কৌশিক দত্ত
রেনকোট থেকে জল ঝরছিল। পাতলা গড়নের লম্বাটে মানুষটির কাঁধ থেকে গোড়ালির খানিক ওপর অব্দি ঝুলছে লাল-কালো রেনকোট। মাথায় হেলমেট এখনও। বাইক থেকে নেমে ফ্ল্যাটবাড়ির একতলার চারদিক খোলা পার্কিং স্পেসে এসে দাঁড়িয়েছেন। হাতে পলিথিনের প্যাকেট। চিকেন ভর্তা আর ছটা রুমালি রুটি। দুশো দশ টাকা। টাকা কটা গুনে রেনকোটের আড়ালে লুকোনও প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করতে না করতেই সেলফোন টুংটাং। ফের এসে গেল অর্ডার।
“এখান থেকে সন্তোষপুর কীভাবে যায় স্যার?”
“রেলগেটটা পেরিয়ে চলে যেতে পারেন। হাইল্যান্ড পার্কের দিকটায় না গিয়ে বাঁদিক নিয়ে নেবেন।”
“আচ্ছা। হ্যাঁ। ওদিকে, মানে খাল বরাবর তো? বুঝেছি।”
“ওখানে ডেলিভারি এরপর?”
“না স্যার, ওখান থেকে অর্ডার পিক আপ। ডেলিভারিটা দেখে নিই। ও বাবা! বিজয়গড়। মানে আবার এদিক দিয়েই যেতে হবে।”
“তা কেন? সুলেখা দিয়ে ঢুকে যাবেন।”
“হ্যাঁ, তাই তো।” মৃদু হাসে লোকটা। ভেজা রেনকোট আর হেলমেটের আড়াল থেকে হাসে। “আসলে ঝড়-বৃষ্টির দিন তো! লোকে চাইলেও যেতে পারবে না হোটেলে। তাই আজ অর্ডার বেশি একটু। আচ্ছা, চলি স্যার।”
পিছন ফেরে লোকটা। পিঠের ব্যাগের গায়ে ‘সুইগি’ লেখাটা ঝলমলিয়ে ওঠে এতক্ষণে। সদ্য ধোয়া হয়েছে লেখাটা। সারাদিনে কতবার ধোয়া হয়েছে বলা কঠিন। আজ অর্ডার বেশি। কাল রাত থেকে নাগাড়ে বৃষ্টি পড়ছে। লোকটার নাম জানা হল না। না জানাই স্বাভাবিক। সুইগি জানলেই হয়। এই কোম্পানির এসএমএস আসত মোবাইলে। ডেলিভারি বয়ের চাকরির জন্য। এই লোকটার কাছেও এসেছিল নিশ্চয়। আমি মুছে দিয়েছিলাম সেসব বার্তা। এই একহারা ভেজা লোকটা মোছেনি নির্ঘাত। আমার নাম অনিন্দ্য। এই লোকটার নাম সুইগি।
খাবারের কৌটো ভরা প্যাকেট হাতে নিয়ে কোলাপ্সেবল গেটে তালা লাগাতে একটু কসরত করতে হয়। সিঁড়ির লাইট নিবিয়ে লিফটের আলো জ্বালানো এবার। তারপর বোতাম টিপতে মানুষ পেটে নিয়ে বাক্সটা উঠে যায় তেতলায়। ঘর। জানালাগুলো বন্ধ। কাচের পাল্লার ওপাশে বৃষ্টির ঘ্যানঘ্যানানি। প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা হতে চলল। শার্সি বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা সন্ধেরাতের গন্ধ। পোড়া দুপুরের গন্ধ মেশেনি আজ সন্ধের দেহে। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত হয়নি আজ আশেপাশে কোথাও। শুধু ঘড়ি ধরে দিন আর রাত এসেছে মানুষের। ঘড়ি ধরে খিদে পাবার অভ্যেস ধুয়ে দিতে পারেনি কার্তিক শেষের বৃষ্টি। ঝড়টা এবার আসবে। নটা নাগাদ বোধহয় ল্যান্ডফল হবে বকখালির দিকে। টিভিটা খোলা যাক।
টিভিতে এক কমবয়সি সাংবাদিক টুপি রেনকোট চশমা আর লম্বা মাইকের আড়াল থেকে কিছু বলে চলেছেন। চেতাবনি। ঝড় আসছে। কোথায় পাওয়ার কাট হয়ে গেছে। অন্ধকার আর ফাঁকা শহরের ছবি দেখতে ভালো লাগছে না, সে তো নিজের ভেতরেই আছে। নিজেকে ফটো-ফ্রেম মনে হয় মাঝেমাঝে। বাঁধানো রাতের ছবি। দুর্গাপূজার রাত নয়, নাইটক্লাব নয়, সোহাগী বেডরুমও নয়… রাত দুটোর দেশপ্রিয় পার্ক… ঝাঁপ বন্ধ দোকান, একটা ম্যাটাডোর চলে গেল বালিগঞ্জের দিকে, শরৎ বোস রোডে ল্যান্সডাউনমুখো বাঁক নিল একটা হলুদ ট্যাক্সি, হ্যালোজেনের আলোয় পুড়ে পুড়ে এমন রঙ হয়েছে তার। সেরকমই একটা শহরের ছবি দেখাচ্ছে। একটা উড়ালপুল। আরও বেশি অন্ধকার। ফাঁকা। জায়গাটার নাম বলছে না আর। বলা হয়ে গেছে টিভি খোলার আগে। বাসন্তী বোধহয়।
ভালো লাগছে না। একঘেয়ে। দুদিনের বৃষ্টির মতো নিরুত্তাপ। ঝড়ের ছবি তুলতে পারে না এরা? হাতির শুঁড়ের মতো নেমে আসছে টর্নেডো। হুস হুস করে শুষে নিচ্ছে পুকুর, বাড়ির ছাদ, দামি গাড়ি। এক ফুঁয়ে নিভে যাচ্ছে মার্কিন লোকালয়। ধ্বংস প্রত্যক্ষ করার একটা থ্রিল আছে। অপরের প্রতি ঈর্ষা নয়, অন্যের কষ্ট দেখে আনন্দ পাবার স্যাডিজম নয়, স্রেফ উন্মত্ততাকে টের পাওয়া… মনে এবং শরীরে। ম্যাদামারা জীবনে ওইটুকু অ্যাড্রিনালিন। পকেটমার সন্দেহে কাউকে একচোট পিটিয়ে দেওয়া, ফেসবুকে দল বেঁধে কোনও অচেনাকে হুহু খিস্তি। অনিন্দ্য এসবও পারে না। তাই ইউটিউবে অ্যাকশন ছবির কাটপিস দেখে সে আজকাল। টনি জা, মাইকেল জে হোয়াইট…. ভাঙা হাত-পা… চোঁয়ানো রক্ত। আমি নিশ্চিত নই, অনিন্দ্য আসলে চোয়াল ভেঙে পড়ে যাওয়া দেখে না রক্তাক্ত উঠে দাঁড়ানো?
