কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়
কিসলোস্কি, যে যাই বলুক, ইজ দ্য গ্রেটেস্ট।
হেমন্তের কুয়াশায় সিগারেটের ধোঁয়া মিশিয়ে দিতে দিতে বলেছিল পার্থদা। আর আমি পার্থদাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।
কিন্তু পার্থদা আমাকে ভালোবাসবে কি না আমার সন্দেহ ছিল। এমনিতে আজন্ম লোকে বলে এসেছে আমাকে না ভালোবাসার কোনও কারণ নেই। মেঘের মতো চুল, মুক্তোর মতো দাঁত, মেমের মতো রং— ভালোবাসা পাওয়ার মতো সবই আমার আছে। সত্যি বলতে কি লোকের ভালোবাসার চোটে আমি তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম। ক্লাস নাইনে উঠতে না উঠতে পিসিমাসি, পাড়ার লোক সম্বন্ধ আনতে শুরু করেছিল, ইস্কুলে যাতায়াতের পথে যে সে কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং অক্ষরে ‘ভালোবাসি’, ‘তোমাকে ছাড়া বাঁচব না’ লেখা চিরকুট গুঁজে দিয়ে যেত। জ্বালাতনের একশেষ। এদের একজনকেও উল্টে ভালোবাসার কথা আমার মাথাতেই আসেনি। একজনের প্রতি কেমন একটু ভাব জেগেছিল, ভেবেছিলাম কে জানে, এটাই ভালোবাসা বোধহয়। একটা চিঠিতে সে ভালোবাসা ব্যক্তও করেছিলাম। চিঠি তার হাতে পড়ার আগেই বাবার হাতে পড়ে গেল আর বাবা আমার কান মুলে গালের সমান লাল করে দিল। ব্যস, ভালোবাসা উধাও।
কিন্তু পার্থদার প্রতি ভালোবাসাটা সে রকম ঠুনকো নয়, এ আমি ওই কিসলোস্কি মুহূর্ত থেকে বুঝে গিয়েছিলাম। পার্থদার প্রতি আমার প্রেমটা হল গিয়ে ট্রু লাভ। যেটা জীবনে একবারই হয়। কোনও বাবার কানমলার সাধ্য নেই যার মুখোমুখি দাঁড়ায়।
পার্থদার ফেসবুক প্রোফাইলে লেখা ছিল স্যাপিওসেক্সুয়াল। ক্লাস এইটে ইংরিজিতে একশোয় তেরো পেয়েছিলাম; মধুপর্ণাকে জিজ্ঞাসা করলাম, স্যাপিওসেক্সুয়াল মানে কী রে? মধুপর্ণা বোঁচা নাক আকাশে ঠেকিয়ে বলল, জানিস না? যারা বুদ্ধিমানদের প্রেমে পড়ে তারা স্যাপিওসেক্সুয়াল হয়।
ক্লাস এইটে ইংরিজিতে তেরো পেলে আর যাই হোক বুদ্ধিমান হয় না। সারা রাত কেঁদে কেঁদে সর্দি হয়ে গেল, সকালে বাবা বলল, কলেজে যেতে হবে না। বললাম, পাগল নাকি? আজ না গেলে ফেল জানো? বলে দৌড়ে ইউনিভার্সিটিতে চলে এলাম।
আমি মীরাবাঈ হয়ে যাব, পার্থদা আমাকে না ভালোবাসুক, আমি দূর থেকে পার্থদাকে ভালোবাসব।
কিন্তু দেখা গেল পার্থদা আমাকে নজর করেছে। প্রথম কয়েকদিন কটমট করে তাকাল, তারপর মধুপর্ণাকে দিয়ে বলে পাঠাল, তোদের ডিপার্টমেন্টের ওই মেয়েটাকে ঠেকে নিয়ে আসিস তো। মফস্বলের মেয়ে, ইউনিভার্সিটিতে এসেও যদি চোখকান না খোলে তাহলে আর কী। সেই ক্লাবে পার্থদার মতো আরও অনেক দাড়িওয়ালা, ঝুঁটিবাঁধা লোক ছিল, যারা পার্থদার মতোই প্রতি বাক্যে ‘ফ্যাসিবাদ’ আর ‘নিপাত যাক’ গুঁজে কথা বলত, কিন্তু পার্থদার মতো কিসলোস্কির ভক্ত আর কেউ ছিল না। কিসলোস্কির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে পার্থদার সঙ্গে তাদের কেউ কেউ এঁড়ে তর্কও জুড়ত। বলত, বার্গম্যান আর বুনুয়েল দেখার পরও তুই কিসলোস্কির গ্রেটনেস নিয়ে এত অ্যাডামেন্ট হোস কী করে? আমার খুব ইচ্ছে হত পার্থদার হয়ে গলা ফাটাই, কিন্তু আমি মুখ্যুসুখ্যু মেয়ে, কিসলোস্কি সম্পর্কে কিছুই জানি না, কী নিয়ে গলা ফাটাব।
আমিই বলেছিলাম, আমাকে কিসলোস্কি বুঝিয়ে দেবে পার্থদা?
সেই শুরু। ক্লাসের পর পার্থদা আমাকে বিশ্বসিনেমায় কিসলোস্কির অবদান নিয়ে লেকচার দিত। যুক্তি প্রতিযুক্তি সাজিয়ে কিসলোস্কির অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠত্ব ধরে ধরে প্রমাণ করত। মজা পুকুরের ধারে বসে পার্থদা, আর কিসলোস্কির সঙ্গে কাটানো সেই সময়গুলো, আমি মনে করি আমার জীবনের সুন্দরতম সময়গুলোর মধ্যে একটা। কিসলোস্কি থেকে লেকচার ঘুরে যেত ওয়ার্ল্ড সিনেমার ভূত ভবিষ্যতে আর দেশের সিনেমাতেও। পার্থদাই প্রথম বলেছিল, ইউরোপিয়ান, ল্যাটিন অ্যামেরিকান, বেসিক্যালি যে সব ভাষা আমি কেন আমার বাবাও বোঝে না, সে সব ভাষাতে যা সব সিনেমা হচ্ছে বা হয়েছে, তার তুলনায় হলিউড, বলিউড, টলিউডে যা হচ্ছে সেগুলো সব জঞ্জাল। আর সে সব জঞ্জাল দেখে যারা আহাউহু করে? পার্থদা ছোট্ট ঝুঁটি ঝাঁকিয়ে বলত, আর যাই হোক, বুদ্ধিমান নয়।
পার্থদার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে পর্যন্ত আমি নিজে অবশ্য বাংলা বই দেখে (বাবা যেগুলো দেখতে অ্যালাউ করত,) আহাউহুই করতাম। কিন্তু আমার একটুও গায়ে লাগত না। কারণ, এক, সত্যিই তো আমি বুদ্ধিমান নই। আর দুই, পার্থদার জ্বলজ্বল করা বড় বড় চোখ আর চিবুকের ভাঁজে ছোট্ট কাজলের টিপের মতো দাড়ির নড়াচড়া দেখতে আমার এত ভালো লাগত, যে পার্থদা কী বলছে তাতে খুব একটা কিছু আসত যেত না। অনেক সময় আমি ঠিক করে শুনতামও না পার্থদা কী বলছে (এটা অবশ্য কোনওদিন পার্থদাকে বলিনি।) এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বার করে দিতাম। সন্ধের মুখে দুজন যে নিরিবিলিতে বসার সুযোগ পাচ্ছি, সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে ভালোলাগার ছিল।
ওই পুকুরধারে বসেই একদিন, কিসলোস্কির কথা শেষ হওয়ার পর পার্থদা চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। অসামান্য গোল একটা চাঁদ উঠেছিল সেদিন। মনে পড়ল বেরোনোর সময় বাড়িতে সত্যনারায়ণ পুজোর আয়োজন দেখে এসেছি। বাবা বলেও দিয়েছিল, তাড়াতাড়ি ফিরতে।
