কৌশিক দত্ত
লেখক কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক এবং স্নায়ুরোগবিশেষজ্ঞ।
এখানে ক্রোধ লেখার কথা, ঘৃণা লেখার কথা। ফুঁসে ওঠা পৌরুষে তুলে ধরার কথা বজ্রমুষ্টি। দাবিটা ন্যায্য। দাবিটা সময়ের। সময়টা তেমনই। এখনও যদি ক্রোধ না আসে, তবে কবে আসবে? কবে জাগবে নওজোয়ান? দুর্ভাগ্যক্রমে আমার পুরুষ হয়ে ওঠার পথে ব্যারিকেড ছিল অনেক। মানুষের প্রতি অবিমিশ্র ঘৃণা অর্জন করতে পারিনি। কোনও মানুষের প্রতিই না। এমনকি ঘাতকের প্রতিও। দীর্ঘস্থায়ী ক্রোধ সঞ্চয় করে রাখার জন্য প্রয়োজন যে লৌহ আধার, তেমন কাঠিন্যে তৈরি হয়নি দেহ-মন। অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। তাই মূর্খ ঘাতককে দেখে প্রতিহিংসার বদলে বিস্ময় জাগে মাঝেমাঝে। মানুষ এমন হয় কী পদ্ধতিতে? প্রশ্ন জাগে। আর জাগে আতঙ্ক। সহমানুষের কথা ভেবে, পৃথিবীর কথা ভেবে… এমনকি স্বয়ং ঘাতকের ভবিষ্যৎ ভেবে আতঙ্ক হয়। আমি বীরপুরুষ নই। আমি আতঙ্কই লিখব নির্লজ্জভাবে।
হিংসা আর অবদমন আমরা আগেও দেখেছি। আগেও ভয় পেয়েছি। পাশের মানুষকে সন্দেহ করতেও শিখেছি সেই ভয়ের হাত ধরে। তবু এই সময়কে অভূতপূর্ব লাগছে। যেভাবে দেশকে, দেশের সংস্কৃতি আর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে, দেশের মানুষকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার চেষ্টা শুরু হয়েছে, এমনটা আগে দেখিনি। এই মুহূর্তের সঙ্কট এক অন্য মাত্রার। সারা পৃথিবী জুড়েই হৃদয়হীন, বিবেকহীন, মানবিক মূল্যবোধহীন উগ্র দক্ষিণপন্থীরা ক্রমশ ক্ষমতা নিজেদের কুক্ষিগত করছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে জীবনযাপনের দৈনন্দিন ক্লেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমশ বাড়ছে হতাশা, ক্ষোভ। এই ক্ষোভ ক্রোধ হয়ে যেকোনওদিন মূল সমেত উপড়ে ফেলতে পারে অত্যাচারী শাসকের সদম্ভ প্রতিষ্ঠাকে। সেই সম্ভাবনার বিষয়ে বৃহৎ পুঁজির কর্পোরেট মালিক এবং তাঁদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার ভারপ্রাপ্ত দেশ-শাসকেরা সম্যক অবগত আছেন। সেই কারণেই নানা কূট কৌশলে তাঁরা দখল নিচ্ছেন জনসাধারণের ক্ষোভেরও। ক্ষোভকে ক্রোধ হয়ে উঠতে বাধা দিচ্ছেন না, কিন্তু তাকে পরিচালিত করছেন বিপথে।
ভারতের কথা ধরা যাক। স্বল্পসংখ্যক ধনীতম ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখতে গিয়ে সরকার একের পর এক এমন নীতি নিলেন (বস্তুত অনৈতিক কাজ করলেন) যাতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো ধ্বংস হবার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে ধসে গেল। সেই বিপর্যয় থেকে মুষ্টিমেয় প্রিয় বণিকদের আড়াল করতে গিয়ে এবং তাঁদের অফেরতযোগ্য