হকচাচার মিছিল নামে তেহাইয়ের শহরে

সুমিত দাস

 

এই ঝুপ করে নেমে আসা শীতের দিনগুলিতে আমার আজবল হকের কথা মনে পড়ে। মাটির ঘর বানাতেন। দেশভাগের সময় নিম্ন বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের মাটির ঘর। প্রথমে কোনও রকমে চিটে বেড়া, তারপর গুছিয়ে বসা সংসারের জন্য মোটা দেওয়াল, দাওয়া। কাজ শুরু করেছিলেন দাদুর সঙ্গে। তারপর নিজেই। আমাদের উদ্বাস্তু কলোনি ক্রমেই বেড়েছে এই সাত দশকে। আজকাল মাটির ঘর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। নয়ের দশক পর্যন্ত দামোদর পেরিয়ে রোজ আসতেন নীলপুরে।

বাড়িগুলো যেন ওঁরই। নারকেল, পেয়ারা, পাতিলেবুর গাছগুলোও ছিল ওনারই। বেড়াকলমির ডালও। ৭৮-এর বন্যায় দিগ্বিদিক ডুবে যাওয়া খানিক উঁচু দাওয়ায় একসঙ্গে থাকতেন যাঁরা, তাঁদের কারও কারও স্মৃতিতে দক্ষিণ বাংলাদেশের শ্রাবণস্মৃতি উঁকি দিত। আর জল সরলে ডাক আসত হকের। চিটে বেড়ায় লাগত নতুন মাটি। বড় হতে হতে শুনেছি ষাট-সত্তরের উত্তাল দিলগুলিতে আমাদের অঞ্চলের বাম যুবারা আশ্রয় নিতেন তাঁরই বাড়িতে। নদী পেরিয়ে সে বাড়িতে ছিল নিশ্চিত থাকাখাওয়া।

নয়ের দশকে আমাদের কৈশোর, প্রাক-যৌবন। তখন উদ্বাস্তু কলোনিতে মাটির বাড়ি কমতে শুরু করেছে। বেড়াকলমি আর ভ্যারেন্ডার ডাল দিয়ে বাঁশের বেড়া বিদায় নিচ্ছে। উঠোনে উঠোনে পাঁচিল, বদলে যাচ্ছে মাধুকর মধুদার চেনা রাস্তা। হকচাচা আসতেন। বাড়ি বানানোর বদলে জঙ্গল পরিষ্কার তখন পেশা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের দূরত্ব বাড়লে তিনি দাদু-ঠাকুমার গল্প নামিয়ে আনতেন ছোটদের কাছে। উদ্বাস্তু পরিবারের বর্ধমানে এসে ঘর বাঁধার গল্প।

৯২ আর ৯৩-এর শীত। একদিন নদীর পাড়ে বিষণ্ণ হকচাচার সঙ্গে দেখা। কেউ আদবানির রথের ধাক্কায় ভরা বাজারে মুসলমান বলে চিহ্নিত করেছে তাঁকে। ইতিমধ্যে তাঁর আত্নীয়া আনারকলি পিসি আমাদের পাড়ার বাড়ি বিক্রি করে গেছেন সংখ্যালঘু পাড়ায়। তিনিই ছিলেন আমাদের ওয়ার্ডের শেষ সংখ্যালঘু ভোটার।

এই ১০-১২ বছর আগে পর্যন্ত হকচাচা কাজের খোঁজে, পুরনো পাড়া দেখার জন্য আমাদের অঞ্চলের অলিগলি দিয়ে ঘুরতেন। স্মৃতিতে একটা কলোনি গড়ার মাটিবাঁশজল। ততদিনে দ্রুত গতিতে বদলাতে শুরু করেছে বাস্তুহারার পাড়া। নয়া অর্থনীতি আর পরিষেবা ক্ষেত্রের সুবিধাভোগী নতুন প্রজন্ম দালান আর ফ্ল্যাটে বদলে ফেলেছে হকসাহেবের নীলপুর। শ্বেতপাথর আর চকচকে রঙের দেওয়াল ঘেরা নতুন বাড়িতে ক্যাশ বাড়লেও ক্লাস বাড়ে না।  নয়ের দশকের গোড়ায় জন্মানো শনিমন্দিরে লাইট আর পাথর বসে। পুরুষহাতের তাগা আর আংটি জানান দেয়, বাস্তুহারার পাড়া আসলে হিন্দুদের। নতুনেরা বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ডিগ্রি কিনে আনে। দেখতে দেখতে হকসাহেবের মৃত্যু পেরিয়ে যায় ৩ বছর।

