কুণাল চট্টোপাধ্যায়
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও তার শতবর্ষ (একটি মতে) নিয়ে বাম মহলে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। অথচ বিস্ময়করভাবে, ভারতের জাতীয় বিপ্লবী আন্দোলনের প্রগতিশীল ধারা এবং শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে সংযুক্তি ঘটিয়ে, কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার চিন্তা ও অনুপ্রেরণা এসেছিল যে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক থেকে, তা নিয়ে আলোচনা, সেই ঐতিহ্যের সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা বা কোনও ধরনের গভীর চর্চা কার্যত অনুপস্থিত।
সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে নরমপন্থী ও বিপ্লবী, এই ভাগ নানা আকারে বহুকাল ধরেই ছিল। বিপ্লবীরাও অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের তত্ত্ব ও অনুশীলনের উন্নতি করতে থাকেন। তাই এ কথা আশ্চর্যের নয় যে ঔপনিবেশিক শাসন নিয়ে কড়া সমালোচনা প্রথম এসেছিল ১৮৫৭-র ভারতীয় মহাবিদ্রোহের পর। মার্ক্সের বন্ধু, চার্টিস্ট আন্দোলন নামে বিখ্যাত ব্রিটিশ শ্রমিক আন্দোলনের বামপন্থী নেতা আর্নেস্ট জোন্স এই সমালোচনাটি করেন। কিন্তু সংগঠনগতভাবে, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বেড়ে ওঠার পর, তার মধ্যে লড়াই বাধে। দ্বিতীয় বা সমাজতন্ত্রী আন্তর্জাতিক ছিল বড় আন্তর্জাতিক সংগঠন। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, ও জাপানের সমাজতন্ত্রীরা এখানে একত্রিত হয়েছিলেন। কিন্তু জাপান বাদে এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বড় অংশ এখানে অনুপস্থিত ছিল। এই আন্তর্জাতিকের ১৯০৭ সালে অনুষ্ঠিত স্টুটগার্ট কংগ্রেসে দেখা গেল যে সংগঠনের নরমপন্থীরা চাইছেন “সমাজতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক নীতি”— অর্থাৎ উপনিবেশ থাকবে, কিন্তু শাসক দেশ শাসিতের “উন্নতির জন্য” কাজ করবে। বামপন্থীরা এর বিরুদ্ধে দাবি করেছিলেন যে উপনিবেশবাদ হল পুঁজির শাসনের এক উৎকট রূপ তাই সরাসরি এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। ১৯১৪ সালে যখন সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হল তখন ওই নরমপন্থীরা নিজ নিজ দেশের সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের পক্ষে অবস্থান নিলেন। আর বামপন্থীদের মধ্যে ফাটল ধরল। একটা অংশ ঐক্যের ধুয়ো তুলে চুপ করে গেলেন।
১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের পরে বলশেভিক নেতৃত্ব নিশ্চিতভাবে মনে করতেন পুঁজিবাদের চেয়ে উন্নত সমাজ সমাজতন্ত্র গড়তে চাই বিশ্ব বিপ্লব। তাই রাশিয়ার স্বার্থে নয়, আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির স্বার্থে তাঁরা এক নতুন বিপ্লবী আন্তর্জাতিক গড়ার ডাক দিলেন। তাঁরা যে নীতিগুলো সামনে রাখলেন তার মধ্যে ছিল সবার ঐক্য নয়, বিপ্লবীদের ঐক্য; নির্বাচন আর ট্রেড ইউনিয়ন— এই দুই কৌশলের বাইরেও কীভাবে বিপ্লবী রণনীতি গড়া যায় তা দেখা, শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই; সমাজের অন্যান্য শোষিতের সঙ্গে জোট গড়া।
