রক্তে মুসোলিনির ছানা কিলবিল করছে

শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় 

 



লেখক কবি ও স্পেনীয় ভাষা-সাহিত্যের অধ্যাপক।

 

 

 

 

হঠাৎ একদল গুন্ডা ঢুকে এলো ক্যাম্পাসে। মুখে রুমাল বাঁধা। হাতে লাঠি, হকি স্টিক। দিল্লি পুলিশের বিশেষ লাঠি, আচমকাই পিটতে শুরু করল নির্বাচিত বিশ্ববিদ্যালয়-প্রতিনিধিদের। শিক্ষকদের। যাঁরা মার খেলেন, রক্তাক্ত হলেন, তাঁরা বামপন্থী বা আমাদের চলমান উগ্র হিন্দু-তালিবান সরকারের বিরোধী। যারা মারল, তারা “অজ্ঞাতপরিচয়”। পরে ফেসবুকে বেরিয়ে পড়ল তাদের “প্রস্তুতি পর্বের” ছবি। চিহ্নিত হল এবিভিপি নামক শিশু তালিবান ছাত্রসংগঠনের নেতা। মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বাঁধেনি, পাছে ধরা পড়ে যায়। আমি যখন এই লেখা লিখছি, তখন এক হিন্দু দল এই ঘটনার দায় নিয়েছে। একেবারেই আলকায়দার মতো ভিডিও ছেড়ে।

একটা ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমার ছোটবেলার বারুইপুরে এক রোববারের সকাল। ১৯৮৯ সাল। বাবার সঙ্গে পুরনো বাজার নামক একটা অঞ্চলে গেছি। হঠাৎই স্থানীয় একটা মাঠে দেখি, খাকি হাফপ্যান্ট পরা একদল ছেলে হাতে লাঠি নিয়ে লাফালাফি করছে। বাবা বলেছিল, হনুমানের দল জামাকাপড় পরতে শিখেছে। এরপরেই শুরু হল করসেবা। জানলাম, স্থানীয় বারুইপুর হাইস্কুলের নামকরা শিক্ষক, স্থানীয় হনুমানদের জ্ঞানগুরু, তিনি গেছেন রামমন্দিরে ইট বসাতে। এরপর বাবরি ধ্বংস হল। এবং আমি তিরিশ বছর সময় নিয়ে দেখলাম, কীভাবে মিডিয়া থেকে বাবরি কথাটা উঠে গিয়ে রাম চলে এল। এবং সারা দেশ জুড়ে শেষপর্যন্ত চলেই এল রামরাজত্ব। 

ইতিহাস ইত্যাদি তেমন আর গুরুত্ব রাখে না। আসলে কোনওদিনই গুরুত্ব ছিল না। আমরা আমাদের নিজেদের মধ্যেই বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছি এক আস্ত ফ্যাশিবাদ। বেনিতো মুসোলিনির ছানা আমাদের রক্তে কিলবিল করেছে। আমাদের মফস্বলে (গ্রাম আরও কঠিন) ২০ পেরোনর পরেই নিজের পায়ে না-দাঁড়ানো মেয়েদের বিয়ে দেওয়া দেখেছি। দেখেছি পণ। সেইসব বিয়েতে কব্জি ডুবিয়ে খেয়েছি। তারপর নিজেদের বিয়ের বিজ্ঞাপন খবরের কাগজে জাতি-গোত্র মিলিয়ে ছেপে দিয়েছি। এখন অনলাইনে দিচ্ছি। বিয়ের পর চাকরির ব্যাপারে প্রথমেই যাকে আপস করতে হয়েছে, সে মেয়ে। বাচ্চা মানুষ করার দায়ে চাকরি ছেড়েছে মেয়ে। আমরা সেই সব মানুষদের সঙ্গে অনায়াস সামাজিক থেকেছি। অথচ আমরা এই সমাজে ঢোকার কয়েক বছর আগে কলেজে গলা ফাটিয়েছি। আমরা সে সস্ময় বর্ণব্যবস্থা নিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়েছি। অথচ চোখের সামনে একটা কমিউনিস্ট পার্টি শুধু উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মন্ত্রী বানিয়ে গেল, তা নিয়ে চুপ থেকেছি।

