মৃণাল চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
৬
–আমি মন বলছি। তোমার মুখে রাই। কেমন আছ?
–এতক্ষণ চুপ করে ছিলে কেন? আমি বহুবার ডেকেছি।
–তোমার ডাক শুনতে ভাল লাগছিল যদি বলি?
এসব কী আশ্চর্য সংলাপ। এসব কি সত্যি বলছে রাই? আমি তো এই কথাই শুনতে চাইছিলাম সারা জীবন। আজ কোন প্রেমিকের ভগবান নেমে এল দার্জিলিং-এ? রাইকে আমি বিয়ে করব না জেনেও কেন এই বিলোল ভালবাসার ডাক শুনিয়ে গেল আমাকে? কী অদ্ভুত চুক্কি প্রভু!
–আজ সারা দিন তোমার কথা ভেবেছি।
দার্জিলিং পাহাড়ে ততক্ষণে তৈরি হয়ে গেছে কনসার্টের পরিবেশ। গিটার, বেহালা, পিয়ানো এমনকি স্যাক্সোফোন নিয়ে প্রস্তুত বাজনদারেরা। হালকা গোলাপি রঙের আলোয় গাছের নিচে রাই আর আমি। একটা হাল্কা ইশারা, একটা বেটনের মৃদু ওঠানামা, তার পরেই শুরু হয়ে যাবে গুঞ্জন করে ছুটে আসা রাইয়ের আর তার পরে আমার গান।
–কথা বলছ না কেন?
–অণু কি আমাদের কথা শুনছে রাই? মাইক্রোফোন কি অন করা?
–তুমি আমাকে এতটা অবিশ্বাস করো! আমি খুব হার্ট হলাম।
গলা কি একটু বিষণ্ন হয়ে উঠল রাইয়ের? অন্য সময় হলে আমার বুক মুচড়ে উঠত দুঃখে। কিন্তু আমি কেমন যেন একটা ফাঁপা আওয়াজ পাচ্ছিলাম, যেমন হয় মাইক্রোফোন অন থাকলে। পরের বার যখন রাই কথা বলল, সেই ফাঁপা আওয়াজটা আর ছিল না।
–আমি ফোন বন্ধ করছি। তুমি যখন আমাকে বিশ্বাসই করো না…
–এবার তুমি মাইক্রোফোন বন্ধ করলে রাই। ভালই হল। অণুর সামনে একটা কথা আমি তোমাকে বলতে পারতাম না। তাহলে তোমাকে ছোট করা হত। কথাটা হল, আমি তোমাকে বিয়ে করব না।
ওদিক থেকে আমার চেনা রাই হেসে উঠল। প্রেমিকা টাইপের গলাটা গেছে মিলিয়ে। স্টিলের বাসন মেঝেয় ছড়াতে ছড়াতে কী অদ্ভুত হাসি। আমার মনে হল হয়ত অণুও হাসছে গলা মিলিয়ে।
একটু পরে হাসি থামিয়ে অনুনয়ের গলায় রাই বলল,
–প্লিজ, এমন করো না। আমি সবাইকে বলে রেখেছি তোমার কথা। এরপর তুমি না বলে দিলে আমার মাথা হেঁট হয়ে যাবে গো। আমার কলঙ্ক হয়ে যাবে!
রাই হাসছিল। এবার সত্যি ওর সঙ্গে হাসছিল আর একটা গলা। একটু কর্কশ। আমি বুঝলাম ওরা আমাকে নিয়ে একটা মজা হচ্ছে ভাবছে। সেকেলে কথাবার্তা বলে, ন্যাকা ভঙ্গিতে আমাকে বোঝাতে চাইছে আমি কত অযোগ্য, কত হাস্যকর, কতটা পঞ্চাশ। কিন্তু আমি ব্যাপারটাকে অন্যভাবে দেখলাম। ওদের বোঝাবার চেষ্টা করলাম।
–ওভাবে হাসে না রাই। অণু হাসুক। তুমি ওর হাসি হেসো না। অথবা অনেক বছর পরে হেসো যখন তোমার মন নির্জন হায়েনার মনের মত হয়ে যাবে। যেতে পারে। এখন হেসো না। আমার হয়ত বিয়ে হবে না আর, কিন্তু তোমাকে আমি বিয়ে করব না।
–কেন? আমাদের মেয়েটা কী দোষ করল?