সবে বলতে যাব, পার্থদা, আমি এবার যাই গো, দেরি হয়ে গেলে বাবা… অমনি পার্থদা মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। অন্যদিনের মতো না, একেবারে পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকানো যাকে বলে। সে দৃষ্টি একে বারে আমার ভেতর সেঁধিয়ে গিয়ে আমার বুক, গলা, আলজিভ সব খটখটে শুকনো করে দিল, আর তারপর পার্থদার মুখটা আমার দিকে এগিয়ে এল, চোখের সামনে সব ঝাপসা, কড়া তামাকের গন্ধ, আর নরম নরম, ভীষণ নরম কিছুতে আমি ডুবে গেলাম।
***
পিএইচডি শেষ করার পর পার্থদার কলেজের চাকরিটা হয়ে গেল। গ্র্যাজুয়েশনের পর আমি খবরের কাগজে একটা চাকরি পেয়ে গেলাম। অনলাইন খবরের কাগজ। ফেসবুকে অ্যাড বেরিয়েছিল, বাংলা বানান-জানারা অ্যাপ্লাই করুন। গিয়ে দেখি আরও সত্তর জন ছেলেমেয়ে একটা পনেরো ফুট বাই কুড়ি ফুট ঘরে অপেক্ষা করছে। সাদা ফুলস্কেপ পাতা আর নটরাজ পেন্সিল ধরিয়ে দেওয়া হল। কর্তৃপক্ষের একজন দরজায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বানান বলতে লাগলেন; ঊরুর ওপর কোনওমতে পাতা ব্যালেন্স করে সবাই লিখতে থাকল। মুহূর্ত-এ পঁয়ত্রিশজন আউট হয়ে গেল, নূপুর আর মুমূর্ষুতে বাকি তিরিশ, কুজ্ঝটিকা আর ঝঞ্ঝাবাত পার করে পাঁচজন অবশেষে চাকরির জন্য মনোনীত হলাম। চিফ মিডিয়া করেস্পন্ডেন্ট, চিফ স্পোর্টস করেস্পন্ডেন্ট, চিফ পলিটিক্যাল করেস্পন্ডেন্ট, চিফ ক্রাইম করেস্পন্ডেন্ট আর চিফ এন্টারটেনমেন্ট করেস্পন্ডেন্ট, অর্থাৎ আমি। শনিবারে শনিবারে গুপ্তধন আর মাংসের ঘুগনি নামওয়ালা সিনেমার রিভিউ লিখতাম, আর পার্কে বসে পার্থদার তত্ত্বাবধানে চলত বিশ্বসিনেমার চর্চা।
একদিন পার্কে পৌঁছে দেখি ওয়ার্ল্ড সিনেমায় পার্থদার রুচি নেই। আমি নোটখাতা বার করে অপেক্ষা করতে লাগলাম, পার্থদা আনমনে ঘাস ছিঁড়তে লাগল।
তোকে একটা কথা বলার আছে।
এত গম্ভীর লাগছিল পার্থদাকে। আমার বুক ধকধক করতে লাগল। পার্থদা যদি বলে আমাদের কমপ্যাটিবিলিটি নেই, আমি স্যাপিওসেক্সুয়াল, তুই বোকাহাঁদা, আমি তোর সঙ্গে আর প্রেম করতে পারব না? যদি বলে মধুপর্ণারা তোর থেকে অনেক বেশি বই পড়েছে আর কিসলোস্কির সিনেমা দেখেছে কাজেই ওদের মতো কাউকেই…
আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, তুমি যে যে সিনেমাগুলোর নাম বলেছিলে আমি সবগুলো ডাউনলোড করেছি, যদিও শক্ত লাগছে, আমি সবগুলো দেখার চেষ্টা করছি, কিন্তু পার্থদা আমার কথায় কান দিল না। ঘাস ছিঁড়ে দুই আঙুলের মধ্যে পিষতে পিষতে বলল, খুব বেশি দেরি হওয়ার আগে, জানি না, হয়তো দেরি হয়ে গেছে অলরেডি, তোর কাছে একটা ব্যাপার কনফেস করার দরকার।
সেই মুহূর্তে আমি স্থির করে নিয়েছিলাম, কনফেশন যতই মর্মভেদী হোক না কেন, পার্থদাকে আমি ক্ষমা করে দেব। পার্থদা যদি আর কাউকে, এমনকি মধুপর্ণাকেও, কিস করে থাকে তাহলেও ক্ষমা করে দেব। পার্থদা যদি আমার আড়ালে আর কারও কিসলোস্কির ক্লাস নিতে থাকে… ভাবামাত্র আমার বুক ভেঙে গেল, কিন্তু আমি বুকে পাথর রাখলাম; আমি ক্ষমা করে দেব।
দাড়ির আড়ালে পার্থদার ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠল।
আমি তোর সঙ্গে এতটা অ্যাটাচড হয়ে পড়ব ভাবিনি রে, আমার খুব কষ্ট হবে তুই যদি আমাকে ক্ষমা না করিস, কিন্তু আমি বুঝব। আমার রাজনীতি, আমার পড়াশুনো, আমার লেখালিখি— সব আসলে একটা মিথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
হাঁফ ছাড়লাম। কিসলোস্কি আমারই আছে।
পার্থদার গলা শেষদিকটায় ভেঙে গেল।
আমার হৃদপিণ্ডটা যেন কেউ গামছার মতো নিংড়ে দিল। আমি পার্থদার হাতদুটো চেপে ধরলাম, আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না, কিছুতেই যাব না পার্থদা।
পার্থদা বলল, যাদের বিরুদ্ধে আমার, আমাদের সংগ্রাম, আমি নিজে সেই শ্রেণিশত্রুর প্রতিনিধি। ইন ফ্যাক্ট, বলতে পারিস আমার গোটা সংগ্রামটাই আমার শিকড়টাকে অতিক্রম করার জন্য। আমার পূর্বপুরুষ বাঁশবেড়িয়ার রাজা ছিল। আমরা এখনও অশ্লীল রকমের বড় রাজবাড়িতে থাকি, আমাদের ক্ষমার অযোগ্য পরিমাণে জমিজমা আছে, সে সব জমিতে মনিষরা খাটে, বুড়ো মনিষরা এখনও আমার বাবাকে রাজামশাই বলে ডাকে, অনেক বারণ করা সত্ত্বেও ডাকে। আমি বাবার একমাত্র ছেলে, বাবার পর আমাকে ডাকবে। আমি কিছুতেই ওদের আটকাতে পারব না।
পার্থদার চোখ জল এসে গেছে। আমারও। বেজাতে প্রেম করছি শুনলে বাবা ঠ্যাঙাবে ভয় ছিল, রাজার জাতের সঙ্গে প্রেম করছি শুনলে বাবার মুখটা কেমন হবে মনে পড়ে চোখের জলের মধ্যে হাসি ফুটল। আমি স্থান কাল পাত্র ভুলে পার্থদাকে জড়িয়ে ধরে পার্থদার দাড়ির ওপর একটা কিস করলাম।
***
আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ে থেকে আমরা পুরোহিত বাদ দিলাম কিন্তু পুঁজিবাদ এড়ানো গেল না। দামি শাড়ি, দামি পাঞ্জাবি, দামি গয়না, দামি ঘড়ি, দামি জুতোয় বাড়ি ভরে গেল। দামি ক্যাটারার ডেকে পাঁচশো লোক খাইয়ে, এয়ার কন্ডিশনড ইনোভা চড়ে আমি বাঁশবেড়িয়া রওনা দিলাম।
ভেবেছিলাম কাঁদব না, কান্নার তো কিছু নেই, পার্থদাকে দেখার প্রথম মুহূর্ত থেকে ভালোবেসেছি, একসঙ্গে থাকতে চেয়েছি, কিন্তু বাবা জড়িয়ে ধরে ‘বুলটি রে’ বলে এমন কাঁদল যে আমারও কেমন কান্না পেয়ে গেল। অত কান্নাকাটি আর ভালোমন্দ খাওয়ার জন্যই বোধহয়, জিটি রোডে গাড়ি ঢুকতেই মাথা ঘুরে গা বমি করতে লাগল। আমার ননদ আর দেওর এসেছিল আমাদের নিয়ে যেতে। ওরা গাড়ি থামিয়ে দৌড়ে লিমকা কিনে আনল। লিমকা খেতে খেতে আমরা বাঁশবেড়িয়া পৌঁছলাম। একটু পরে পার্থদা হাঁফ ছেড়ে বলল, ফাইন্যালি। দেখি মাঠের ভেতর আলোয় সাজানো বিরাট একটা বাড়ি। গাড়ি থামা মাত্র আলো, শাঁখ আর উলু আর ‘এসে গেছে!’ চিৎকার আর হাসিতে আমার ধাঁধা লেগে গেল। সেই আলো আর উল্লাস আর কলরবের মধ্য দিয়ে আমি আমার শাশুড়িকে দেখলাম।