প্রথম কংগ্রেস ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট একটা সভা। কিন্তু ১৯২০-র দ্বিতীয় কংগ্রেসের প্রস্তুতির সময় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সচেতনভাবে আজ যেসব দেশকে “তৃতীয় বিশ্ব” বা “দক্ষিণের দেশ” বলা হয়, সেই সমস্ত দেশগুলি থেকে বিপ্লবীদের একজোট করার প্রয়াস নেয়। দ্বিতীয় কংগ্রেস একটি প্রস্তাবে বলে পূর্ববর্তী আন্তর্জাতিক (দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক) কার্যত শ্বেতাঙ্গ মানুষের অস্তিত্ব স্বীকারে সীমাবদ্ধ ছিল। ওই কংগ্রেসে, মেক্সিকোর নবগঠিত কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় বিপ্লবী মানবেন্দ্রনাথ রায়। তিনি বলেন ১৯১৪-র আগে আন্তর্জাতিকের কাছে ইউরোপের বাইরে জগত ছিল না।
ওই দ্বিতীয় কংগ্রেসের সময় থেকে উপনিবেশ-আধা উপনিবেশগুলোতে কমিউনিস্ট দল গড়ার উপরে জোর দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে গ্রহণ করা হয় এক দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি। একদিকে উপনিবেশের শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। কীভাবে তা করা হবে তা নিয়ে লেনিন এবং মানবেন্দ্রনাথ রায় বেশ কিছুটা ভিন্ন মতামত রেখেছিলেন। ভারতীয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রায়ের বক্তব্য ছিল উপনিবেশের বুর্জোয়ারাও বুর্জোয়া, শ্রমিক বিরোধী। বলশেভিকরা রুশ বুর্জোয়া শ্রেণির তীব্র বিরোধিতা করলেও মনে করেছিলেন যে জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে বুর্জোয়া-গণতন্ত্রীদের ভূমিকা থাকবে। লেনিন ও রায়ের দীর্ঘ আলোচনার ভিত্তিতে দুজনের দলিলে পরিবর্তন করা হয়। লেনিন বলেন, তিনি “বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক” কথাটা পাল্টে জাতীয়-বিপ্লবী করছেন কারণ যে বুর্জোয়া মুক্তি আন্দোলন বাস্তবে বিপ্লবী, এবং যারা শ্রমিক-কৃষককে বিপ্লবী চেতনায় সচেতন করার প্রচেষ্টায় বাধা দেবে না, কেবল তাদেরই সমর্থন করা যায়।
অন্যদিকে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক প্রবলভাবে চাপ দিল উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে কমিউনিস্ট পার্টিকে নীতিনিষ্ঠ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী হতে হবে। শোভনলাল দত্তগুপ্ত এবং জন রিডেল তাঁদের গবেষণায় দেখিয়েছেন এই কাজটি কত কঠিন ছিল, কিন্তু বলশেভিক নেতৃত্ব কীভাবে প্রান্তিক দেশের কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে সেই কাজটি করেছিলেন।
প্রথম দিকে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক প্রায় প্রতিবছর একটি করে বিশ্ব কংগ্রেস ডাকত (১৯১৯, ১৯২০, ১৯২১, ১৯২২, ১৯২৪)। ১৯২১-এর তৃতীয় কংগ্রেসে উপনিবেশ-আধা উপনিবেশের কমিউনিস্টরা দলিল-দস্তাবেজ লিখলেও সেগুলি নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি। কিন্তু ১৯২২-এর চতুর্থ কংগ্রেসে ভারত, ভিয়েতনাম, আলজেরিয়া, পারস্য সহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা এ নিয়ে আলোচনার জন্য চাপ দেন। ফরাসি কমিউনিস্টদের তিরস্কার করা হল, কারণ আলজিরিয়া সহ ফ্রান্সের উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে তাঁদের পার্টি যথেষ্ট নীতিনিষ্ঠ ও সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছিল না।