ঈশিতা ভাদুড়ী
দিদিমার বাড়িতে বেড়াতে গেলে ‘ইলাবাস’-এর দেওয়ালে টাঙানো ‘সপ্তাশ্ববাহিত সূর্য’ ছবিটি অপার বিস্ময়ে দেখতাম— বিশ্বকবি ছাড়াও সাত-সাতজন কবি-লেখক একসঙ্গে, তাঁদের মধ্যে একজন আবার আমার মায়ের পিতামহও— এও কি কম আশ্চর্যের ছিল সেই বালিকার কাছে, সেই কিশোরীর কাছে! প্রমাতামহ যতীন্দ্রমোহন বাগচী যে রবীন্দ্রোত্তর যুগের অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক কবি ছিলেন, সেই সত্যটি বুঝতে অবশ্য বেশ কিছু সময় লেগেছিল। অনেকদিন অবধি যতীন্দ্রমোহন আমার কাছে একটি নাম ছিলেন মাত্র আর স্কুল-পাঠ্য বইতে-পড়া কবিতার রচয়িতা। দিদিমা এবং মায়ের কাছে শোনা গল্পই হোক্, অথবা প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘মাগো আমার শোলোক বলা কাজলা দিদি কই’-ই হোক্, অথবা গৌরী ঘোষের কণ্ঠে ‘পায়ের তলায় নরম ঠেকল কী’-ই হোক্, কে যে মন্ত্রমুগ্ধের মত আমাকে টেনে নিয়ে গেল ধীরে ধীরে!
পরবর্তীকালে লক্ষ্য করলাম যতীন্দ্রমোহন রবীন্দ্রানুসারী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। একথা ঠিক, তিনি রবীন্দ্রধারায় কবিতা লিখতে আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু তাঁর পদক্ষেপটি ছিল একেবারেই তাঁর নিজস্ব। এবং ক্রমে তিনি স্বস্থানে যথেষ্টই উল্লেখযোগ্য স্বাক্ষর রেখেছেন। রবীন্দ্রনাথের লেখনী যখন প্রবল তেজের সঙ্গে চলেছে, সেই সময় দাঁড়িয়ে প্রখর সূর্যের তাপে দগ্ধ না হয়েও যতীন্দ্রমোহন যে এমন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে নিজস্ব স্থান করে নিতে পেরেছিলেন, এ বড় কম কথা নয়।
যতীন্দ্রমোহনের সাহিত্যকৃতি নিয়ে নয়, আজ তাঁর ব্যক্তিচিত্র আঁকতেই বসেছি। যদিও তাঁর বালক-বয়স যমশেরপুরেই অতিবাহিত হয়েছে, পরবর্তীকালে তিনি যমশেরপুর থেকে কলকাতায় এসে প্রথমদিকে পৈতৃক বাড়ি আরপুলি লেনে যমশেরপুর হাউসে বসবাস করতেন। সেখানে একটি আড্ডার আসর বসত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য প্রতিভাবান মানুষেরও পদার্পণ হয়েছিল সেই বাড়িতে, সঙ্গীত সাহিত্য রাজনীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন মজলিশে। সেই মজলিশের আকর্ষণ এড়ানো খুবই কঠিন ছিল অন্য মানুষদের পক্ষে। কাজী নজরুলের উপস্থিতিতে সেই আসর আরও জমজমাট হয়ে উঠত, তিনি একাই একশো ছিলেন। নজরুলের গানে, আবৃত্তিতে, অট্টহাসিতে আকৃষ্ট হয়ে পথচারীরাও এসে হাজির হতেন। কাজী নজরুল নাকি তাঁর বিবাহের দিন বিবাহ-পর্ব সেরে আরপুলি লেনের মজলিশে এসে বসেছিলেন এবং গল্পে গানে আলোচনায় সম্পূর্ণ আত্মবিস্মৃত হয়েছিলেন। রাত বারোটার সময় যতীন্দ্রমোহনের হঠাৎ খেয়াল হয় এবং তখন নজরুলকে তিনি তিরস্কার করে বাড়ি পাঠান। কাজী নজরুল ইসলাম যতীন্দ্রমোহনের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন। তিনি যতীন্দ্রমোহনকে ‘যুবরাজ’ বলে সম্বোধন করতেন।
