চার নম্বর নিউজডেস্ক
অবনী মোহন সিং। নায়ক। অবশ্য যতদিন লড়াই শুরু করেননি, তার আগে অবধি সাধারণ ছিলেন। আইএএফ অফিসারের ছেলে। বাবার বদলির চাকরির সূত্রে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পা রাখা। পড়াশুনো। প্রাণীবিদ্যায় স্নাতক। পরে, পরিবেশ শিক্ষায় বিশেষ কোর্স। আর এখানেই চকমকি পাথর। অবনী খোঁজ পেলেন অন্য এক জীবনের।
অবশ্য ঠিক তার পরই পরিবারের চাপে একটি ওষুধের কোম্পানির চাকরি। সেটলম্যান। স্ত্রী। পুত্র। নির্ভরতা। সচ্ছলতা। কিন্তু অবনীরা যে অন্য মানুষ। অবনীদের যে অন্য এক গল্প থাকে…
ঝাঁসিতে থাকার সময় রান্ড কারারি ব্লকে এলেন। দেখলেন ভারতবর্ষ। খরা। জলের অপচয়। পুকুর শুকোনো। ওয়েস্ট ডাম্পিং। ক্লুলেস এক বেবাক জেনারেশন। অবনী ব্লকের ঘরে ঘরে গেলেন। কোথায় শৌচালয় নেই, পর্যাপ্ত স্যানিটেশন নেই, দেখলেন। স্থানীয় ডিআরডিএ-র সাহায্য। ফান্ডিং। ঘরে ঘরে টয়লেট হল। পাইপ দিয়ে পানীয় জল এল। অবনীর আকাশে তারা ফুটল। এক, দুই, তিন…
ঝাঁসিতে পরিবারকে রেখে বেরোলেন। বাঁধা চাকরি ছাড়লেন। আপত্তি? হ্যাঁ, এসেছিল শুরুর দিকে। তবু, অবনীকে আটকানো যায়নি। ১৯৯৪ সালে তৈরি হল হরীতিকা। অবনীর এনজিও। শুরুতেই, জল সংরক্ষণের দিকগুলো ধরলেন অবনী। ফিল্ড বান্ড বা আর্থ বান্ড। ক্ষেত থেকে বৃষ্টির জলের রান-অফ বাইরের জমিতে মিশছে। জল নষ্ট। বান্ড বা ছোট বাঁধ করে সেই জল আটকালেন। ট্রাক্টর কিনে ছোট জলাশয় থেকে জমে থাকা ময়লা তুলে নেওয়া হল। মধ্যপ্রদেশ এবং উত্তরপ্রদেশের চল্লিশটি গ্রাম ঘুরে চারশ চল্লিশটির ওপর কমিউনিটি ওয়েল বানালেন। লক্ষ্য কুয়োর ভেতর ভৌম জল সংরক্ষণ, রিচার্জিং, কখনও চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সেচের জলেরও যোগান।
সরকারের সহযোগিতা দরকার। তার জন্য প্রকল্পগুলো বুঝতে হবে। অবনী পড়াশুনো করলেন। কোথায় কোন স্কিম গ্রামীণ ভারতবর্ষের লক্ষ্যে চালু হচ্ছে। একে একে দরজা খুলল। ইন্টিগ্রেটেড ওয়াটারশেড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম। একটা বড় বাড়ির ভেতর কৃষিজ আয়, জল সংরক্ষণ, স্যানিটেশন— সবকটা ঘর ঠেসেঠুসে রাখা। চাষিদের বোঝালেন। হরীতিকা থেকে প্রশিক্ষণ এবং সরকার থেকে বিনামূল্যে বীজ সরবারাহ করা হল। মনোক্রপ না, অবনী ইন্টারক্রপিং শেখালেন চাষীদের। জমির নিউট্রিয়েন্ট ভারসাম্য সঙ্ঘটিত হল। আয়ের সাম্যও দেখা গেল। প্রচলিত ধান বা গম চাষের বদলে সেই জমিতেই হর্টিকালচার ইত্যাদি করে সারা বছর চাষিরা একটা স্থায়ী আয়ের রাস্তা পেল। নাবার্ডের সাহায্যে ঝাঁসি এবং ছতরপুরের দুহাজার একর অনাবাদী ওয়েস্টল্যান্ডে আদিবাসীদের দিয়ে ফলের বাগান বানালেন। পেয়ারা, আম এবং আরও অন্যান্য। যার পরিণতিতে এখন এক লাখের ওপর আয় হচ্ছে তাঁদের। মধ্যপ্রদেশ সরকারের 65 লক্ষ টাকার অনুদান পেয়ে ড্রট প্রোন এরিয়া প্রোগ্রামে গ্রামে গ্রামে খরা আক্রান্ত জায়গাগুলোকে বাছলেন অবনী। জল সংরক্ষণের পথ দেখালেন। সাফল্য, কার সাধ্য, আটকায়?
এখনও অবধি হিসেবটা দাঁড়ালে মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ওড়িশা— চারটি রাজ্যে পাঁচশোর ওপর গ্রামে খরা থেকে ক্রমশ জলের খোঁজ দিয়েছে অবনী এবং তাঁর হরীতিকা। রাষ্ট্রসঙ্ঘ, বেসরকারি ব্যাঙ্ক, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি— সাফল্যের সিঁড়িতে উঠে আর স্পনসরশিপ নিয়ে ভাবতে হয়নি অবনীকে। গ্রামের মানুষের স্বার্থেই কাজ— স্বভাবতই তাঁদের আগ্রহে অধিকাংশ প্রোজেক্টেই পনেরো থেকে কুড়ি শতাংশ অর্থ দিয়েছেন গ্রামবাসীরাই। পাশে থেকেছে পরিবার। নিরলস পরিশ্রমের পর ঝাঁসিতে গিয়ে তাদের সঙ্গে স্বপ্ন ভাগ করে নিয়েছেন অবনী।
অবনী মোহন সিং-এর অবশ্য নিজের কোনও বাড়ি হয় না। পাঁচশোটি গ্রামে কাজ করার ফাঁকে সেখানেই অস্থায়ীভাবে থেকেছেন। কখনও আলাদা, কখনও গ্রামবাসীদের সঙ্গে। হরীতিকা পৃথিবীর মানচিত্রে এসেছে। দৃষ্টান্ত হয়ে। অবশ্য, বিশেষ কোনও সংস্থা না, গ্রামীণ ভারতবর্ষ, আপামর না-পাওয়া ভারতবর্ষকে স্বপ্নের প্রোগ্রামিং বহুদিন থেকেই শিখিয়ে আসছেন অবনী। হয়ত, আমৃত্যু শেখাবেন…