অনিন্দ্যর হয়ে আমি টিভি খুলি মাঝেমাঝে। খবর-টবর দেখি। ভোটের খবর, টাঙ্গি-হাঁসুয়ার খবর, যোধপুর পার্কের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে একাকী বৃদ্ধার রোমহষর্ক হত্যার খবর। অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট দেখি। সিংহী হরিণের পিছে আজও ধায়। অঞ্চলাধিপতি পুরুষ ব্যাঘ্র মহরা নেয় অনুপ্রবেশকারী ভাগ্যান্বেষী তরুণ বাঘের। এলাকা বাঘের বড় প্রিয়। সীমান্ত ছাড়া পুরুষও বাঁচে না। ছয় রাউন্ড মল্লযুদ্ধের শেষে প্রবীণ কামড়ে ধরে নবীনের জুগুলার। রক্ত হারিয়ে, শ্বাস হারিয়ে ঝিমিয়ে ফুরিয়ে এলিয়ে পড়ে হলুদ তরুণ। অথচ তার হেমন্ত আসতে দেরি ছিল। সর্বদা নবীনের পদসঞ্চারে ত্রস্ত প্রাচীন জায়গা ছেড়ে সরে যায় না। কখনও সে বেঁচে থাকে আয়ুর সীমানা পর্যন্ত, আঁকড়ে থাকে জমি। আমার টিভিতে বয়স্ক বাঘের জিতে যাওয়া দেখালে অনিন্দ্য খানিক সহজ শ্বাস নেয়। বোধহয় আমাদের বয়স বেড়ে যাচ্ছে বলে। এমন সব পরাজয় ইদানীং ঘিরে থাকে অনিন্দ্যকে, যার খবর আমি ছাড়া কেউ জানে না। বাথরুমে ভেজা পিঠে গামছা ঘষার অবসরে অথবা মাঝরাতের বারান্দায় আমি আর অনিন্দ্য এসব আলোচনা করি… বয়সের কথা, দুর্বলতার কথা, হেরে যাওয়া আর ভয়।
সুদেষ্ণাকে কিছুটা বলতে পারলে হত, অন্তত ভয়গুলো। কিন্তু ওকে বলা খুব কঠিন। বস্তুত ওকে বলা যায় না। আসলে ওকেই তো বলা চলে না। ভয়, পরাজয় সব ওর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতেই তো এত আয়োজন। এই চাকরি, প্র্যাকটিস, এই ফ্ল্যাট, নতুন সোফা, এলইডি টিভি, ইনশিওরেন্স, সুইগি-জোম্যাটো। এসব চাদরের আর কী কাজ আছে বয়স লুকোনও ছাড়া? আমার ফুরিয়ে যাওয়াকে সুদেষ্ণার চোখের আড়ালে রাখার জন্যই তো এত দৃশ্য, এত আড়ম্বর। হরিণের এই শিং, গরিলার বুকে এই দুমদুম চাপড়… পুরুষের এত যে লড়াই ফুরিয়ে না যাবার, সুদেষ্ণার মনোযোগ আকর্ষণের জন্যই তো! এই যে তরুণ বাঘ মরে গেল, হিসেবের খাতায় ক্ষতি হল না বাঘসুমারির? বিজয়ী বাঘটি হয়ত আর চার-পাঁচ বছর বাঁচবে বড়জোর। যে মরে গেল, সে বাঁচতে পারত আরও বছর নয়-দশ। তবু সে স্থান পেল না, অধিকার পেল না জীবনের। বয়স্ক বাঘের কাছে পরাজয়ে প্রমাণিত হল সেরা শরীর, শ্রেষ্ঠ জিনের উত্তরাধিকার তার কাছে নেই… নারীকে দিয়ে যাবার মতো কিছু নেই তার। সে বাতিল পুরুষ। সুদেষ্ণা তাকে কেন নেবে? চলে তো যেতেই হত।
এইসব ভয়ের কথা সুদেষ্ণাকে বলতে পারলে হত। স্কুলে ভীরু বালক ছিলাম। নাগরদোলা চড়লে মাথা ঘুরত। রঞ্জিতাকে সমগ্র কলেজ প্রহরে অনিন্দ্য বলতে পারেনি। তার বিয়ের নেমন্তন্ন খেয়ে এসেছিল বন্ধুদের সঙ্গে। অনিন্দ্যর শিং চিরকাল সবুজাভ কমজোরি। রাত একটার সময় মায়ের পুরনো ড্রেসিং টেবিলের সামনে বুকে দমাদম চাপড় মেরে দেখেছি জঙ্গল কাঁপানো আওয়াজ হয় না। এমনকি শুনশান ঘরেও কান পেতে শুনতে হয় সেই ক্ষীণ ফটাফট শব্দ… বাসুদার চায়ের দোকানের কর্মচারী শিবুর ছেঁড়া হাওয়াই চপ্পলের মতো আওয়াজ ওঠে। আয়নায় দৃশ্যটা দেখায় হাহাকারের মতো… ঠিক আর্তি নয়, শোকের ক্যারিকেচার যেন। এসব কথা সুদেষ্ণাকে একবার বলে ফেলতে পারলে হত। বলা হচ্ছে না। সে জেনে ফেলতে পারে, সেটাই সবচেয়ে বড় ভয়। সেই ভয়ের চাতালে ভায়াগ্রার দোকান।
“দু-একদিন খেতে পারি?” ঋতব্রত জিজ্ঞেস করছিল গত মঙ্গলবার। “ওই মাঝেমধ্যে আরকি। এখন তো আর রেগুলার হয় না ওসব।” ঋতব্রত স্কুলের বন্ধু। অ্যাকাউন্টেন্ট।
“তোর কি হয় না? মানে হচ্ছে না?”
