অরিজিৎ আদিত্য
গত সংখ্যার পর
অর্জুন: হাওরের সবাই কয়, তুই উকিল ধর, হাতে টাকা রাখ, না হলে বড় বিপদে পড়বি অর্জুন।
বিপদের আর বাকি আছে কী? উকিলের খবর করতে করতেই টাকাগুলো জলের মতো বেরিয়ে যায়। এর মধ্যে পুলিশ তো রয়েইছে। শুধু খাইখাই আর খাইখাই।
এখন দেখি অবিনাশ উকিলের বদলে কার কাছে নিয়া যায় ওই মুহুরিবাবু। না, আইজ কপালটা ভালো, মুহুরিবাবুকে পেয়ে গেলাম রাস্তায়। আমাকে দেখে বলেন, কোথায় গেলে বলো তো বাপু? স্যারকে বলে এসছি তোমায় নিয়ে যাব।
তো গেলাম উকিলবাবুর বাড়ি। উকিলবাবু আমার ফাইলপত্তর দেখলেন। কাগজটাগজ সব দেখলেন। তারপর আমার দিকে চেয়ে হেসে বললেন, প্রথম কথা হল বাপু তুমি একটা আস্ত গাড়ল। অরিজিন্যাল কাগজপত্র কেউ এভাবে ফাইলে করে নিয়ে শহরে ঘুরতে আসে? তা এসে যখন গেছ, তো বলি, তোমার কাগজপত্র তো এমনিতে ঠিকই আছে। তা তোমার লিগ্যাসি মিলছে না কেন, প্রশ্ন সেটাই। তোমার বাপ কবে এসেছিল বাংলাদেশ থেকে? সত্যিসত্যি বলবে।
কপাল! উকিলবাবু বলেন কী? আমার বাপের জন্ম ধলছড়া রিফিউজি ক্যাম্পে। আমার বাপরে পেটে নিয়া আমার ঠাকুমা আর ঠাকুর্দা অনাথবন্ধু ওই দেশ থেকে পালিয়ে এসেছিল। এরপর এই ক্যাম্প থেকে ওই ক্যাম্প, শুধু ঝাঁটালাথি খেয়েছে বুড়ো। তবে বুদ্ধিমানের কাজ করেছিল একখান, রিফিউজি ক্যাম্পেই বুড়ি পোলার জন্ম দেয়। ফলে কাগজ তো হল, না কী বলেন স্যার? এই দেখেন না। ফাইলে দেখেন আমার বাপের জন্মের সাট্টিপিকেট আছে। এরপরও বলবেন আমরা বাংলাদেশি? আরে স্যার, কর্তাবাবা তো বলেন বাংলাদেশই ছিল না ওই সময়। তো তার বাপ ঠাকুর্দা বাংলাদেশি হয় কী করে?
উকিলবাবুর যেন একটু গোঁসা হল, বললেন, মেলা বোকো না হে। তোমাদের হাওরের মানুষগুলোর এই এক বদঅভ্যেস, বড় বেশি বকবক করো। পেটে বিদ্যে নেই এক চামচ। এই যে বললে এসব কথা, তা কোর্টে প্রমাণটা করতে পারবে? পারবে প্রমাণ করতে?
আমি বলি, স্যার স্যার দোষ নেবেন না, আর বকবক করব না। আপনি স্যার কোনওমতে আমার লিগ্যাসিটা বের করে দিন। বউ বাচ্চা নিয়ে বড় গাড্ডায় পড়েছি, আমার সাতকুলে আর কেউ নেই যে একটু ভরসা দেয়।
বললেন, ঠিক আছে ঠিক আছে। তা বাপু বলো তো, পয়সাকড়ি কেমন খরচা করতে পারবে? নগদ আছে কিছু? জমি জিরেত?
বললাম, দেখুন উকিলবাবু নগদ টাকা কোথায় পাব? জমিজিরেত আছে, অল্প, খানিকটা বিক্রি করেছি। বাকিটা বিক্রি করতে মন চায় না। আমার বাপে অনেক মেহনত করে ওই জমি কিনেছিল, হাওরে যে বাড়িটা, সেটাও আমাদের নিজের— কিন্তু আর জমি বিক্রি করলে আমার কী হবে?
