রৌহিন ব্যানার্জী
অতঃপর নীতিশ তো লালুপ্রসাদের গুলিসুতো খেয়ে ফেলেছে। রাজ্যজুড়ে হইহই রইরই মারমার কাটকাট। ইতিমধ্যে নরেন্দ্র বলে বসল, “দুর্নীতিই যদি হবে, তবে লেজ নেই কেন?” সত্যিই তো, লেজ কোথায় গেল? পাত্র মিত্র অমিত কোবিন্দ সব হইহই করে উঠল-– ব্যাটাকে শূলে দাও-– ব্যাটার সাত দিনের ফাঁসি আর তিন মাসের বেল— থুড়ি-– জেল। তখন সবাই তেজস্বীকে আসামী হবার জন্য ধরল-– সে ব্যাটা ভাবল আসামী হলেও বোধহয় চারা খাওয়া যাবে, তাই রাজী হয়ে গেল। এতে বামেদের ভারী দুঃখ হল, তারা কারাতকে তেড়ে গালমন্দ করতে লাগল। কংগ্রেস সেই যে দেশে গেল, আর ফিরল না-– সবাই ভাবল সে মরে গিয়েছে।
এবং এই সকল প্যান্ডেমোনিয়ামের মধ্যেই সেই মহাআকাঙ্খিত আচ্ছে দিনের দিকে আরও এক কদম এগিয়ে গেল দেশ-– এক দেশ, এক জাতি, এক রাজনীতির সেই মহান স্বপ্নের নৌকায় সওয়ার হয়ে পড়লেন নীতিশ কুমারও। এবারে আর ভোটের ম্যান্ডেটটুকু নেওয়ার প্রয়োজনও হল না-– জনরায়কে উপেক্ষা করেই আরেকটা রাজ্য দখল হয়ে গেল বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে। না না, বিচারক মোটেই ঘুমাননি-– তাঁর চোখের ব্যারাম আছে তাই চোখটা বুজে শুনছিলেন সব।
এখন কথা হচ্ছে ভারতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে এই ঘটনাটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ-– আর কতটাই বা চমক সৃষ্টিকারী? বিহারের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বাইরেও কি এর কোনও সামগ্রিক ভূমিকা আছে? আরও জরুরি-– আমাদের পশ্চিমবঙ্গে কি এর কোনও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়তে পারে? এগুলি এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করব এক এক করে-– সেটুকুই এই লেখার স্কোপ।
রাজনৈতিক গুরুত্ব:- এই মুহূর্তে ভারতের রাজনীতিতে বিজেপি নেতৃত্বাধীন দক্ষিণপন্থী রাজনীতির জয়জয়কার। একের পর এক রাজ্যের উপনির্বাচন বা নির্বাচনে বিজেপির নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা-– উত্তরপ্রদেশ যার শেষ এবং চরমতম উদাহরণ। হাতে গোনা যে কয়টি রাজ্যে বিজেপি বিরোধী শক্তি প্রবল বা নিদেনপক্ষে কিছুটাও শক্তিশালী, তাদের একটা বিরাট ভরসা ছিল বিহার নির্বাচনের ফলাফল-– যেখানে এই প্রবল বিজেপি হাওয়াতেও রুখে দেওয়া গেছিল তাদের বিজয়রথ-– খোদ গো-বলয়ের অন্যতম প্রধান রাজ্যে। কিভাবে তা সম্ভব হয়েছিল? সম্ভব হয়েছিল বিরোধী ভোট ভাগ হতে না দিয়ে। যা আগে অসম্ভব মনে হত, সেই নীতিশ-লালু, বিহারের দুই যুযুধান শক্তির হাতে হাত মেলানোর মাধ্যমে। এই জোটের সাফল্যের পর, অন্যান্য রাজ্য, যেমন পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি বিরোধী সব দলের একজোট হওয়া উচিত কি না এ নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছিল। ফলে এই জোট ভাঙার অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক গুরুত্ব হিসাবে দেখতেই হবে যে এই ঘটনা অন্য রাজ্যে কিন্তু এ ধরণের জোট গড়ে ওঠার সম্ভাবনা অনেকটা কমিয়ে দিল। তা আখেরে বিজেপির কোনও সুবিধা করবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে-– আমরা নজর রাখব, বিজেপি বিরোধী রাজনীতির ধারাটি এবার কোনদিকে চলে সেদিকেও।