সেই প্রথম। এ বাড়ির বউদের নাকি বিয়ের আগে পাত্রীপক্ষের বাড়িতে জলগ্রহণ করার নিয়ম নেই। বিয়েতেও যাননি। স্বাস্থ্যবতী। সারা গায়ে সোনার গয়না ঝলমল করছে। গোল মুখ, সিঁথিতে টকটকে সিঁদুর। পাতলা ঠোঁট। নাকটা পার্থদার থেকেও টিকোলো, রং পার্থদার থেকেও ফরসা। খালি চোখ দুটো একই রকমের বড় বড়। ঠিক যেন জগদ্ধাত্রী।
জগদ্ধাত্রী আমার মাথায় ধান দূর্বা আরও কীসব কুটকুটে জিনিস ডাঁই করলেন। আমার চিবুক ধরে একমুহূর্ত তাকিয়ে থেকে হাত ঠোঁটে ছুঁইয়ে চুমু খেলেন।
রাজবাড়ির বাগানচেরা রাস্তায় পাতা গরদের শাড়ির ওপর বাটার পাঁচ নম্বর পায়ের ছাপ ফেলতে ফেলতে আমার যুবরানিত্বে অভিষেক হল।
***
সেদিন রাতে আশীর্বাদের সময় কারা যে মাথায় হাত রেখে কী বলল, কী যে রসিকতা করল, কে যে মামি কে যে কাকি কে যে জ্যাঠা সব গুলিয়ে ঘণ্ট পাকিয়ে গেল। পরদিন সকালে নিচে যেতেই বাড়িভর্তি ননদদেওর, চার থেকে একুশ পর্যন্ত তাদের বয়স, ছেঁকে ধরল। আমি নিউক্লিয়ার বাড়ির এক মেয়ে, তুতো ভাইবোন থাকলেও সব ছাড়া ছাড়া। এদিকে এদের বাঁশবেড়িয়ার বাড়িতে না থাকলেও আশেপাশে আত্মীয়রা থাকেন, কেউ কলকাতায়, কেউ বিদেশে, কিন্তু এত পুরনো শিকড় বলেই বোধহয় টান পড়লে সব এসে জড়ো হয়। টিপু আর গুলতি আর লুডো আর ছক্কা আমাকে ঘিরে রইল, সকালের চায়ের কাপ মুঠোয় ধরা গা এলানো পরিবেশে সবার সঙ্গে নতুন করে আবার আলাপ হল। টের পেলাম, বুককাঁপুনিটা কখন উধাও হয়ে গেছ। আমি দিব্যি রসিকতায় গলা ছেড়ে হাসছি, বাবামায়ের গল্প শোনাচ্ছি সবাইকে।
খালি একজনের প্রতি অস্বস্তিটা জেগে রইল। আমার শাশুড়ি জগদ্ধাত্রী। বলা বাহুল্য ওঁর নাম জগদ্ধাত্রী নয়। মমতা দত্ত। কিন্তু প্রথম দেখার মুহূর্তে শব্দটা যে মাথায় ঢুকে গিয়েছিল, অনেক চেষ্টা করেও সেটাকে তাড়াতে পারলাম না।
খেয়াল করলাম, উনি স্বভাবত গম্ভীর। হাসির কথায় হাসেন, কিন্তু সংযত হাসি। আমার মতো গড়াগড়ি খাওয়া হাসি নয়। কাউকেই বকছেন না ঝকছেন না, আদর করে নরম সুরে কথা বলছেন, কিন্তু সকলেই ওঁর সঙ্গে সমীহপূর্ণ ব্যবহার করছে। আমার শ্বশুর বিভূতি দত্ত এদিকে মারাত্মক মাইডিয়ার। কথায় কথায় হাহা করে হাসেন, রাতে আমাদের আশীর্বাদ করার সময় চোখে জলও এসে গিয়েছিল। শ্বশুরকে আমি ভালোবেসে ফেললাম, কিন্তু জগদ্ধাত্রীকে ভালোবাসতে পারলাম না। উল্টে একটা ভয় আর ভয়জাত বিরাগ মনে জেঁকে বসল।
জলখাবার খাওয়ার পর সবাই বৌভাতের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ননদদেওররা বলল, বৌদি চল তোমাকে দত্তবাড়ির ট্যুর করাই। অলিগলি পেরিয়ে, এ তলা ও তলা উঠে নেমে আমরা চললাম। উঁচু সিলিং, কড়িকাঠের ছাদ, খড়খড়ির জানালা। বেশিরভাগ ঘরেই ভালো করে আলো ঢোকে না। আলোআঁধারিতে ঘরের কোণে দাঁড় করানো গামবাট কালো কাঠের আসবাবের ছায়া গুটিসুটি মারা মানুষ বলে ভুল হয়। ঘুরে টুরে আমরা অবশেষে বসার ঘরে এসে পৌঁছলাম।
পেল্লায় হল। উঁচু কড়িকাঠের ছাদ থেকে টানা পাখার আংটা ঝুলছে। বিয়ে উপলক্ষ্যে রং করা চার দেওয়ালে প্রায় আধমানুষ লম্বা লম্বা তৈলচিত্র। দত্তবাড়ির প্রজন্মের পর প্রজন্মের কর্তামশাইদের পোর্ট্রেট। যাঁদের বাইরের লোক রাজামশাই বলে জানত। গোড়ার দিকের কর্তামশাইরা অনেকেই, উত্তর দিকের দেওয়ালে যাঁরা টাঙানো আছেন, মরা বাঘের পেটের ওপর পা রেখে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। উত্তর ঘুরে পুবে আসতে আসতে বাঘের যোগান কমে এসেছে, তখন বাঘের বদলে আরামকেদারা, দাঁড়ানোর বদলে আধশোয়া। পূর্ব ঘুরে দক্ষিণে এলাম। কেদারা একই রয়েছে খালি ফোটোগ্রাফের জায়গা বদলে যাচ্ছে, ছাদ, বাগান, কোনওটা এই হলেই তোলা। পশ্চিমের দেওয়ালে আপাতত একটাই ছবি, পার্থদার ঠাকুরদার। সেই কেদারাতেই বসা, ছাদে সম্ভবত। পশমিনা শাল গায়ে জড়ানো, কেদারার হাতায় হেলানো লাঠির মাথায় রুপোর সিংহের মাথা। ঠাকুরদার ছবির পাশে এখনও আরও দুটো ছবি বসানোর মতো জায়গা খালি।
দিনদুয়েক পর গাল টিপে, চুমু খেয়ে, আশীর্বাদ করে, যে যার বাড়িতে যাওয়ার অনেক করে নেমন্তন্ন করে আত্মীয়রা চলে গেলেন। জগদ্ধাত্রী সবাইকে আদর করে, হাঁটুর ব্যথা চেপে বয়স্কদের প্রণাম করে, ছোটদের প্রণাম নিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। শেষ দল যখন বিদায় নিল জগদ্ধাত্রী বড় করে নিঃশ্বাস ফেললেন। মুখে প্রশান্তি ছেয়ে গেল।
আমাদেরও যাওয়ার সময় হল। জগদ্ধাত্রী আমার চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আবার এসো।
কিন্তু আমার কেবলই মনে হতে লাগল, আমাদের গাড়িটা মোড় ঘোরার পরমুহূর্তেই উনি ফোঁস করে হাঁফ ছাড়বেন। গাড়ি যখন বড় রাস্তায় পড়বে ততক্ষণে উনি শান্ত, ফাঁকা রান্নাঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে গান গাইছেন। জানালা দিয়ে এসে পড়া রোদ্দুরে ওঁর মুখটা আগের থেকেও বেশি তৃপ্ত দেখাচ্ছে।