তা বাপু তোমার কী হবে, তা আমি বলব কী করে? দেখো, আমার কাছে এসেছ যে কাজে, তা কী? না, তোমার লিগ্যাসি ডাটা ঠিক করে দিতে হবে আর তোমার ডি নোটিসটা কোর্টে খালাস করে দিতে হবে। এই তো, না কি? তো এর জন্য তো টাকা চাই। বিনি পয়সায় তো কোর্টে কেস লড়ন যায় না রে ভাই। আর আমারও তো চলতে হবে। বানের জলের মতো ডেইলি দেদার ডি ভোটার আসছে, প্রত্যেককে যদি বিনা পয়সায় কেস লড়ে দিই তো আমাকে যে পেটে গামছা বেঁধে থাকতে হবে, বোঝো সেটা?
হক কথাই কন উকিলবাবু। ঠিকই তো, টাকা তো লাগবে। তো টাকা পাই কই? অল্প যে জমিজিরেত রয়েছে, বিক্রি করে দেব? তারপর? তারপর? এই জন্মে আবার নতুন করে পারব নিজের জন্য একখান জমি কিনতে?
উকিলবাবু মনের কথা পড়তে পারেন। আমাকে অভয় দিয়ে বলেন, এত কী চিন্তা করো হে বাপু? বাংলাদেশি বলে যদি তাড়িয়েই দেয় তাহলে তো জমিও মায়ের ভোগে যাবে। বরং আগে মামলা থেকে খালাস হও, কপালে থাকলে ফের জমি হবে।
কপালে থাকলে! কপাল? কী আর করন! আমি বলি, হবে উকিলবাবু, আপনি কেসটা নিন, আমি হাওরে ফিরে টাকার ব্যবস্থা করি।
উকিলবাবুর রাগটা পড়েছে মনে হয়। কইলেন, ঠিক আছে ঠিক আছে। তুমি চিন্তা কোরো না, কাগজপত্তর মোটামুটি তোমার সব ঠিক আছে। তা বাপু, রাত তো হয়েছে অনেক, হাওরে ফিরবে কী করে?
মুহুরিবাবু বলেন, ও আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। অর্জুন আজ রাতটা স্টেশনে থেকে যাবে।
হ ইস্টিশনেই রাত কাটাইমু আজ। কী আর করন!
উকিলবাবুর দয়ার শরীর, মুহুরিবাবুরে কন, কই হে, লোকটারে স্টেশনে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দাও দিকিনি, একটা রিকশা-টিকশা কিছু একটা…
তা এলাম ইস্টিশানে…
(মোবাইলে সময় দেখে)
অর্জুন: না, রাত তো বেশ হয়েছে। কী আর করা, টান মেরে পড়ে থাকি এক কোণায়। ইস্টিশনটা তো বাক্কা বড়ই, কিন্তু জনমনিষ্যি নেই দেখি এক্কেবারে। ভোরের আগে ট্রেন নেই দেখেই বোধহয় এমন ভূতুরে অবস্থা, না কি? বাব্বা, এ তো জব্বর ব্যাপার— কর্তাবাবার সেই ইস্টিশনে আমি এখন শুয়ে আছি— আমি অর্জুন নমঃশূদ্র— ডি ভোটার— আমার লিগ্যাসি নেই, কিচ্ছু নেই… অথচ কর্তাবাবা বলেন, ওই কমলারা জান দিয়েছিল বলেই আমরা এখনও বাংলায় কথা বলতে পারি। বাংলায় কথা বলে কী ঘোড়ার ডিমটা হবে যদি আমার লিগ্যাসিই না থাকে…! শালা বাংলা ভাষা…
ওইডা কারা আসে? চার পাঁচটা ছ্যামড়ারা না? এ কী এরা আমারে ঘিরে ফেলছে কেন? কী ভাই তোমরা, কী চাও বলো তো? ইস্টিশনের অল্প অল্প আলোয় ছেলেগুলার মুখ দেখা যায়। না বয়স তো বেশি হবে না— কিন্তু দেখলেই বোঝা যায় নেশা করছে… একটা ছ্যামড়া গালভাঙা-মাথায় বেণি বাঁধা… আমাকে পা দিয়ে গোঁতা মারে… ওই ব্যাটা তুই কোত্থেকে এখানে এলি?
