সম্পর্ক মন্ডল
উত্তর রাঢ়ে যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রাম আছে, তার মধ্যে অন্যতম হল নৈহাটি গ্রাম। বাংলার ইতিহাসে যে গ্রামটি প্রাচীনকাল থেকে নবহট্ট বলে প্রচারিত ছিল, কালক্রমে নবহট্ট থেকে নৈহাটি নামে পরিচিত হয়। নবহট্ট থেকে নৈহাটি নামের উৎস নিয়ে অনেক মত প্রচারিত আছে, যেমন নবহট্ট নামটির অপভ্রংশরূপে ন্বহাটি > নৈহাটি হয়েছে, অন্যমত অনুযায়ী মধ্যযুগে নৈহাটি গ্রামের নৈরাজা নামে একজন সামন্ত রাজা বা জমিদার ছিলেন, এই নৈরাজার স্থান থেকে নৈহাটি নামটি এসেছে, তবে দ্বিতীয় মতটির চেয়ে প্রথম মতটির গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি।
কুয়াশা ঘেরা নৈহাটি গ্রাম
জানা যায়, এই নৈরাজার দরবারে দেওয়ানের কাজে নিযুক্ত ছিলেন নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর দ্বাদশ গোপালের অন্যতম ষষ্ঠগোপাল ‘সুবাহু’ উদ্ধারণ দত্ত, আবার অন্য একটি মতানুসারে নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর কাছে দীক্ষার আগে উদ্ধারণ দত্ত গৌড়রাজ হোসেন শাহের কাছ থেকে নৈহাটি গ্রামের জমিদারি লাভ করেন এবং দীক্ষার পর আর তিনি নৈহাটিতে বাস করতেন না, কারণ তার বৈষ্ণব সাধনক্ষেত্র ছিল উদ্ধারণপুর। পরে যাঁর নাম থেকেই রাধাকৃষ্ণপুর গ্রাম উদ্ধারণপুর নামে পরিচিত হয়। অন্যদিকে, লেখক অবধূতের কল্যাণে উদ্ধারণপুর ঘাটের কথা তো মানুষের মুখে মুখে ফেরে আজও। একসময় এই নৈহাটিতেই বাস করতেন পরম বৈষ্ণব চৈতন্য-পরিকর দুই বিখ্যাত মানুষ রূপ গোস্বামী (হোসেন শাহের দবিরখাস) ও সনাতন গোস্বামী (হুসেন শাহের সাকর মল্লিক)-দের প্রপিতামহ পদ্মনাভ কিন্তু পদ্মনাভ নৈহাটির আদি বাসিন্দা ছিলেন না। তিনি রাজা দনুজমর্দনের অনুরোধে মানভূম (তৎকালীন নাম ছিল শিখরভূম) থেকে এসে এখানে তার বাস্তুভিটা নির্মাণ করান এবং মুর্শিদাবাদের দক্ষিণখন্ডে গোস্বামী বংশীয় একজনের কাছে দীক্ষালাভ করেন আর এখানেই বাকি জীবনটা কাটিয়েছিলেন। যদিও পদ্মনাভরও পূর্বপুরুষ রূপেশ্বর এসেছিলেন দক্ষিণ ভারতের কর্নাটক থেকে শিখরভূমে। পদ্মনাভ নৈহাটিতে এসে জগন্নাথদেবের সত্রোৎসব বা রথযাত্রার প্রচলন করেন। ঐতিহাসিক রজনীকান্ত চক্রবর্তীর লেখাতে পাওয়া যায়, চৈতন্যদেবের দীক্ষালাভের আগে কাটোয়ার চেয়েও উল্লেখযোগ্য গ্রাম ছিল নৈহাটি। এই পদ্মনাভের সন্তান বা রূপ ও সনাতনের এবং বল্লভের পিতা ছিলেন কুমার দেব। কুমার দেব একজন মহাপণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন কিন্তু নৈহাটির বাসস্থানকে কেন্দ্র করে তিনি ক্রমশ জ্ঞাতিবিরোধের সম্মুখীন হলে, তখন এখানকার বাসস্থান ত্যাগ করে বর্তমান বাংলাদেশের যশোরে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। এককালে রূপেশ্বর কর্নাটক থেকে জ্ঞাতিভাইদের সাথে বিবাদের জন্যই শিখরভূমে এসেছিল। একইভাবে কুমারদেবকেও নৈহাটি ছাড়তে হয় এবং পূর্ববঙ্গে চলে যেতে হয়। তবে সেই গৌড়রাজের যুগ থেকেই এই গ্রামে বৈষ্ণব পণ্ডিতদের বসবাস ছিল, তাদের উল্লেখযোগ্য ছিলেন শ্রী সর্বানন্দ সিদ্ধান্ত বাচস্পতি, যিনি সনাতন গোস্বামীর শিক্ষাগুরু ছিলেন এবং নরোত্তম দত্তের শিষ্য পণ্ডিত তথা সাধক শ্রী শঙ্কর ভট্ট। শ্রী শ্রী গৌড়ীয় বৈষ্ণব তীর্থ-এর তথ্যানুসারে, এই নৈহাটি গ্রাম তৎকালীন সময়ে বিখ্যাত ছিল সংস্কৃত ভাষায় বিভিন্ন গ্রন্থ সঙ্কলনের জন্য এবং এইসব লেখকরা চৈতন্যদেবের আশীর্বাদধন্য ছিলেন।
কল্লোলিনী ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত নৈহাটি গ্রামটির প্রাচীন অবস্থানের সঙ্গে আজকের অবস্থানের কিছুটা অমিল আছে। কারণ তখন ভাগীরথী নদী আরও পশ্চিমে ছিল, তারপর নদীটির ধারা ধীরেধীরে পূর্বদিকে সরে গেছে। তাই আজকের ভাগীরথী ও নৈহাটির সাথে এক সারিতে তাকে মেলানো ভুল।
ভাগীরথী তীরবর্তী নৈহাটির বিভিন্ন রূপ
প্রাচীনকালে একপথেই নৈহাটি, কঙ্কগ্রাম (বর্তমান মুর্শিদাবাদের কাগ্রাম) এবং কর্ণসুবর্ণ হয়ে গৌড়ে যাওয়া যেত। আবার অবস্থানগতভাবে ধীরে ধীরে নৈহাটির গুরুত্ব হারাতে থাকে সেই মধ্যযুগের পর থেকেই কারণ কৃষ্ণদাস কবিরাজের জন্মস্থান হিসাবে ঝামটপুর বিখ্যাত হতে শুরু করে বৈষ্ণবদের কাছে। তবে নৈহাটি খ্যাতিলাভ করে লক্ষ্মণ সেনের তাম্রশাসনখ্যাত গ্রাম হিসাবে। আনুমানিক ১১৬৯-৭০ সনে বল্লাল সেনের তাম্রশাসনে উল্লেখিত উত্তর রাঢ়মণ্ডলের দক্ষিণবীথির অন্তর্গত গ্রাম হল নৈহাটি। তৎকালীন সময়ে সেনরাজাদের চারটি রাজধানীর কথা জানা যায়, যথা বিক্রমপুর (বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকার কাছে), গৌড়-লক্ষণাবতী (মালদার কাছে), স্বর্ণগ্রাম (মুর্শিদাবাদে) এবং নবদ্বীপ। তার মধ্যে বিক্রমপুরকে বাদ দিলে বাকি তিনটি রাজধানী ছিল একই পথে। সেন রাজারা উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে যাত্রা করলে ক্রমে গৌড়-লক্ষণাবতী, স্বর্ণগ্রাম এবং নবদ্বীপ পরপর আসবে, উল্লেখযোগ্যভাবে স্বর্ণগ্রাম এবং নবদ্বীপের মধ্যের রাস্তায় অবস্থান ছিল নৈহাটির। সেহেতু সেসময়ে নৈহাটির একটা আলাদা গুরুত্ব ছিল। ১৯১১ সালে নৈহাটি থেকে তাম্রশাসনটি উদ্ধার করা হয়। লেখক বঙ্কিম চন্দ্র ঘোষের গ্রন্থ ‘রাঢ়ের বৈষ্ণব তীর্থ পরিক্রমা’ থেকে জানা যায়, অর্ধনারীশ্বরকে বন্দনা করে বল্লাল সেনের লিপিটি শুরু হয়েছে—