কাজী নজরুলও যখন খুশি চলে আসতেন যতীন্দ্রমোহনের বাড়িতে। “উনি আসা মানেই আনন্দের ঢেউ ওঠা বাড়িতে। এসেই যতীনদা বৌদি বলে চিৎকার। কি দরাজ গলা, মনে হত দিলখোলা মানুষ, কোনও মারপ্যাঁচ নেই। নাহলে কি কেউ ঐরকম প্রাণখোলা হা-হা করে হাসতে পারেন! এসেই ‘কই, হারমোনিয়াম কই? যতীনদা, গান লিখেই সুর দিয়ে চলে এসেছি আগে আপনাকে শোনাব বলে।’ ব্যস হারমোনিয়াম এসে গেল, প্রচুর পান এসে গেল (খুব পান খেতেন) সঙ্গে সঙ্গে।”
যতীন্দ্রমোহন শুধু কবিতামনস্ক ছিলেন তাই নয়, অত্যন্ত সঙ্গীতপ্রিয়ও ছিলেন। গায়ক নলিনীকান্ত সরকার লিখেছেন— “কেবল বাংলা কাব্যসঙ্গীতই নয়, হিন্দুস্থানি মার্গসঙ্গীতেও তাঁর সমান অনুরাগ ছিল। একটি দিনের বিশেষ অনুষ্ঠানের কথা বলি। মার্গসঙ্গীতের আসর। গায়ক ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বনামধন্য সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার। টপ-খেয়াল গানে সারা ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণী শিল্পি সুরেনবাবু। অতি সুমিষ্ট কণ্ঠ— যেটা ওস্তাদ গাইয়েদের মধ্যে খুব কমই মেলে। যতীনদা এ আসরের মর্যাদা আরও বাড়িয়েছেন, এ আসরের প্রধান শ্রোতা রবীন্দ্রনাথ। দিলীপকুমার রায়, হেমেন্দ্রকুমার রায় প্রভৃতি আরও অনেকে নিমন্ত্রিত হয়েছেন। দোতলার হলঘরে গানের আসর বসল। রবীন্দ্রনাথ এলেন। সুরেনবাবু আগেই এসেছেন। যতীনদাই রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে করে উপরে নিয়ে এলেন। কবিকে আসরে স্বাগত জানালেন স্বয়ং সুরেনবাবু। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুরেনবাবুর পূর্ব পরিচয় ছিল। এর আগে তিনি রবীন্দ্রনাথকে একাধিকবার তাঁর গান শুনিয়েছেন। তানপুরা, তবলা সুরে বাঁধা হল। আরম্ভ হল গান। সুরেনবাবু সুরের সুধা নির্ঝর বর্ষণ করলেন প্রায় দুঘণ্টা ধরে। গান শেষ হবার অব্যবহিত পূর্বে দিলীপকুমার রবীন্দ্রনাথের কাছ ঘেঁসে গিয়ে রবীন্দ্রনাথকে কী যেন বললেন। গান শেষ হতেই রবীন্দ্রনাথ সুরেনবাবুকে অনুরোধ করলেন, ‘আর একটি গান শুনতে চাই।’ কৃতার্থ হয়ে সুরেনবাবু বললেন— ‘কী গান শুনতে চান বলুন।’— ‘কেদারের গান।’… রবীন্দ্রনাথকে বললেন ‘ও গান গানই নয়, একটা ক্যারিকেচার। ও আপনার কাছে গাওয়া চলে না।’ রবীন্দ্রনাথের আরও আগ্রহ বেড়ে গেল কেদারের গান শোনার জন্য। বললেন ‘শোনাতেই হবে আপনাকে।’ সুরেনবাবু গাইবেন না, রবীন্দ্রনাথও ছাড়বেন না। অগত্যা শেষ পর্যন্ত সুরেনবাবু সম্মত হলেন। এবারে তানপুরা নয়। সুরেনবাবু হারমোনিয়াম নিয়ে কেদারের গান ধরলেন। কেদার নামক এক ব্যক্তির কণ্ঠে আদৌ সুরের বালাই নেই। সাতটি স্বরের একটি স্বরও গলা দিয়ে বেরোয় না। সম্পূর্ণ বেসুরো। কিন্তু কি আশ্চর্য, অমন যে সুমিষ্ট সুরেলা-কণ্ঠী সুরেনবাবু হারমোনিয়াম বাজিয়ে আগাগোড়া একটি গান বেসুরো কণ্ঠে গেয়ে গেলেন। আসরে স্রোতাদের হাসির রোল উঠল। সুরের ওপর কতটা দখল থাকলে সাতটি স্বরকে বিকৃত করে গাওয়া যায়, একথাও জাগল অনেকের মনে। রবীন্দ্রনাথ অভিভূত।”