তড়াক করে মাথায় রক্ত উঠে যায় আমার। তবু ঠান্ডা গলায় বলি— সকালের ট্রেন ধরব তো, রাতে থাকার জায়গা নেই, তাই এখানে শুয়ে আছি।
শুয়ে আছি? পোলাডা ভ্যাংচায়। তা বাপ জানো, ইস্টিশনে শুতে গেলে ট্যাক্সো দিতে হয়।
বলে কী ছ্যামড়াটা! পয়সা চায় নাকি? আমি বলি, ট্যাক্সো?
ইয়েস বস ট্যাক্সো, মানে মাল্লু, ছাড়ো ছাড়ো তো দেখি বাপ কী আছে তোমার ধুতিকা ব্যাকপকেটে?
পোলাডা আমার ধুতির কোঁচা ধরে টান দেয়। আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠি। ছেলেগুলা নেশার চোটে ভালোভাবে দাঁড়াতে পারছে না, আমি যদি এক দৌড়ে পালিয়ে যাই… বাইরে কি পুলিশ নেই…
হাওরের রক্ত স্যার শরীরে, হঠাৎ তার ছিঁড়ে যায় আমার, হুঁশ থাকে না, চেঁচিয়ে বলি, লজ্জা লাগে না তোমাদের? এই বয়সে নেশা করে গরীবলোকের পয়সা কেড়ে নিচ্ছ? আমার কথা শুনে ছ্যামড়াগুলো বিশ্রীভাবে হাসে। হায়নার মতো হাসি।
এবার ডর লাগে আমার, হাতজোড় করে বলি, আমাকে ছেড়ে দাও ভাইধনরা, সত্যি বলছি পয়সা নেই, দেখো দেখো… এগুবে না কিন্তু… আমি আমি কিন্তু পুলিশ ডাকব…
পুলিশ ডাকবি? ডাক। ডাক শালা—
ফাইলটাকে বুকে চেপে দু হাতে হাতজোড় করি… ভাই আমি বড় গরীব, বিশ্বাস করো আমার কাছে পয়সা নেই…
নেতাগোছের ছ্যামড়াটা এগিয়ে আসে… তোর ফাইলে কী আছে? টাকা, না? ফাইলটা নে তো বুল্টি।
আমি এবার চেঁচিয়ে উঠি। খবরদার আমার ফাইল ধরবা না। বলছি তো আমার কাছে টাকা নাই— খবরদার বলছি, কেউ এগুবে না। আমার ফাইলে হাত দেবে না বলছি, দোহাই তোমাদের এই ফাইলে টাকা নেই, শুধু আমার লিগ্যাসির কাগজ। আমার ভোটার লিস্ট, ভোটার কার্ড, আমার বাপের জন্ম, আমার জন্ম, আমার স্কুলের সার্টিপিকেট, জমির কাগজ… না না, তোমাদের পায়ে পড়ি ভাইধন, আমার ফাইল… আমার ফাইল… না হলে আমায় বাংলাদেশি বলে লাথি মেরে… ছেলেগুলা আমাকে ঘিরে ধরে… আমাকে টেনে নিয়ে যায় অন্ধকারের দিকে… বলে, দে শালা তোর ফাইল দে, শালা বাংলাদেশি, ফাইলে টাকা রেখে বলছিস টাকা নেই…
(ফাইলটা উপরে উঠে খুলে যাবে। সব কাগজ উড়ে উড়ে পড়বে। অর্জুন হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়বে। দু হাতে ছেঁড়া কাগজ তুলে পাগলের মতো চিৎকার দেবে…)
অর্জুন: আ-আ-আ—। শেষ শেষ সব শেষ সব শেষ— শালা শুয়োরের বাচ্চা পুঙ্গির পুত— আয় শালা মার আমাকে— মার শালা মার আমাকে… আমার আমার ও বাবুমশাইরা, ও স্যার, আমার সব শেষ হয়ে গেল… আমার লিগ্যাসি হারিয়ে গেল— হারিয়ে গেল… এই অলুক্ষুণে রাক্ষুসি ইস্টিশান… আমার সব শেষ, হে জলধর বাবা হে জলধর ঠাকুর…
(মাটি থেকে পাথর তুলে ছুড়ে ছুড়ে মারবে)
অর্জুন: আয় শালা তোদের নেশার মুখে পেছাব করি… আয় কত মারবি, কত মারবি… শালা…
(এবার কিছু একটা দেখে অর্জুন তড়াক করে উঠবে)
অর্জুন: একী, একী, এ কে আসে… একটা মাইয়্যামানুষ, সর্বাঙ্গ রক্তে ভেজা… এ কে, কে ইনি?