***
সাউথ ক্যালকাটারও খানিকটা সাউথে পুরনো বাড়ি ভেঙে উঁচু ফ্ল্যাটের চারতলার পেছন দিকে একটা দেড় কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া হল। টেম্পো চড়ে পার্থদার ভাড়াবাড়ি থেকে খাট, লেখার টেবিল, বইয়ের বাক্স, আমার বাড়ি থেকে আলমারি, বইয়ের বাক্স এল। শোবার ঘরের জানালার বাইরে পাশের বাড়ির বাথরুম দেখা যায়। একটা বাজে লোকের বাথরুম। এক সপ্তাহ পর জানালা বন্ধ করে পেরেক মেরে দেওয়া হল। পার্থদা একটা কিসলোস্কির পোস্টার এনে তার ওপর সেঁটে দিল।
সেই শুরু হল। পার্থদা আর আমার আর কিসলোস্কির সংসার। পার্থদার কলেজ, আমার ওয়েবসাইট। প্রথম প্রথম অদ্ভুত লাগত। এতদিন ঘুম থেকে উঠে মাআআ বলে চেঁচালেই সব হাতের কাছে এসে যেত, এখন চোখ খুলে মনে পড়ল মায়ের না, এটা আমার সংসার। যা জোগাড় করার নিজেকেই করে নিতে হবে। খাটনিও সব আমার, স্বাধীনতাও। ইচ্ছে হলে কাজ করো। না হলে কোরো না। ইচ্ছে হলে রাঁধো, না ইচ্ছে হলে অর্ডার করে খাও।
আরও একটা জিনিসে ধাতস্থ হতে আমার একটু সময় লাগল। একটা লোকের সঙ্গে বাড়ি খাট বাথরুম ভাগ করে নেওয়া তো অদ্ভুতই, তার থেকে বেশি অদ্ভুত হচ্ছে দুজনের সম্পর্কে কার রোল কী সেটা বুঝে নেওয়া। পার্থদা যখন ঘুম থেকে আমারও আগে উঠে চা করে নিয়ে এসে আমার মুখের সামনে ধরল, কী খাবি বল, কচুরি? বলে নিজেই দুমদাম করে কাবার্ডের ঢাকা খুলে ময়দা নিয়ে ঠাসতে বসে গেল আর ঠাসতে ঠাসতে চিল্লিয়ে “পথে এবার নামো সাথী/ পথেই হবে এ পথ চেনা” বেসুরে গাইতে লাগল, আমি একেবারে বুঝভম্বুল মেরে গেলাম।
আমি, খারাপ কথা বলার জন্য সরি, বাপের জন্মে দেখিনি পুরুষমানুষ যেচে রান্নাঘরে ঢুকে ময়দা ঠাসছে। বাবারা বাইরের কাজ করবে, মায়েরা বাড়ির কাজ, সেটাই দেখে এসেছি। আমার বাবা যেমন। চাকরিবাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ঘরকন্নার ব্যাপারে নাক গলাতেন না। ওটা ছিল মায়ের ডিপার্টমেন্ট। আবার বাইরের কাজে মা সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ লোকজন, যেমন চাঁদা নিতে পাড়ার কাকুরা বা ব্যাঙ্ক বা পোস্টঅফিসের এজেন্টটেজেন্ট এলে, দরজা খুলে বসিয়ে বাবাকে ডেকে দিতেন। মায়েরা বাইরের কাজ করলেও ভেতরের কাজটা করতেন, তাও দেখেছি। আমার কাকিমা চাকরি করতেন। তার মানে কি কাকিমা বাড়ির কাজ করতেন না? কোনওদিন অফিস থেকে এসে কাকুকে ভাত বসাতে দেখিনি। কাকিমাই বসাতেন। দুজনের ছুটির দিন বাড়িতে অতিথি এলেও কাকু বসে তাদের সঙ্গে গল্প করতেন, কাকিমাকেই উঠে চা করতে যেতে হত।
আমাদের সংসারে বাড়ির কাজ আর বাইরের কাজ গুলিয়ে গেল। এমন অনেক সময় হত যে বাড়িওয়ালা এলে পার্থদার বদলে আমাকে বেরিয়ে কথা বলতে হত কারণ পার্থদার হাতে ময়দা লেগে আছে। কোথায় কত টাকা জমানো হবে, ছোটখাটো ইনভেস্টমেন্টটেন্টের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পার্থদা এমন করে আমার মত চাইত, যেন এসব ব্যাপার আমি ওর সমান বুঝব।
সুখের কথা মুখে বললে লোকে ভাবে শোনাচ্ছে বুঝি। কিন্তু বানিয়ে বানিয়ে তো দুঃখের কথা বলা যায় না। অনেক বেছে আমি আমাদের জীবনে মোটে একটা কাঁটা বার করতে পেরেছি।
বিয়ের ক’মাস আগে পার্থদা ওর জীবনের প্রথম উপন্যাসটাতে হাত দিয়েছিল। এর আগে ছোটখাট পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনে পার্থদার কবিতা, দুয়েকটা ছোটগল্প ছেপে বেরিয়েছিল। কিন্তু পার্থদার স্বপ্ন ছিল উপন্যাস লেখার। পার্থদার মাস্টারপিস। বাংলা সাহিত্যের মরা গাঙে জীবনের জোয়ার ফেরানো। আমি উৎসাহ নিয়ে উপন্যাসের প্লট জানতে চাওয়ায় পার্থদা বলেছিল এটা সে জাতের উপন্যাস নয় যাতে শুধু প্লটই থাকে আর প্লট ছাড়া কিছুই থাকে না। এ ধরনের উপন্যাসের শিরদাঁড়া হচ্ছে থিম। পার্থদা উপন্যাসের থিম যা বলল আমি খুব একটা ভালো বুঝতে পারলাম না। এটুকু বুঝলাম যে সে থিম কমরেড আর লাল সেলাম আর ইনকিলাবে ঠাসাঠাসি। বোকার মতো বলে বসেছিলাম, প্রেম নেই? পার্থদা বলেছিল, আছে তো। নায়িকার পুঁজিবাদ আর নায়কের সাম্যবাদের প্রাথমিক সংঘর্ষ পার করে অবশেষে সাম্যবাদের প্রেমে পুঁজিবাদের আত্মসমর্পণ। আমার ভয় হত উপন্যাস বেশি দাঁতভাঙা হয়ে গেলে আবার বোকাসোকা পাঠকেরা মর্ম না বুঝতে পারে। আমার সন্দেহ ছিল বেশিরভাগ পাঠক আমারই মতো, বাংলা সাহিত্যের জোয়ারভাঁটা নিয়ে ভাবিত নয়, তারা চায় গল্প পড়তে।
বিয়ের পর পার্থদার অমন গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাসটা এগোতে চাইল না। একে তো কলেজের পড়ানো, খাতা দেখা নানাবিধ ঝামেলা, কিন্তু আসল বাধাটা তা ছিল না। কলেজ থেকে ফিরে আসার পরেও লেখালিখি করা যায়। চাইলে শনিরবি সময় বার করা যায়। কিন্তু পার্থদার মন বসত না। আমারও দোষ ছিল। সারাদিন চিফ এন্টারটেনমেন্ট করেসপন্ডেন্টের দায়িত্ব সামলে বাড়িতে এসে ইচ্ছে করত পার্থদার সঙ্গে গল্প করি। তবে আমি বাংলা সাহিত্যের স্বার্থে আমি সে ইচ্ছে ত্যাগ দিতে রাজি ছিলাম। পার্থদাকে বললাম, তুমি বাড়তি ঘরটার দরজা বন্ধ করে বসে লেখো পার্থদা, আমার মাথা খাও।
পার্থদা প্রথম প্রথম গিয়ে দরজা দিয়ে লিখতে বসত। আমি এ ঘরে কিসলোস্কির পোস্টারের নিচে বসে বসে বিয়ের আগে পার্থদা বিশ্বসিনেমার যে সব নোট দিয়েছিল সেগুলো নাড়াচাড়া করতাম, কিন্তু মিথ্যে বলব না, একটু পরেই হাই উঠত। কিসলোস্কির মুখের দিকে তাকিয়ে বলতাম, এক এপিসোড ক্রাইম পেট্রোল দেখে নিই, তারপর আবার পড়তে বসব, প্রমিস।
একটু পরেই পার্থদা দরজা খুলে উঁকি মারত।
মুড়িমাখা খাবি? চপ আনব? চা খাবি?
