ডিউ প্রসেসের পরে

দেবারতি সরকার

 

আমার ছোটবেলায় একটা অজানা রোগ হয়েছিল। আমি বাইরে বেরোতে ভয় পেতাম। ঠিক যতটা বাড়ির মধ্যে বসে ভূতে পেতাম, ততটা। আমি এতটাই ভূতে ভয় পেতাম যে গরমকালেও গায়ে চাদর দিয়ে ঘুমাতাম যাতে কোনও উটকো ঠান্ডা হাত হঠাৎ আমার গায়ের উপর এসে না পড়তে পারে। বলা যেতে পারে কোথাও উপস্থিত না থাকতে পারার রোগে ধরেছিল আমায়। একবার বহুমাস বাড়ি থেকে বের হইনি ভয়ে। এইভাবেই বড় হয়ে যাই তারপর জানতে পারি নানারকম মানসিক রোগ শেকড় গেঁড়েছে। এই মাথা নিয়ে না একমনে সেলাই করা যায়, না শান্তিতে চুল আঁচড়ানো যায়, না দুদণ্ড চুপচাপ করে বসে থাকা যায়, না ঘুমিয়ে চাঙ্গা হওয়া যায়। বিদেশিনী রাস্তায় হাঁটলে হন flaneuse, আমি হাঁটলে হই ফানুস। এ ভালনারেবল হট এয়ার বালুন আবাউট টু ক্র্যাশ ডিউ টু স্ট্রেস এন্ড স্ট্রিট-হ্যারাসমেন্ট। আমি বাড়ি থেকে বেরোই একটাই চাপ নিয়ে লাস্ট মেট্রোটা না পেলে রাস্তায় মরতে হবে, কাজেই। এত চাপ নিয়ে জাস্ট কখনও flaneuse হওয়া যায় না। সিলভিয়া প্লাথ বা গ্রেটা গের্‌উইগ বাগানে, মিউজিয়ামে, জনমানবহীন রাস্তায় হাঁটার সময় তাঁদের মাথায় এইসব ফালতু ভাবনা ঘুরলে বুঝতেই পারছেন কি কেলোটা হত! এইসব সাতপাঁচ ভেবে যখন কোনওক্রমে খানিক কাজ উদ্ধার করে ক্ষান্ত হই ঠিক তখনি এসে জোটে আরও নতুনরকমের সব অশান্তি যেগুলো নিজস্ব সমস্যা নয় তবে নৈর্ব্যক্তিকও নয়, কাজেই রাজনৈতিক। যেমন ধরুন এই তেলেঙ্গানার ঘটনাটার পর থেকে প্রতিদিনই রুটিনমাফিক কোনও না কোনও ভয়াবহ যৌন হিংসার কথা টাইমলাইন জুড়ে চোখে পড়তে শুরু করেছে। কিঞ্চিৎ বেশিই চোখে পরছে আগের থেকে। অথচ পুলিশ ৪ জন অভিযুক্তকে এনকাউন্টারে খুন করা সত্ত্বেও উন্নাও-এর সার্ভাইভারকে অভিযুক্তরা পুড়িয়ে মেরে ফেলতে পারল কি করে তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন দেখছি না।[1] কারণ আমরা তো ভেবেছিলাম ওই ৪ জন নিহত হলে দেশ থেকে, থুড়ি গোটা পৃথিবী থেকেই যৌন হিংসা উঠে যাবে! ধরাধামে নেমে আসবে আসলি আচ্ছে দিন! ঠিক যেমন ২০১২ সালে নির্ভয়া কাণ্ডের পর হয়…নি। ওটা হবে না কারণ আমরা আসল কথাগুলো বলছি না।

কী পরিস্থিতিতে একজন অভিযুক্ত তার লক্ষ্যে পৌঁছে যায়, কীভাবে একজন মানুষ একজন অভিযুক্ত হয়ে ওঠে, কেন একজন নির্যাতিতাকে একটা ছদ্মনামে[2] পরিণত হতে হয়, অভিযুক্তের সামাজিক অবস্থান, তার পরিবেশ তাঁকে কিভাবে তৈরি করে, কিভাবে বজায় রাখে তার অবস্থানকে, কোন জাতের, ধর্মের, ভাষাভাষীর অভিযুক্তকে আমরা খুন করতে বেশি আগ্রহী হই, কাদেরকে আমরা ছাড় দিই এবং এই বাছবিচার আমাদের সম্বন্ধেই বা কী বলে? ন্যায়বিচার আমরা কিসের ভিত্তিতে কাদের জন্য চাই? কোন নির্যাতিতাকে বিশ্বাস করি আর কাকে দেগে দিই মিথ্যেবাদী বলে?