এবার অণুর গলার স্বর শোনা গেল। ফাঁপা আবহে। আবার দুজনে মিলে শুনছে। এবার হাঁটতে হাঁটতে ওরা অন্য একটা ঘরে ঢুকল, সেখানে টিভি চলছে। আমি স্পষ্ট দেখলাম অণুর বর টিভি দেখছে। অণু টিভি বন্ধ করে দিল। বরকে চুপ করতে বলল। আমি দেখলাম তুমি এসে ঢুকছ রাই। এই ব্যাপারটা তোমার ভাল লাগছে না। আমাকে এভাবে বাজারে নামিয়ে মজা পেতে চাওনি তুমি।
–তোমার মাথায় কথাটা এল কী করে বলো তো ইন্দ্রজিৎ? তোমার মত একটা আধপাগলা আধবুড়ো লোককে মন বিয়ে করার স্বপ্ন দেখছে!
–আমি ওকে বিয়ে করব না কারণ হেলেনা কাল আসছে শিলিগুড়িতে।
প্রথমে চমকে গেলেও পরে সম্ভবত পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তোমার মুখে মৃদু প্রশ্রয় দেবার হাসি দেখে অণু আত্মবিশ্বাস ফিরে পেল।
–এখানে একটা লুনাটিক অ্যাসাইলাম আছে না? ভাবছি সেখানে তোমাকে ভর্তি করে দিয়ে যাব।
ফাঁকা আর জ্বালা ধরা হাসি হাসছিল অণু। আগের রাতের চিন্তাটা মাথায় এল।
–তুমি হাসছ, কিন্তু অ্যাসাইলামের মানুষেরা তোমাকে করুণা করবে। ওধারের লোকেরা আসলে রাইদের জন্যে একা-একা প্রার্থনা করে। ওরা চায়, তোমরা সেরে ওঠো। সংখ্যাগুরুর চাপে থমকে যাওয়া বিপন্ন মানুষেরা চায় রাইয়ের এক সুন্দর বিয়ে হোক। ও যেন বিয়ের পর প্রতি দিন তোমার কাছ থেকে একশো মাইল দূরে চলে যায়। আমাকে ওখানে ভর্তি করালে আমি খুশি হব রাই, তুমি কান পেতে শুনছ, আমার আপন হৃদয় গহন দ্বারে কান পেতে বিয়ের প্রস্তাব কিন্তু শুনতে পাবে না।
ফোন বন্ধ করে দিল ওরা। আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি রাই। তুমি বুঝতে পারছ না কী করবে। ফোন নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে তুমি। অণুর বর টিভি চালাল আবার। ছেলেমেয়েদুটো কোন ঘরে কে জানে। অণু ভাঙা গলায় ওদের চেঁচিয়ে ডাকতে শুরু করলে। আমি জানি রাই আমাকে ফোন করবে এবার। কিন্তু আমি ধরব না ওর ফোন। শুধু ফোনটা খোলা থাকবে সন্তোষ পালের ডাকের আশায়। বার বার মনে হচ্ছে, উনি ফোন করবেন।
এদিকে দার্জিলিং-এ বরফ পড়ছে। বারান্দায় এসে চোখ জুড়িয়ে গেল। বাইরে কাছে-দূরে সব অন্ধকার। হোটেলের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ঝরে পড়ছে শীতল তুলোর মত তুষার। ওয়েন পিপল ওয়র অল আস্লিপ, দ্য স্নো কেম ডাউন… লাইনটা উড়ে এল হঠাৎ। আচমকা মনে হল আমি ভিজে যাচ্ছি। ঘরে ঢুকে যাচ্ছে সন্ধানী তুষার। মনে পড়ল, পুল্টুশ চলে গেছে।
ঘরে এসে দেখলাম, ফোনে একুশটা মিসড কল। রাইয়ের। না। দুটো অন্য নম্বর। আমি সেই নম্বরে ফোন করলাম। সন্তোষ পাল আমাকে কাল ভোর বেলা বেরিয়ে যেতে বললেও আমি যাব। আমি আর কোনও দিন এখানে আসব না।
–আয়ম স্যরি।
তার মানে ওটাও রাইয়ের নম্বর ছিল। আমি শুনতে থাকলাম।
–আমি ঠাট্টা করছিলাম ঠিকই, বৌদিও বার বার খুঁচিয়ে দিল। কিন্তু একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। আয়ম স্যরি।
–এখানে বরফ পড়ছে রাই। অনেক রাত হয়েছে। আমি খুব সুন্দর ঘুমোব। কাল আমি শিলিগুড়ি ফিরে যাব।
–কাল-ই?