“তেমন নয়, কিন্তু ঠিকমতো বোধহয় হচ্ছে না। মানে সাইজ হয়ত। মানে আমি ঠিক জানি না। বউ স্যাটিসফায়েড নয় মোদ্দা কথা। সবসময় ওর মেজাজ খিঁচড়ে থাকে আজকাল আর আমাকে যা-তা বলে।”
“ওই জন্যেই কিনা জিজ্ঞেস করেছিস?”
“কী জিজ্ঞেস করব? ওসব ছাড়। তুই ডাক্তার, কিছু একটা উপায় বল।”
“আরে ধুর! ওসব কিছু নয়। যার নর্মালি হচ্ছে, সে ভায়াগ্রা খেলে কুতুব মিনার হবে না। মাঝখান থেকে মাথা ধরবে, গা ব্যথা করবে।”
“আর কিছু হবে না তো সাইড এফেক্ট?”
“খাস না। লাভ নেই। বরং সিগারেটটা ছাড়। আর কাউন্সেলিং করা। দেখ অন্য কোনও কারণে বিরক্ত থাকে হয়ত। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে কি একটাই কাজ আর একটামাত্র ঝামেলা? তাহলে তো ভায়াগ্রা চালু হবার পর আর ডিভোর্স হত না।”
ঋতব্রত চুপিচুপি সিলডেনাফিল খাবেই, আমি জানি। পুরুষ তো। উত্থানে আস্থা কমে গেলে আত্মবিশ্বাসই টলে যায়, এমন বন্দোবস্ত। গত ডিসেম্বরে বেঙ্গল ক্লাবে কুকরেজার পার্টিতে সেই কথাটা শুনেছিল অনিন্দ্য। হাঁসেদের এসব পার্টি সে এড়িয়ে চলে সাধারণত। সকলে গ্লাস হাতে বকবক করে আর নিজেকে বক যথা বেখাপ্পা মনে হয় অনিন্দ্যর। শ্যামসুন্দর মিত্রর চাপে পড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল তবু। কয়েকজনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে “হ্যালো” করতে হল। ভিজিটিং কার্ড বিনিময়। বেশিরভাগ লোকের নাম মনে রাখার চেষ্টাই করে না অনিন্দ্য। ভিজিটিং কার্ড হারিয়ে ফেলে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি। তবু অ্যামওয়ে গ্লিস্টার দিয়ে দাঁত মেজে “কেমন ঝকঝক করছে বলুন” জাতীয় প্রদর্শনী করতে হয় মাঝেমধ্যে। প্রফেশনাল হ্যাজার্ড। বড় কর্পোরেট ক্লায়েন্টকে বঁড়শিতে গাঁথার জন্য আজকাল খানিক সুনামওয়ালা ডাক্তারদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে হাসপাতালগুলো।
“মিট ডক্টর রয়। ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট। হি ইজ উইথ আস ফুলটাইম। গোল্ডেন পেয়ার অব হ্যান্ডস, বুঝলেন স্যার। আই ক্যান অ্যাসিওর ইউ। অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি স্টেন্টিং নিখুঁত। হি নেভার ফেইলস। সবচেয়ে বড় কথা, রাত দুটোতেও পেশেন্ট পাঠান, দুটো পনেরোয় ডঃ অনিন্দ্য রয় ক্যাথল্যাবে।” শ্যামসুন্দর খাতা খোলে।
“আজকাল শুনছি খুব ক্রিটিকাল কেস আর নিতে চাইছেন না কেউ কেস খাবার ভয়ে!” ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি কেটে কেটে বলে।
“আমরা নিচ্ছি মিস্টার বসাক। আমাদের ডাক্তারেরা ভয় পান না। তিনবার হার্ট অ্যাটাক, দুবার বাইপাস হওয়া চারটে পুরনো স্টেন্ট লাগানো পেশেন্ট পাঠান না ডক্টর রয়ের কাছে। মনে করুন ওই বাইপাস গ্রাফট বা আগের স্টেন্টের মধ্যে থ্রম্বোসিস হয়েছে। দশ পার্সেন্ট ইজেকশন ফ্র্যাকশন। শ্বাস উঠেছে। জাস্ট সেন্ড দেম ওয়ান আওয়ার বিফোর ডেথ। ক্যাথল্যাবের কাজে যেটুকু সময় লাগে। ডক্টর রয় উইল সেভ দেম উইথ গ্যারান্টি। হি সাকসিডস হোয়ার আদারস ফেইল।”
“এক মারব শালা কানের গোড়ায়। ইজেকশন ফ্র্যাকশন বুঝিস? দশ পার্সেন্ট! তিনটে হার্ট অ্যাটাক! একগাদা বাজে বক্কা। তারপর পেশেন্ট মরলে হুড়কোটা তুমি নেবে?” অনিন্দ্য মনে মনে বলে সুরারসে তুরীয় শ্যামসুন্দরকে। শ্যামসুন্দর, বসাক বা কুকরেজা একটা শব্দও শুনতে পায় না। সবাই দেখতে পায় গাঢ় নীল স্যুটের কলারের ওপর থেকে বেরিয়ে আছে ডক্টর রয়ের ঘাড়, যা জীবন-মৃত্যুর বোঝা বইতে পারে, যথেষ্ট পুরুষ্টু, হালকা বাদামি এবং নিয়মিত সাবান ঘষার ফলে খাঁড়ার কোপ মারার উপযুক্ত পরিচ্ছন্নতা সেখানে ইতোমধ্যে আছে। সেই ঘাড়ের উপর একটা মাথা, যার চুলের ঢাকনাটা পুরনো আর পাতলা হয়ে গেছে। সেই মাথার সামনের দিকে নাকের নীচে ঈষৎ ফাঁক হয়ে আছে একজোড়া ঠোঁট আর সেই ফাঁকটুকু দিয়ে দেখা যাচ্ছে টুথপেস্ট কা কামাল! তার মানে রয় হাসছে। তার মানে ব্যাটা সহমত। তার মানে সে ঘাড়টা দান করেছে হাঁড়িকাঠে। সমবেত সুরারসিকেরা হেসে ওঠে। ফটো ওঠে “ক্লিক”!