সন্ধ্যাতাণ্ডব সন্নিধান বিলসন্নান্দী নিনাদোর্মিভি —-
নিমর্যাদরসার্ণবো দিশতু বঃ শ্রেয়োর্ধনারীশ্বরঃ।
যদিও ওই তাম্রশাসনে রচয়িতার নাম নেই কোনও। একাদশ শতকের কেতুগ্রাম থানার ইতিহাসের আকর হিসাবেই এই লিপিটির গুরুত্ব অসীম। এই লিপি অনুযায়ী, সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে বল্লাল সেনের মা বিলাসদেবী হেমাশ্ব দক্ষিণাস্বরূপ সামবেদী ব্রাহ্মণ বাসুদেব শর্মাকে উত্তর রাঢ়ের কয়েকটি গ্রাম যেমন— বাল্পছীটা গ্রাম (বালুটিয়া গ্রাম), অম্বুলিমা (অম্বলগ্রাম), মোড়ালডি (মুরুন্দি), জলশৌখী (জলসুতি) দান করেছিলেন। লিপিটি থেকে তৎকালীন সারস্বত সাধনার চিত্রটিও দারুণভাবে ফুটে ওঠে। আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক নৈহাটি সম্পর্কে উঠে আসে, সেটি হল নৈহাটির উপরে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব। যার সম্পর্কে স্থানীয় গবেষকদের লেখাতে তেমনভাবে কোনও বিবরণ পাওয়া যায় না। পালযুগের পর থেকে সেনযুগের মুসলিম আক্রমণ শুরুর পর পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমানের এই উত্তর রাঢ়ে বৌদ্ধধর্ম বিপুলভাবে প্রচার পেয়েছিল, যার স্থানীয় পীঠস্থান ছিল সাল্যগ্রাম (বর্তমানে সালার গ্রাম) এবং সেই বৌদ্ধধর্মের নিদর্শনস্বরূপ তৎকালীন সময় থেকেই বৌদ্ধদের ভয়ঙ্কর দেবমূর্তি কালারুদ্রাগ্নিদেবম বা কালারুদ্রদেবের পুজো প্রচলন শুরু হয়েছিল নৈহাটিতে এবং যে পুজো আজও হয় এখানে, তবে তা মহাদেবের কালারুদ্র রূপকে কল্পনা করে।
কালরুদ্রদেবের মন্দির
মুসলিম আক্রমণের ভয়ে সেই বৌদ্ধরা বেশিরভাগই মুসলিম ধর্মগ্রহণ করে এবং তাদের দেবতাদের শিবের অবতাররূপে প্রচার করে হিন্দুরা অধিকার করে নেয় তাদের উপাসনার স্থানগুলিকে। এই কালারুদ্রদেবকে শিবরূপে পূজা করা হলেও নৈহাটির বৈষ্ণব মণ্ডলে এই শাক্তপুজোমতের জন্যই কালারুদ্রতলাকে শাক্ত-বৈষ্ণবের মিলনস্থল বলে গণ্য করা হয়। প্রতিবছর গাজনের জলসন্ন্যাসের দিন বীরভূম, পূর্ব বর্ধমান ও মুর্শিদাবাদের প্রতিটি শিবের দোলপ্রতিমা তাই গঙ্গা-স্নানের প্রাক্কালে সন্ন্যাসীসহ আগে কালারুদ্রতলাতে এসে একবার থামবেই এবং সেই দিন গঙ্গাটিকুরির দোল বেরিয়ে যাওয়ার পর কালারুদ্রদেবকে গঙ্গায় স্নান করাতে স্নানযাত্রা করানো হয়। তাই প্রাচীনকাল থেকে আজও কোনও ধার্মিক মানুষই নৈহাটিতে এলে একবার অন্তত কালারুদ্রতলা দিতে যাওয়ায় সময় মাথা নত করে যাবেনই যাবেন।