–হ্যাঁ, শুনলে না ওখানে হেলেনা আমার জন্যে ওয়েট করছে? আমরা একটা হারানো মেলা দেখতে যাব।
অন্যদিকে চুপচাপ। এখানেও ঘরের মধ্যে বরফ পড়ার কোন শব্দ আসছে না। আমরা কোথাও পৌঁছতে পারব না জেনেও পার হয়ে যাচ্ছি দীর্ঘ দেবদারুবীথি। ভোর হওয়ার আগেই নো মোর পয়েন্টে গিয়ে আমি ছেড়ে দেব রাইয়ের হাত। তার পর বাঁদিকের ঢাল বেয়ে নেমে যাব অন্য উপত্যকায়। রাই কী করবে আমি জানি না। আমি তখন কোনও অজানা এলাকায় চলেছি ঢাল ভাঙতে ভাঙতে।
–চললাম রাই, না, মন। একবার তোমাকে মন বলে ডেকে দিলাম। আজ মন আমার সেন্টুতে মাখামাখি। এর পরে চট করে চোখে জল চলে আসবে। বুড়ো হলে কিছু মানুষ শুকনো চোখ রগড়ায় আর অন্যেরা ভেজা চোখ মোছে। আমি দ্বিতীয় মোডে আছি। একটা ফোন আসবে এবার আমার কাছে। আসবেই। গুড নাইট রাই।
এরপর বসে রইলাম থুম হয়ে। আমি জানি ফোন আসবে। আসতেই হবে। কাল থেকে আমার ভ্রমণ বদলে যাবে। অন্যান্য সব এলোমেলো পাহাড়ি রুট দিয়ে আর উপত্যকা আর সরু নদীর আশপাশে ঘুরে বেড়াব আমি। যা খুশি হতে পারে।
ফোন বাজল। না, রাই। ধরলাম না। কিছুক্ষণ বেজে থেমে গেল। ও নিশ্চই বুঝল কোনও ফোন আসেনি আমার কাছে। দার্জিলিং-এ লাইট চলে গেল এই সময়, যখন বাইরে তুষারপাত বেড়ে যাচ্ছে। অন্ধকার হয়ে গেল নির্মোক। আমার উঠতে ইচ্ছে করছে না, রুম সার্ভিসকে ডাকতে ইচ্ছে করছে না। এমন সময় খুব নিচু স্বরে ফোন বেজে উঠল এমন এক অন্য রিং টোনে যা আমি কখনও শুনিনি।
একটা নদী যেন হেঁটে পার হচ্ছে কয়েকজন। শীতের নদী, তেমন জল নেই, কিন্তু যেটুকু আছে খুব ঠান্ডা। সেই জলে পা পড়ার শব্দ, টুকরো হাসি আর হাওয়ায় মিলিয়ে দেওয়া কথা, নারী আর পুরুষের, যারা জানে না আমি শুনছি। কেউ যেন শেষে আলতো গলায় তার সঙ্গীকে বলল কাল বিকেলে পুরনো মেলায় দেখা হবে। আস্তে আস্তে থেমে গেল স্বর, শব্দ, যেমন ফেড আউট করে। জলের শব্দ শোনা গেল আর কিছুক্ষণ। তারপর ফোন থেমে গেল। আমি অন্ধকারেই বসে রইলাম।
পরদিন ফেরার পথে দার্জিলিং ছাড়িয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালবেলা দার্জিলিং-এর বরফ ভেঙে সোনাদা নামতে সব বদলে গেল। হালকা বসন্তের হাওয়া যেন লাগল গায়ে। কর্মার পাশের জানলার একটা কাচ অল্প নামানো ছিল, সেখান থেকেই হাওয়া ঢুকল। কর্মা ওপরের রাস্তায় চিন্তায় ছিল। খুব সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছিল যাতে পিছলে না যায়। আমারও কেমন যেন লাগছিল। সকালে আমরা শুধু কফি খেয়ে বেরিয়েছিলাম। রাতে ঘুম হয়নি। একটাও গাড়ি বেরোয়নি তখন। আমরা যেন প্রথম দুই যাত্রী পাহাড়ি শহরকে তুষারযুগে ফেলে রেখে যাচ্ছিলাম। তার সঙ্গে বেপাত্তা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। দুদিনের ঠান্ডা ফ্যাকাশে ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না তখনও। তার পর সোনাদা।