পার্কসার্কাসের গুলশনারা একা ভয় পায়নি। বাসে, ট্রামে, ধর্মতলায়, মছলন্দপুরে বা জয়নগরে ভয় পেয়েছিল অনেকে। আদবানির বাবরি ধ্বংসের সময় বা গোধরা দাঙ্গার দিনগুলিতে এত ভয় ছিল না। বিরক্তি ছিল। গোধরা কাণ্ডে গ্রামাঞ্চলে প্রথম ঢুকে পড়া দাঙ্গাকে স্মৃতি-সত্তা উষ্ণতায় আটকে দেওয়ার গরিমা ছিল। এবার ভয় পেয়েছিলাম আমিও।

ক্লাস টুয়ে টিফিন আর বসার জায়গা হিন্দু-মুসলমানে আলাদা করে— গেটে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা-মায়েরা আলাদা  নন। আমাদেরই মত দেখতে। ক্লাস এইটের শান্ত মিতভাষী ছাত্রের অকাল বীর হয়ে সহপাঠী সংখ্যালঘুকে দুর্মুখ করার কথাও শুনেছি। কাশ্মিরী শালওয়ালাকে দাওয়ায় ডেকে মুসলমান হওয়ায় দুকথা শুনিয়ে দেওয়া কৃষ্ণনগরের যুবতীকেও আজ চিনি। চিনি আজান শুনে সদ্যোজাতর কান চেপে ধরা শহুরে মাকে। নিউজ চ্যানেলের কর্পোরেট প্যান্ট্রিতে টিফিনবক্স খুলতে না পারা সৈয়দ বা আলিকেও চিনেছি। চিনতে বাধ্য হয়েছি। চিনিয়ে দিয়েছে মুর্শিদাবাদের রাজমিস্ত্রি বা হকচাচার বানানো পাড়া বা খিলানে বড় হওয়া প্রজন্ম। বাপ-মায়ের দিনকাল পেরিয়ে যারা ডিজিটাল, যারা আইটি, যারা সার্ভিস সেক্টর, যারা কপালে সিঁদুর, যারা হাতে তাগা-আংটি— আর শেষমেশ জয় শ্রীরাম!

বন্যায়, প্রবল খরায়, কনকনে শীতে নদী পেরিয়েছেন আজবল হক। বাধ্যতায়? রুজি রুটির জন্য? ভালোবেসে? হয়তো সবকিছুর জন্য। হকচাচার হেঁটে যাওয়া পথে আমারই আত্মীয় বা প্রতিবেশী কেউ শাহরুখ খানে মুগ্ধ হয়ে বলেই ফেলেছেন— ‘দেখে বোঝাই যায় না মুসলমান!’ রান্নার শেষে গরমমশলা ছড়াতে ছড়াতে আজও বিজেপিতে মুগ্ধ ছেলেটা জানলই না মোগলাই হেঁসেলের রহস্য! জানবেই না বামুনের পৈতার অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতেই এদেশের মূলনিবাসী আলিকে বরণ করেছে। পরের দীর্ঘযাপনে কোনও কোনও বটবৃক্ষ তলে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে আলিকালী!