 

পরিশীলিত পিতৃতন্ত্র

#মিটু-পরবর্তী ভারতবর্ষে বিভিন্ন নারীবাদী মহলে দাবি উঠেছিল যৌন হিংসা দমনের জন্য তৈরি আইনগুলোকে নতুন করে ভাববার। কোথায় ভুল হচ্ছে? #মিটু প্রমাণ করেছে যে ডিউ প্রসেস আসলে অচল। প্রথমত, কে অভিযোগ নথিভুক্ত করতে পারবেন তা নির্ভরশীল তিনি সমাজের কোন স্তরে বিরাজ করেন তার উপর। যে মহিলারা AFSPA-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বাস করেন এবং সৈন্যদের হাতে নির্যাতিত হন বা যে মহিলারা ইনফর্মাল সেক্টর ও হোম-বেস্‌ড ইকনমির অন্তর্গত তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ব্যবস্থার উপযোগ করতে পারেন না। অর্থাৎ নির্যাতন ও নির্যাতন-পরবর্তী অভিযোগ কতটা জায়েজ তা ঠিক করে দেয় অভিযোগকারীর শ্রেণি এবং বর্ণ। যেমন ধরুন উন্নাও-এর সার্ভাইভারের অভিযোগ নিতে রাজি হয়নি রাইবারেলির পুলিশ, কোর্ট থেকে আর্জি আসার পর, নির্যাতন শুরু হওয়ার এক বছর তিন মাস পর পুলিশ এফআইআর লজ করে। মনে রাখতে হবে এই ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা হলেন উচ্চবর্ণ  ব্রাহ্মণ সন্তান। যে বছর নির্ভয়া কাণ্ডে সারা দেশে রে-রে রব উঠেছিল সেই একই বছর প্রায় একই সময়ে বস্তারে সোনি সোরিকে কাস্টডিয়াল রেপ এবং ভাওলেন্সের শিকার হতে হয় এসপি অঙ্কিৎ গর্গের হাতে। এই এসপিকে পরবর্তীকালে ভারত সরকার রাষ্ট্রপতি পোলিস এ্যাওয়ার্ড ফর গ্যালেন্ট্রির সম্মানে সম্মানিত করে।

অভিযোগ নথিভুক্ত করা সত্ত্বেও সার্ভাইভারকে নানাধরনের বিপ্রতীপ ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। উন্নাও-এর ঘটনাটি এই ক্ষেত্রেও লক্ষণীয়, সার্ভাইভার অভিযোগ দায়ের করার ৯ মাসের মধ্যে নৃশংসভাবে খুন হয়ে যান অপরাধীদের হাতে। এফআইআর দায়ের করার পর কোনওরকম ফলোআপের ব্যবস্থা না থাকায় যৌনহিংসা নিবারণের জন্য তৈরি আইনগুলো অভিযোগকারীর দৈহিক ও মানসিক সংরক্ষণের কোনওরকম দায়িত্বই নেয় না। বর্তমানেএই আইনগুলো ভিক্টিম-কেন্দ্রিক না হওয়ায় তাদেরকে নানারকম ট্রমা, ব্লেমিং, শেমিং-এর সম্মুখীন হতে হয় প্রতিটি পদক্ষেপে। এই ঘটনাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সার্ভাইভারকে বাধ্য করে ডিউ প্রসেস থেকে বেরিয়ে আসতে।

