সৌভিক ঘোষাল
একদিকে যখন ভারতে দলিতদের ওপর একের পর এক নির্যাতন হচ্ছে, হায়দ্রাবাদ থেকে গুজরাট বা উত্তরপ্রদেশে দলিতদের বিক্ষোভগুলি আছড়ে পড়ছে, আন্দোলনের নেতাদের কারাবন্দি করে রাখা হচ্ছে, তখনই আমরা পেয়ে গেলাম আরও এক দলিত রাষ্ট্রপতিকে। রামনাথ কোবিন্দ।
কোবিন্দের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরিঘটনাটিকে ভালোভাবে বুঝতে আগে দলিত প্রসঙ্গটিকে ভালো করে বোঝা প্রয়োজন। এখানে সেই বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নেই বলে আমরা সরাসরি শুরু করব আমাদের সাংবিধানিক গণতন্ত্র নিয়ে আম্বেদকরের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দিয়ে। আমাদের সবারই জানা সংবিধান গৃহীত হবার সময় আম্বেদকর যে বক্তব্য রেখেছিলেন তাতে বেশ কিছু দুশ্চিন্তা ছিল। মধ্যরাতের স্বাধীনতার ভাষণে নেহরুর যে উচ্ছ্বাস তার তুলনায় আম্বেদকরের সংবিধান গ্রহণের মুহূর্তে দেওয়া ভাষণটি যেন অনেকটাই স্কেপটিক। কেন? আম্বেদকরের মনে হয়েছিল আমরা একটা গণতান্ত্রিক সংবিধান চালু করছি, কিন্তু তা তৈরি হচ্ছে একটা চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক সমাজকাঠামোয়।
পরের সাত দশকে আমরা এই অন্তর্লীন স্ববিরোধ বারেবারে লক্ষ করেছি। অগণতান্ত্রিকতার বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আম্বেদকর কয়েকটি জরুরি প্রসঙ্গ এনেছিলেন। বলেছিলেন আমাদের দেশটা ভক্তির দেশ। ধর্মে যখন ভক্তি আসে তখন তা ধর্মকে উদার করে দেয়। ভক্তি আন্দোলন আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্তু রাজনীতিতে ভক্তি এবং ব্যক্তিপুজো যদি আসে, সেখানে গণতন্ত্রের শেষ, ব্যক্তিপুজোর শুরু। বর্তমান প্রসঙ্গে কথাটা একারণেই তুলতে হল, কারণ দলিতদের সামগ্রিক উন্নয়ন দূরে থাক, তাদের ওপর একদিকে নানা আক্রমণ চালিয়ে অন্যদিকে একজন দলিতকে রাষ্ট্রপতি করে দেওয়াটা এক ধরনের টোকেনিজম এবং ব্যক্তিপুজো। এতে দলিত সমাজের কোনও প্রকৃত লাভ হয় না। অসাম্য বজায় থাকে ও গণতন্ত্র খর্ব হয়। মনে রাখতে হবে আমাদের সমাজে সাম্য ব্যাপারটা যে নেই, তার অন্যতম কারণ জাতিভেদ। আম্বেদকর বলেছিলেন জাতিভেদের জন্যই আমরা নেশন হইনি। এই নিরিখ থেকেই কাস্ট হল অ্যান্টিন্যাশনাল।
একদিকে ভারতে চলেছে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতির আধিপত্য। অন্যদিকে সমস্ত শাসক দলকে বৃহত্তম জনগণের ভোট সংগ্রহ করে ক্ষমতায় আসতে হয়েছে যার এক বড় অংশের মানুষ দলিত। আমরা শাসক দলগুলির রাজনীতি বিশ্লেষণ করে লক্ষ করি তারা দলিত প্রশ্নের সমাধান করে সামাজিক সাম্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা না করে তাদের মূলত ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে কাছে টানার চেষ্টা করেছে। এজন্য কখনও কিছু ওপর ওপর সংস্কার, কিছু সংরক্ষণ তারা করেছে। কিন্তু যখনই তলার দিকের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ওপরের রাজনীতিকে দলিতরা চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করেছে, তখনই শাসকেরা কখনও গণগত্যা, কখনও নানা মাত্রার নির্যাতন ও ভয় দেখানোর বিভিন্ন তরিকা ব্যবহার করে দলিতদের দাবিয়ে দিতে চেয়েছে। বিহারে দলিত আন্দোলন আশি ও নব্বইয়ের দশকে যখন নকশালবাদী বিপ্লবী রাজনীতির হাত ধরে ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে শুরু করে, তখন তাকে দমন করার জন্য তৈরি করা হয় রণবীর সেনার মতো এক কুখ্যাত প্রাইভেট আর্মি। ঘটে যায় বাথে বাথানিটোলা আরওয়ালসহ অসংখ্য নৃশংস গণহত্যা। আমাদের মনে পড়বে সেই দলিত গণহত্যাগুলির সময় রাষ্ট্রপতি পদে আসীন ছিলেন এক দলিত রাষ্ট্রপতিই। কে আর নারায়ণন।