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কিন্তু এইসব চিন্তাভাবনা তো মস্কোতে হচ্ছিল। ভারতে তার কী হল? এ প্রসঙ্গে আমরা কয়েকটি জরুরি কথা বলতে পারি। প্রথম কথা হল, প্রকৃত আন্তর্জাতিকতাবাদী সংগঠন গড়া এবং বিপ্লবী নীতি ও কৌশলের তালিম। এই কাজ সচেতনভাবে প্রতিটি দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর ক্ষেত্রেই করা হত। আমরা একটা বিখ্যাত ইউরোপীয় ঘটনার কথা ভাবতে পারি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত পক্ষ হিসেবে জার্মানির উপর বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপানো হয়েছিল। জার্মানি ক্রমেই তা দিতে অক্ষম হলে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদী সরকার চাপ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে জার্মানির রূহর অঞ্চল দখল করে ১৯২৩-এর গোড়ায়। এর জবাবে জার্মান বুর্জোয়া সরকার রাইখ্স্টাগে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেয়। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক আহ্বান করে, প্রলেতারীয় শ্রেণিগত স্বাধীনতা ও আন্তর্জাতিকতাবাদের ভিত্তিতে লড়াই করতে হবে। ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ করে। জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক পত্রিকা রোটে ফাহন্ বুর্জোয়া দলগুলোর সঙ্গে নিজেদের বিরোধিতা স্পষ্ট করে। চান্সেলর উইলহেলম কুনোর সরকার ফ্যাসিবাদী ধাঁচের সংগঠনগুলিকে গোপনে অস্ত্র সরবরাহ করে এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচার করে। সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক দল (সংস্কারপন্থী এবং জার্মানির বৃহত্তম বামপন্থী দল) কার্যত এসব সমর্থন করে। কমিউনিস্ট পার্টি, তার বদলে, ডাক দেয় যে ফরাসি দখলদার ও বার্লিনের দক্ষিণপন্থী সরকার— এই দুইয়ের বিরুদ্ধেই লড়াই করতে হবে। কুনোর সরকার “জাতীয় সঙ্কটের” ধুয়ো তুলে সামাজিক ব্যয় কমানো, এবং শ্রমিক শ্রেণির ওপর আক্রমণ বাড়ায়। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে সাধারণ ধর্মঘট হয় যাতে তিরিশ লাখ শ্রমিক অংশ নেন। ইতিহাসবিদ আর্থার রোসেনবার্গ লিখেছেন, ১৯২৩ সালে জার্মানি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে যতটা এগিয়ে ছিল তা আর কখনও ঘটেনি।
এই ইতিহাস দেখার কারণ, একটা আপাত জটিল পরিস্থিতিতে বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতাবাদ কীভাবে শ্রেণিসংগ্রামের মোড় ঘোরাতে পারে তা বুঝতে সহায়ক হবে। একই চেষ্টা করা হয়েছিল ভারতের মতো দেশের ক্ষেত্রেও। দ্বিতীয় কংগ্রেসে লেনিন যখন বলেছিলেন ‘বুর্জোয়া-গণতন্ত্রী’ নয়, কেবল জাতীয় বিপ্লববাদীদের সমর্থন করা যেতে পারে তখন তিনি এবং রায় একমত ছিলেন যে ভারতের মতো উপনিবেশেও বুর্জোয়াদের সবসময় সমর্থন করা যাবে না।
চতুর্থ কংগ্রেসে বড় সাম্রাজ্যবাদী দেশের পার্টিগুলির সমালোচনা করা হয়, তারা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট সোচ্চার হচ্ছেন না বলে। সুতরাং আন্তর্জাতিক যে ধরনের বিপ্লবী আন্তর্জাতিকতার উপর জোর দিয়েছিল তা থেকে আজকের দিনে কয়েকটা সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি।