তারপর সেই যে গল্প শুরু হত সারা সন্ধে কাবার।
পার্থদাকে বলতাম, আমার জন্য তোমার এমন জরুরি উপন্যাসটা শেষ করা হচ্ছে না, গ্রেট থিংস অ্যাচিভ করা হচ্ছে না। পার্থদা বলত্, না রে, সমস্যাটা সেটা নয়। আসলে এই ধরনের সিরিয়াস উপন্যাস লেখার জন্য যে মানসিক অবস্থা দরকার সেটা আমার এই মুহূর্তে নেই।
আমি বিচলিত হয়ে বলতাম, তোমার মনে শান্তি নেই, পার্থদা?
দরকারের বেশি আছে। সেটাই বিপদ। তোর সঙ্গে বড় বেশি সুখী হয়ে পড়েছি রে। গ্যাদগেদে গেরস্ত হওয়াই আমার ভবিতব্য ছিল।
পার্থদা মুখ চুন করে বসে থাকত।
সরি। আমি বলতাম।
পার্থদা বলত, তুই কেন সরি। আমি তো সরি নই। গোটা ব্যাপারটার মধ্যে সবথেকে অদ্ভুত ব্যাপার ওটাই, যে আমি একটুও সরি নই। এ ছাড়া অন্য কিছু হলে যে কেমন হত আমি কল্পনা করতে পারি না, কিন্তু যা হয়েছে তার থেকে ভালো যে কিছুতেই হত না, হলফ করে বলতে পারি।
***
আমাদের বিয়ে হয়েছিল শীতে। দেখতে দেখতে বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষা পেরিয়ে পুজো এল। বাঁশবেড়িয়ার বাড়িতে পুজো হয়। পার্থদা বলল, তুই যদি যেতে না চাস অ্যাবসলিউটলি অলরাইট। তুই থাক, আমি একবার টুক করে ঘুরে আসি। তারপর দুজনে মিলে ম্যাডক্স স্কোয়্যার। বলে চোখ মটকাল।
পরে বারবার আমি ওই মুহূর্তটা মাথার ভেতর রিপ্লে করেছি। যদি পার্থদার কথা মেনে নিতাম? যদি রাজবাড়ির বউ হয়ে শাড়িগয়না ঝমঝমানোর মোহ অতিক্রম করে পার্থদার কথামতো কলকাতার পুজো দেখে ম্যাডক্স স্কোয়্যারে বসে রাজাউজির মারতাম? সেটাও তো একটা ঐতিহ্যময় ব্যাপার।
কিন্তু নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে বেড়ে ওঠা আমার মনের ভেতর ওই বড় বাড়িটা আর বাড়ির অগুন্তি দেওরননদ, মাসিশাশুড়ি, পিসিশাশুড়ির এন্তার কলকল কানে ভাসতে লাগল। ছোটবেলা থেকে যত বাংলা সিনেমায় যত বাড়ির পুজোর সিন দেখেছি, সব মাথার ভেতর গাদাগাদি করতে লাগল। তাছাড়া বিয়ের শাড়িগয়নাগুলো পরে তো আর চিফ রিপোর্টারগিরি করতে যাওয়া যায় না, ওগুলো পরারও তো একটা ছুতো চাই। এত কিছুর মধ্যে খালি জগদ্ধাত্রীর মতো মুখ কাঁটার মতো জেগে রইল, কিন্তু আমার রাজবাড়ির পুজোয় রাজপুত্র-বধূ হওয়ার স্বপ্নে তা যথেষ্ট বাগড়া দিতে পারল না।
চাতালে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই এসে জড়িয়ে ধরল। মন্দিরপ্রাঙ্গণে মাটি লেপা মায়ের মূর্তি দেখে বুকের ভেতর কত কিছু যে হল। অন্ধ চোখেও এত মায়া থাকতে পারে? পার্থদার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে টপ করে কপালে আর বুকে তর্জনী ছুঁইয়ে নিলাম। মা মা গো, দেখেশুনে রেখো মা। আমাকে, আর যারা অবিশ্বাসী কিন্তু মনটা ভালো, তাদেরও ভালো রেখো।
পরের চারটে দিন যে কী আনন্দে কাটল। অত আনন্দ আর কোনও পুজোয় হয়নি। কতরকমের গল্প, কতরকমের খাওয়াদাওয়া, কতরকমের আচারবিচার। পার্থদা কিছুই মানল না, কেউ জোরও করল না। আমি সিঁদুর টেনে, ঘোমটা দিয়ে, পুজোর থালা হাতে, পার্থদার চোখে যথাসম্ভব চোখ না ফেলে ঘোরাঘুরি করতে লাগলাম। আফটার অল, এগুলো যে সব পুরুষতান্ত্রিক, থুড়ি, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের চাপিয়ে দেওয়া শেকলবাকল, সে নিয়ে পার্থদা আমাকে অনেক বুঝিয়েছে, আমিও যে বুঝিনি তেমন নয়। কিন্তু ওই পরিবেশে সব বোঝা হাওয়া হয়ে গেল। আমার জা, ননদ, জগদ্ধাত্রী, সবার সঙ্গে সবার মতো সাজতে ইচ্ছে করল।
আড়াল হলে পার্থদাকে বললাম, তুমি রাগ করেছ? আসলে সবাই…
পার্থদা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে বলল, রাগের কী আছে। তোর সাজতে ইচ্ছে করছিল তো?
ঘাড় নাড়লাম।
তোকে কেউ জোর করেনি তো?
জোরে জোরে ঘাড় নাড়লাম।
তাহলে কোনও সমস্যা নেই। সমস্ত ইজমের ওপর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সত্য। আমি তোকে বোঝাতে পারি। কিন্তু আমার বোঝা তোর ওপর চাপাতে পারি না। তোর যেদিন এগুলো অসার মনে হবে করবি না। মনে না হলেও অসুবিধে নেই।
পাতার ওপর রাখা পার্থদার রোগা, ফরসা আঙুলের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, আচ্ছা আমাকে কেমন দেখতে লাগছিল বললে না তো? তোমার বোধহয় এ রকম গাঁইয়া সাজ পছন্দ না, তাই না?