বাক্যালাপের এই পর্যায়ে বলিপ্রদত্ত ঘাড়ের কাছটা অনিবার্যভাবে শিরশির করে ওঠায় “এক্সকিউজ মি” বলে হলের অন্য প্রান্তের দিকে পালাতে গিয়ে অনিন্দ্য আচমকা শুনে ফেলে কথাটা। “আ ম্যান ইজ নাথিং বাট আ বায়োলজিকাল সাপোর্ট সিস্টেম ফর আ ডিক।”
ধারালো ইস্পাত রঙের শাড়ি পরা এক মধ্যবয়স্কা বলছিলেন এক উজ্জ্বল মেরুন যুবতীকে। “আ ম্যান ইজ এসেনশিয়ালি আ ডিক, ইউ নো। দ্য প্রিহিসটোরিক উওম্যানস ডিল্ডো।” সোনালী জনি ওয়াকার্সের সমুদ্রে ভাসমান আইসবার্গের পিছনে খিলখিলিয়ে ওঠে যুবতীর যত্নে আঁকা মুখ। কাচ আর বরফের প্রতিসরণে বিচ্ছুরিত হয়ে এদিক ওদিকে ধেয়ে আসে তার হাসি। অনিন্দ্য সামান্য টলে যায়। মধ্যবয়সিনী হাসছেন, “দিস ম্যাক্সিম ইউ মাস্ট রিমেম্বার। হা হা।”
অনিন্দ্যর আত্মবিশ্বাস বরাবর দুর্বল। সহজে মুখ থুবড়ে পড়ে। শ্যামসুন্দর, বসাক, কুকরেজার হাসি আর ইস্পাত ও মেরুন রঙের দুই প্রজন্মের দুই অচেনা মহিলার হাসির অভিঘাতে এক পেগেরও কম অ্যালকোহল খাওয়া অনিন্দ্যর মাথা ঝিমঝিম করে। এইসব মেডিসিন, কার্ডিওলজি, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি শিখে তবে কী হল? শেষ অব্দি পুরুষ হবার দৌড়ে পিছিয়ে পড়ল না তো? কী হয় এসব দক্ষতায় যা কুকরেজাদের খুশি করে, কিন্তু নারীকে মোহিত করতে পারে না? গোল্ডেন পেয়ার অব হ্যান্ডস! সোনালী হাত কোন বাজারে বিকোয়? অন্দরমহলে মিনাবাজারে কি কেউ সেদিকে ফিরেও দেখে?
ঋতব্রতর সঙ্কটটা অনিন্দ্য জানে। সেই রাতে হুইস্কির সুবাসে আমোদিত পার্টি ছেড়ে ডিসেম্বরের কোলকাতায় পা রাখতে গিয়ে জীবনে প্রথমবার নিজের জৈবিক পৌরুষ নিয়ে সংশয় গ্রাস করেছিল অনিন্দ্যকে। গাড়ির ড্রাইভারের সিটে বসে স্টার্ট দেবার আগে সিট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে একবার হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল নিজেকে। কেমন যেন ছোট লাগছে না? সে যেন হেরে যাচ্ছে হুহু করে একা। কোনওদিন পুরুষ হিসেবে নিজেকে জাহির করা হয়নি। শিশ্নের অহঙ্কারে পুরুষ ধর্ষক হয়, এমনটাই ভেবেছে চিরকাল। পৌরুষের আত্মঘোষণাকে ভয় পেতে শিখেছিল সে। নিজে গোপন থেকেছে। অনুচ্চারিত থেকেছে। নিজেকে বিজ্ঞাপিত করতে সঙ্কোচ বোধ করেছে, তাই সুনামের অনুপাতে অর্থ উপায় করতে পারেনি। তা নিয়ে বিশেষ আফসোস নেই। শ্যামসুন্দরদের মতো অহঙ্কারে উলঙ্গ হতে পারবে না সে কোনওদিন। অথচ এক ইস্পাত-রঙ আপ্তবাক্য আর বৈদ্যুতিক মেরুন হাসিতে তার মনে হল… বারো ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে হঠাৎ… যেন পৃথিবীর যাবতীয় লম্পটের কাছে সে হেরে গেছে।
এতটা ছোট হয়ে গেল কী করে? এরকম তো ছিল না! নাকি এরকমই ছিল? সুদেষ্ণা তো কখনও কিছু বলেনি! হয়ত এসব ফালতু কথা আলোচনা করতে সুদেষ্ণার মতো মেয়ের ভালো লাগে না। এই কারণেই কি আজকাল সুদেষ্ণা তাকে পাত্তা দেয় না তেমন? বেশিরভাগ সময় বিরক্ত হয়ে থাকে এইজন্যই? হয়ত সে খুশি নয় আসলে, কিন্তু এত কিছু নিয়ে সে অতৃপ্ত যে তার মধ্যে একটা শারীরিক ব্যাপার আলাদা করে বলতে তার প্রবৃত্তি হয় না।