কর্মা শিস দিয়ে কী যেন একটা গানের সুর করতে শুরু করল। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। তিস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে আমাকে ডাকল কর্মা। চোখ খুলে আমি অবাক। পাহাড় এত দূরে! মিষ্টি হেসে কর্মা বলল,
–বহোত ভুখ লাগি হ্যয় স্যর।
আমার মাথা ঝকঝক করছিল আকাশের মত। খিদেও পেয়েছিল জব্বর। আমরা গুছিয়ে খেলাম। হা হা করে হাসলাম ফালতু কথা বলে বলে। যত শিলিগুড়ির দিকে এগোচ্ছিলাম, তত আনন্দ বাড়ছিল আমাদের। একটা এটিএমে নেমে টাকা তুলতে গেলাম। এক মহিলা এসে সাহায্য করতে বলল। নিরক্ষর। আমি বীরের মত তাকে সাহায্য করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। কারণ সে একটার পর একটা কার্ড আমাকে এগিয়ে দিতে লাগল, কোনওটায় একশ টাকা আর কোনওটায় পঞ্চাশ টাকা তুলবে বলে। এই রকম গোটা চারেক কার্ডে টাকা তোলার আমি রেগে গেলাম। সে তার ব্লাউজের ভেতর থেকে আর একটা ছোট্ট ব্যাগ বের করল আর দুটো কার্ড। এবার আমি আমার টাকা তুললাম। বেরোনোর সময় দেখি মহিলা আমারই মত আর একটা লোককে ধরেছে। আমার দিকে ফিরেও তাকাল না।
এই ব্যাপারটা নিয়েও কর্মা আর আমি খুব হাসলাম। তারপর শিলিগুড়ির ঘিঞ্জি চত্বর ছাড়িয়ে আমার হোটেলে আমাকে নামিয়ে দিল কর্মা। আমি ওর টাকা মিটিয়ে দিলাম। ওকে জড়িয়ে ধরলাম। কর্মা ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেল ওর বাড়িতে। বৌ আর বাচ্চার কাছে। আমি এমনই এক স্বাদু জীবন চেয়েছিলাম।
সমতলে নেমে ম্যাড়মেড়ে মেজাজটাও বদলে গেল। হোটেলের লোকেরা ভাবেইনি আমি ফিরে আসব। রিসেপশনে একটা চিঠি রাখা ছিল। ওরা বলল এক ভদ্রলোক কাল দিয়ে গেছেন। চেহারা কারওই মনে নেই। তাই আমার মনে হল নিশ্চই সন্তোষ পালের চিঠি হবে। নিজের রুমে ফিরতে চাইলে ওরা আটকে দিল। রুম সার্ভিস শুরু হবে। লাউঞ্জে বসে কফি খেতে খেতে আমি চিঠিটা খুললাম।
‘আজ দেখা হবে। শিলিগুড়ির জয় হিন্দ হোটেলের সামনে থাকবেন বেলা বারোটায়। আমার লোক আপনাকে নিয়ে আসবে। তার চোখে কালো চশমা আর মাথায় কালো টুপি থাকবে। জগদীশ। লোকটার নাম।– সন্তোষ পাল’
দু-তিন বার পড়লাম চিঠিটা। পুরনো কালের ডিটেকটিভ গল্পের মত। কিন্তু এ-নিয়ে ভেবে লাভ নেই। গল্পটাই তো পুরোনো কালের। এখন সকাল দশটা। আমাকে একটু রেস্ট নিয়েই বেরোতে হবে।
রিসেপশনে কিছু টাকা দিতে হল। ওরা মনে হয় ভাবছিল আমি দরাদরি করব দু-দিন না থেকেও টাকা দেওয়া নিয়ে। সেসব কিছু না-করায় আমি রাজার সম্মান পেলাম। ফুরফুরে গন্ধে ভরা ঘরে এক গ্লাস কমপ্লিমেন্টারি ওয়াইনও পেয়ে গেলাম। এই সময় ফোন বাজল। রাই।
–কী করছ?