পার্থদা বলল, সাজ ইমমেটেরিয়াল। আমার তোকে পছন্দ। তুই যেমনই সাজবি আমার তোকে পছন্দ হবে।
টান মেরে ম্যাগাজিন মেঝেতে ছুঁড়ে বেডসুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিলাম। জানালা দিয়ে অষ্টমীর চাঁদের আলো এসে খাটে পড়ল।
***
দশমীর দিন ছোটবেলার মতো কান্না পেয়ে গেল। সিঁদুর খেলা হল খুব। জগদ্ধাত্রী আমার কপালে গালে সিঁদুর মাখিয়ে বললেন, সুখী হও।
একাদশীর দিন নাড়ুনিমকি খেয়ে সবাই বাড়ি চলে গেল। অ্যামেরিকার জা জাপটে ধরে বলে গেল, আবার কবে দেখব তোকে। আমরা লক্ষ্মীপুজো পার করে যাব। বিভূতি দত্ত নরম গলায় বললেন, বাড়ির লক্ষ্মী প্রথম বছর লক্ষ্মীপুজোতে… জগদ্ধাত্রী বললেন, আহা ওদের চাকরিবাকরির ব্যাপার, তুমি জোর কোরো না।
আমার স্বরটা ভালো লাগল না। আমি বললাম, না না আমার ছুটি নিতে কোনও অসুবিধে হবে না। জগদ্ধাত্রী চুপ করে গেলেন। বিভূতি দত্তর মুখ হাসিতে আলো হয়ে গেল।
দ্বাদশীর দিন সকালবেলা লুচি তরকারি খেয়ে পার্থদা গেল বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। আমি গেলাম ছাদে। পার্থদাদের গোটা বাড়ির মধ্যে ছাদটা আমার ফেভারিট জায়গা। মাঠের মতো বড়। তার মধ্যে কত যে খোপ। এইখানে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে হয়, ওইখানে আবার একটুখানি ওঠা। পুজো যেতে না যেতে হাওয়া অলরেডি ঠান্ডা হয়ে গেছে। ওড়নাটা টি শার্টের ওপর জড়িয়ে নিয়ে বুকসমান রেলিং-এর ওপর দুই হাত আর হাতের ওপর চিবুক রেখে দাঁড়ালাম। গুবগুব করে পায়রা ডাকছে। পুকুরের পাশের সরু মাটির রাস্তাটা দিয়ে একটা লোক সাইকেল করে যাচ্ছে, সাইকেলের দুই হ্যান্ডেলে, ক্যারিয়ারের দু পাশ থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি নারকেল ঝুলছে। সব যাচ্ছে গ্রামের হাটে। এ বাড়ির বাগান থেকেও জগদ্ধাত্রী নারকেল পাড়িয়ে রান্নাঘরের কোণে ডাঁইকরে রেখেছেন। নাড়ু হবে লক্ষ্মীপুজোতে।
লোকটা ডানদিকে বাঁক নিল আর লোকটাকে আরও খানিকক্ষণ চোখে চোখে রাখব বলে আমি রেলিং ছেড়ে এদিকে এলাম আর চোখ পড়ল ঘরটার ওপর। ওখানে একটা ঘর আছে আগে খেয়াল করিনি তো? এগিয়ে গেলাম। পুরনো ঝুরঝুরে কাঠের পাল্লা থেকে ছোট শিকল বেরিয়ে ওপরের ফ্রেমের আংটায় গলানো, আংটা থেকে একটা তালা খুলে গিয়ে ঝুলছে।
বাইরে থেকে দেখে যতটা মনে হচ্ছিল, ততটাও ছোট নয় ঘরটা। ভাঙা আসবাব আর বাতিল জিনিসে ভর্তি। একটা জানালার খড়খড়ি কে যেন তুলে রেখে গেছে, সেখান থেকে সারি সারি আলোছায়া এসে পড়েছে ঘরের ভেতর।
সেই আলোছায়ায় বাকি জঞ্জালের থেকে আলাদা হয়ে অবস্থান করছে একটা চেয়ার। চেয়ার বললে অবশ্য মারাত্মক অবমাননা করা হয়, কারণ সাধারণ চেয়ারের তিনগুণ কাঠ দিয়ে ও চেয়ার বানানো। হেলানো পিঠ, এলানো চওড়া হাতল। ক্রিসক্রস পায়া। পিঠ আর বসার জায়গার বেতের বুনুনি ছিঁড়ে গেছে। মাকড়সা জাল বুনেছে শরীর জুড়ে।
কোনও সন্দেহ নেই, এই সেই বসার ঘরের তৈলচিত্রের কর্তামশাইদের কেদারা।
কেদারার সামনে পরিপাটি একজোড়া খড়ম। কর্তামশাইদেরই হবে।
ন্যাপথলিনের গন্ধমাখা ঘরে কেদারা আর খড়মের সামনে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। অবশ্য আমি কেদারাটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম, নাকি কেদারাটা আমাকে সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল, সেটা পরে অনেক ভেবেও মনে করতে পারিনি।
***
দুপুরে বেদানা ছাড়াতে ছাড়াতে পার্থদাকে বললাম, পড়ার ঘরের জন্য তুমি একটা কাঠের আরামকেদারা খুঁজছিলে না?
পার্থদার নামে চালালেও আমরা দুজনেই খুঁজছিলাম। মধুপর্ণারাও বিয়ে করেছে সদ্য, ওদের ফ্ল্যাটে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে দেখি দেওয়ালের প্লাস্টার চেঁছে তুলে ফেলা হয়েছে, সারি সারি দাঁত বার করা ইটের সারি সারি দাঁত, তার ওপর আবার মধুপর্ণার বর দেওয়াল জুড়ে চুন দিয়ে গোদা গোদা অক্ষরে লিখে রেখেছে, COGITO, ERGO SUM. খরখরে মেটাল গ্লাসে ভদকা ঢেলে এগিয়ে দিয়ে মধুপর্ণা ডগমগ হয়ে বলেছিল, ওরা নাকি গোটা ফ্ল্যাটে একটাই ডেকোরেশন স্টাইল মেন্টেন করেছে— ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্যাবি শিক।
আমাদের দুজনেরই ঘর সাজানোর ব্যাপারে ট্র্যাডিশনাল স্টাইল পছন্দ। অনলাইন ফার্নিচার দেখতে দেখতে দুজনেরই চোখ একটা আরামকেদারায় আটকেছিল। সলিড সেগুন কাঠের, হেলানো পিঠে বেতের কাটাকুটি বাঁধুনি, চওড়া হাতল। দাম দেখার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ল্যাপটপ বন্ধ করেছিলাম।
পার্থদা বলল, কর্তামশাইয়ের কেদারা? কোথায় পেলি? আমরা তো ভেবেছিলাম ভেঙেচুরে গেছে।
উৎসাহ পেয়ে বললাম, ভেঙেছে মানে একটু ধুলো পড়েছে, আর পিঠের বেতের বাঁধুনিও খুলে খুলে এসেছে। মোড়ের মাথার ফার্নিচারের দোকানটায় দিলে নতুন করে বেঁধে দেবে না?
রাতে খেতে বসে পার্থদা বিভূতি দত্তকে বলল, বাবা, চিলেকোঠার বন্ধ ঘরটায় নাকি কর্তামশাইয়ের কেদারাটা ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে? তোমরা ব্যবহার করছ না যখন কলকাতার ফ্ল্যাটে নিয়ে যাই?
বিভূতি দত্ত বললেন, কর্তামশাইয়ের কেদারা? আমি তো ভাবলাম ভেঙেচুরে গেছে।
পার্থদা বলল, ভেঙেছে মানে ধুলো পড়েছে, আর পিঠের বেতের বাঁধুনিও খুলে খুলে এসেছে। পাড়ার মোড়ের মাথার ফার্নিচারের দোকানটা থেকে নতুন করে বাঁধিয়ে নেব।
খাওয়ার পর জগদ্ধাত্রী আর লক্ষ্মীদি রান্নাঘর গুছোচ্ছিল, আমি একখাবলা তেঁতুলের আচার চাটতে চাটতে রান্নাঘরের দরজার ফ্রেমে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সঙ্গ দেওয়ার ভদ্রতা করছিলাম। জগদ্ধাত্রী দত্ত হাত মুছতে মুছতে পাশে এসে দাঁড়ালেন।
তোমরা কি সত্যিই ওইসব কেদারামেদারা কলকাতা নিয়ে যাবে নাকি? আমার দিকে না তাকিয়ে গলা যথাসম্ভব হালকা রেখে প্রশ্ন করলেন জগদ্ধাত্রী।
পার্থদা ঠিকই বলে। সম্পত্তি কুক্ষিগত করে রাখাটা সামন্ততন্ত্রের ধ্বজাধারীদের রন্ধ্রে-মজ্জায় ঢুকে গেছে।
এসইউভি-র মাথায় কেদারা বেঁধে আমরা কলকাতা ফিরে এলাম। পার্থদা খড়মজোড়াও নিয়ে এল। পায়ে গলিয়ে বলল, দেখেছিস, কেমন ফিট করে যাচ্ছে?
