দোলন গঙ্গোপাধ্যায়
মহামান্য ভারত রাষ্ট্র,
মেয়েগুলোকে বাঁচতে দিন। মেয়েগুলো বাঁচতে চায়। উন্নাও-এর মেয়ে, হায়দ্রাবাদের মেয়ে, আসমুদ্রহিমাচলের মেয়েরা এদেশের নাগরিক। আপনি যে নিজের উন্নয়নের এত বড়াই করেন, সেই উন্নয়নে মেয়েদের অবদানও কিছু কম নয়। বেটি বাঁচানো মানে কন্যাভ্রূণ বাঁচিয়ে শুধুমাত্র মেয়েকে জন্ম দেওয়া নয়। বেটি পড়ানো মানে তাকে লেখাপড়া করিয়ে সুপাত্রে বিয়ে দিয়ে গৃহবন্দি করা নয়। বেটি বাঁচানো মানে আমৃত্যু তাকে সুরক্ষা দেওয়া, বেটি পড়ানো মানে মেয়েদের পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের সব ক্ষেত্রে মেয়েদের সমান সুযোগ, স্বাধীন গতিবিধির অধিকার সুনিশ্চিত করা।
মান্যবর, গালভরা স্লোগান দেওয়ার আগে স্লোগানের মর্মার্থ অনুধাবন করুন অনুগ্রহ করে। আর যদি শুধুমাত্র লোকদেখানোর জন্য এইসব বড় বড় কথা বলেন, তাহলে মানতেই হবে আপনি রাষ্ট্র হিসেবে অত্যন্ত অসৎ। এদেশের পুরুষ আজ আর মেয়েদের শুধুমাত্র ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয় না, খুন করে। রাষ্ট্র হিসেবে আপনি কীভাবে, কী শিক্ষায় ছেলেদের বড় করছেন, একবার ভাবুন। আপনি একটি বিকৃত পুরুষাকারের (Toxic masculine) ধারণাকে মহিমান্বিত করছেন। আপনি ছেলেদের বলিউডের হিরো হতে শেখাচ্ছেন। আপনার তথাকথিত সেবকের দল বলিউডের নায়কদের সঙ্গে সারাক্ষণ ছবি তুলে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। পুরুষের মানসে এমনিই বলিউডের তারকারা আদর্শ পুরুষ, আপনি সেই আদর্শে সিলমোহর লাগাচ্ছেন। আপনার প্রধান প্রধান সেবায়েতদের কথা শুনে, ব্যাবহার দেখে এদেশের কচি ছেলেটি পর্যন্ত জানে যে তারা হয় মেয়েদের রক্ষা করবে, নয় তাদের ধ্বংস করবে।
মহামান্য, সম্প্রতি কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার পর, আপনার অন্যতম সেবকের ভাষণে শুনলাম, এর ফলে কাশ্মিরি মেয়েদের জীবন স্বাধীন হবে। কাশ্মিরে এবং মণিপুরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দ্বারা গত তিরিশ বছর ধরে ঘটে চলা ধর্ষণ এবং অন্যান্য নির্যাতনের বিচার মেয়েরা আজও পায়নি। সম্প্রতিকালের কাঠুয়ার বাচ্চা মেয়েটিকে ধর্ষণের ঘটনায় একজন আইনরক্ষক এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও ধর্ষক হিসেবে অভিযুক্ত। কাশ্মিরি মেয়েদের জন্য যদি সত্যিই চিন্তা থাকে, তাহলে আপনার সেনাবাহিনিকে সংযত করুন। ওদের স্বাধীনতার ব্যাপারটা ওরা বুঝে নেবেন।
মাননীয়, ধর্ষণ বন্ধ করার জন্য বরং বেটা পড়ানোর কর্মসূচি নিন। স্কুলের পাঠক্রমে ছোট বয়স থেকে মেয়েরা কেন সব বিষয়ে সমান সে বিষয়ে আলোচনা আবশ্যিক করুন। আর হ্যাঁ, এই আলোচনায় মেয়েদের সঙ্গে মধুর ব্যবহার আর পৌরুষ জারির কথা নয়, মেয়েরা এদেশের নাগরিক, তাদের ঘরে বাইরে স্বাধীনতা চাই, শিক্ষায়, কাজে, জীবনধারণের সব ক্ষেত্রে সমান সুযোগ চাই, এই পাঠ দিন। নার্সারি ক্লাস থেকে কর্মরতা, ডাকাবুকো, মাঝরাতেও বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়ানো, বাউন্ডুলে মেয়েদের ছবি দেখান। মা মানেই রান্নাঘর, এই ছবি ছাপা বই পাঠক্রম থেকে বাদ দিন। অন্যরকম পুরুষের গল্পও তুলে ধরুন পাঠক্রমে। এমন বাবার ছবি আঁকুন যে বাবা ঘরের কাজ করেন, যে বাবা বাচ্চা সামলান, যে বাবা অহেতুক পরিবারের মেয়েরা কোথায় যাচ্ছেন, কখন ফিরবেন প্রশ্ন করেন না, যে পুরুষ বাইকে সঙ্গিনীর পিছনে বসেন, যে পুরুষ নম্র, যে পুরুষ পৌরুষের অন্যরূপ নির্মাণ করেন। যৌনতা বিষয়ে সঠিক শিক্ষা দিন স্কুল, কলেজে। বয়ঃসন্ধিকালের কৌতূহল নিরসনের জন্য যৌনতা একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার এই সহজ শিক্ষাটি আমাদের ছেলেমেয়েদের শেখানো দরকার। আর একটা কথা, স্কুল-কলেজে এই শিক্ষাও দিতে হবে যে, মেয়ে কোনও একমাত্রিক পরিচিতি নয়। মেয়েদের মধ্যে গরীব মেয়ে আছেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মেয়ে আছেন, দলিত মেয়ে আছেন, শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী মেয়ে আছেন, সমকামী মেয়ে আছেন, রূপান্তরিত এবং রূপান্তরকামী মেয়ে আছেন, জেন্ডারের ছক মানেন না এমন মেয়েও আছেন, একক মেয়ে আছেন, বৃদ্ধা নারী আছেন এবং আরও বিভিন্ন পরিচিতির মেয়ে আছেন।
শুধুমাত্র স্কুলে শিক্ষা দিয়েই কাজ শেষ হয় না। সার্বিক সামাজিক শিক্ষার জন্য প্রচারান্দোলন সংগঠিত করুন। ধর্ষণ অথবা যৌন নির্যাতনের দায় যে মেয়েদের নয়, ধর্ষণকারীর, এই বার্তা মহল্লায় মহল্লায় ছড়িয়ে দিন। সারাক্ষণ আপনার মূল সেবায়েত যে রেডিও, টিভি-তে, রাস্তার বিলবোর্ডে আত্মপ্রচার করেন, সেখানে একটু আত্মপ্রচার কমিয়ে সব মানুষের সমানাধিকারের খবর ছড়িয়ে দিতে বলুন তাকে। আপনার সেবায়েতদের চা-পানের আসরে নিজেদের ভোটের প্রচার না করে ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতন প্রসঙ্গে আলোচনা করতে বলুন। তবে হ্যাঁ, আলোচনার আগে ওদের শিখিয়ে দিন, কী বলতে হবে। ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন মেয়েদের ওপর ঘরে-বাইরে সর্বত্র হয়। ধর্ষণের সঙ্গে কামেচ্ছা অথবা মেয়েদের পোশাক, চালচলনের কোনও সম্পর্ক নেই। ধর্ষণ হল ক্ষমতা প্রদর্শনের হাতিয়ার। ব্যক্তি ও দলবদ্ধ পুরুষ এবং প্রতিষ্ঠান এই ক্ষমতা কখনও গরীব মেয়ের ওপর, কখনও মুসলমান মেয়ের ওপর, কখনও ৯০ বছরের খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনীর ওপর, কখনও অনুপ্রবেশকারী সন্দেহে নিতান্ত বালিকার ওপর, কখনও হাসপাতালে বা হোমে সরকারি হেফাজতে প্রতিবন্ধী নারীর ওপর, দলিত মেয়েদের এবং রূপান্তরকামীদের ওপর দেখায়। আসলে যে মেয়ে তার যে পরিচিতির জন্য প্রান্তিক তাকে বেশিরভাগ সময় সেই পরিচিতির কারণেই ধর্ষিত এবং খুন হতে হয়। কখনও শুধুমাত্র মেয়ে বলেই মেয়েদের ধর্ষণ করা হয়। আবার কখনও মেয়ে পরিচিতির সঙ্গে তাদের অন্য প্রান্তিকতাগুলি যুক্ত হয়।
মহামান্য রাষ্ট্র, আপনার কর্তব্য এখানেই শেষ নয়। যে দেশে ২০১৭ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম রিপোর্ট ব্যুরো-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিদিন ৯২টি মেয়ে ধর্ষিত হয় সে দেশে শুধুমাত্র সচেতনতার প্রসারে কাজ হবে না। সে দেশে সর্বত্র পুলিশ টহল, রাস্তায় রাস্তায় আলো, রাস্তার মোড়ে মোড়ে সক্রিয় পুলিশ বুথ, দ্রুত এবং নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার আশু প্রয়োজন। একটি ধর্ষণের কিছুদিন পরেই যখন ধর্ষককে বুক ফুলিয়ে রাস্তায় ঘুরতে দেখা যায়, তখন ধর্ষিতা (যদি তাকে খুন না করা হয়) এবং তার পরিবারের তো রাগ হবেই। সেই রাগ এবং বেদনা থেকে তাঁরা ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডও চাইতে পারেন। কিন্তু এক্ষেত্রে দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি এবং যথাযথ শাস্তি হলে হয়তো তাঁদের একটু স্বস্তি হয়। শুধু তাঁদের জন্যই নয়, সমাজের বৃহত্তর অংশের মানুষের কাছেও এই বার্তা পৌঁছায় যে, ধর্ষণ করলে ছাড় পাওয়া যাবে না, আইনানুগ শাস্তি হবে ধর্ষকের। সে শাসক দলের বিধায়ক হলেও আইনের কাছে তার ছাড় নেই।