(মঞ্চে সাদা শাড়ি পরা মহিলা ঢুকবে। বুকের জায়গাটুকু রক্তে লাল)
অর্জুন: কে? কে আপনি? কন না ক্যানে আপনি কে?
মহিলা: আমি কে? আমাকেই তো খুঁজছ তুমি! চিনতে পারছ না?
অর্জুন: আপনাকে খুঁজছি? আমি? আপনার শরীরে রক্ত ঝরে ক্যান? আপনি কে গো মা?
মহিলা: দেখো, চেয়ে দেখো, চেয়ে দেখো, আমাকেই তো খুঁজছ…
অর্জুন: আবার হেঁয়ালি! ধুর ভাল্লাগে না। আমি মরছি নিজের জ্বালায়, ইনি রক্তারক্তি করে কোত্থেকে এসে বলছেন আমি খুঁজছি এনাকে… আমারে নিস্তার দেন… এমনিতেই লিগ্যাসি খুঁজতে খুঁজতে সর্বস্ব গেল আমার…
মহিলা: এই তো বললে, খুঁজছ, তাহলে? কিছু খুঁজছ তো?
অর্জুন: আপনি কে বটে? হ খুঁজছি, আমার লিগ্যাসি খুঁজছি, আপনাকে তো আর খুঁজছি না…
মহিলা: এখনও চিনতে পারোনি? আমিই তো তোমার লিগ্যাসি। দেখো চেয়ে দেখো, আমিই তোমার লিগ্যাসি। আমি কমলা। নাম শোনোনি? আমি কমলা ভট্টাচার্য।
অর্জুন: কমলা ভট্টাচার্য? কমলা মানে সেই শহিদ কমলা, কর্তাবাবা যার কথা কয়? সেই কমলা ভট্টাচার্য আপনি? আপনি তো নাকি শহিদ হয়ে গেছেন? শহিদ মানে তো মরা, আপনি তো সেই কবে মইর্যা ভূত, কোন একষট্টি না কত সালে?
কমলা: মরেছে যে সে তো আমার শরীর। আমার চেতনার মৃত্যু হয়নি। আমার চেতনার মৃত্যু নেই।
অর্জুন: রাখেন ঠাকরুন রাখেন… এই আপনাদের পড়াশোনা জানা লোকেরা কথা বলে বলে কথা বলে বলে কানের পোকা বের করে দেন… চেতনা না গুষ্টির পিণ্ডি? এই চেতনা ফেতনা ধুয়ে কি জল খাব? পারবে আপনার ওই চেতনার বকবকানি আমার লিগ্যাসি খুঁজে দিতে?
কমলা: ভুল পথে খুঁজলে কোনওদিনই কেউ নিজের লিগ্যাসি খুঁজে পায় না… এটা কেন বোঝো না তোমরা?
অর্জুন: কী ভুল পথ? অ্যাঁ, কী ভুল পথ? দেখেন মা ঠাকরুন, মাথাটা এমনিতে বিগড়ে আছে, আপনার ইস্টিশনের ওই নেশাখোর মাস্তানগুলা আমার সব সাট্টিফিকেট, জমির কাগজ সব ছিড়ে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। আর আপনি বলছেন, ভুল পথ! ভুল পথে কই গেলাম আমি? যে পথেই যাই শুধু মার আর মার। আর কত মার খাব? পুলিশের কাছে গেলে বলে শুধু দে দে আর দে। টাকা দে মাছে দে সবজি দে। কর্তাবাবার কাছে গেলে শুধু লেকচার আর কথার খেলা। প্যাচপ্যাচানি। কী লাভ তাতে বলুন তো? নেতার কাছে গেলাম, তা তিনি এমন দূরের মানুষ, তার কাছে ঘেঁষাই যায় না। রিপোটার ছ্যামড়াটা তো আর একটু হলে বাংলাদেশেই পাঠিয়ে দিয়েছিল আর কী! উকিলবাবু বলেন, জমি বেচো, জমি বেচে টাকা আনো কোর্টের খরচ। আর ঠাকরুন, আপনার ইস্টিশনের ছ্যামড়াগুলাও বলে টাকা দে টাকা দে নেশা করব। সবার শুধু এক কথা, টাকা দে টাকা দে… তো আর কোন পথে যাব আমি?