ধার দেবার উৎস হিসেবে কাজ করতে থাকা গৌরী সেন ব্যাঙ্কগুলোকে সচল রাখার জন্য নোটবন্দি জাতীয় ভয়াবহ পদক্ষেপ নিয়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক তথা ছোট ব্যবসায়ীদের চূড়ান্ত দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিলেন। বাজারের আরও বেশি অংশ রিলায়েন্স জাতীয় বৃহৎ কর্পোরেট গোষ্ঠীর দখলে আনার লক্ষ্যে সরকার সিদ্ধান্ত নিলেন যে ফুটপাথ বা ছোট দোকানে নিজেদের ক্ষমতানুসারে ব্যবসা করা মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত ব্যবসায়ীদের স্বাধীনভাবে ব্যবসা করার ক্ষমতা একেবারে শেষ করে দিতে হবে। সেই লক্ষ্যে করব্যবস্থার পরিবর্তন, ক্যাশলেস ইকোনমির জন্য চাপ দেওয়া ইত্যাদি একগুচ্ছ পদক্ষেপ নেওয়া হল। পাশাপাশি হু হু করে বাড়ল খুচরো ব্যবসায় কর্পোরেট বিনিয়োগ। এখন প্যাকেট বন্দি ঝালমুড়ি বিক্রি করা সুসজ্জিত মলের এবং সেই প্যাকেটজাত মশলা-মুড়ির উৎপাদক সংস্থার সরাসরি টক্কর ফুটপাতের ঝালমুড়ি বিক্রেতার সঙ্গে। এই যুদ্ধে সরকারের কর্তব্য ছিল দুর্বলতরকে রক্ষা করা। বদলে সরকার সেই দুর্বলেরই টুটি টিপে ধরলেন নানারকম অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে।
এতসব করেও বর্তমান ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার সঙ্কট সামলানো যাচ্ছে না। মন্দা আসছে দ্রুত পায়ে। জিডিপির পারদ নামছে হু হু করে। মাঘমাসের শীতে কেঁপে উঠছে বাজার। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে আর অগ্নিমূল্য হচ্ছে খাদ্য, ওষুধ আর নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। বাজার বসে আছে হাম্পটি-ডাম্পটির মতো দেওয়ালে মাথায় মহাপতনের প্রতীক্ষায়। এ হল সেইরকম ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যখন ফ্যাসিবাদের প্রকোপ দেখা যায়। জার্মানি, ইতালিতে হয়েছিল যেমন, অনেকটা তেমনই পরিস্থিতি। ভারতেও ফ্যাসিস্ট শক্তি ক্রমশ দাঁত-নখ বের করছে। এই দেশে এই বিশেষ ঘরানার আগ্রাসন, লোভ, বিবেকহীন হিংস্রতা আগে দেখা যায়নি। আগে আমরা যা দেখেছি, তা এর ট্রেলারও নয়। হিংস্রতা মাত্রেই নিন্দনীয় হলেও, ফ্যাসিবাদী অবলম্বন এক সম্পূর্ণ ভিন্ন স্তরের, ভিন্ন গোত্রের জিনিস, যা কোনওরকম নীতি (এথিকস) মানে না।
জনগণের ওপর ফ্যাসিবাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন এটা নিশ্চিত করা যাতে জনগণ নিজেদের ‘জনগণ’ বলে ভাবতে না পারে। ফ্যাসিবাদী শাসক হলেন প্রভু, কিন্তু ‘জনগণমন অধিনায়ক’ তাঁরা নন। তাই জনমানসের ওপর প্রভুত্ব করার পদ্ধতি তাঁদের ক্ষেত্রে বিকৃত এবং নেতিবাচক। বিসমার্কের হাতে বিখ্যাত হওয়া ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ নীতিটি এখন ‘পোস্ট ট্রুথ’ জমানায় হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ডিভাইড, ডাইভার্ট, ডিসিভ অ্যান্ড ডিকটেট’। সাধারণ মানুষের মধ্যে ফাটল ধরানো হল এর প্রথম ধাপ। মানুষকে নানা গোষ্ঠীর পরিচয়ে বেঁধে দিয়ে পরস্পরের শত্রু বানিয়ে দেওয়া, পরস্পরের বিরুদ্ধে লেকিয়ে দেওয়া, রক্তক্ষয়ে বাধ্য করা এবং সেই মিথ্যা অন্তর্দ্বন্দ্বে জনগণের সময় ও শক্তিকে ক্ষয় করে ফেলাই হল তাঁদের ওপর রাজত্ব করে যাবার উপায়। সেই লক্ষ্যে ভারতে ব্যবহার করা হচ্ছে ধর্মীয় পরিচয়কে। হিন্দু-মুসলমানকে লড়িয়ে দিয়ে ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধভাবে জেগে ওঠার সম্ভাবনাকে নষ্ট করা হচ্ছে।
পাশাপাশি চলছে নিত্যনতুন নিয়ম, পরিচয়পত্র, ফর্ম, এনআরসি ইত্যাদির চক্করে মানুষকে ব্যস্ত এবং সন্ত্রস্ত রাখার প্রক্রিয়া, যাতে নিজেরটুকু গোছাতেই সবাই পাগল হয়ে যায়। সরকারি নির্দেশিকা বা ভাষ্যের স্থিরতা নামক ব্যাপারটিও অবলুপ্ত। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কোষাগার লুণ্ঠিত। আইনের শাসনের জন্য মানুষের শেষ ভরসাস্থল পুলিশ ও আদালতকেও অভাবনীয়ভাবে গ্রাস করেছে রাজনৈতিক ক্ষমতা। আগে আমরা ভাবতাম, রাজনৈতিক দলগুলো দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করলেও প্রশাসন এবং আদালত তা রোখার চেষ্টা করবে। এখন দেখা যাচ্ছে সরকার স্বয়ং রোজ চেষ্টা করছেন দাঙ্গা লাগানোর। পুলিশ আগুন জ্বালাচ্ছে বাসে। রোজ নানাভাবে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে অকারণে মানুষের উপর আক্রমণ চালিয়ে পুলিশ নিজেই চেষ্টা করছে কিছু জনগোষ্ঠীকে ক্ষেপিয়ে দেবার, যাতে কেউ উত্তেজিত হয়ে খুনোখুনি শুরু করে এবং দেশজুড়ে নরঘাতী দাঙ্গার জন্ম হয়। কোথায় যাবে, কার দরজায় যাবে মানুষ? কোথায় পাবে সামান্য মানবিক আশ্বাস, দুই দণ্ডের শান্তি? এই আতঙ্ক অভূতপূর্ব। এর সঙ্গে আমরা পরিচিত ছিলাম না।
এই প্রক্রিয়াকে সার্থকভাবে রূপায়িত করতে হলে মানুষের মগজের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে হবে। মগজে কারফিউ জারি করার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক মানুষের শিক্ষা। শিক্ষা তাই অশুভ শক্তির বা অত্যাচারী শাসকের চক্ষুশূল। বেছে বেছে তাই শিক্ষিত মানুষ, চিন্তাশীল তরুণ প্রজন্ম আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আক্রমণ করা শুরু হয়েছে। আলিগড়, আহমেদাবাদ, দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদিতে শুরু হয়েছে ভয়াবহ সন্ত্রাস। জেএনইউ-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো, যারা কর্পোরেট মালিকদের চাকর তৈরিতে বিশেষ সাহায্য করে না, বদলে চিন্তাশীল নাগরিকের জন্ম