–এই তো হোটেলে ঢুকলাম। তুমি কী করছ?
–যত সময় যাচ্ছে আমার ততই খারাপ লাগছে। তোমাকে দুঃখ দিয়ে ফেলেছি।
ইস, এই সংলাপই যদি রাকা বা বনানীর সঙ্গে হত! কিন্তু ওরা কোথায় কে জানে?
–ঠিক আছে। আমি ভুলে যাচ্ছি। আজকের পর আমি এসব ভুলে যাব।
–পেলিং থেকে শিলিগুড়ি নামছি। একটু পরে জোরথাং পৌঁছব। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে ইন্দ্রজিৎ?
–একা নামছ কেন?
–আমার ভাল লাগছে না। আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে?
রাই শুধু আমার জন্যে নেমে আসছে পাহাড় বেয়ে! আমি যাকে ভালবাসব সে কেন নেমে আসে না? মেয়েটার জন্যে খুব মায়া হল আমার।
–ওখানে আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারব না রাই। আয়ম স্যরি। তাছাড়া তোমার ওখানে যাওয়ার সময় হয়নি।
–কীসের সময়? আমি তোমার সঙ্গে যেতে চাই। আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি ইন্দ্র।
ভালবাসা! এই শব্দটাই আমার মাথা খেল। কিন্তু আমি তো ওকে ভালবাসি না। আমার প্রেম এক নির্জন নদীর গান শোনে। সেই নদী পা ছড়িয়ে বসে থাকে ডুরে শাড়ি পরে। ছোট শাড়ি। হাঁটুর ডিম দেখা যায়। বাঁধ হয়ে যাওয়ার ফলে ছড়ানো বালিয়াড়ি আর নেই। আমার নদী সেই বালিয়াড়ির স্বপ্ন দেখে আর আমার জন্যে পথ চেয়ে বসে থাকে।
রাকা এসব কথা পছন্দ করত না। আমাকে বলত, এ-সমস্তই তোমাদের মেল শভিনিস্টিক টেক্সট। তোমরা, পুরুষেরা, এটা মন দিয়ে তৈরি করেছ। মেয়েদের এই ইমেজকে লাথি মারি আমি। আই হেট ইওর গাটস, আগলি ম্যান!
অথচ এই রাকাই আমাকে নরম ভাত আর ডিমসেদ্ধ আর আলুসেদ্ধ আর ডালসেদ্ধ গোল্লা করে খাইয়ে দিয়েছিল একবার। ওর চোখে ছিল করুণ সূর্যের আলো। কিন্তু আমার বিয়ের প্রস্তাব গ্রাহ্য করেনি রাকা। জোর করে মে মাসের মাঝদুপুরের রোদ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখনও ওকে দেখতে দারুণ লেগেছিল। রাকা বেশি রাতে ফুরফুরে নাক ডাকত। প্রথম রাতে আমি মুগ্ধ হয়ে ওর নাক ডাকা শুনছিলাম। এক সময় পাশ ফিরতে গিয়ে ও আমাকে দেখে এবং ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠে। আমি ওকে পাশ ফিরতে বারণ করি। তাহলে হয়ত আর নাক ডাকবে না ওর। এসব কথা শুনে রাকা খুব বিরক্ত হয়ে যায়। ধাক্কা মেরে আমাকে খাট থেকে ফেলে দেয়। আমার কোনও দুঃখ ছিল না। কারণ একটু পরেই ওর নাক ডাকতে শুরু করে। আমি মেঝেতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।
–হ্যালো, হ্যালো…
রাই ডাকছে আমাকে। ওর দু-কানে ছিপি লাগিয়ে রাই আমার সঙ্গে কথা বলছে একটা বড় গাড়িতে বসে। আমি ওকে দেখতে পাই। কিন্তু তখন আমি স্নান করতে যাব তো। বারোটার সময় আমাকে পৌঁছতে হবে, হবেই। তাই ফোন রেখে দিয়ে চলে গেলাম। শুনতে পাচ্ছিলাম ও হ্যালো হ্যালো বলে যাচ্ছে।
জয় হিন্দ হোটেলের সামনে পৌঁছে আমি একটু থতমত খেয়ে যাই। কারণ ওখানে বেশ কয়েকজন লোক কালো টুপি আর কালো চশমা পরে সন্ধানী চোখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। তাদের মধ্যে চেলুকেও দেখতে পেলাম। সরাসরি তাকে বললাম, আরে, চেলু না!