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
(২৭/১১/১৮৭৮ – ১/২/১৯৪৭)
পরবর্তীকালে যতীন্দ্রমোহন হিন্দুস্থান পার্কে অনেকখানি জমি নিয়ে মনের মত করে বাড়ি করেছিলেন, সামনে বিরাট বাগান। তিনি শৌখিন ছিলেন খুব। ফুলের ওপর তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। গেটের মাথায় হাস্নুহানা, গেট দিয়ে ঢুকে তারপর দুধারে ফুলবাগান, বেল, জুঁই, চাঁপা, গন্ধরাজ, গোলাপ, কামিনী, ম্যাগনোলিয়া, ডালিয়া, এমন কোনও ফুল-গাছ নেই, যে গাছটি ছিল না তাঁর বাগানে। সেই ফুলবাগান পার করেই বাড়ির সামনে ছিল লম্বা টানা বারান্দা। সেই খোলা বারান্দায় কার্পেটের ওপর তাকিয়া নিয়ে বসে থাকতেন যতীন্দ্রমোহন। সামনে ছোট ছোট কাচের বাটিতে বিভিন্ন সুগন্ধী ফুল রাখতেন, সেই সব ফুলের ভরপুর গন্ধ নিতে নিতে তিনি লিখতেন। যখন লিখতেন না তখন পারিবারিক গল্পগুজবও চলত। শুধু ফুল নয় বিভিন্ন ফলেরও গাছ ছিল। তাঁর ঘরের পাশেই একটি লেবু গাছ ছিল, লেবু-গন্ধে ম-ম করত ঘরটি সারা দিন সারা রাত। বাড়ির নাম দিয়েছিলেন ‘ইলাবাস’।
সেই ইলাবাসেও একইরকম মজলিশ অব্যহত রেখেছিলেন তিনি। যতীন্দ্রমোহনের খুব রসবোধও ছিল। ইলাবাসে একতলায় একটি বিরাট হলঘর ছিল, সেইখানে বিভিন্ন খ্যাতনামা সাহিত্যিক কবি সঙ্গীতজ্ঞ ও যন্ত্রশিল্পীদের সমাবেশ হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সেই হলঘরে কবিতা পাঠ করেছিলেন, গান গেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘ইলাবাস’-এ প্রথম আসার দিনটিও বিশেষ ঘটনাবহুল, যতীন্দ্রমোহনের কনিষ্ঠা কন্যা সেই ঘটনা বর্ণনা করেছেন— “কবিগুরু পিতার নবনির্মিত বাড়ি দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করায় পিতৃদেব সানন্দে তাঁকে নিয়ে আসার দিন স্থির করে তাঁকে আনতে গিয়ে শুনলেন, ইলাবাসে আসা মনস্থ করার পর রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, হার্টে গোলমাল দেখা দিয়েছে— তাই জোড়াসাঁকো থেকে বালিগঞ্জ এত দূর পথ আসতে দিতে ডাক্তাররা রাজি হচ্ছেন না। একথা শোনার পর পিতৃদেব তাঁর আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নেন এবং রবীন্দ্রনাথকে ডাক্তারের নির্দেশ মানার জন্যে অনুরোধ করেন। তাতে রবীন্দ্রনাথ হেসে বলেন ‘তুমি যদি এখন আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করো, আমি নিরুপায়। কথা রাখার সঙ্কল্পে আমি ডাক্তারদের বলেছি, যতীনের কাছে আমি কথা দিয়ে তা না রাখতে পারলে আমার হার্টের ক্রিয়া যে আরও খারাপ হবে না, বলতে পারো? এতে আমারও অশান্তির শেষ থাকবে না। আমি যাবই।’ এর পর তিনি যে শুধু এলেন, তাই নয়, রাত্রের আহার্যও গ্রহণ করলেন। আমার মা যখন তাঁকে কিছু মুখে দেবার আহবান করলেন, তিনি বলে ওঠেন ‘কিছু মানে ? তুমি কি ভেবেছ বাড়ি ফিরে আমি বাজারের খাবার খাব? বাড়িতে আমি বারণ করে এসেছি’।”
