অম্লানকুসুম চক্রবর্তী
পুলিশের গুলিতে তেলেঙ্গানাতে সদ্য ঝাঁঝরা হয়ে গেল যারা, তাদের ঠিক এভাবে মরা উচিত ছিল কি না তা নিয়ে দেশ এখন ঠিক দুভাগে বিভক্ত।
গরাদবন্দি করে, পাঁচ-সাত-দশ বছর ধরে বিচার চলার পরে, ফাঁসি কিংবা যাবজ্জীবন দেওয়ার থেকে একবারে সব চুকেবুকে গেল। ঝামেলা মিটল। মারার পরে স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে বিচারের মাঠে টেস্ট না খেলে তেলেঙ্গানা প্রশাসন দিব্যি টি-টোয়েন্টি খেলে দিলেন। দ্য ল উইল টেক ইটস ওন কোর্স বলার মতো সুযোগ রইল না আর। বেশ হয়েছে, মরেছে— বলছেন বহু লোক। কিন্তু উল্টো দিক থেকেও একটা মত শোনা যাচ্ছে। কুখ্যাত অপরাধীরও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার, অন্তত আইনি লড়াইটুকু করার অধিকার দেশের সংবিধান নাগরিকদের দিয়েছে। সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করার আগেই হঠাৎ করে সব শেষ হয়ে গেল চারজনের। এই ঘটনার বিরোধীরা বলছেন, এভাবে পুলিশ যদি নিজেদের হাতে নিজেদের মর্জিমতো আইন তুলে নেয়, তাহলে দেশের বিচারব্যবস্থা তো লাটে উঠবে। চোখ বাঁধা মূর্তির হাতে দাড়িপাল্লাটা রাখার আর কোনও প্রয়োজন হয় না। এ যেন অনেকটা একটা ধুন্ধুমার ক্রিকেট ম্যাচ, শুধু মাঠে আম্পায়ার নেই।
ভারতবর্ষ এখন শুধুমাত্র সূর্যেরই এক নাম নয়। ধর্ষণেরও। সকালবেলা উঠে, মুখে চোখে জল দিয়ে, খবরের কাগজটা খুলে ধর্ষণের খবর পড়তে ভালো লাগে না, বিশ্বাস করুন। যে দেশে দিনের পর দিন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একটার পর একটা কলকারখানা, যে দেশে কাজ কমে যাচ্ছে প্রতিদিন, যে দেশের জিডিপি তলানিতে, যে দেশের কর্মসংস্থানের হার গত পঁয়তাল্লিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে, গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে যে দেশ লজ্জায় টিকে থাকে কোনওমতে, সেদেশে খবর কাগজ আর টিভি চ্যানেলের হেডলাইনে ধর্ষণ জায়গা করে নিচ্ছে দিনের পর দিন। লোকের মুখে মুখে এখন শুধু নির্যাতিতার কথা, ধর্ষকদের কথা, এনকাউন্টারের কথা। সমাজের সঙ্কট কতটা গভীর হলে তা বিষ মেশানো জলে মরা মাছের মতো রাতারাতি ভেসে ওঠে পুকুরে, তা আমরা দেখতে পাচ্ছি আজকাল। দেখতে দেখতে চোখ জ্বলছে, চোখ থেকে জলও পড়ছে। এর সমাধান কবে জানা নেই।
কয়েকটা কথা এ সুযোগে স্পষ্ট করে বলা দরকার। এ ধরনের ঘটনা যখন পরপর ঘটতে থাকে, কিছু বিষয়ের উপরে আলোচনা প্রাধান্য পায়। চায়ের দোকান থেকে পাঁচতারা হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হলে চ্যানেল আয়োজিত বিতর্কসভা, আম আদমির ফেসবুকের পোস্ট থেকে বিখ্যাত মানুষদের ব্যক্তিগত ব্লগ, সম্পাদকীয়— সব জায়গাতেই একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে খুব। নারীরা কি শুধুই ভোগ্যপণ্য? সমাজের চোখে মেয়েরা কি শুধুই ভোগের বস্তু? মূল্যবোধের অবক্ষয় আর কত ঘটবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