আজকাল মুসলমান পাড়ায় থাকি। এ যাবৎকাল ‘মুসলমান পাড়া’ নামকরণ না-পসন্দ ছিল আমার। হকচাচার প্রত্যন্ত পাড়ার নাম কামদীঘি, আর গুলশনারার পাড়া— পার্কসার্কাসের ঝাউতলা। বিস্তর দূরত্ব। দূরত্ব অর্থনীতির, জীবনসংস্কৃতির। আমার পাড়া দক্ষিণ কলকাতার প্রান্তে একদা মুসলমান কৃষকের জমিতে গড়ে ওঠা কলোনি— বাঁশদ্রোণীর বন্দে আলি পল্লী। এই বছর দুয়েক আগেও— মেটে মসজিদ মেরামতির সামগ্রীতে সেজে ওঠে পাশের মন্দির। পরীক্ষা দিতে যাবার পথে মন্দির মসজিদে প্রণাম ঠুকে নেয় বিশ্বাসী মন। আবার তিলেতিলে জমতে থাকা বিদ্বেষ, হরিনাম আর আজানের পাশে বাড়ে ‘জয় জগদীশ হরে’। ফ্ল্যাট বাড়ে, মাঠ ছোট হয়। পুজোর আড়ম্বরে জুড়ে যায় ডিজে-বিসর্জন। সে আওয়াজে বুক ধড়ফড় করে, ভয় বাড়ে।

১৯ ডিসেম্বরের প্রাক বড়দিনের কলকাতায় মিছিল হল। হাজারো মিটিং-মিছিল পাশ কাটিয়ে যাওয়া নতুন প্রজন্মেরও ভিড় মিছিলে। ভয় আর বিরক্তি জড়ো করে স্লোগানে সুর শানিয়ে নিচ্ছিল ১৮-২২-২৫। কারা এরা? আমার মহল্লার সাদ্দাম, ভিকি, গুলশনারা, অরিত্র? নাকি কলকাতায় তিলতিল করে জড়ো হওয়া শিলিগুড়ি, যাদবপুর, রায়গঞ্জ, রাণাঘাট? হকচাচাও ছিলেন বোধহয়? বাসে, ট্রেনে খিস্তির মুখে সটান জবাব দেওয়া বা থম মেরে যাওয়া মেয়েটা বা ছেলেটাও ছিল? ছিল কি— সিরিয়ালবিভোর দর্শক বা গড়ের মাঠের ভবঘুরে? ছিল কি মিছিলে হাঁটা-না-হাঁটা অভ্যস্ত পা? ছিল, ছিল প্রজন্মের গ্লানি নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো সময়। অ্যান্ড্রয়েডে তথ্যবিকৃতির যুগে, তথ্য আর জ্ঞানের ফারাক গুলিয়ে দেবার যুগে পথে নামা এ কলকাতায় এখনও একযোগে রাত জাগেন নবাব ওয়াজেদ আলি আর রামমোহন। মনের মত দিনগুলির অপেক্ষায় ইতস্তত পাইচারি করেন বিদ্যাসাগর আর মাইকেল। সে পথটাও সময়ে সময়ে ছিনিয়ে নিতে হয়। জঞ্জাল যাতে না বাড়ে— তাই যেমন সময়ে সময়ে নজরদারি করে যেতেন হকচাচা! এ মিছিলের এখন তেমনই দায়।

হকচাচা, আমিও ভয়ে ছিলাম। ভয় পেয়েছিলাম। এ কলকাতা হিন্দু-মুসলমানের হয়ে যাবে না তো! ওই দামোদরের পার থেকে ডানা ভেঙে নয়, তবুও এ শহরে পৌঁছনোর স্বপ্ন ছিল। একটু ভালো থাকার স্বপ্ন। একযোগে অনেকে ভালো থাকার বাসনা ছিল। আমার তেহাই আসার পর— সাময়িক আনন্দ টপকে রোজকার জীবনে শুধুই বিদ্বেষ দেখেছি। এবার বিদ্বেষ ভাঙ্গার হুঙ্কার দেখলাম। এই তো আমার সন্তানের শহর! আন্দোলন যেখানে ফিরে ফিরে এসে উৎসব হয়, হবে। না, আর ভয় পাচ্ছি না চাচা। তোমার মাটিবাঁশজলে গাঁথা মহল্লার সব স্নেহচ্ছায়া আজও হারিয়ে যায়নি। স্রেফ দুঃস্বপ্ন ছিল যেন রাতটুকু। আবার ভোর। এই সকালেই রুট তৈরি করেছে কলকাতার যৌবন।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...