চমক উপাদান:- লালু-নীতিশের রাজনীতি, বিহারের বাস্তবের সাথে যারা পরিচিত তারা নিশ্চিত এই জোট ভাঙায় একটুও চমকাননি। ইন ফ্যাক্ট, নীতিশ কুমারের রাজনীতির সাথে পরিচয় থাকলে সহজেই বোঝা যায় নীতিশ বিজেপির স্বাভাবিক মিত্র। মুসলিম ভোট উত্তরপ্রদেশের মতো বিহারে তেমনভাবে নির্ণায়ক নয় প্রায় কোনও কেন্দ্রেই-– এখানকার রাজনীতি আবর্তিত হয় মূলত জাতপাতের ভিত্তিতে। যাদব বনাম কুর্মী, দলিত বনাম মহাদলিত, ব্রাহ্মণ বনাম দলিত, এরকম নানা সমীকরণকে কাজে লাগায় রাজনৈতিক দলগুলি-– লালু, নীতিশ বা বিজেপি কেউই এই খেলার বাইরে নয়। এবং সেই খেলার ওরিয়েন্টেশন ফলো করলেই কার ঝোঁক কোনদিকে সেটা বোঝা যায়। উপরন্তু “উন্নয়ন” এবং “সুশাসন” বলতে বিজেপি যে ধারণাটি দেশ জুড়ে চালাতে চায়, নীতিশ সেই ধারণার একজন ধারক-– নিজের প্রথম মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময় থেকেই-– ফলে শাইনিং বিজেপির সাথে তার সখ্যতা থাকাই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হল তা সত্ত্বেও নীতিশ লালুর সাথে জোটে কেন গেছিলেন আদৌ? গেছিলেন কারণ সেই মুহূর্তে বিজেপির সঙ্গে দর কষাকষিতে নিজের অবস্থানটাকে দৃঢ় করার প্রয়োজন ছিল তার-– সেটাই করেছিলেন। এই পুরো আখ্যানে চমকের উপাদান তাই বেশি নেই বললেই চলে।
এবং পশ্চিমবঙ্গ:- অনেকেই মনে করছেন, বিহার কাঁটা উপড়ে ফেলার পর এবার মোদী-অমিত জুটি পুরোপুরি বাংলার দিকে কনসেন্ট্রেট করবেন হয়তো। যদিও এর মধ্যে অনেকটাই উইশফুল থিঙ্কিং রয়েছে। যেমন নব্বই দশক অবধি প্রদেশ কংগ্রেস ভাবত তাদের হয়ে হাইকম্যান্ডই সিপিএমের সাথে লড়ে দেবে-– প্রদেশ নেতারা বেশ ক্ষীরটুকু খাবেন। সেটা কোনওদিনই হয়নি। তৃণমূল কংগ্রেস নিজেরা লড়ে, ছলে-বলে-কৌশলে যেভাবেই হোক, বাম শাসনের অবসান ঘটিয়েছে-– তখনও হাইকম্যান্ড মমতা নাকি বুদ্ধ, কার হাত ধরবেন তাই ভেবে গেছেন-– প্রদেশ কংগ্রেস ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চাই থেকে গেছে। তাদের তাও কিছু সংগঠন ছিল এবং আছে, প্রিয়রঞ্জন, গণি খান বা নিদেনপক্ষে শোভনদেবের মতো কিছু নাম ছিল-– রাজ্য বিজেপির অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। ফলে এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম-তৃণমূল এক ঘাটে জল খাবে এরকম মনে করার কোনও কারণ নেই। লালু-নীতিশ জোট থাকুক বা না থাকুক, তার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির স্লো পয়জনিং-এর স্ট্র্যাটেজি আপাতত চালু থাকবে-– এখানে ওখানে ভুয়ো খবর ছড়িয়ে বিক্ষিপ্তভাবে দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা, কোথাও সাফল্য পেলে তাই দিয়ে মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে বাজার গরম করা আর সাধারণ মানুষের মধ্যে গেঁড়ে বসা ইসলামোফোবিয়াকে কাজে লাগিয়ে একটু একটু করে জমি তৈরী করা। এগুলোর কোনওটাই বিহারের জোট ভাঙার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়-– এই বাংলায় “সম্পর্কতা বানাতে হলে যে সব প্রমিস বানাতে হবে” তার জমি আলাদা।
তাহলে কী দাঁড়াল? দাঁড়াল এই যে এই জোট, যা আজ না হয় কাল ভাঙারই ছিল, ভেঙে গেল। রাজনীতির বাজারে নীতিশ যেমন বিজেপির স্বাভাবিক মিত্র, লালু তেমনই বামপন্থীদের, তার এবং তার পরিবারের হাজারো দুর্নীতিতে জড়িয়ে থাকার পরেও-– কারণ ব্যক্তি লালু অসৎ হতেই পারেন, কিন্তু তাঁর রাজনীতি শ্রেণীসংগ্রামের কথাই বলে। ভারতীয় বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়েই বলে। এই বিষয়টা বামপন্থীরা, বিশেষত কমিউনিস্ট দলগুলি যত তাড়াতাড়ি বোঝে ততই মঙ্গল।
চমৎকার বিশ্লেষণ৷ লালুপ্রসাদের রাজনীতি শ্রেণীসংগ্রামের কথা বলে এটায় আপত্তি রয়ে গেল৷ পাপ্পু যাদব, সাহবুদ্দিনদের মত যারা কমিউনিস্টদের রক্তে হাত রাঙিয়েছিল তারা কিন্তু আরজেডির শেলটারেই ছিল৷ তবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লালুর রড়াই আপোষহীন৷ সেজন্যেই তিনি বামপন্থীদের স্বাভাবিক মিত্র৷
আরে লালু তো কমিউনিস্ট নয়। ফলে ওর শ্রেণীসংগ্রাম মার্ক্সবাদী শ্রেণীসংগ্রাম যে হবে না সে তো জানা কথা। আর বিহার ইউপিতে জাতের সাথে শ্রেণী প্রায় সমার্থক..