আমাদের বর্তমান আইনি ব্যাবস্থার মূল উদ্দেশ্য দোষীকে যোগ্য শাস্তি দেওয়া। এই ব্যাবস্থাকে বলা হয় রেফর্মেটিভ জাস্টিস সিস্টেম বা যে ব্যবস্থা সংশোধনমূলক। শাস্তি পাওয়ার পর তাঁরা সমাজে কীভাবে ফিরে যাবেন বা তাঁরা যাতে আবার মূলধারার জীবনযাপন করতে পারেন তার জন্য তাঁদেরকে যা যা টুল্‌স দেওয়া যেতে পারে সেগুলোর জন্য কোনও ব্যবস্থা নেই। তাঁরা যাতে আবার ওই একই ধরনের বা অন্য ধরনের কোনও অপরাধ কমিট্‌ না করেন তার জন্য তাঁর যে মানসিক ও ব্যবহারিক পরিবর্তনের দরকার সেই দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করা উচিৎ। একজন অভিযুক্তকে ‘পৈশাচিক’ না ভেবে মানুষ ভাবলে এই মূল্যায়নগুলো করতে সুবিধে হয়। তাদেরকে মানুষ ভাবলে তারা যে এই সমাজেরই, এই পিতৃতন্ত্রেরই, এই রেপ কালচারেরই অংশ তা মানতে সুবিধে হয়। পিতৃতন্ত্রের সংশোধন হলে তাকে বলা হবে পরিশীলিত পিতৃতন্ত্র। ব্যাপারটা একই, মোড়কটা নতুন। এমতাবস্থায় কী করতে পারি আমরা?

ঘটনাটাকে প্রাধান্য না দিয়ে যদি সার্ভাইভারকে মূল কেন্দ্র হিসেবে ধরে এগোনো যায় তাহলে যা দাঁড়ায় তাতে আমরা ঘটনাকে একটা স্থিরতা থেকে বের করে একটা চলমান প্রসেসের অন্তর্গত করতে পারি। এই চলমান প্রসেস অভিযোগকারীর কথা ভেবে এবং মেনে এগোবে। তা চরিতার্থ করতে আমাদেরকে নাগরিক হিসেবে কতগুলো দায়িত্ব নিতে হবে। সার্ভাইভারকে বিশ্বাস করতে হবে সবার আগে। তাঁর জন্য তৈরি করতে হবে সেফ স্পেস যাতে তিনি নিজের কথা বলতে পারেন নির্দ্বিধায়। মাথা থেকে গুড ভিক্টিম-ব্যাড ভিক্টিমের ন্যারেটিভগুলোকে বাদ দিতে হবে। এই অভিযোগের ব্যবস্থাটাকে আরও পাকাপোক্ত করতে হবে।

 

নারীবাদী অভিযোগ[3] ও রেস্টরেটিভ জাস্টিস সিস্টেম

দৈনন্দিন জীবনে অভিযোগ শুধু পুলিশ স্টেশনে নথিভুক্ত হয় না, বিশাখা গাইডলাইন্স অনুযায়ী যেকোনও কাজের জায়গার নির্দিস্ট সেলে, এনজিওতে, ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে বাড়িতে, ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছেও তা নথিভুক্ত হয়। এই সূক্ষ্মতাকে মান্যতা দিতে হবে। রাস্ট্র প্রদত্ত জেলখানার বাইরে এসে ভাবেতে হবে কীভাবে আমরা বিকল্প হিসেবে রেস্টরেটিভ জাস্টিস সিস্টেমের দিকে এগোতে পারি। তার কাঠামো কখনওই অন্য ধরনের (চুরি, খুন) আইনি অপরাধের কাঠামোর সঙ্গে সদৃশ হতে পারে না।