দেয়, তারা ফ্যাসিবাদীদের বিশেষ মাথাব্যথার কারণ। এদের বদনাম করার এবং ভেতর থেকে ঘুণ ধরিয়ে নষ্ট করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। তাসত্ত্বেও যখন যথেষ্ট সাফল্য এল না, তখন শুরু হল শারীরিক আক্রমণ। মুখে ফেট্টি বেঁধে রাতের অন্ধকারে রড হাতে ছাত্রীদের হস্টেল আক্রমণ করে চলল অকল্পনীয় সন্ত্রাসবাদী তাণ্ডব। যে দিল্লি পুলিশ মাত্র কদিন আগে জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ঢুকে পাঠরত ছাত্রছাত্রীদের পিটিয়ে এসেছে, সেই পুলিশ জেএনিউ কাণ্ডের সময় ছাত্রীদের উদ্ধারের চেষ্টা না করে গেট আগলে নিশ্চিত করল যাতে গুণ্ডারা নির্বিঘ্নে তাণ্ডব চালাতে পারে, যাতে বাইরে থেকে কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ভেতরে ঢুকে ছাত্রীদের সাহায্য করতে না পারে। হাঙ্গামাকারীদের ছবি দেখার পরেও পুলিশ যথারীতি তাদের গ্রেপ্তার করতে পারছে না। এ এক নিদারুণ প্রহসন। সরকার স্বয়ং গুণ্ডাবাহিনীর সাহায্যে নিজের দেশের রাজধানী শহরের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়টিকে আক্রমণ করছেন! এরপর আর কী বাকি থাকে? সিরিয়ার আসাদ সরকারের মতো স্বদেশবাসীর উপর বিমান থেকে বোমা ফেলতে বোধহয় আর বেশি দেরি নেই।
আমরা স্তম্ভিত। আমরা আতঙ্কিত। বিবেকবান নাগরিকদের মধ্যে যাঁরা ক্রোধ জানেন, তাঁরা ক্রোধে ফুঁসছেন। আর আমরা, যারা বাঘ নই, তারা বিপন্ন বোধ করছি দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বেড়ালের মতো। বেড়ালকে কখনও চারদিক বন্ধ করে মারতে নেই। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সেই ক্ষুদ্র প্রাণী স্রেফ ভয় পেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। সেইসব মুহূর্তে কে নাকি তাদের কানের কাছে গেয়ে ওঠে, “মার খেতে খেতে বেধড়ক মার খেতে, মরে যেতে যেতে বেঁচে থেকে মরে যেতে, বেঁচে নিতে যদি একবার, বড় ভালো হত।” বেড়াল যখন বুঝতে পারে যে তার মৃত্যু নিশ্চিত, তখন সে নাকি শেষ লাফটা দেয় আক্রমণকারীর কণ্ঠা লক্ষ্য করে। এদেশে এখন কোটি কোটি দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বেড়াল।
আতঙ্কিত হতে হতে একসময় ভয় ক্লিশে হয়ে যায়। যখন দেখি যাই করি না কেন, এরা আরও চেপেই ধরবে, মেরেই ফেলবে, তখন শাসকের কথা শুনে চলার ব্যাপারে অনীহা এসে যায়। যখন দেখি পালাতে পালাতে খাদের ধারে এসে দাঁড়িয়েছি, পায়ে আর শক্তি নেই, অশক্ত শরীর আর পারছে না, তখন মনে হয়, ধুস! আর পালিয়ে কী হবে? বাঁচব তো না কোনোভাবেই, তাহলে একবার ঘুরেই দাঁড়াই। সশস্ত্র শাসকের চেয়ে আমার গায়ের জোর বেশি, এমন ভ্রান্ত বিশ্বাসে ঘুরে দাঁড়ানো নয়। মরে যাব, এই স্থির প্রত্যয়ে, মৃত্যু সম্বন্ধে