তার সঙ্গে জুড়েছে আমাদের অদম্য এলিটবাদ। যে আমরা প্রথমেই প্রশ্ন করি কোন কলেজ বা ইউনিভার্সিটি, যে আমরা পদবি দেখে ডাক্তার দেখাই, যে আমরা কলেজে পড়ালেও “বাঙালি না মুসলমান” বলে সগর্বে প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলি না, সেই আমাদের জন্য আজকের এই ভারতবর্ষই অপেক্ষা করে ছিল। আমরা নিজেরাই মৌলবাদী। আমরা শুধু ভেক ধরে থাকি। কিন্তু যারা গোড়া থেকেই মৌলবাদের প্রগাঢ় চর্চা করেছে তাদের এই ভেক নেই। তারা বলে দেয় পলিটিকালি ইনকারেক্ট কথা। আর এখন তাতে আমাদের কিছু লোকের গায়ে লাগে। কিন্তু সংখ্যাগুরুর লাগে না। কারণ তারা যা করে সেই কথাই স্পষ্ট করে বলছে এই মৌলবাদীর দল। আমরা যারা মাঝবয়সী তাদের জ্বালায় মেয়েরা খাটো পোশাক পরতে পারে না। এই মৌলবাদীরা তো তাই বলছে। বলছে পোশাকের জন্যই ধর্ষণ হয়। আমরা দুয়ে দুয়ে চার করেছি। হিন্দু-মুসলমান বিয়ে হলে তাই নিয়ে ব্লকবাস্টার সিনেমা হয়। অর্থাৎ এ জিনিস বাস্তবে হয় না। আমি বাংলার মুসলমান-প্রধান দুটি জেলায় জীবনের অনেকটা কাটিয়েছি। সেখানে মুসলমানরা হিন্দুদের সমস্ত সম্পর্কনাম জানলেও হিন্দুরা ফুফা-খালার তফাৎ জানে না। আমরা যত্ন করে একটা ভাষা তৈরি করেছি ৭০০ বছর ধরে নির্বীজ সংস্কৃতের মৃত শব্দের জোরে। আমাদের ভাষা দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় সংস্কৃত ভাষার গোরস্থান। আমাদের “সংস্কৃতির” ভাষায় “প্রাকৃতজনের” কোনও জায়গা নেই। একটা উদাহরণ দিই। দূরদর্শনের জমানায় sorry for the interruption কথাটার হিন্দি করা হত রুকাওয়াট কে লিয়ে খেদ হ্যায়, আর বাংলা করা হত অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটায় দুঃখিত। এবার ভাবুন। হিন্দিতে রুকাওয়াট বনাওয়াট জাতীয় দেশি শব্দ তাদের আনুষ্ঠানিক বাচনে ঢুকে গেছে। অথচ আমরা সাধারণ কথা বলতে গিয়ে তৎসম শব্দের ঝংকারে কুপোকাত। এইবার ভাবুন, হিন্দুস্তানের নব্য ফ্যাশিবাদীরা কী বাচনভঙ্গি চাপাতে চাইছে? কেমন তাদের হিন্দি? একদম তৎসম-প্লাবিত। এইবার তাকান নিজের দিকে। চেনা যাচ্ছে? যে জাতির ৬৫% ভাগ লোক মুসলমান আর শব্দভাঁড়ারের ২৫ ভাগ তৎসম সেই ভাষার আনুষ্ঠানিক বাচন কী করে তৎসম প্লাবিত হয়? হয়, কারণ আমাদের রক্তে কিলবিল করছে বেনিতো মুসলিনির ছানা। আর এটা শুধু আমরা নয় সর্বত্র। আজ যে বিভাজন সামনে এসেছে তার ভিত্তি আমরা দীর্ঘ শতাব্দি ধরে লালন করেছি। 

মনে পড়ছে এজরা পাউন্ডের কথা। সকলেই জানি পাউন্ড মুসোলিনির হয়ে রেডিও-তে অনুষ্ঠান করেছেন। উগ্র ফ্যাশিবাদী হয়ে গিয়েছিলেন। এই ঘটনার শাস্তি হিসেবে তাঁকে প্রকাশ্য চৌরাস্তায় খাঁচায় ভরে রাখা হয়। পরে মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচেন এলিয়ট হেমিংওয়ে-সহ তাবড় কবি-লেখকদের কথায়। এই ঘটনার অনেকদিন পরে ১৯৬৭ সালের ২৮ শে অক্টোবর পাউন্ড এক রেস্তোরাঁতে অ্যালেন গিন্সবার্গ ও সঙ্গী আরও দুজন লেখককে বলেন “The worst mistake I made was that stupid, suburban prejudice of anti-Semitism” আমাদের ভাষার পাউন্ডরা তো স্বীকার করার জায়গায় নেই। সে তো অনেক শতাব্দীর ব্যাপার।

এই রাগ হওয়া ও অসহায়তা নিয়ে দেয়ালে ঘুঁসি মারা ভাষাশ্রমিকের এখন রাস্তায় নামা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। গোটা দেশ যখন ভরে গেছে প্রকাশ্য ফ্যাশিবাদীতে, তখন আমাদের রক্তের মুসোলিনির ছানাদের শান্ত করার একমাত্র উপায় রাস্তায় নামা। প্রতিবাদ করা। এবং এ-কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, এরা এনআরসি দিয়ে দিয়ে শুধু বাংলাভাষীকেই চিহ্নিত করতে চাইছে। এদের “ঘুসপেটিয়াঁ” হল বাংলাভাষী মানুষ। এবং আরও ভুলে গেলে চলবে না অসমের লোক সিএএ বিরোধিতা করছে তাদের অসমীয়া পরিচয় বজার রাখার মৌলবাদী ধারণা থেকে। সেখানে তাদের লক্ষ্য বাংলাভাষীরা। সেই বিদেশি-ভীতি থেকে শুরু হওয়া মৌলবাদ আজ ছড়িয়ে গেছে গোটা দেশে। তার নেতৃত্বে একটাই দল। 

আর এইখানেই আমার শাহীনবাগ (আমি হ্রস্ব ই লিখব না। কারণ সংস্কৃতও আমার কাছে বিদেশি ভাষা। সেখানে দীর্ঘস্বর চলে মৌলবাদী কারণে)। এখানেই আমাদের তরুণ প্রজন্ম। আমি শাহীনবাগে গিয়ে দেখেছি, কী আশ্চর্য সেই অবস্থান। যেখানে মা দিদিমারা বসেছেন ভবিষ্যতের দাবি নিয়ে। মনে পড়ে যাচ্ছে ৩০ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে, তানাশাহ খোর্খে রাফাএল বিদেলার বিরুদ্ধে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মেরে ফেলা (সরকারিভাবে নিরুদ্দেশ) তরুণদের মায়েদের বিক্ষোভ সমাবেশ। এমনকী তাঁরা একটি বেতারকেন্দ্রও চালু করেন। আজ তাঁরা বিখ্যাত “প্লাসা দে মায়ো-র মায়েরা” নামে। আজ শাহীনবাগের মায়েরা আমাদের অপেক্ষায়। আমাদের এতকাল চলে আসা অবিচারের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর একটাই সুযোগ। হয়তো বা শেষবারের মতো।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4656 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...