যেকোনও যৌনহিংসাকে যদি ক্ষমতার প্রদর্শন হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয় তাহলে তার সঙ্গে অন্য ধরনের অপরাধের পার্থক্য বুঝতে সুবিধে হয়। এই ব্যাখ্যা একরৈখিক হতে পারে না কখনওই কারণ রাষ্ট্র সমস্ত শরীরকে একই চোখে দেখে না। সেঁজুতি দত্ত তার প্রবন্ধে ভিক্টিম ও অপরাধীর শরীরের রাজনীতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লিখছেন, “রাষ্ট্রের কাছে ভিক্টিমের শরীর যেমন প্রাকৃতিক অধিকারের ঊর্ধ্বে দয়া এবং করুণার ক্ষেত্র, তেমনি অপরাধীর শরীর এক নিছকই হেলার বস্তু। অপরাধ দমনে অতৎপরতা এবং অপরাধীর সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অবস্থানের নিরিখে অন্যায় বিচার করায় অপারগ শাসক চেষ্টা করে এমন কিছু অপরাধী শরীর চিহ্নিত করতে, যার মাধ্যমে জনসমক্ষে ক্ষমতাশীলের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদর্শন করা সম্ভব। এর ফলে সর্বোপস্থিত রাষ্ট্র তার পরাক্রম জিয়িয়ে রেখে এক প্রকার ন্যায্য ভীতি উৎপাদনে সফল হয়। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সন্দর্ভের পরিসরে এইরূপ ভীতিকে আতঙ্কবাদ থেকে তফাত করার প্রক্রিয়াও চলতে থাকে প্রতিনিয়ত।”[4] শিল্পা ফাড্‌কে তাঁর বই Why Loiter-এ রাষ্ট্রের এই পক্ষপাতপুর্ণ ট্রিটমেন্টের সোশিওলজিক্যাল দিক নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। যৌন হিংসা শারীরিক ও মানসিক, তা বস্তুকেন্দ্রিক নয়। অনেক ক্ষেত্রেই পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় না, সেক্ষেত্রে নির্যাতিতার হারানো সময়, বিশ্বাস, স্মৃতি, ক্ষমতা, সার্ভাইভাল স্কিল, মানসিক ভারসাম্য, এই ধরনের অবয়বহীন সামগ্রীর মূল্যায়ন আমরা করব কী করে? কতটা শাস্তি দিলে ফিরে পাওয়া যাবে বা উসুল করে নেওয়া যাবে সেসব ইন্ট্যাঞ্জিবল অ্যাসেটের মূল্য?