***
বাড়তি ঘরটার জানালার পাশে কেদারাখানা পাতা হল। পার্থদার কলেজ শুরু হল। আমার চাকরি।
কিন্তু বাকি সব আগের মতো হল না। কোথা থেকে বদলটা শুরু হল আমার মনে নেই, একদিন সকালে উঠে পার্থদার খড়মের খট খট শব্দ শুনতে শুনতে টের পেলাম আমাদের ফ্ল্যাটটা আগের থেকে অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। আমরা আগের থেকে কথা অনেক কম বলছি, হাসছিও কম। পার্থদার উপন্যাসও দ্রুতবেগে এগোচ্ছে নিশ্চয়। আমি জানি না। উপন্যাস নিয়ে পার্থদা আজকাল আমার সঙ্গে আলোচনা করে না। কলেজ থেকে ফিরে চা খেয়ে পার্থদা লেখার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। অনেক সময় রাতে খেতেও বেরোয় না। আমি ডিনারের থালা ও ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসি। এ ঘরে আমি, কিসলোস্কির সঙ্গে ক্রাইম পেট্রোল দেখতে দেখতে খাই। মাঝে মাঝে পার্থদার লেখক বন্ধুরা আসে, পার্থদা তাদের সঙ্গে নিয়ে লেখালিখি নিয়ে আলোচনা করে। বন্ধ দরজার আড়াল থেকে মাঝে মাঝে রাজনীতি থেকে সাহিত্য, বিবিধ বিষয় নিয়ে উত্তেজিত তর্ক কানে আসে। চা দিতে গেলে অনেক সময় বন্ধুরা, যাদের অনেকেরই মাথায় ঝুঁটি আর চিবুকে দাড়ির টিপ, বলে, বসুন না, কিন্তু পার্থদা কিছু বলে না। হেসে বেরিয়ে এসে দরজা আস্তে করে ভেজিয়ে দিই।
সংসারের কাজে সুস্পষ্ট বদল ঘটল। রান্নাঘরে পার্থদা ঢোকে না, কিন্তু বাড়িওয়ালা বেল বাজালে উঠে এসে আমাকে ঠেলে সরিয়ে সামনে দাঁড়ায়। টাকাপয়সা খরচের ব্যাপারে আমার সঙ্গে আর শলাপরামর্শ করে না, কী রাঁধব জিজ্ঞাসা করতে গেলে এই তুচ্ছ সিদ্ধান্তটাও নিজে নিতে পারি না বলে বিরক্ত হয়। আজকাল পার্থদা থেমে থেমে, কেটে কেটে কথা বলে। যেন দ্বিতীয়বার বলে সময় নষ্ট করতে না হয়। আমার অফিসের গল্প শোনাতে গেলে বলে, তোদের ওই সার্কাস সম্পর্কে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। প্লিজ, বলিস না। কখনও কখনও মুখেও বারণ করে না। শুধু একখানা হাত তুলে দেয়। আর আমি বুঝে নিই, পার্থদা এখন কোনও কথা শুনতে চায় না।
পার্থদার চেহারাতেও একটা সূক্ষ্ম বদল এসেছে। ভঙ্গিটা আগের থেকে অনেক দৃপ্ত। সারাদিন কেদারায় বসে লিখতে লিখতে একটা ছোট্ট নেয়াপাতি ভুঁড়িও হয়েছে। চেহারায় বদল অবশ্য এসেছে আমারও। ওজন কমেছে, চোখের তলায় কালি। আর ঘাড়ে কী একটা যেন সমস্যা হয়েছে, বেশিক্ষণ সোজা রাখলে টনটনায়।
সেদিন রান্নাঘরে মিক্সি চালিয়ে মালাইকারির পেঁয়াজ বাটছি, চিৎকার করে পার্থদা বলল, ফোনে কথা বলছি, এক্ষুনি কি ওই যন্ত্রটা না চালালেই নয়? তারপরের শব্দটা, গলা সামান্য নামিয়ে বললেও, স্পষ্ট শুনতে পেলাম।
ইডিয়ট।
ফোনের ওপারে জগদ্ধাত্রীও সম্ভবত শব্দটা শুনতে পেয়েছিলেন, কারণ তার পরের রবিবার সকালবেলায় বেল বাজতে দরজা খুলে আবিষ্কার করলাম একটা ছোট সুটকেস হাতে নিয়ে জগদ্ধাত্রী দাঁড়িয়ে আঁচল চেপে গলার ঘাম মুছছেন।
সাড়া পেয়ে পার্থদা ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এসে ভুরু সামান্য ওপরে তুলে বলল, হঠাৎ?
ইচ্ছে হল। জগদ্ধাত্রী পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে এলেন।
***
রাতে পার্থদা লেখার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর কিসলোস্কির নিচে বসলাম দুজনে। কাপে চুমুক দিয়ে জগদ্ধাত্রী বললেন, ভালো হয়েছে চা।
গলার ভেতরটা কেমন করে এল। জগদ্ধাত্রী হাত বুলিয়ে আমার মাথার চুল সমান করে দিলেন।
তুমি কী ভেবেছিলে, আমি সেগুন কাঠের লোভে তোমাকে খড়ম কেদারা নিয়ে আসতে দিতে চাইনি?
আমি ওঁর মুখের দিকে তাকালাম। আপনি জানতেন?
আমি না জানলে ওই শাপ কে ছাদের ঘরে লুকিয়ে রেখে এসেছিল?
জগদ্ধাত্রী গল্প শুরু করলেন। তাঁর দাপুটে শ্বশুরমশাইয়ের গল্প। বসার ঘরের পশিমের দেওয়ালে আপাতত যার একলা ছবি শোভা পাচ্ছে। কেদারায়, পশমিনা গায়ে এলিয়ে বসে আছেন, পাশে রুপোর সিংহমাথা লাঠি। চোখমুখ থেকে দাপট ঝরে পড়ছে।
দত্তবাড়ির কর্তামশাইদের দাপটের ঐতিহ্যের গল্প জগদ্ধাত্রী শুনেছিলেন বিয়ের পরদিন, আত্মীয়দের মুখে। কবে কোন কর্তামশাই খালি হাতে বাঘ মেরেছিলেন, কবে কোন চাকরকে তামাক ভালো করে সাজতে না পারার দায়ে চাবুক মারতে মারতে খুন করেছিলেন। বাঘ আর চাকর মারা, দুইই যখন বেআইনি হয়ে গেল, তখন বাধ্য হয়েই কর্তামশাইদের দাপটের ধরন বদলাতে হল।
আর দিক বদলাল ঘরের মুখে। জগদ্ধাত্রী শাশুড়ির মুখে শুনেছিলেন, বিভূতি দত্তের বাবার দাপটে নাকি বাড়িশুদ্ধু লোক তটস্থ ছিল। শাশুড়ি সাবধান করে দিয়েছিলেন, শ্বশুরের সামনে কীভাবে চলতে হবে, কত জোরে কথা বলতে হবে। ঠিক কতখানি নুন ঝাল টক হলে বা না হলে শ্বশুরমশাই খাবেন না, ভাতের থালা ঠেলে উঠে যাবেন। সর্বদা খেয়াল করে বাড়িতে উপকরণ মজুত রাখতে হবে যাতে গ্রীষ্মকালের মাঝরাত্তিরে ইচ্ছে হলে, যা তাঁর মাঝে মাঝেই হয়, নারকেলর পুর ভরা পাটিসাপটা বানিয়ে দেওয়া যায়।
না হলে? আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
কেউ জানে না। কারণ কেউ প্রশ্নটা করেনি কখনও। ওই কেদারায় বসা কাউকে যে প্রশ্ন করা যেতে পারে, সেটাই কারও মাথায় আসেনি।
শ্বশুরমশাই যথাসময়ে তৈলচিত্র হয়ে পশ্চিমের দেওয়ালে ঝুললেন। শ্রাদ্ধশান্তি মিটিয়ে শোকতপ্ত, শ্রান্ত বিভূতি দত্ত কেদারায় বসলেন একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য।
আর সব বদলাতে শুরু করল। বদলে যে চেহারাটা নিতে শুরু করল, সেটা জগদ্ধাত্রীর চেনা। সান্নিধ্যের জায়গা নিল দূরত্ব, ভালোবাসার জায়গায় এল দাপট। পছন্দের থেকে কম তপ্ত ভাতের থালা আঙুল দিয়ে ঠেলে সরিয়ে পাথুরে মুখে নিঃশব্দে উঠে যেতেন বিভূতি দত্ত।
সোজা কথায়, বিভূতি দত্ত আপাদমস্তক কর্তামশাই হয়ে উঠলেন। জগদ্ধাত্রী বললেন, আর সবথেকে অদ্ভুত কী জানো? আমিও তোমার বাবাকে ভয় পেতে শুরু করলাম।
বাবাকে? আমার চেনা লোকটার সঙ্গে মেলাতেই পারছিলাম না। যিনি আমাদের আশীর্বাদ করতে গিয়ে বার বার চাদরে চোখ মুছছিলেন, আমার খাওয়াবেন বলে মাছ ধরানোর উত্তেজনায় যিনি নিজে প্রায় পুকুরে নেমে যাচ্ছিলেন, সেই মানুষটা?