অবশ্য দলিতদেরই মূল লক্ষ্য ও ভিত্তি করে দলিত পার্টিগুলি যে কিছু কাজ করেনি তা নয়। আম্বেদকরের তৈরি করা রিপাবলিকান পার্টি মহারাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে সক্রিয় ছিল। পরে এই দলের ক্রমদুর্বলতার পটভূমিতে আমরা “দলিত কা পার্টি”র উত্থান বিকাশ দেখেছি উত্তরপ্রদেশে। কাঁসিরাম-মায়াবতীর দলিত রাজনীতির ধারাটি যথেষ্ট আলোড়নও তৈরি করে। সাফল্য পায় দ্রুত। কিন্তু রিপাবলিকান পার্টির মতোই তারা দলিত প্রশ্নকে মূলত আইডেনটিটি ও সংরক্ষণের প্রশ্ন থেকেই অ্যাড্রেস করেছিল। শ্রেণির দৃষ্টিকোণটি ক্রমশ পেছনে চলে যেতে থাকে আর অনুপস্থিতি দেখা যায় জোরদার কৃষক আন্দোলনের। ফলে ক্রমশ তা দলিত ক্রিমি লেয়ারের স্বার্থের মুখ্য প্রতিভূ হয়ে ওঠে। সাময়িক সাফল্যের পর তার পতনের প্রেক্ষিতটি তার এই রাজনীতির ঘরানার মধ্যেই নিহিত ছিল।
চলে আসা যাক সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দিকে। বিজেপির দলিত রাজনীতির দিকে। শাসক দল হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই দলিত রাজনীতির ফাঁকা হয়ে আসা জমিটির দিকে বিজেপির নজর গেল। ব্রাহ্মণ্যবাদী অবস্থান বজায় রেখেও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য বিরাট সংখ্যক দলিতকে তার ভোটারে রূপান্তরের তাগিদ বরাবরই ছিল। মুসলিম বিপদের জুজুকে সামনে রেখে গোটা হিন্দু সমাজকে এককাট্টা করার চেষ্টা সে করল এবং তার এই রাজনীতি খানিক সাফল্যও পেল। উত্তরপ্রদেশের শক্ত জমিতেই সে মায়াবতীর দলিত ভোটের বড় অংশকে ছিনিয়ে নিতে পারল। ২০১৪-তে দলিত ভোটের ভালো অংশ করায়ত্ত করে সে একক ক্ষমতায় কেন্দ্রে সরকার গড়ল।
রাজনীতির জগতে পরিবর্তন খুব দ্রুত আসে। বিজেপি-আর এস এস-এর ব্রাহ্মণ্যবাদী অবস্থান তার নিজস্ব রাজনীতির ক্রিয়াতেই বেশ কিছু ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল। হায়দ্রাবাদে দলিত ছাত্রনেতা রোহিত ভেমুলার মৃত্যু গোটা দেশের ছাত্রসমাজ ও বৃহত্তর জনসমাজের মধ্যে আলোড়ন তুলল। মোদীর নিজের রাজ্য গুজরাটের উনায় দলিতরা হামলার মুখোমুখি হলেন। উত্তরপ্রদেশের সাহারাণপুরেও ঘটল এই ধরনের হামলার ঘটনা। দেশজুড়ে সংখ্যালঘুদের পাশাপাশি দলিতদের ওপর আক্রমণের ধারাবাহিক ঘটনাগুলি চর্চার বিষয় হয়ে উঠল। দলিত আন্দোলনও তলা থেকে নতুন চেহারায় আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করল।
দেশজোড়া দলিত আন্দোলনের নতুন জোয়ারের এই প্রেক্ষিতেই বিজেপির তরফে নামানো হল অতি পরিচিত প্রতিনিধিত্বের রাজনীতি। রামনাথ কোবিন্দ নির্বাচিত হলেন রাষ্ট্রপতি পদে। এটা আশ্চর্যের বিষয় নয় যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর এখনও কোবিন্দের মুখে আম্বেদকর বা দলিত নিপীড়ন নিয়ে কথা শুরু হয়নি। কিন্তু নয়া রাষ্ট্রপতির অভিষেক হয়েছে ধর্মীয় স্লোগান থেকে পলিটিক্যাল স্লোগানে রূপান্তরিত “জয় শ্রীরাম”-এর মধ্যে দিয়ে।
পরিস্থিতি কি শুধুই শাসকের কৌশলের বিজয়ের কথা বলছে? তা কিন্তু নয়। বিজেপির তরফে যখন প্রতিনিধিত্বের রাজনীতিকে সজোরে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে “দলিত” কোবিন্দকে রাষ্ট্রপতি করে, তখন ওপরের ভয়ংকর ক্ষমতার আস্ফালনের চ্যালেঞ্জ হতে পারে যে তলা থেকে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলি, তার এক আশাব্যঞ্জক উত্থান আমরা প্রত্যক্ষ করছি।
তরুণ দলিত নেতা জিগনেশ মেবানী বা উত্তরপ্রদেশের সাহারাণপুরের ভীম আর্মির চন্দ্রশেখররা ধরতে পেরেছেন দলিত সঙ্কটের সমাধান কেবল আইডেনটিটি পলিটিকস-এর মধ্যে নেই। জমি আন্দোলন ও অধিকার আন্দোলনের মধ্যে, দলিত রাজনীতির সঙ্গে শ্রেণি আন্দোলনের রাজনীতির সংশ্লেষ ঘটানোর মধ্যেই ভারতে দলিত সমস্যার সমাধানের মূল রাস্তাটি নিহিত আছে। দলিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মঞ্চ থেকে যখন জয় শ্রীরাম স্লোগান শোনা যায়, গণআন্দোলনের রাস্তা থেকে তখন ভেসে আসে স্লোগান— “গো কা পুছ তু রাখ লে/হামে হামারি জমিন দে দে।” গোরক্ষার রাজনীতি জিতবে না জমি জীবিকা অধিকার আদায়ের রাজনীতি, তার দিকে আমাদের নজর থাকবে। কারণ সেটাই নির্ণয় করে দেবে ভারতের রাজনৈতিক গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।