নারীবাদী লেখক ও তাত্ত্বিক সারা আহমেদ তাঁর লেখায় বারবার বলছেন অভিযোগকে ফেমিনিস্ট টুল্‌ হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। তিনি বলছেন এই ব্যবস্থাকে ফেমিনিস্ট টুল হিসেবে কাজে লাগাতে গেলে আমাদের কিছু উপরি হোমওয়ার্ক করতে হবে। শোনার মতো এক জোড়া নারীবাদী কান তৈরি করতে হবে সবার আগে। যে কান দিয়ে আমরা মহিলাদের যেকোনও অভিযোগকে শুনতে পাই ‘ঘ্যানঘ্যানে,’ ‘বিলাপ’, ‘নাকিকান্না’, ‘ন্যাকামি’ হিসেবে এবং তারপর সেগুলোকে ওই একই ভিত্তিতে বাদ দিয়ে দিই সেই কানটাকে মেরামত করতে হবে জবরদস্ত। সারা এই প্রি-মেডিটেটেড্‌ অভিমতটাকে খতিয়ে দেখতে বলছেন। কেন এই ধরনের অভিমত আমরা তৈরি করে থাকি? “…we learn from how we are not heard.”[5] সারার এই মূল্যায়নের সত্যতা অভিযোগকারী মহিলারা জানেন। শুধুমাত্র যৌন হেনস্থা নয়, কুরুচিকর কোনও মন্তব্য বা ঠাট্টা ইয়ার্কি অনায়াসেই মান্যতা পেয়ে যায় কোনওরকম প্রতিবাদ ছাড়া। মহিলারা প্রতিবাদ করলে তারা হয় ‘জোক নিতে পারেন না’ আর নয়ত তারা ‘বেশি চাপ’ নিয়ে ফেলেন। এই হেনস্থা যে শুধুমাত্র তৃতীয় বিশ্বের বাদামি চামড়ার মহিলাদেরই ফেস্‌ করতে হয় এমনটা ভাববার কোনও কারণ নেই। যেমন ধরুন, প্রফেসার সিমোনা শারোনি, একজন জেন্ডার স্টাডিজের অধ্যাপক, প্যালেস্টাইন ও নারী আন্দোলন নিয়ে অনেকগুলো বই লিখেছেন, মেরিম্যাক কলেজের ইন্টারডিসিপ্লিনারি ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর। তিনি একজন সহকর্মীর সেক্সিস্ট জোকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করার অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে গিয়ে বলছেন, “…he referred to my complaint as ‘frivolous’ and urged me to focus on ‘real offenses, not those that are imagined or marginal’.”[6] এই ‘ফ্রিভোলাস্‌’ অভিযোগটি যদিও পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠানটির কোড অফ কন্ডাক্ট অনুযায়ী যথেষ্ট জায়েজ প্রমাণিত হয়। শারোনি গোটা প্রবন্ধটায় বোঝার চেষ্টা করেছেন মিডিয়ার, তার অন্যান্য সহকর্মীর এবং অভিযুক্তের তার অভিযোগটাকে ‘পলিটিক্যাল কারেক্টনেস’ বলে ভিত্তিহীন দেগে দেওয়ার প্রবণতার আসল উৎস কী। তিনি শরণাপন্ন হয়েছেন আরেকজন নারীবাদী লেখকের ভাবনার কাছে। এম্মা পিট্‌ম্যান তার প্রবন্ধে লিখছেন, “it [misogyny] functions like a human pyramid, where minor acts support the major by providing, at best, a foundation of blithe indifference, and at worst an atmosphere of amusement at the denigration of women.”[7] অর্থাৎ মহিলাদের প্রতি বিদ্রূপ এবং সেই বিদ্রূপকে জোর করে মানিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি আসলে মিসোজিনির ফলস্বরূপ। আইনি ব্যবস্থা নয় এই সংস্কৃতিই আসলে ঠিক করে দেয় কখন একটা অভিযোগ যোগ্য আর কখন তা কল্পিত। বিদ্রূপ বলতে মনে পড়ল ১৮৮৭ সালে আমেরিকায় সাফ্রাজিস্টদের বিদ্রূপ করার জন্য একদল পুরুষ সুজানা সল্টার নামের একজন সাফ্রাজিস্টকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে নিযুক্ত করে। সেটা অন্য ব্যপার যে সুজানা আমেরিকার সর্বপ্রথম মহিলা মেয়র হন ৬০% ভোট পেয়ে সেই ইলেক্‌শনে কিন্তু জরুরি বিষয় হল নানারকম বিদ্রূপ উপেক্ষা করে একজন মহিলার রাজনৈতিক অধিকারের দাবি নিয়ে সাফ্রাজিস্টরা অভিযোগ না তুললে, না লড়লে অনেক কিছুই অসম্পন্ন থেকে যেত ইতিহাসে। নারীদের অভিযোগকে বিদ্রূপ সমুচিত মনে করাটা মিসোজিনিস্ট। কিন্তু এর উলটো দিকে দাঁড়িয়ে যেসব অভিযোগ বেরিয়ে এসে নারীর অধিকার নিয়ে লড়ছে, ডিগ্‌নিটি নিয়ে লড়ছে তাদের সারা ‘ফেমিনিস্ট কমপ্লেইন’ বলছেন: “If they hadn’t complained some of us wouldn’t be here. If we don’t complain some of us won’t be here.”[8]

অভিযোগ করলে অভিযোগকারীকে একধরনের অনুল্লিখিত উহ্য নিয়মানুযায়ী সমাজের নানা দিক থেকে ছেঁটে ফেলা হয় খুব সন্তর্পণে। অভিযোগ কেন একধরনের পেডাগজি, অভিযোগ থেকে আমরা সামাজিক চুক্তিগুলো সম্পর্কে কী জানতে পারি তা বোঝাতে গিয়ে আহমেদ বলছেন, “Being stranded is part of the experience of complaint… you come apart; things fall apart. Cutting yourself off can also be a judgement made about the complainer: as if you have caused your own alienation by not going along with something… complaint teaches us about we; how a bond becomes a bind. Those who complain are often judged as causing the problem they identify by failing to be part of a we.[9] অভিযোগের এই বহুমুখী সামাজিক ও অ্যাফেক্টিভ প্রভাবকে বুঝতে গেলে আমাদের ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে সোচ্চার হতে হবে। সেক্ষেত্রে রেস্টরেটিভ জাস্টিস সিস্টেম রাষ্ট্রপ্রদত্ত আইনি ঘোরপ্যাঁচের বাইরে এসে নৈতিক ও সামাজিক স্তরে ন্যায়কে কল্পনা করতে শেখায়।

ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে রেস্টরেটিভ জাস্টিস সিস্টেম কীরকম হতে পারে তার হদিশ খুঁজতে গিয়ে ঋদ্ধি দস্তিদার তার প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে অত্যন্ত জরুরি কিছু মন্তব্য করেছেন। তিনি লিখছেন, “In our criminal justice system, crime in general is imagined as an offence against the State— which is addressed by the State punishing the criminal. Survivors lose control over their narrative, as well as the right to articulate what ‘justice’ might look like for them.”[10] তিনি ক্ষতি (harm) ও মেরামতির (repair) প্রাধান্যকে বেছে নিয়েছেন এই সংশোধনমূলক আইনি ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে। দুপক্ষই সমাজে কী করে ফিরে যাবেন সেটা ভাবতে হবে। তাঁদের মানসিক, আর্থিক, সামাজিক ক্ষয়ক্ষতির দায়ভার নিতে হবে, দেখতে হবে যাতে অভিযুক্ত ফের ওই একই অপরাধ না করেন, তার জন্য যা যা ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব তা নিতে হবে। তা জেলের গণ্ডির বাইরেই সম্ভব। কার্যত দেখা গেছে হাজতবাস বিশেষ কোনও কাঠামোগত বদল আনতে সক্ষম নয়— অভিযুক্তর জীবনেও না, নির্যাতিতার জীবনেও না। ঋদ্ধির গবেষণায় ধরা পরেছে ভারতবর্ষের বিভন্ন প্রান্তরে তৈরি হওয়া তামাম প্রচেষ্টার কথা, যারা তথাকথিত আইনি পদক্ষেপের বাইরে জাত-পাত-ধর্ম নির্বিশেষে রেস্টরেটিভ জাস্টিসকে একটা নতুন দিগন্তে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস করছেন। এই প্রচেষ্টাগুলো বিশেষ করে সাহায্য করছে দলিত-বহুজন এবং অন্যান্য পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের মানুষকে।

কাজের সূত্রে কয়েকদিন আগে সাউথ আফ্রিকার উইট্‌স‌ বিশ্ববিদ্যালয়ের (যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর আগে #FeesMustFall আন্দোলনের সূত্রপাত হয়) জেন্ডার ইকুইটি অফিসের (GEO)[11] প্রাক্তন ডিরেক্টর প্রফেসর জাকি ডুগার্ডের একটি ইন্টার্ভিউ শোনার সুযোগ হয়, তাতে উনি ক্যাম্পাসে জেন্ডার ভায়লেন্সের ক্ষেত্রে তিনটে মূল দিকের কথা বলেছেন— মনসামাজিক সহায়তা, অনুশাসনমূলক প্রক্রিয়া এবং প্রতিরক্ষা (“psycho-social support, the disciplinary process and advocacy”[12])। আইনি ব্যবস্থা এবং কাউন্সিলিং প্রক্রিয়া একেবারেই দুটি ভিন্ন ধরনের মেথডলজি অনুসরণ করে, যেহেতু কাউন্সিলিং প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কিছু তথ্য কনফিডেনশিয়াল থাকে। আবার এদেরকে একে অপরের সঙ্গে কথোপকথনের মধ্যে দিয়েও যেতে হয়। কাজেই GEO-কে খুব সন্তর্পণে এই কাজগুলো করতে হয়। জাকি যেভাবে বরাবর নারীদের প্রতি এবং বিশেষ করে কালো চামড়ার নারীদের প্রতি পিতৃতন্ত্রের বিশেষ প্রকোপের কথা বললেন, সার্ভাইভারদের প্রতি তাঁর সংবেদনশীলতা, তাদের জন্য সেইফ স্পেস তৈরি করে দিতে পারার আপ্রাণ চেষ্টা, ক্যাম্পাসের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিতে জেন্ডার সেন্সিটাইজেশনকে প্রাধান্য দেওয়া এবং বিভিন্ন ফেমিনিস্ট ক্যাম্পেইনের প্রতি তাঁর সহমর্মিতা বুঝিয়ে দিল বিশ্ববিদ্যালয়েও এই রেস্টরেস্টিভ জাস্টিস সিস্টেম কার্যকরী করতে গেলে আমাদের শিক্ষক, অধ্যক্ষ এবং পড়ুয়াদের কতখানি তৎপর ও সংবেদনশীল হতে হবে।