“গাড়ি স্টার্ট কিজিয়ে সাব।” পাগড়ি বাঁধা উর্দিধারী দ্বারপাল জানালার পাশে অনুরোধ হাতে দাঁড়িয়ে। পিছনের গাড়ি হর্ন দিচ্ছিল। অনিন্দ্য গিয়ার মুঠোয় নিয়ে অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দেয়। “কোরো” নামে একটা রোগ আছে। মানসিক রোগ। সেই এমবিবিএস-এর সময় একবার পড়ে ভুলেও গিয়েছিল অনিন্দ্য। কুণাল মনে করাল গতবছর। কুণাল সাইকিয়াট্রিস্ট। রাজ্যে নাকি কোরোর মহামারী লেগেছে। শয়ে শয়ে পুরুষ হঠাৎ ভয় পেতে শুরু করেছে যে তাদের পুরুষাঙ্গ ছোট হতে হতে মিলিয়ে যাবে। লিঙ্গে পাথর ঝুলিয়ে কয়েকজন হাজির ডাক্তারের চেম্বারে। আসলে কিছুই হচ্ছে না। স্রেফ ভয়। পৌরুষ হারানোর ভয়।
“ছেলেদের এই আতঙ্কিত চরিত্রটা খুব ইন্টারেস্টিং, জানিস তো?” কুণাল বলে, “যেমন ইন্টারেস্টিং, তেমনি প্রব্লেম্যাটিক। পৌরুষ ছোট হয়ে প্যান্টের নীচে আটকে পড়ে, আবার সেটাও নাকি শালা ভেতরে সেঁদিয়ে যাচ্ছে! পৌরুষ নিয়ে যদি এত অনিশ্চিত না হত ছেলেরা, এত ভয় না পেত, বুঝলি, তাহলে সেক্সুয়াল ক্রাইম অনেক কম হত। শুধু যৌন অপরাধ কেন, আমার তো মনে হয় ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সও কমে যেত। আরে ভায়োলেন্সই কমে যেত বে দুনিয়ায়!”
কুণালের কথাগুলো ভেবে মনের জোর ফেরাচ্ছিল অনিন্দ্য। কিছু হয়নি আসলে। বাড়ি ফিরে তবু সুদেষ্ণাকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “আচ্ছা, আমি সুস্থ তো পুরুষ হিসেবে?”
“কী হয়েছে তোমার?” সরাসরি উত্তর না দিয়ে প্রতিপ্রশ্ন করে সুদেষ্ণা।
“বলো না, আমি নর্মাল তো? মানে, আমার সব ঠিকঠাক?”
“কী হয়েছে?”
পার্টির গল্পটা বলে অনিন্দ্য, আপ্তবাক্য সমেত। তার পরবর্তী সময়ে নিজের বিচিত্র অনুভূতিটা আর বলে না। লজ্জা পায়।
“আমরা এরকম বলি না। এটা ফ্যালিক কালচার। তোমরা নিজেরাই বানিয়েছ।”
“আমি তো আজ প্রথম শুনলাম। শুনে তো ইয়ে…”
“যিনি বলছিলেন, তিনিও তোমাদেরই লোক।”
“তাহলে তোমরা কী বলো?”
“আ উওম্যান নিডস আ ম্যান লাইক আ ফিশ নিডস আ বাইসিকল। সাইকেল না পেলে মাছ যেমন স্কুলে যেতে পারে না, একজন নারীরও পুরুষকে তেমনই প্রয়োজন। ততটুকুই। আমার কথা নয়, গ্লোরিয়া স্টেইনেম বলেছিলেন। উনিও প্রথম বলেননি আসলে। যাকগে। ফ্যালিক দুশ্চিন্তা ছাড়ো। বুঝলে সাইকেল?” সুদেষ্ণার চোখে দুষ্টুমি। গাল টিপে দ্যায়।
অনিন্দ্য আর কথা বাড়ায় না। সুদেষ্ণা আর কুণালের কথা মিলিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। সত্যি তো, কী যায় আসে এসবে? কিছুক্ষণ ফালতু টেনশনে ভোগার জন্য লজ্জাও হয়। কিন্তু সুদেষ্ণা সোজা জবাব দিল না কেন? “তুমি নর্মাল,” এটুকু যদি বলে দিত! হয়ত ওভাবে নর্মাল বলাটাই ওর পছন্দ নয়। ওভাবে বিচার করে না, বললই তো। হয়ত অন্য কোনওভাবে বিচার করে। অন্য কোনওভাবে নিয়মিত বাতিল হয় অনিন্দ্য, যার রহস্য সে জানে না। ভয় হয়৷ কোথায় যেন হেরে যাচ্ছে। মৎস্যকন্যার রেসিং সাইকেলের মতো অব্যবহৃত পড়ে আছে নদীর ধারে। জোয়ার-ভাঁটার ছোঁয়া পায় না, শুধু শ্রাবণ ভাদ্রের ভেজা বাতাসে মরচে ধরে যায় সর্বাঙ্গে।
আজ ৯ই নভেম্বর ২০১৯, বুলবুল আসছে। সন্ধে পেরোল। এতক্ষণে সাগরদ্বীপে পৌঁছে যাবার কথা। সমুদ্র পেরিয়ে প্রমত্ত বাতাস ঝাঁপিয়ে পড়ছে ঢেউ-ধোয়া তটের উপর। মানুষের বসতি হেরে যাচ্ছে ঝড়ের কাছে, গাছেরা হেরে যাচ্ছে, পাখিরা পলায়মান… অনিন্দ্য একা নয় পরাজয়ে, সমস্ত পৃথিবী কোথাও না কোথাও হেরে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এরকম ছবি এতক্ষণে এসে পড়া উচিত ছিল টিভির পর্দায়। অনেক ভয়ার্ত মানুষের সঙ্গে অনিন্দ্য