মুখ শুকিয়ে গেল চেলুর।
–আমি চেলু-উলু কোই নাহি সাহেব, রামপ্রসাদ আছি।
–মিথ্যে কথা। তুমি চেলু। লায়লিকে তুমি উঠিয়ে এনেছিলে। কোথায় সে?
পালাতে গিয়ে থমকে গেল চেলু। একজন বিষণ্ন চেহারার ধুতি-পাঞ্জাবি পরা মানুষের দিকে এগিয়ে গিয়ে কিছু বলতে সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে তার সঙ্গে এগিয়ে গেল। আমিও এগোতে যাচ্ছিলাম কিন্তু এক বছর ষাটেকের বৃদ্ধ আমাকে ধরে ফেলল। তার পরনে কালো প্যান্ট-জামা, মাথায় কালো টুপি, কাঁধে ঝোলা। দুহাত জড়ো করে নমস্কারের ভঙ্গিতে সে বলল,
–আমি জগদীশ মোদক, বাবু। আমার সঙ্গে আসুন।
আমি গিয়ে দেখি একটা অচেনা জায়গা। এখানে আরও বিকেল হয়ে গেছে। বড় একটা খোলা চত্বর। একটা বাস দাঁড়িয়ে আছে। তার বাইরে অনেক মানুষ-মানুষী আর কালো টুপি আর প্যান্ট পরা কয়েকটা লোক। চেলুকে দেখলাম না। কিন্তু সে যাকে নিয়ে এল সেই লোকটা এক মহিলার সঙ্গে চা খেতে খেতে কীসব বলছিল। বেশ দূরে ওরা। মহিলাও কড়া প্রকৃতির মনে হল। আমি এগোতেই আমাকে এক কাপ চা এনে দিল জগদীশ। আমি চায়ে চুমুক দিলাম আর সব বদলে গেল।
এদের সবাইকে এত ভাল লাগছে আমার। সুন্দর মোলায়েম মানুষ। মেঘের মত নরম আর নির্জন। যেন এক-একটা টুকরো মেঘ উড়ে আসছে, ছুঁচ্ছে, আবার চলে যাচ্ছে অন্য দিকে। আমি ইন্দ্রজিৎ মেঘ হয়ে গেলাম। অভিমানী মেঘ নয়। ক্লান্ত মেঘ নয়। উদার আর উদাসীন এক মেঘখণ্ড। এবার চেলুকে দেখতে পেলাম। গল্প করছে রামপ্রসাদের সঙ্গে। কত মানুষ এসে গেল, কত পুরুষ-নারী, যুবক-যুবতী, বিভিন্ন বয়েসের মানুষের গুঞ্জনে মৌচাক হয়ে গেল আমাদের চারপাশ। বাস অদ্ভুত সুরে হর্ন বাজাল। বড় টান সেই ডাকে। আমরা ধীরে-সুস্থে এগিয়ে গেলাম বাসের দিকে।
কিন্তু বাসে ওঠা হল না। হোটেলের ঘরে আমার ঘুম ভাঙল। তখন সে-বাস দূরে চলে গেছে।
এর পর আগামী সংখ্যায়