কমলা: এটাই তো ভুল তোমাদের। পুরো পথটাই ভুল। লিগ্যাসি কি এভাবে খুঁজে পাওয়া যায়? অথচ তোমার লিগ্যাসি তো তোমার নাগালের মধ্যে। সবাই মিলে খুঁজতে হবে। যেভাবে একষট্টিতে সবাই মিলে আমাদের আইডেনটিটি খুঁজতে পথে নেমেছিলাম।
অর্জুন: ঠাকরুন থন আপনার একষট্টির কথা। সে কোন সত্যযুগের কথা। এই যুগে কে কার? আসল কথা হল গরীব বলেই মার খাচ্ছি আমি। গরীব বলেই আমার পাশে কেউ নেই। আমি ছোট জাত, নমঃশূদ্র, মাছ ধরি, তাই বাবুমশাইরা কেউ নেই।
কমলা: তোমার ওই বাবুমশাইদের মাথার উপরেও তো ঝুলছে খাঁড়া, দেখেন না ওঁরা? শোনো, একষট্টিতে কোনও গরীব বড়লোক ছিল না, কোনও জাত ধর্ম কায়স্থ বামুন কৈবর্ত নমঃশূদ্র ছিল না, কোনও হিন্দু মুসলমান ছিল না। আজও যদি তোমরা এসবের ওপর উঠতে পারো, দেখবে তোমার লিগ্যাসি তুমি ঠিকই পেয়ে গেছ। ভাবো, একবার ভাবো, এই স্টেশন থেকে ওই শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্প কত ফার্লং দূরে? তা হলে কেন পারো না তোমরা? আমরা যদি একষট্টিতে ছেলে মেয়ে বুড়ো কিশোর ধনী গরীব বামুন কায়েত হিন্দু মুসলিম সবাই— সব্বাই মিলে পুলিশের বন্দুকের সামনে দাঁড়াতে পারি, যদি পুলিশের চোখে চোখ রেখে বলতে পারি, জান দেব তবু জবান দেব না, তা হলে ক্ত দূর ওই জেলখানা? ওই জেলের সামনে গিয়ে তোমরা বলতে পারো না— না, একজনও অর্জুন নমঃশূদ্রকে জেলে যেতে দেব না, আর একজন বুলু শব্দকরকেও ডিটেনশন ক্যাম্পে মরতে দেব না, আর একজন ডি ভোটারকেও ডিটেনশনে ঢুকতে দেব না… যেদিন সেটা পারবে, সেদিন তোমার লিগ্যাসিও তুমি খুঁজে পাবে… লিগ্যাসি কোড খুঁজছ তো তোমার? লিগ্যাসি কোড? আসামের বাঙালির আসামের সব বাঙালির—সে হিন্দু হোক মুসলিম হোক, বামুন হোক কায়েত হোক কৈবর্ত হোক, ধনী হোক গরীব হোক, সব বাঙালির একটাই লিগ্যাসি— ভাষা— ভাষা— ভাষা— ধর্ম নয়, জাতপাত নয়, ভাষাই তোমার লিগ্যাসি, আর আসামের সব বাঙালির একটাই লিগ্যাসি কোড— উনিশশো পাঁচ উনিশ ছয় এক। বুঝেছ, ওয়ান নাইন জিরো ফাইভ ওয়ান নাইন সিক্স ওয়ান। ১৯৬১-র উনিশে মে।
(নেপথ্যে আস্তে আস্তে বেজে উঠবে ডাক ওই একাদশ শহিদেরা)
অর্জুন: অ ঠাকরুন, এসব কী কন? আমার যে বুক কাঁপে…