তাহলে নিঃশব্দে ভাগ করে নিতে পারত নিজের অজস্র ভয়, যেসব ভয়ের নাম সে উচ্চারণ করতে শেখেনি, যাদের অবয়ব সে চেনে কেবল সিল্যুয়েটে। বদলে শুধু একটানা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর বৃষ্টি আড়াল করা রেনকোট। মধ্যবিত্ত জীবনের মতো অনন্ত মনোটোনি। প্রখরতা নেই, উন্মাদনা নেই। বিজয় উৎসব নেই, এমনকি স্মরণীয় ধ্বংসলীলাও নেই। কেবল মৃদুমন্দ টিকে থাকা। ঝিরিঝিরি ঝরতে ঝরতে ফুরিয়ে যাওয়া। যেন শ্যাওলার জীবন বা পুরনো পাথরের গায়ে জমা মস। সিংহের জীবন নয়, নয় হরিণেরও।
অনিন্দ্য হতাশ হচ্ছে দেখে আমি বোতাম টিপে চ্যানেল ঘোরাই। একটা বাংলা ছবিকে ধরে ফেলি মাঝরাস্তায়। “হ্যালো, নাম কী ভাই?” নাম বলে না সে। নাম দেখানো হয়ে গেছে ঘণ্টাখানেক আগে। ধীর পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে সে। খুব অল্প আলোয় শুট করেছে দৃশ্যটা। ক্যামেরার কাজ সুন্দর। একজন একহারা যুবক মাথায় কোঁকড়া চুলের বিপুল বোঝা নিয়ে, দুটো লম্বা হাত কাঁধ থেকে ঝুলিয়ে, মাথার বোঝাটাকে হাত দিয়ে ধরার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে, সপ্ত-কলসবাহী রাজস্থানি মহিলার মতো অনায়াসে দীর্ঘ ও চিকন দুই পায়ের উপর চড়ে ধীরে ধীরে প্রাচীন পাথরের সিঁড়ি বেয়ে মাটি পেরিয়ে নেমে যাচ্ছে। সিনেমাটার মতোই তারও কোনও তাড়া নেই। মাটির নীচে ক্রমশ গাঢ় হয় অন্ধকার। গাঢ়তর হয় নেমে যেতে থাকা। প্রায় পাঁচ মিনিট কোনও সংলাপ নেই। ঝিঁঝিঁর প্রচ্ছন্ন তানপুরা ছাড়া নেই কোনও শব্দও, এমনকি জুতোর আওয়াজ খটখটিয়ে শোনানোর তাগিদ নেই পরিচালকের। এহেন গতির আলস্য, কান বা চোখের রাজত্বে প্রকট না হয়ে ওঠার স্থিরতা প্রমাণ করে যে এটা ভালো ছবি। সময় নিয়ে একদিন পুরোটা দেখতে হবে, কিন্তু আজ সেই দিন নয়। আজ ঝড়ের প্রতীক্ষা।
আবার খবরের চ্যানেলটা চালিয়ে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দিই। দুটো থালা ধুয়ে খাবারটা বেড়ে ফেললে হয় সব ঠান্ডা হয়ে যাবার আগেই। তার আগে একবার সুদেষ্ণাকে জিজ্ঞেস করা দরকার এখন খাবে কিনা। আজ সুদেষ্ণারও অফিস বন্ধ ছিল বুলবুলের ভয়ে। কিছু লিখছে। কী লিখছে তা সুদেষ্ণা কোনওদিনই বলে না। বললে ওর লেখা আটকে যায়। সন্ধের মুখে হাসপাতাল থেকে ফিরে অনিন্দ্য দেখে সুদেষ্ণা ঘাড় ডলছে মাঝেমাঝে, আবার ঘাড় ঝুঁকিয়ে লিখছে। তবু টেবিল-চেয়ারে বসবে না, বিছানাতেই যাবতীয় লেখাপড়া। পিঠটা ধনুকের মতো গোল হয়ে আছে। বয়সকালে ভুগবে।
একটু আগে একবার বাথরুমে গেল সুদেষ্ণা। পেটের নীচটা চেপে ধরে ছিল। অনিন্দ্য বুঝতে পারে আজ দ্বিতীয় দিন। প্রথম দুইদিন ওর খুব ব্যথা হয়। গতকাল সকালে সুদেষ্ণার ছেড়ে রাখা নাইটিতে রক্ত লেগে থাকতে দেখেছে অনিন্দ্য। বেশ অনেকটা। শেষ রাতে শুরু হয়েছিল নির্ঘাত। টের পায়নি। সকালে উঠে পড়িমরি করে বেরোয়। অর্ধেক খালি মুখে বেরিয়ে পড়ে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে। অনিন্দ্য তখন হয়ত সবে উঠেছে। “দিদি আজও খেয়ে গেল না,” সবিতা জানায়। চা বিস্বাদ লাগে অনিন্দ্যর।