যতীন্দ্রমোহন বাগচীর বাড়ি ইলাবাসে পূর্ণিমা সম্মিলনীর অধিবেশনে প্রবন্ধ পাঠ, সাহিত্যালোচনা, সঙ্গীত ইত্যাদি হত। করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, হেমেন্দ্রকুমার রায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, কালিদাস রায়, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, মেঘনাদ সাহা, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, নরেন্দ্র দেব, রাধারাণী দেবী প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকদের মজলিশ বসত তাঁর বাড়িতে, সেই হলঘরে। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের গানে, রাধিকামোহন মৈত্রের বাজনায়, এবং ড. মেঘনাদ সাহা, ড. কালিদাস নাগ, ড. কালীকিঙ্কর সেনগুপ্ত, ড. সুনীতি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে সেই সব অধিবেশন অন্য মাত্রা পেত। গানের আসরে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, রাধিকা গোস্বামী, জ্ঞান গোস্বামী, গিরিজাভূষণ, শচীন দেববর্মন, নলিনীকান্ত সরকার প্রমুখ অনেক বিখ্যাত গায়ক অংশ নিতেন। এরকম বিভিন্ন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের সমাবেশে যতীন্দ্রমোহনের বাড়িতে আড্ডা উচ্চপর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছিল। এছাড়া জলধর সেন, নন্দলাল সেনগুপ্ত, অনুরূপা দেবী, ড. সুরেন দাশগুপ্ত, ড. রমাপ্রসাদ চন্দ, যোগীন্দ্রনাথ গুপ্ত, চারুচন্দ্র দত্ত, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রবোধ সান্যাল, বীরেন ভদ্র প্রমুখ বিভিন্ন ব্যক্তির সমাগমও ইলাবাসে কোনও-না-কোনও সময়ে হয়েছে।
শচীন দেববর্মনের সঙ্গেও যতীন্দ্রমোহনের যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। শচীন দেববর্মন যতীন্দ্রমোহনের বাড়িতে এসে গান শুনিয়ে যেতেন, যতদিন না বোম্বে গিয়েছিলেন। যতীন্দ্রমোহনের কনিষ্ঠা কন্যা গীতা চৌধুরীর লেখা পড়ে জানা যায় যে শচীন দেববর্মন প্রথম গানের রেকর্ড যতীন্দ্রমোহনের গান দিয়েই শুরু করেন।
যতীন্দ্রমোহন নাট্যমোদীও ছিলেন, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, নির্মলেন্দু লাহিড়ীর সঙ্গেও খুব যাতায়াত ছিল বলে জেনেছি যতীন্দ্রমোহনের কন্যা ঊর্মি সান্যালের স্মৃতিকথায়— “আমরা থিয়েটারে গেলে বেশ মনে আছে, ওঁরা ফাঁকে ফাঁকে এসে বাবাকে জিজ্ঞেস করে যেতেন— কী রকম হচ্ছে। আর মাকে যে কি শ্রদ্ধাভক্তির সঙ্গে বৌদি বলে ডাকতেন।”
আগেই বলেছি যতীন্দ্রমোহন অনুজ কবি-লেখকদের কাছেও খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। যতীন্দ্রমোহনের কাছে যে কোনও সময়েই তাঁদের ছিল অবারিত দ্বার। “বেশ মনে পড়ে, মাঝে মধ্যেই গভীর রাতে হেমেন্দ্রকুমার রায় মানে আমাদের হেমেনকাকাবাবু কাকিমাকে নিয়ে এসে দরজায় ধাক্কা দিতেন। তখন দরজা খুলে এত রাতে বাবা মা দাদারা সব উঠে হলঘরে একটি জমাট আড্ডা।… বাবা অত রাতে কাকাবাবুর আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে কাকাবাবুর উত্তর— ঘুম আসছিল না, ইচ্ছে হল আপনার কাছে আড্ডা দিয়ে আসি, চলে এলাম।”