কমলা: বুক কাঁপে? এখনও? এখনও বুক কাঁপে? রক্তস্নান দেখোনি এখনও? ওই দেখো, লাশ পড়ে রয়েছে, ওই দেখো। এই যে স্টেশন, চেনো না এই স্টেশনকে? এই স্টেশনে ওই দেখো এখনও পড়ে রয়েছে লাশগুলো… ওই দেখো পড়ে রয়েছে কত কত দেহ, রক্ত ঝরছে কেমন দেখো… চেনো না? চেনো না এঁদের? ওই দেখো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে মানুষগুলো, ওদের পাশে দেখো এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে, ওই দেখো, প্ল্যাকার্ডগুলো… জান দেব তবু জবান দেব না… তুলে নাও, এখনও সময় আছে তুলে নাও ওগুলো, আরও অনেক প্ল্যাকার্ড তোমাদের লিখতে হবে… লিখতে হবে… আমরাও খিলঞ্জিয়া, এই জমিতে আমাদেরও সমান অধিকার… লিখতে হবে আমাদের লিগ্যাসি কোড ১৯ মে, ১৯৬১…
(নেপথ্যে শোনা যাবে পুলিশের হুঙ্কার… ওই এই এন্ধারতে কোনে রখি আছো বে তাতে)
অর্জুন: অ ঠাকরুন পুলিশ আসে যে আবার…
কমলা: পুলিশ? পুলিশকে এখনও ভয় তোমাদের? এখনও? তোমার তো সব গেছে… সবাই মিলে সব কেড়ে নিয়েছে তোমার… শুধু অস্তিত্বটাই এখনও রয়ে গেছে… তোমার পরিচয়টা… এটাও কেড়ে নিতে দেবে? তাহলে আর থাকবে কী? কী থাকবে তোমার যা তোমার ছেলেপুলের জন্য রেখে যেতে পারবে? অর্জুন, সময় আছে, এখনও সময় আছে… ঘুরে দাঁড়াও, ওদের চোখে চোখ রেখে বলো, বলতে শেখো, এই মাটি আমারও, আমিও এখানকার ভূমিপুত্র… ওদের ভাষায় বলো, আমিও খিলঞ্জিয়া…
অর্জুন: হ, হ… আমিও খিলঞ্জিয়া, এই মাটি আমারও, এই দেশ আমারও, আমিও ভূমিপুত্র… তুমি কে হে সুম্বুন্ধির পুত আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার… আমি বানের জলে ভাইস্যা আসি নাই, বুঝলা… মারবা? আমারে মারবা? মারো… পুঙ্গির পুত, মারো… মাইর্যা ছারখার কইর্যা দাও… অনাথবন্ধুও মার খাইছে, আমার বাপও মার খাইছে, এখন আমারেও মারো… একষট্টিতেও গুলি কইর্যা মাইর্যা এইখানে ফালাইয়া গেছলা গিয়া, ভাবছিলা, শেষ পাইছে পুরা জাতটা, তাই না? হইলটা কী? পারলা শেষ করতে? আর কত ফন্দি আঁটবা অ্যাঁ, আঁটো আঁটো… আসাম চুক্তি, এনআরসি, লিগ্যাসি ডাটা, ওআই-এনওআই, খিলঞ্জিয়া… আর কত, আরও কত… কিন্তু বাপধনেরা, সত্যটারে মাইন্যা লও, আমরাও ভূমিপুত্র, খিলঞ্জিয়া, এই মাটি আমারও, দেশভাগ আমার পাপ না, তোমাদের ভুল, তোমাদের লোভ, এর মাশুল আর কত পুরুষ ধরে দেব আমরা… মারবা? মারবা আমারে? মারো মারো শালা মারো, দেখি সত্যরে মাইর্যা শেষ করার ক্ষেমতা রাখে নাকি তোমাদের ওই রাইফেল? আগাইয়া আও, মারো শালা… দেখি আর কত মারতে পারো আমারে…