প্রথমত, কোনও অবস্থাতেই, এমনকি দেশ যদি সরাসরি সাম্রাজ্যবাদের দখলে থাকে, তাহলেও নিজের দেশের বুর্জোয়া শ্রেণিকে নিঃশর্ত সমর্থন করা যায় না। প্রথম দরকার, শ্রমিক শ্রেণির এবং বিপ্লবী দলের স্বাধীনতা। তারপর ব্যাপকতর নিপীড়িত মানুষের মধ্যে তার মতাদর্শ নিয়ে যাওয়া। এ থেকে যে কথা আরও বোঝা যায়, তা হল, শ্রমিক শ্রেণির সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা আর বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ কর্তৃক প্রচারিত দেশপ্রেম এক নয়। তৃতীয় যে কথা এর সঙ্গে জড়িত তা হল বেশি ক্ষমতাশালী আধিপত্যবাদী বুর্জোয়া রাষ্ট্রের শ্রমিক শ্রেণির এবং কমিউনিস্ট পার্টির কর্তব্য। তাদের ‘নিজেদের’ দেশের বুর্জোয়া শ্রেণির আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা জরুরি।
আমরা যদি আজকের বিশ্ব বা ভারতের দিকে তাকাই তাহলে বুঝব, স্তালিন যুগে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের গোড়ার দিকের নীতির বর্জন এবং তারপর কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের বিলুপ্তি কীভাবে ক্ষতি করেছে। আন্তর্জাতিকতাবাদ যখন পার্টির চেতনা থেকে হারিয়ে যায় তখন প্রতিদিনের বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ তাকে নানাভাবে ঘিরে ধরে। পাঁচের দশক থেকেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি পরমাণু অস্ত্র বিরোধী প্রচার করেছিল। কিন্তু ১৯৭৪ সালে যখন পোখরান-১ পরমাণু পরীক্ষা করা হয় তখন থেকে অদ্ভুত পৃথকীকরণ শুরু হল— জাতীয় বিজ্ঞানীদের প্রশংসা আর সরকারের সমালোচনা। প্রশ্ন হল, একটা নীতিগতভাবে অন্যায় কাজের ভালো দিক আসে কোথা থেকে? উত্তর হল, সরকারের সমালোচনা করেও দেশপ্রেম বজায় রাখার চেষ্টা।
এটাই অনেক তীব্র হয়ে দেখা দিল কাশ্মির প্রসঙ্গে। এই প্রবন্ধে কাশ্মির নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার স্থান নেই কিন্তু আমরা সহজেই দলিল থেকে দেখতে পারি ১৯৪৮ সালের ইন্সট্রুমেন্ট অফ্ অ্যাকসেসন-এ কাশ্মিরের যে অধিকার ছিল, বা সংবিধান সভায় যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তাকে ২০১৯-এর অনেক আগে থেকেই ধাপে ধাপে কমানো হয়েছে। আর আমরা সেই সঙ্গে দেখতে পাই কাশ্মিরের মানুষের প্রতিবাদ প্রসঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টিগুলির দৃষ্টিভঙ্গি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, স্বদেশের বুর্জোয়া শ্রেণিকে সমর্থন; কাশ্মির ‘সমস্যা’ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে বলা; বা ভারতের লাখ-লাখ ফৌজি-আধা ফৌজি নিপীড়ন আর সন্ত্রাসবাদকে দাড়িপাল্লায় সমান করে দেখানো। এ এক অন্যরকমের বামপন্থা, যা শ্রেণিসংগ্রাম নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামকে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের পায়ের নিচে রাখে।
কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক যেধরনের শ্রেণিসংগ্রাম, আন্তর্জাতিক ঐক্য, আন্তর্জাতিকতাবাদের ওপর জোর দিয়েছিল, আজকের ভারতে তিনটি অন্তত কারণে তা খুব জরুরি। বিশ্বায়নের অর্থ, ভারতীয় পুঁজি আজ বিশ্ব পুঁজির অঙ্গ। যখন ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ ইত্যাদি ধুয়ো তোলা হয়, বলা হয়, মোদি কেবল আম্বানি-আদানির মুনাফা দেখছে তখন প্রশ্ন তোলা দরকার, কমিউনিস্টরা কী চাইবেন? সব পুঁজির সমান বিকাশ, না পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াই? পুঁজিবাদের অঙ্গ হিসেবে আমরা ভারতীয় পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা বলব, না স্বাধীন, শক্তিশালী ভারতীয় পুঁজিবাদের শাসনেও দেশপ্রেমের নামে ভারতীয় পুঁজির পক্ষে দাঁড়াব?