দুর্ভাগ্যবশত, আপনি এসব কিছুই করেন না, মহামান্য রাষ্ট্র। আপনি শুধু নিষ্কর্মাই নয়, আপনার সেবকবৃন্দ ধর্ষণ এবং খুনের মত অপরাধকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করে। যেমন সম্প্রতি উন্নাও— একটি মেয়ে শাসক দলের বিধায়কের দ্বারা ধর্ষিত হল, সেই অভিযুক্তের এখনও বিচার হল না, মেয়েটির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের খুন করা হল, ধর্ষিতাকেও খুনের চেষ্টা করা হল, বাকি পরিবারকে সারাক্ষণ প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু আপনার সে রাজ্যের এবং দেশের শাসক দল তাদের সুরক্ষার জন্য কোনও ব্যাবস্থা নিচ্ছে না। ঐ উন্নাও-তেই সম্প্রতি একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে আগুনে পুড়িয়ে মারা হল, সে ব্যাপারেও আপনার প্রশাসনের ভূমিকা নিন্দনীয়। হায়দ্রাবাদের প্রিয়াঙ্কা রেড্ডিও যখন ধর্ষিত এবং অত্যাচারিত হচ্ছিলেন, তখন তার পরিবারের লোক পুলিশের দোরে দোরে ঘুরেছেন, কিন্তু কেউ থানা থেকে বেরিয়ে একটুও সাহায্য করেননি। সেইসময় পুলিশ উদ্যোগ নিলে হয়তো প্রিয়াঙ্কা বেঁচে যেত। পরবর্তীকালে নিজেদের অকর্মণ্যতাকে ঢাকতে তারা মিথ্যে এনকাউন্টারের গল্প ফেঁদে বলিউডি কায়দায় চারজন অভিযুক্তকে বিনা বিচারে খুন করল। মাননীয় রাষ্ট্র, আমরা মেয়েরা এমন অবিচার চাই না। আমরা চাই ধর্ষকদের আইনি পথে শাস্তি হোক, আইনের বাইরে অভিযুক্ত খুন করে পুলিশের বাহাদুরি দেখানোর তীব্র বিরোধী আমরা। আমরা আরও বেশি করে চাই যে, আপনি এমন সমাজ গড়তে উদ্যোগী হোন, যেখানে ধর্ষকের জন্মই হবে না।
গত ১০ই ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস গেল। ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অফ হিউমান রাইটস্ ১৯৪৮-এর ১০ই ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘের জেনারাল অ্যাসেম্বলিতে গৃহীত হয়। এই সনদ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে আপনিও অনুমোদন করেছেন। তার মানে ভারতবর্ষের প্রতিটি নাগরিক এই সনদে উল্লিখিত সুযোগগুলি উপভোগের দাবিদার। মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রের ভূমিকাতেই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, সব মানুষ সমান সুযোগ ও অধিকার, স্বাধীন জীবন ও মর্যাদার দাবিদার। যেসমস্ত রাষ্ট্র এই সনদে সই করেছেন তারা নাগরিকদের সাম্য এবং মর্যাদা সুনিশ্চিত করতে দায়বদ্ধ। একটু ভেবে দেখুন মহামান্য ভারত রাষ্ট্র, আপনি আপনার দায়বদ্ধতা পালন করতে সক্ষম হচ্ছেন কিনা, এ দেশে মেয়েদের সাম্য এবং মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হচ্ছেন কিনা। আরও একটু গভীরে চিন্তা করলে এ বিষয়ে আপনার রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন জাগে। আপনার রকমসকম দেখে মনে হয়, আপনি মেয়েদের অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে গ্রাহ্য করেন না। আপনাকে মনে করিয়ে দিয়ে চাই, গত তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সারা পৃথিবীতে এবং এদেশে নারী আন্দোলন “নারী অধিকার মানবাধিকার” এই দাবিতে আন্দোলন করে চলেছে। মহামান্য ভারত রাষ্ট্র, আমরা, মেয়েরা, যে পরিচিতি নিয়েই বাঁচি না কেন, আমরা মানবাধিকারের প্রত্যক্ষ দাবিদার। আর ধর্ষণ এবং যৌন অত্যাচার আমাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে, আমাদের নাগরিক সত্তাকে অপমানে ভূলুণ্ঠিত করে।
অতএব, বেটিকে যদি সত্যিই বাঁচাতে চান, তাহলে মেয়েদের মানবাধিকার সুরক্ষিত করুন। মেয়েদের ওপর সবরকম বৈষম্য বন্ধের সৎ উদ্যোগ নিন। নতুন পুরুষ গড়ুন। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে সব হয়।
ইতি,
জনৈক ভারতীয় নারী
১১.১২.২০১৯