সমাজ কীভাবে মেয়েদের তৈরি করে সে কথা ঘুরিয়ে সমাজকেই একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে। প্রতিদিন যেভাবে বেঁচে আছি আমরা, তার মধ্যে মহিলারা কীভাবে আসেন? নিজের পরেই আমরা সবচেয়ে যাকে ভালবাসি তা হল আমাদের ফেসবুকের প্রোফাইল। সমীক্ষা বলে, দিনে নাকি গড়ে দুঘণ্টা আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকি। ফেসবুকের কত অর্থপ্রাপ্তি হয়েছে জানা নেই। কিন্তু আমার, আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ার প্ল্যাটফর্মে স্ক্রল করলেই ভেসে উঠছে একটার পর একটা প্রায় অর্ধনগ্ন নারীদেহের ছবি। দাবি করা হচ্ছে, সেগুলো নাকি খবর। শিরোনামগুলো অনেকটা এরকম। ‘সমুদ্রতীরে টপলেস হলেন অমুক নায়িকা। ভিডিও মুহূর্তে ভাইরাল।’ ‘স্নানের পোশাকে ছবি আপলোড করলেন অমুক বলিউডি অভিনেত্রীর টিন-এজ কন্যা। মুহূর্তে ভাইরাল।’ ‘এক কোটি টাকার বিনিময়ে টিশার্ট খুলতে রাজি হলেন অমুক। ফোটোশ্যুট মুহূর্তে ভাইরাল।’ প্রতিটা লিঙ্কের সঙ্গে এই ‘মুহূর্তে ভাইরাল’ শব্দদুটো জোড়া দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমন কিছু ছবি দিয়ে ‘আয় আয় চই চই’ ডাক দেওয়া হচ্ছে যেগুলো অস্বস্তি দেয়। বহুবার নোটিফিকেশন ব্লক করার চেষ্টা করেছি। লাভ হয়নি। এ সব খবর আর খবরের ওয়েবসাইটের লিঙ্ক আসলে রক্তবীজের মতো। একটাকে মারলে জন্মায় আরও হাজারে হাজারে। এই নিয়ে কোনও কথা বলতে শুনি না কাউকে। অর্থের বিনিময়ে যাঁরা এগুলো ছাপছেন আর যাঁরা প্রমোট করছেন, তাঁদের কেন শাস্তি হয় না এর উত্তর পাইনি।
অথচ আমরা জানি যে, কোনও মহিলার দিকে কু-নজরও আজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পেজ থ্রি বলে তো আজকাল আর কিছু হয় না ইংরিজি খবরের কাগজে। কাগজের পেটে ভরে দেওয়া থাকে একটা গোটা সাপ্লিমেন্টারি। ক্রোড়পত্র। পাতাজোড়া যে ছবিগুলো ছাপা হয় প্রতিদিন, তার কি কোনও কোয়ালিটি চেক হয়? যে খবরের কাগজ নারীশক্তির জয়গান করে এক পাতায়, তার ঠিক পরের পাতাতেই অর্ধনগ্ন মহিলার ছবি ছাপে। সে ছবির নিচেই আবার কোনও খবরে সেলিব্রিটিরা প্রশ্ন তোলেন, মেয়েরা আর কত দিন পণ্য হয়ে থাকবে? পচে যাওয়া সমাজ নিয়ে তাঁরা নাক সিঁটকোন, ভুরু কুঁচকোন।