এমনিতে সবার জামাকাপড় সবিতাই কাচে, কিন্তু সুদেষ্ণার রক্তটা কাজের মেয়ের হাতে দিতে ইচ্ছে করে না। ছোট প্লাস্টিকের প্যানে সার্ফের জলে হলুদ নাইটিটা ভিজিয়ে রাখে অনিন্দ্য। হাসপাতালে বেরোনোর আগে সাবান ঘষে কচলে কচলে ধোয়, ব্যথায় হাত বোলানোর মতো করে। হাত বোলাতে বোলাতে অনিন্দ্য টের পায় লজ্জা-ফজ্জা কিছু না, সুদেষ্ণার শরীর থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত এতটাই দামি যে একজোড়া ভালোবাসাহীন পেশাদার হাতে তাকে তুলে দেওয়া দুষ্কর।
এখনও টিভিতে ঝড়ের তাণ্ডব দেখাচ্ছে না। তবে ঝড় আসছে, ঝড় আসছে চেতাবনিটাও বেশ থ্রিলিং। ‘এনআরসি আসছে, এনআরসি আসছে’ বার্তার মতো। অ্যাড্রিনালিন মিশুক রক্তে যেকোনও উপায়ে। পলায়মান হরিণের প্রাণের যে গতি, সেটুকু মিশুক শিথিলতায়। দেশ হারানোর, প্রাণ হারানোর আতঙ্কটুকুও বারুদ গুলে দিক না হয় রক্তে। নইলে আজকাল এই শহর, এই দেশ ফুটবল-ক্রিকেটের ম্যাচ ঘিরেও জাগে না। পুজোর রাতেও প্যান্ডেলে লোক হয় না আগের মতো। বুড়োটে অনিন্দ্যর মতো সকলের সোঁদা হাঁটুতে জঙ ধরে গেছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে৷ এরপর তুফান এলেও সেই মরচে ধুয়ে যাবে না, ঝড় এলেও দৌড়ের জন্য ‘অন ইওর মার্ক’ টানটান জেগে উঠতে ইতস্তত করবে পেশীরা। মানুষ কেমন নিরীহভাবে হাত-পা না ছুঁড়ে বন্দিশালায় চলে যাচ্ছে! নিঃশব্দে মরেও যাচ্ছে একে একে। জঙ্গলে এমন অপ্রতিরোধী মৃত্যু মোষ তো দূরস্থান, নিশ্চুপ জিরাফ বা ক্ষুদ্র কাঠবিড়ালিও নিজেকে উপহার দেয় না।
খাবার টেবিলটা সাজাতে সাজাতে অনিন্দ্য ভাবে মানুষই দুনিয়ার সবচেয়ে অদূরদর্শী আর অলস প্রাণী কিনা। আবার চ্যানেল বদলায় অস্থির হাত। অরণ্য খোঁজে। ন্যাট জিও ওয়াইল্ড। একটা নীলচে-সবুজ বোলতা খ্যাঁক করে ধরে নিজের চারগুণ চেহারার একটা ধেড়ে আরশোলাকে। প্রথমে হুল ফোটায় পাঁজরের কাছে। আরশোলা আর নড়তে পারে না। দ্বিতীয় দফায় বিষ ঢালে মগজের গোড়ায়। মেরে ফেলে না, অজ্ঞান করে রাখে দক্ষ অ্যানেস্থেটিস্টের মতো। তারপর অপ্রতিরোধী আরশোলাকে চিত করে তার পেটের ভেতর একটিমাত্র ডিম পেড়ে বিদায় নেয় বোলতা। একদিন ডিম ফুটে বেরোয় শূককীট। সে ধীরে আরশোলাটিকে ভেতর থেকে খেতে শুরু করে। খুব সাবধানে কুরে কুরে খায়। মেরে ফেলে না। আরশোলার রক্তপ্রবাহ, আরশোলার অক্সিজেন তার ভরসা। এভাবে খেতে খেতে একদিন সে যথেষ্ট বোলতা হয়ে ওঠে। আরশোলার প্রয়োজন ফুরোয়। তখন সে আরশোলা ভেদ করে বেরিয়ে আসে। পুরনো বাসা ছেড়ে চলে যায়। পড়ে থাকে এলোমেলো দেহ। এভাবেই যেন পড়ে ছিল শিবু মিস্ত্রির শরীর। আরও অনেকের।
এটুকু দেখার ঘোর কাটতে না কাটতে দৃশ্য বদলে যায়। জলের গভীরে বহুবর্ণ মাছ। বড় মাছ ছোট মাছকে খেতে যাচ্ছে। বিচিত্র ড্রিবলিং করে প্রাণটিকে শিকারীর নাগালের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে ছোট মাছ। যতক্ষণ এই খেলাটি সে চালিয়ে যেতে পারবে, ততক্ষণই সে বাঁচবে। কোনও বিরতি নেই, খেলা শেষ হবে আজ অথবা পরশু রাতে তার মৃত্যুতেই। এতটা নিশ্চিত ফলাফলের খেলা এতখানি নিষ্ঠা নিয়ে মানুষ চালিয়ে যেতে পারে না। মাছেদের জ্যোতিষী নেই ভাগ্যিস। মৃত্যুর দিনক্ষণ জানে না বলে তারা উল্লাসে আরও পাঁচ মিনিট বেঁচে নেয়।
ওদিকে ডুবুরির ক্যামেরা দেখতে পায় জলের একদম নীচে মাটি-বালির বুক ঘেঁষে একঝাঁক উজ্জ্বল কমলা মাছ গড়গড়িয়ে আসছে। পাখনায় ভর করে নয়, অন্য কোনও অভিনব উপায়ে। তাদের বুক আর পেটের তলায় ঘুরছে কী যেন? চাকা! এ তো সাইকেল! বাকরুদ্ধ হয়ে যায় অনিন্দ্য। কি সুন্দর সাইকেল চালায় ওরা! মাছেরাও তাহলে!