পার্থকে এ রকম দেখেছ কখনও আগে?
চুপ করে গেলাম।
সত্যি বলব? নিজের জন্য যত না, তার থেকে বেশি তোমার বাবাকে ফিরে পাওয়ার জন্য আমি একদিন রাতে লক্ষ্মীর সঙ্গে ওই চেয়ার আর খড়মখানা ওই তেতালার ভাঙা ঘরে তুলে রেখে এসেছিলাম। তোমার বাবা তখন অফিসের কাজে ট্যুরে গিয়েছিল। হোটেলে থাকতে থাকতেই হয়তো অভ্যেস কমে এসেছিল, বাড়ি ফেরার পর সংসারের হাজারটা কাজে আর কেদারার কথা তোলেনি। যদি বা তুলত, আমি কথা ঘুরিয়ে দিতাম। আমি সত্যি ভেবেছিলাম, কেদারার অভিশাপ দত্তবাড়ি থেকে দূর হয়েছে।
যতদিন না আমি ছাদে ঘুরতে গিয়ে আবার সেটাকে খুঁড়ে আনলাম।
নিজের গালে ঠাস ঠাস করে চড়াতে ইচ্ছে হচ্ছিল।
যতদিন না তুমি ছাদে ঘুরতে গিয়ে সেটাকে খুঁড়ে আনলে। জগদ্ধাত্রীর চোখ কৌতুকে চকচক করে উঠল।
***
পার্থদার দিল্লিতে সেমিনার ছিল। দুর্গা বলে ওপরে এসে আমরা পড়ার ঘরে ঢুকলাম। কেদারাটা জানালার পাশে রোদ্দুরে বসে আছে। জগদ্ধাত্রী বললেন, ওটায় বসেছ কখনও?
উঁহু।
সাবধানে বসলাম কেদারায়। অনেকখানি পেছনে হেলে পিঠ পেতে দিলাম। দুই হাত ছড়িয়ে রাখলাম চওড়া হাতলের ওপর।
আহ, কী আরাম। চোখ বুজলাম। শরীরের মধ্যে আরাম ছাড়াও আরও কী যেন একটা বদল ঘটছে। একটা তেজ, পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে। বন্ধ চোখের আড়ালে পৃথিবীটা বদলে যাচ্ছে। আমার জন্য বাকি সবাই, সবকিছু। রাখলে আমি রাখব, মারবও আমিই। এ দুনিয়ার যা কিছু ভালো, যা কিছু সেরা, যা কিছু আমার কামনার, সব আমার জন্য তৈরি হয়েছে। চাইলেই, যখন খুশি আমি সেগুলো নিয়ে নিতে পারি। আমার ইচ্ছের সামনে আর কারও ইচ্ছের কোনও মূল্য নেই।
কেদারা ছেড়ে উঠে এলাম।
কেমন লাগল?
ভালো। আবার ভালো না-ও।
আমারও অবিকল অমনটাই লেগেছিল। নাও শুরু করো। শুভ কাজে দেরি করে লাভ নেই।
গ্যাস সিলিন্ডারের পেছনে রাখা প্লাস্টিক থেকে হাতুড়িটা বার করে আনলাম। জগদ্ধাত্রী প্রথম বাড়িটা মারলেন। হাতল টোল খেল। পাঁচনম্বর বাড়িতে ডানদিকের হাতল খসে পড়ল। জগদ্ধাত্রী হাঁপাচ্ছিলেন। আমি হাতুড়িটা হাত বাড়িয়ে নিলাম। জগদ্ধাত্রী বললেন, জোড়ার জায়গাগুলোয় মারো। সহজ হবে।
কুড়ি মিনিটের মাথায় কর্তামশাইয়ের কেদারা, কয়েকটা সেগুনকাঠের টোল খাওয়া ভাঙাচোরা ডাণ্ডায় পরিণত হল। একটা বস্তায় পুরে আমি সেগুলোকে নিচে জঞ্জালের জায়গায় রেখে আসতে যাব, জগদ্ধাত্রী পিছু ডেকে খড়মজোড়া বস্তায় পুরে দিলেন।
পার্থদা ফিরে এল। জগদ্ধাত্রী বললেন, এবার আমি যাব। আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে, চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেয়ে, জগদ্ধাত্রী বাঁশবেড়িয়া ফিরে গেলেন।
গাড়ি মোড় ঘোরা পর্যন্ত অপেক্ষা করে আমরা ফ্ল্যাটে উঠে এলাম। পড়ার ঘরে ঢুকে পার্থদা দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি পেছনে এসে দাঁড়ালাম। পার্থদার চোখ জানালার পাশের ফাঁকা জায়গাটার দিকে। যেখানে আমি আমাদের তুলে রাখা মোড়া আর মোড়ার সামনে পার্থদার পুরোন চপ্পল রেখে দিয়েছি। পার্থদা জানালার দিকে এগোল। চপ্পল পায়ে গলাল। মোড়ায় বসল, দুই হাঁটুতে কনুই রেখে। কয়েক সেকেন্ড সব স্থির।
লাফ দিয়ে মোড়া ছেড়ে উঠল পার্থদা। আমি কিছু বোঝার আগেই রান্নাঘরে ঢুকল।
চা খাবি তো?
দড়াম দড়াম ক্যাবিনেটের পাল্লা খুলছে, বন্ধ হচ্ছে।
লেবু দিয়ে খাবি না দুধ দিয়ে?
চোখের জল মুছে রান্নাঘরে ঢুকে পার্থদাকে জড়িয়ে ধরলাম। পার্থদা ঘুরে দাঁড়াল। অনেক, অনেক দিন পর আমি পার্থদাকে কিস করলাম। চোখ বুজে।
তারপরের গল্পটুকু কিসলোস্কি জানে।
সন্দীপ, দেখেছেন, আমি নিজে বাঙাল, সন্ধেবেলা লিমকা খেতে খেতে শ্বশুরবাড়ি গেছিলাম বলে গল্পেও তাই চালিয়ে দিয়েছি। ঠিকই বলেছেন, বাঁশবেড়িয়ার জমিদার ঘোর ঘটি, সকালবেলাই বউ বরণ হয়েছিল নির্ঘাত। থ্যাংক ইউ।
থ্যাংক ইউ, পার্থ।