বিজ্ঞাপনের কারবারি যাঁরা, তাঁরা খুব ভাল করে জানেন কে পণ্য আর কে পণ্য নয়। তাঁরা জানেন, পাবলিক কোনটা খায় আর কোনটা খায় না। যদি তা না হত, তাহলে হাতে গোণা কয়েকটা বিজ্ঞাপন বাদ দিলে বাকিগুলোর মুখ শুধু মহিলারা হতেন না। কিছু টিএমটি বার আর কোষ্ঠকাঠিন্য উপশমের গুঁড়োর বিজ্ঞাপন ছাড়া প্রচারের কাজে পুরুষদের মুখ কোথায়? ছেলেদের ডিওডোরেন্টের বিজ্ঞাপনে কোনও মহিলা তাঁর নিজের জামার বোতাম খোলেন কেন? বডি অয়েলের বিজ্ঞাপনে কোন বুদ্ধিতে শুধু স্যুইম স্যুট পরিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করানো হয় মডেলকে? পুরুষদের অন্তর্বাস প্রচারেও দেখি অর্ধনগ্ন নায়িকা। আচারেও মহিলা, সর্ষের তেলেও মহিলা। সিলিং ফ্যানের বিজ্ঞাপনেও কোনও নারীর বুকের আঁচল উড়ে যায়। ফ্যান নয়, যেন আঁচলটাই আসল। কমোড পরিষ্কার করার ব্রাশেও সামনে ঝুঁকে পড়া কোনও নারীদেহ। মাথার উপরে ভনভন করা মশার ঝাঁকের মতো এমন উদাহরণ আছে। আমাদের বেঁচে থাকার বৃত্তটার পরিধি ধরে একবার হেঁটে এলেই বোঝা যায়, রসদের অভাব নেই।
তত্ত্বগতভাবে তো সবাই বেশ নারী পুরুষ সমান সমান জাতীয় কথা মানি। কিন্তু দুনিয়াদারি করা বিপণনের যে কালো সমুদ্র আছে, তা নারী-পুরুষের সমান সমান থাকার কথা স্বীকার করে তো? অন্তর্বাস পরা মহিলা এবং অন্তর্বাস পরা পুরুষের ছবি একই দামে বিকোবে তো লালা উগরানো বাজারে? যে দেশের সমাজে প্রতি পনেরো মিনিটে একটা করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, নারী শরীরের ‘পবিত্রতা’ রক্ষায় যে সমাজরক্ষকদের চোখে ঘুম নেই, নারীদের পণ্য হয়ে যাওয়া আটকাতে তাঁরা কী করছেন? কী করছি আমরা? টিকটক বলে যে নতুন ভিডিও শেয়ারিং সোশ্যাল মিডিয়া ঝড় তুলেছে আজকাল, তাতে ঢুকলে দেখি অধিকাংশ ভিডিওতেই শুধু শরীর আর শরীর। কোনও মহিলার পেটে মুখ ঘষছেন এক পুরুষ। সাড়ে দশহাজার ভিউ। অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর এন্টারটেইনমেন্ট কামরায় গিয়ে একবার ক্লিক করবেন। নায়িকারাই শুধু খবর হন, নায়কেরা নন। কী করলে তাঁরা খবর হয়ে ওঠেন, সম্পাদকেরা জানেন।
চারপাশটা মিথেন গ্যাসে ভরে গিয়েছে বলে আমরা নাক চাপা দিয়ে হাঁটছি এখন। বেঁচে থাকায় বদ গন্ধ। মনস্তাত্ত্বিকরা বলছেন অবক্ষয়ের কথা। ভেঙে যাওয়া মূল্যবোধের কথা। কিন্তু অন্তরে শুদ্ধ হতে গেলে বাইরেটাও শুদ্ধ করতে হয়। যে মশাটা রক্ত শুষছে অনেকক্ষণ ধরে, এনকাউন্টারের ঘটনাটা বাগে পেয়ে এক থাপ্পড়ে তাকে মেরে ফেলার মতো। এর ফলে ধর্ষকদের সংখ্যা কমবে কি? পরিসংখ্যান তো সেকথা বলে না। আমরা যারা মহিলাদের সম্মান করতে চাই, শ্রদ্ধা করতে চাই, তা করার মতো আরও একটু ভাল পরিবেশের দাবি কি আমরা করতে পারি না, সবাই মিলে?
—