সুদেষ্ণাকে খাবার টেবিলে ডাকতে গিয়ে অনিন্দ্য বলে ফেলল, “দেখবে এসো সোনাই, মাছেরা সাইকেল চড়ছে।”
“কেন বাজে বকছ আবার?” মুখ না তুলে কণ্ঠস্বরে পঁচাত্তর শতাংশ বিরক্তি মিশিয়ে বলে সুদেষ্ণা।
“না গো, সত্যি। টিভিতে দেখাচ্ছে।”
এবার মুখ তোলে সুদেষ্ণা। “ডিজনি দেখছ? দ্যাখো। আমাকে লিখতে দাও।”
অন্যদিন হলে এতেই দমে যেত অনিন্দ্য, কিন্তু আজ এই মুহূর্তে বুলবুলের ডানার ঝাপটায় বাইরে জোর বাতাস শুরু হয়েছে আর সহসা মৎস্য বিষয়ক গূঢ়তম তত্ত্বটি জেনে ফেলায় তীব্র অ্যাড্রিনালিন। এসব সাইক্লোন তাকে থামতে দেয় না। “ডিজনি নয় গো, ন্যাট জিও। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক। অথেনটিক।”
“তুমি স্বপ্ন দেখছ অনি। অথবা ফ্যান্টাসাইজ করছ। তোমার পক্ষে স্বাভাবিক।”
“সত্যি দেখলাম। বিশ্বাস করো আমাকে। এসো না একবার।”
দুজনে টিভির সামনে এসে দাঁড়ায়। এক ঝাঁক উজ্জ্বল কমলা মাছ সুশৃঙ্খলভাবে সাঁতরে আসছে অতল বরাবর। ইতস্তত জেগে আছে জলজ উদ্ভিদ। কোথাও কোনও সাইকেল নেই। সম্ভবত এই একটু আগে, আগের দৃশ্যে বা আগের ফ্রেমে তারা সাইকেলের অপ্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে ফেলে রেখে এসেছে সব দ্বিচক্রযান। সেই ফ্রেমটাতে ফেরত যেতে পারলে এখনও সুদেষ্ণাকে দেখানো যেত জলের তলায় স্তুপীকৃত সাইকেল। এতগুলো এল কেমন করে ওখানে, মাছেদের নাই হবে যদি? কিন্তু সেই ফ্রেমটায় ফিরে যাচ্ছে না ডুবুরি। শুধুমাত্র উজ্জ্বল মাছেদের জয়যাত্রা নিয়ে ব্যস্ত সে। সাইকেল মাছের কাজে লাগে না, একথা এতদিনে সব দর্শকই জানে, ওসব আর দেখানোর কিছু নেই। সুদেষ্ণার কাছে আবার খেলো হয়ে যেতে হবে? আরও একবার প্রমাণিত হবে যে অনিন্দ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়!
আরও একবার হেরে গিয়ে পিছোতে পিছোতে অনিন্দ্য একেবারে সুদেষ্ণার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। সেই মুহূর্তে জানালায় আছড়ে পড়ে জোরালো বাতাস। ফেটে চৌচির হয়ে যায় টেলিভিশনের কাচ আর বাধা সরে যেতেই সমুদ্রটা স্ক্রিন ছাপিয়ে উপচে পড়ে ঘরের মধ্যে। সোফা, চেয়ার, খাবার টেবিল ভাসিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে পড়ে বন্যার জল। জলের স্রোতে ঘরে এসে পড়ে অগুন্তি কমলা মাছ। তাদের পাখনার কাছে হালকা নীল আভা। মাছেদের পাশেপাশে সাঁতরে যাচ্ছে রেনকোট পরা এক ডুবুরি। তার পিঠে অক্সিজেনের বোতলের গায়ে লেখা ‘সুইগি’।
মাছেরা ধীরে ধীরে সুদেষ্ণাকে ঘিরে ধরে। গোল হয়ে ঘুরতে শুরু করে। জল থেকে মাথা তোলে আর নামায় নৃত্যের ছন্দে। সুদেষ্ণার মুখে হাসি ফোটে। বহুদিন পর সুদেষ্ণার মুখে হাসি। অবাক হয়ে দেখে অনিন্দ্য। মাছেদের ডানায় হাত মিলিয়ে নাচতে শুরু করে সুদেষ্ণা। এত সুন্দর নাচতে পারে, জানাই ছিল না।
জল বাড়তে বাড়তে গলা সমান হয়ে জানালার শার্সি ভেঙে ফেলে। অমনি সমুদ্র ঘর ছাপিয়ে শহরে লাফ দেয় আর ঝড় ঢুকে পড়ে ঘরে। মাছেদের সঙ্গে ভাসতে ভাসতে সুদেষ্ণাও জানালা পেরিয়ে চলে যাচ্ছে দেখে মরিয়া অনিন্দ্য জল চিরে তার বুকে ঝাঁপায়। “আমি বড় অসহায় সোনাই। বড় দুর্বল। একা। আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি ভয় পাই।”
এটুকু বলে ফেলতে পেরে হাল্কা বোধ করে অনিন্দ্য। ডুবে যেতে যেতে ভুস করে ভেসে ওঠে। মাছের পেখমের মতো দীর্ঘ তরল হাতে সুদেষ্ণা তাকে জড়িয়ে ধরে। টেনে নেয়। তুলে নেয় মাছের পিঠে। অনিন্দ্য অবাক হয়ে দেখে, মাছেদের মধ্যে একজন দুজন কয়েকজন অনেকটা বড় হয়ে গেছে এতক্ষণে। সুদেষ্ণার হাতের আশ্রয়ে নিশ্চিন্ত বোধ করে অনিন্দ্য। সেই হাত তাকে টেনে তোলে ক্রমশ বড় হয়ে ওঠা মীনের পিঠে। যত্ন করে বসায়। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে যাতে সে পড়ে না যায়। তারপর জানালা পেরিয়ে, নগর পেরিয়ে, ঝড় পেরিয়ে মহা-মীনে সওয়ার দুজনে মিলে ভাসতে ভাসতে… ভাসতে ভাসতে…