দ্বিতীয়ত, সারা পৃথিবীতে পুঁজির নিয়ম মেনে মুনাফার হার বৃদ্ধির জন্য যে যে পদ্ধতি নেওয়া হচ্ছে তার একটা হল বিদেশি শ্রমিকদের শোষণ। দারিদ্রের ফলে বহু দেশের মানুষ অন্য দেশে কাজ করতে যান। ভালো আয়ের আশায় কেউ কেউ ‘বেআইনিভাবেও’ অন্য দেশে যান। সেদেশের পুঁজির মালিকরা একদিকে “আইন” করে তাদের বিপন্ন করে রাখে। আবার অন্যদিকে এই বিপন্ন পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে জঘন্য মজুরিতে, জঘন্য কাজের পরিবেশে, তাদের কাজ করতে বাধ্য করায়। ভারতে এনআরসির মাধ্যমে এক বিরাট সংখ্যক মানুষকে যেভাবে অত্যাচার করার কাজ শুরু হয়েছে তার থেকে একটা দিক (অবশ্যই সবটা নয়) হল পুঁজির স্বার্থে সস্তা শ্রমিকের যোগান তৈরি করা। আন্তর্জাতিকতাবাদের দিশা না থাকলে এর বিরুদ্ধে যথাযথভাবে লড়াই করা যায় না। সিপিআই (এম) যখন অসমে বা ত্রিপুরায় এনআরসির পক্ষে কথা বলে তখন আমরা দেখি আঞ্চলিকতাবাদ ও উগ্র দেশপ্রেমের কাছে আন্তর্জাতিকতাবাদ কীভাবে হেরে যেতে থাকে।
তৃতীয় প্রসঙ্গ হল পৃথিবী জুড়ে উষ্ণায়ন এবং আবহাওয়ার পরিবর্তন। পরিবেশের ক্ষয় সীমান্ত মানে না। অন্যদিকে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার প্রভাব কিন্তু শ্রেণিগতভাবে আলাদা হয়। আজ দিল্লিতে পরিবেশ দূষণের সঙ্গে এসেছে অক্সিজেন পার্লার। বিত্তবানরা নিজেদের বাড়িতে বায়ু পরিষ্কার করার যন্ত্র রাখবে আর রাস্তায় কষ্ট হলে টাকা দিয়ে পরিশুদ্ধ বায়ু সেবন করবে। শ্রমিক শ্রেণি কিন্তু শ্বাসকষ্টে ধীরে ধীরে রোগগ্রস্ত হবে। মেরু অঞ্চলের তুষার গলে সমুদ্রের জল বাড়লে তৈরি হবে নতুন এক ধরনের শরণার্থী— পরিবেশগত শরণার্থী। ভেবে দেখুন, কলকাতার অপেক্ষাকৃত বিত্তবানরা সময়মতো বারাসাত দুর্গাপুর আসানসোলে দ্বিতীয় ফ্ল্যাট কিনে রাখবে কিন্তু দক্ষিণ ২৪ পরগণার গরিব চাষি, শ্রমিক-ক্ষেতমজুর কাজ হারিয়ে কোথায় যাবে? পরিবেশ সঙ্কটের আরও বহু মাত্রা আছে যেখানে শ্রেণি, জাত, লিঙ্গভিত্তিক অসাম্য মানুষের ওপরে চাপ বাড়াবে কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে সব নিপীড়িত মানুষের ঐক্য এবং সীমান্তের কাঁটাতার পেরিয়ে ঐক্য জরুরি। সুন্দরবন ধ্বংস হলে সীমান্তের বাধা মানবে না। এমন বহু উদাহরণ টানা যায়। অথচ কমিউনিস্ট দলগুলি যদি কিছু গোল গোল আনুষ্ঠানিক কথা বলে কাজ সারেন, জোট বেঁধে সাধারণ রণকৌশল নির্ধারণ করার কথা না ভাবেন— যেমন ভেবেছিল গোড়ার দিকের কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক— তাহলে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে শ্রেণিভিত্তিক লড়াই সম্ভব নয়। আর সে রকম ক্ষেত্রে খেটেখাওয়া মানুষকে টেনে নেয় উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতি, কল্পিত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামিয়ে। অত্যাচারিত মানুষ অত্যাচারের মূল কারণ না বুঝলে কল্পিত শত্রুদের (জাতীয়, ধর্মীয়, জাতভিত্তিক, ভাষাভিত্তিক) ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তাই কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের প্রথম পাঁচ বছরের ইতিহাস, ভারতে তার প্রভাব এবং আজকের দিনে তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে চর্চা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।