যদিও যতীন্দ্রমোহনের জীবনের অধিকাংশ সময়ই কলকাতায় অতিবাহিত হয়েছে, তবুও পল্লীগ্রামের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি। দুর্গাপুজোয় এবং বিভিন্ন সময়ে তিনি পৈতৃক বাড়িতে যমশেরপুরে যেতেন, গ্রামবাংলার রস আস্বাদন করতেন। দুর্গাপুজোর সময় প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে গানের আসর বসত, যাত্রাভিনয় হত। নলিনীকান্ত সরকার যমশেরপুরে সেই অনুষ্ঠানে গিয়ে অভিনয় করেছেন বলে তাঁর স্মৃতিকথা ‘হাসির অন্তরালে’ থেকে জানা যায়— “নেমে পড়লাম যাত্রার আসরে সাজপোষাক পরে, খালি গা, পরণে লুঙ্গি, হাতে লাঠি, মাথায় টুপি। আসরে নেমে যখন ভাবের অভিব্যক্তির সঙ্গে গান ধরলাম… তখন দর্শকেরা আমাকে দেখবে কি যতীনদাকে দেখবে ঠিক করতে পারছে না। যতীনদার সে কী উল্লাস!”
যতীন্দ্রমোহন গ্রামে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলালের বহু নাটক তাঁর অগ্রজ, অনুজ এবং তাঁর পুত্র-কন্যাদের দিয়ে অভিনয় করাতেন এবং নিজেও করতেন। একবার পুজোর সময় মহাসমারোহে দ্বিজেন্দ্রলালের ‘শাজাহান’ নাটক মঞ্চস্থ হয়, যতীন্দ্রমোহন শাজাহানের ভূমিকায় অপূর্ব অভিনয়-কলার পরিচয় দেন। মহারাজ জগদীন্দ্রনাথও যতীন্দ্রমোহনের যমশেরপুরের বাড়িতে আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন। এবং সান্ধ্যকালীন গানের মজলিশে তবলা ও পাখোয়াজ সঙ্গত করেছেন।
যতীন্দ্রমোহন যখন যমশেরপুরে যেতেন, গ্রামে গিয়ে তিনি ছিপ দিয়ে গ্রামের বড় পুকুর থেকে বড় বড় মাছ ধরতেন। প্রতিটি মুহূর্তই তিনি গ্রাম্য পরিবেশকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতেন। এবং সেই অনুভবের থেকেই তাঁর একের পর এক নির্মাণ। তাঁর কবিতায় পুকুরের বর্ণনার খাঁটি চিত্র দেখা যায় সেই কারণেই। গ্রামে গিয়ে তাঁদের হাউস-বোটে পদ্মা ও জলঙ্গি নদীতেও বেশ কয়েকদিন কাটাতেন। সম্ভবত তাঁর ‘পদ্মাতীর’ কবিতাটিতে যতীন্দ্রমোহন তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতাকেই কাব্যরূপ দিয়েছেন অনবদ্য ভাষায় ও সুষম ছন্দে।
আগেই বলেছি, শুধুমাত্র সাহিত্যক্ষেত্রে নয়, তদানীন্তন সকল জরুরি ক্ষেত্রেই যতীন্দ্রমোহন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। জাতিভেদ অস্পৃশ্যতা ও তৎকালীন অসামাজিক অত্যাচার তাঁর মনকে ব্যথিত করেছিল। ড. নলিনাক্ষ সান্যাল ও ড. জ্ঞানেশ নারায়ণ বাগচীর সাহায্যে যমশেরপুর গ্রামে ‘জল চল’ আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন এবং সেই আন্দোলনকে সর্বপ্রকারে সফল করার যাবতীয় চেষ্টা করেছিলেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্খীদের নিন্দা ও বারণ উপেক্ষা করে সেই সভায় নমঃশূদ্র পরিবারের থেকে জল পান করে সেই যুগে জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতার কুসংস্কার ভাঙার সূচনা করেন এবং সফলও হন।