ভয় পেতে পেতে ভয়ের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে যাওয়ায় ঘুরে দাঁড়ানো। অত্যাচারীর মুখে ঘৃণার থুতু ছিটিয়ে দেবার ইচ্ছেটুকুও নেই, স্রেফ শান্তভাবে তার চোখে চোখ রেখে দাঁড়ানোর, হাসি ছুঁড়ে দেবার, তার প্রতিটি হুঙ্কারকে অবজ্ঞা করার লোভে ঘুরে দাঁড়ানো। আমাদের মাথাগুলো কেটে ফেলার মুহূর্তে সেই বিজয়ের গর্বের বদলে পরাজয়ের গ্লানি অনুভব করবে, সশস্ত্র হওয়া সত্ত্বেও তার রক্তে বয়ে যাবে ভয়ের হিম স্রোত… এই কথাটা নিশ্চিতভাবে জেনে ঘুরে দাঁড়ানো। অথবা হয়ত মৃত্যুর আগের মুহূর্তে বেড়ালের মতো লাফ… কণ্ঠনালীর দিকে।
জার্মানি, ইতালি, স্পেন, চিলে, পেরু, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া… পৃথিবীর নানা জায়গায় অত্যাচারী রাজনৈতিক শক্তি কিছু সময়ের জন্য ভতাবহ অত্যাচার চালিয়েছে। তারা নিজেদের ভেবেছে সর্বশক্তিমান, কিন্তু বেশিদিন টিকতে পারেনি। ইতিহাসের এই শিক্ষাটা আগ্রাসী শাসকেরা ভুলে যায়, কিন্তু শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম মনে রাখে। ভারতের শিক্ষিত নওজোয়ান তাই মার খাবার পর অনায়াসে হাসিমুখে ফয়েজের গান গেয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন, “হাম দেখেঙ্গে…”। তাঁরা নিশ্চিত সাম্যের, সৌন্দর্যের, শান্তির প্রভাত তাঁরা দেখবেনই একদিন। এই চ্যালেঞ্জের মধ্যে স্বপ্ন আছে, প্রত্যয় আছে, কোনো হুমকি নেই, প্রতিশোধস্পৃহা নেই। এই চ্যালেঞ্জ বড় প্রিয় আমার। এঁদের মুখ চেয়ে আরও দুদিনক বেঁচে থাকি, এই তরুণদের জন্য দুনিয়া বাঁচাতে অঙ্গীকারবদ্ধ হই।
যাঁদের ক্রোধ হয়, তাঁরা অনেকে প্রতিশোধের কথাও ভাবছেন এখনই। প্রতিটি রক্তবিন্দুর হিসেব রাখা হচ্ছে, প্রত্যেক দুরাচারীর মুখ মনে রাখা হচ্ছে, এই অত্যাচারী সরকার যখন মুছে যাবে, তখন সব হিসেব বরাবর করা হবে… ইত্যাদি। এমন প্রতিশোধে আমার বিশেষ আস্থা নেই। হাজার হাজার বছর ধরে বহু প্রতিশোধের পথ পেরিয়েই তো আমরা আজ এখানে পৌঁছেছি। যেসব চেনা মুখ আজ অচেনা লাগছে, যাঁরা ফ্যাসিবাদীদের সমর্থন করছেন, সূর্যের ভোরে তাঁদের ওপর প্রতিশোধ চরিতার্থ করার বদলে হিংস্রতার রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাকেই শেষ করে দেবার স্বপ্ন দেখি, যাতে পট-পরিবর্তনের পর নতুন অত্যাচারীর হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত না হতে পারে। প্রতিশোধ চাই না, কিন্তু সূর্যোদয় অবশ্যই চাই। সূর্য ওঠার পর যদি বেঁচে থাকি দৈবাৎ, তাহলে লাঠি দিয়ে আজকের পথভ্রষ্ট অচেনা মূর্তি ধরা চেনা মানুষদের মাথা ভেঙে দেবার কোনও ইচ্ছা নেই, কিন্তু এই রাত পেরোনোর পথে তাদের হাতের ফ্যাসিবাদী লাঠি অবশ্যই ভেঙে দেব… প্রয়োজনে নিজের মাথা দিয়ে।