এদিকে কলকাতার নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা যখন যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনেন তখন তাদের আমরা জিগ্যেস করি সে কী জামা পড়েছিল, তাঁর কটা ছেলেবন্ধু আছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। বেশিরভাগ কলেজের পড়ুয়ারা তাদের কলেজের আইসিসি সেল সম্পর্কে ওয়াকিফ নন। বহু শিক্ষাকেন্দ্রে GSCASH (Gender Sensitisation Committee Against Sexual Harassment) হয় কাজ করে না আর নয়ত তাঁর পুনর্নির্মাণের জন্য লড়াই চলছে। এমতাবস্থায় প্রতিদিন কোনও না কোনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যৌন হেনস্থার খবর আসতেই থাকে। অভিযুক্ত যদি কোনও মেধাবী ছাত্র বা বড়মাপের আকাডেমিক হয় তাহলে তারা ছাড় পেয়ে যায় কোনওরকম প্রতিবাদ ছাড়াই। রায়া সরকারের লিস্টে উঠে আসা নামগুলোর বেশিরভাগ অভিযুক্তই এখন বহাল তবিয়তে আছেন। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে যাঁরা অভিযোগ এনেছেন তাঁদের ক্ষেত্রে সেই একই কথা আমরা বলতে পারব কি?

নারী শরীরে কোথাও উপস্থিত না থাকতে পারার রোগটার নাম জানি, রেপ কালচার। আসল কথাগুলো বলতে গেলে এই রেপ কালচারের উপস্থিতিটাকে স্বীকার করতে হবে। অধ্যাবসায় ও শ্রম দাবি করে এই স্বীকারোক্তি, হকি স্টিক নয়।

 

ডিসেম্বর, ২০১৯


[1] যেহেতু এই দুটি ঘটনা পাবলিক ইমাজিনেশানে সবথেকে বেশি দাগ কেটেছে বর্তমানে তাই এই দুটি উদাহরণ নিয়েই এগোচ্ছি।

[2] এই বিষয়ে আরও জানতে পড়ুন সেঁজুতি দত্ত, “আক্রমণ এবং আকৃতি: রাজনৈতিক শরীর নিয়ে কিছু ভাবনা,” চার্বাক, সপ্তম সংখ্যা, বৈশাখ ১৮২৩

[3] See Sara Ahmed, “Feminist Complaint”. https://feministkilljoys.com/2014/12/05/complaint/. Dec 2014

[4] দত্ত, ১৮২৩

[5] Ahmed, 2014

[6] Simona Sharoni, “Speaking up in the Age of #MeToo and Persistent Patriarchy or What can we learn from an elevator incident about anti-feminist backlash” https://femrev.wordpress.com/2018/05/31/speaking-up-in-the-age-of-metoo-and-persistent-patriarchy-or-what-can-we-learn-from-an-elevator-incident-about-anti-feminist-backlash/. May 2018

[7] Emma Pitman, “Misogyny is a Human Pyramid” https://meanjin.com.au/blog/misogyny-is-a-human-pyramid/ January 2018

[8] Ahmed, 2014

[9] Sara Ahmed, “Cutting Yourself Off”. https://feministkilljoys.com/2017/11/03/cutting-yourself-off/ November 2017

[10] Riddhi Dastidar, “Cancel Culture vs Rape Culture, and the Case for Repairing Harm” https://thewire.in/women/cancel-culture-vs-rape-culture-and-the-case-for-repairing-harm August 2019

[11] অনেকটা আমাদের দেশের ইন্টারনাল কমপ্লেন্ট্‌স কমিটির মতো একটা ব্যবস্থা

[12] ঋণস্বীকার: জুজিওয়ে খুজওায়েও, পিএইচডি, উইট্‌স ইউনিভার্সিটি

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...