সৌমিত্র দস্তিদার
ভারতীয় জনতা পার্টির একটা বিশেষ গুণ— তারা সবসময় কোনও না কোনও ঘটনা ঘটানোর আগে বিষয়টিকে নাটকীয়ভাবে পেশ করেন। ঘটনা ছাড়াও তাদের পছন্দ নাটক, তাও আবার বেশ একটু চড়া দাগের। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সংসদ ভবনে ঢোকার আগে মাননীয় নরেন্দ্র মোদির ছলছলে চোখে ভবনের সিঁড়িকে গণতন্ত্রের ‘পবিত্র মন্দির’ বলে প্রণাম করার আবেগবিহ্বল দৃশ্য ভোলবার নয়। এই যেমন সেদিন মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে নাটকীয় গলায় জানিয়ে দিলেন সারা দেশে এনআরসি হবেই। ফলে গত চার বছর ধরে জনসাধারণের ১২২০ কোটি টাকা ও ৫২০০০ সরকারি কর্মচারীর কয়েক হাজার শ্রমদিবসের মূল্যে তৈরি অসমের এনআরসি তালিকা বাতিল। কোনও স্বীকৃত গণতান্ত্রিক দেশে এরকম স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের প্রকাশ অন্তত সংসদের ভেতরে ঘটছে দেখলে কেমন যেন লাগে। এ যেন সত্যি হবুচন্দ্র রাজার রাজত্ব। যেখানে এক কলমের খোঁচায় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি সরকারি কোষাগারের অর্থ জলে ফেলে দেওয়া হয় স্রেফ শাসক দলের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক স্বার্থে। শাসক দলের এই চরম সিদ্ধান্ত কিন্তু আচমকা বা হঠকারী নয়। একটু তলিয়ে গোটা বিষয়টি বিশ্লেষণ করলেই আপনি বুঝতে পারবেন কীভাবে এক পা এক পা করে ক্রমেই আমরা একটি মনুবাদী রাষ্ট্রের পথে এগোচ্ছি। ভারতীয় জনতা পার্টির এক-একটি ‘মাস্টারস্ট্রোক’ দেশের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করছে। ভয় হয় ক্ষমতায় থাকার লোভে এদেশের শাসকেরা সারা দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে না দেয়। সারা দেশে সাধারণ মানুষের নানা ক্ষোভ যেভাবে বিক্ষোভের চেহারা নিচ্ছে, তাতে সেই আশঙ্কা বাড়ছে। আগামীতে আরও বাড়বে।
তবে আজকের এই আলোচনায় আমি এনআরসি নিয়ে নয়, বেশি আগ্রহী নাগরিকপঞ্জী নিয়ে আমার যে ডকুমেন্টারি ছবিটি প্রায় শেষের মুখে তার নির্মাণ পদ্ধতির আলোচনায়। এই লেখাটির সঙ্গে থাকছে ছবিটির প্রথম টিজার। এরপর আসবে আরও দুটি। সম্পূর্ণ ছবিটি প্রকাশ পাবে তার পরে পরেই।
কখনও সখনও সত্যিই মনে হয় এ ধরনের কঠিন ডকুমেন্টারি আর করব না। এ যেন এক ম্যারাথন দৌড়। ক্লান্ত, নিঃসঙ্গ দৌড়বিদের একাকী অনিশ্চিত যাত্রা। অনেক দিন ধরে এ ধরনের কাজে মাঝে মধ্যে একটু হতাশা আসে বৈকি! একবছর আগে দেশভাগের সিরিজের প্রথম পর্ব করেছিলাম। দেশভাগের চেনা ন্যারেটিভ পাল্টে দিতে চেষ্টা করেছিলাম। চেনা ইতিহাসের বাইরে গিয়ে দেখেছিলাম বলেই সম্ভবত প্রগতিশীল বাংলা সেভাবে নেয়নি। মুখে আমরা প্রগতি প্রগতি খুব বলি বটে, আসলে তো তা নয়! আমাদের রাজ্যের বুদ্ধিজীবী শিবিরের অধিকাংশই চেতনে-অবচেতনে বামুনবাদী। ইসলামোফোবিক। ফলে দেশভাগের চেনা আখ্যান মানেই শুধু জিন্নাকে খলনায়ক বানানো আর পুববাংলা থেকে বাধ্য হয়ে এপারে চলে আসার একমাত্রিক যন্ত্রণা। ‘মুসলমানের কথা’, ‘সীমান্ত আখ্যান’ এবং এখন এই এনআরসি নিয়ে ছবিটি বলা যেতে পারে একই ছবির আলাদা আলাদা পর্ব। অবশ্য নতুন করে ‘সীমান্ত আখ্যান’ লোকে এখন দেখছে, নানা জায়গা থেকে প্রদর্শনের জন্য ডাক পাচ্ছি, এটা নিঃসন্দেহে পরিচালকের শ্লাঘার বিষয়। এনআরসি তারই সম্প্রসারিত আর এক পর্ব, যেখানে নিজের দেশে স্রেফ উগ্র জাতীয়তাবাদ কিভাবে সাধারণের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, তার এক ভিস্যুয়াল দলিল। একবছর ধরে অনেক কষ্টে তৈরি করা ছবি প্রায় শেষের মুখে। কোনও প্রোডিউসার নেই এ ছবির। শুধু সাধারণ মানুষের ভরসায় ছবি করতে বারবার ছুটে গেছি অসমের বিস্তীর্ণ এলাকায়। একথা স্বীকার করতেই হবে সাধারণ লোক দুহাত বাড়িয়ে আমাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিন-তিনটি টিজার পোস্ট করব। তা থেকে লোকজন কিছুটা আন্দাজ করবেন ছবির চরিত্র কেমন। আজ করছি প্রথমটা। আমি নিজে করছি না। আমি যাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত সেই ‘চার নম্বর প্লাটফর্ম’-এর বন্ধুরা করছেন। ওদের আর ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করব না। ওরা আমার নানারকম পাগলামির সঙ্গী। এর পরেরটি পোস্ট করার সময় বলব কীভাবে কারা পাশে থেকেছেন তাদের কথা। শেষের পোস্টে জানাব নির্মাণের অভিজ্ঞতা। পারলে পাশে থাকুন। পরামর্শ দিন। দেখুন। আর অসমের গরিব মানুষের যন্ত্রণার শরিক হন।
এককথায় অসাধারণ