অভিনেতা: আমাদের নাটক, বুঝতেই পারছেন, এখানেই শেষ। মাথামুণ্ডু কী হয়েছে, আপনারা বলবেন। তবে নাটকটা করতে গিয়ে আমার গোড়া থেকেই একটা খটকা ছিল। কী যেন একটা মিলছে না। যেমন ধরুন, মূল যে ক্যারেক্টারটা, তার নাম অর্জুন নমঃশূদ্র। এই নামটা তো আমাদের চেনা। কিন্তু যদ্দুর জানি, অর্জুন নমঃশূদ্র ডি ভোটার ছিলেন, হ্যাঁ কাটিগড়া হরিকিটরের, কিন্তু তিনি তো সুইসাইড করেছেন সেই টু থাউজেন্ড টুয়েলভে। অথচ দেখুন ওই সময়ে কিন্তু এই এনআরসি বা লিগ্যাসি কোড ফোড ছিল না। ওআই এনওআই তো আরও পরের। তারপর ধরুন, ওই যে নেতার ভাষণ, তাতে নগাঁও শিলাপথারের ইনসিডেন্টের কথা রয়েছে। কিন্তু এই দুটো ইনসিডেন্টই তো একদমই রিসেন্ট। অর্জুন নমঃশূদ্র তো এই সব ঘটনা পাননি। তাহলে? বললাম না, কী যেন একটা মিলছে না, একটা মিসিং লিঙ্ক। ওভারঅল আরও একটা বিষয় আমার একটু খারাপই লাগছিল। কী বলুন তো? ওইসব ডেট-ফেট না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু নাটকটা নাট্যকার শেষ করলেন কীভাবে দেখুন… শহিদ কমলা ভট্টাচার্যকে আনলেন, কমলা ভট্টাচার্যকে দিয়ে বলানো হল যে আমাদের লিগ্যাসি কোড একষট্টির উনিশে মে। ভালো কথা। একটা মেসেজ না হয় দেওয়া হল। কিন্তু মেসেজটা মার খেয়ে গেল, তাই না? কমলা ভট্টাচার্য কাকে বলছেন? বলছেন অর্জুন নমঃশূদ্রকে। কোন অর্জুন নমঃশূদ্র? না, যিনি আত্মহত্যা করেছেন। তাহলে মানেটা গিয়ে কী দাঁড়াল? এটাই কি দাঁড়াল না যে, কমলা ভট্টাচার্যকে দিয়ে লিগ্যাসির ব্যাপারে যে মেসেজটা দেওয়া হল, সেটা আসলে রং মেসেজ, কারণ অর্জুন তো আত্মহত্যা করেছেন। মানে ওই মেসেজ তাঁকে ইন্সপায়ার করতে ব্যর্থ হয়েছে। খটকাটা বুঝলেন ছিল আমার মধ্যে। ফলে নাটকটা যিনি লিখেছেন, তাঁকে সরাসরি একদিন জিজ্ঞেস করলাম। উনি একটা অদ্ভুত কথা বললেন। বললেন, হ্যাঁ, ওই অর্জুনকেই এনেছি নাটকে, যিনি সুইসাইড করেছিলেন টুয়েলভে। হ্যাঁ ওই সময় লিগ্যাসি কোড-ওআই-শিলাপথার-নগাঁও ঘটেনি। তাতে কী, আসলে অর্জুন তো আমরা সবাই। আপনি আমি ওই যিনি বসে এই নাটকটা দেখছেন, উনি… উনি… ইনি, আমরা সবাই তো একেকজন অর্জুন। আপনারা যদি ভাবেন, হুহু বাবা, আমরা তো শহরের, আমাদের ভোটার আইডি কার্ড আছে, প্যানকার্ড আছে, পাশপোর্ট আছে, তাহলেও আপনি অর্জুন নমঃশূদ্র। যদি আপনার মাতৃভাষাটা বাংলা হয়। তো, নাট্যকার বললেন এই কথাটা। আপনি কী বলেন? আপনিও কি সত্যিসত্যিই একজন অর্জুন নমঃশূদ্র? আপনি? আপনি? আপনি? আপনার সামনে ওই যিনি বসে আছেন, তিনি?— অর্জুন নমঃশূদ্র মনে হয় নিজেকে? ভাবুন ভাবুন। এই প্রশ্নের উত্তর আপনাকেই খুঁজতে হবে। ও হ্যাঁ, ওই যে ও দাদা, আপনাকেও বলছি, আপনিও ভাববেন কিন্তু…
সমাপ্ত