োগ একটি বিশেষ কারণে করা হলেও আজ স্কুলের ফুলটাইম যেকোনও শিক্ষক শিক্ষিকাদের সমানই কাজ করতে হচ্ছে এনাদের। আদালতের রায়ে সমকাজে সমবেতনের উল্লেখ এলেও তার কোনও ছাপ বাস্তবে কোথাওই পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া তাঁরা বলছেন, বেশ কিছু সুযোগসুবিধা থেকেও তাঁরা বঞ্চিত। গত ৩-৪ বছরে শতাধিক পার্শ্বশিক্ষক-শিক্ষিকা বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছেন এবং বহু মানুষ দারিদ্র‍্যের কাছে হার মেনে আত্মহত্যা করেছেন বলে তাঁদের দাবি।

এমত অবস্থায় তাঁরা আন্দোলনের পথকে বেছে নিয়েছেন। শত শত পার্শ্বশিক্ষক-শিক্ষিকা বিকাশ ভবনের সামনে অবস্থানে বসে আছেন। অবস্থানের পাশাপাশি ৩৭ জন পার্শ্বশিক্ষক-শিক্ষিকা অনশনে বসেছেন। যতদিন যাচ্ছে তাদের শরীরের অবনতি ঘটছে। ইতিমধ্যে একজন আন্দোলনকারী মারা গিয়েছেন। একজন ব্রেনস্ট্রোকের ফলে হাসপাতালে ভর্তি। বিকাশ ভবনের সামনে এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে আন্দোলনকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সমাজ নির্মাণকারী এই মানুষগুলি। আছে মশার উপদ্রব, শৈত্য, বাথরুমের অভাব। এতকিছু পরেও রাজ্য সরকার থেকে কোনও রকম আলাপ-আলোচনায় বসা তো দূরের কথা, একবার দেখা পর্যন্ত করেননি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী। তার উপর তাদের আন্দোলনের মঞ্চের সামনেই শুরু হয়েছে “আহারে বাংলা”। এক অনশনকারী বলছিলেন, ‘আহারে বাংলা করে একদিকে আমাদের উপর মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচার চালাচ্ছেন এই রাজ্য সরকার’। এতকিছুর পরেও প্রত্যেক পার্শ্বশিক্ষক-শিক্ষিকাদের আন্দোলন ছাড়বেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তাদের আন্দোলন থেকে স্পষ্ট দাবি-

  1. পূর্ণ শিক্ষক-শিক্ষিকার মর্যাদা দিতে হবে।
  2. সমকাজে সমবেতন দিতে হবে।
  3. মৃত পার্শ্বশিক্ষক-শিক্ষিকাদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা সহ পোষ্যকে চাকরি দিতে হবে।
  4. যে সব পার্শ্বশিক্ষক-শিক্ষিকা ২০১৮ সালের বর্ধিত ভাতা পাচ্ছেন না, অবিলম্বে তাদের বর্ধিত ভাতা চালু করতে হবে।

এই সমস্ত দাবি যতক্ষণ না পূরণ হচ্ছে, তাঁরা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলেই জানাচ্ছেন।

দেখা যাক, তাঁদের এই ন্যায়সঙ্গত অধিকার দাবির আন্দোলন এখনও অবধি মূক ও বধির এই সরকারকে কোনও সদর্থক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে কিনা।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...