তৃষ্ণা বসাক
লেখক কবি, গদ্যকার এবং অনুবাদক।
‘ফিরাক’ সিনেমায় (পরিচালক- নন্দিতা দাশ) ধ্রুপদী সংগীতশিল্পী নাসিরুদ্দিন শাহ দাঙ্গা-পরবর্তী মহল্লায় বেরিয়ে তাঁর চিরকালের পরিচিত ল্যান্ডমার্কগুলো খুঁজে পাননি। আমরা আজ নিজেদের দেশটাকেই খুঁজে পাচ্ছি না।
এরকমভাবেই শুরু করব ভেবেছিলাম। কিন্তু লিখতে গিয়েও থমকে যাই। আমরা কি তাহলে প্রত্যেকেই রিপ ভ্যান উইঙ্কল? এমন ঘুমঘোরে ছিলাম যে মনোহর কখন এসে শিয়রে শমনের মতো দাঁড়িয়েছে,জানতেই পারিনি? উলটে বলেছি নমো নমো, ঠাকুর হয়, গড় করো হে গড় করো।
এখন বলছি, কারণ জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় নামটা। আমরা জানি, প্রতিবাদের একটা বাজার আছে। পেঁচির মায়ের ধর্ষণআর পদ্মমধু সেনেরনিগ্রহের বাজার আলাদা। কিংবা, একটার বাজার নেই, আর একটার আছে। একটায় দুঃখের স্মাইলি দিলে চলে, আরেকটায় হাতে মোমবাতি নিয়ে হাঁটতে হয়।
তবে মোমবাতি এমন একটা জিনিস, বেশিক্ষণ হাতে ধরে থাকলে গলন্ত মোম হাতে পড়ে, বড় জ্বালা। সেটা জানা সত্ত্বেও মোমবাতিই আমাদের ভরসা। বেঁচে থাক কুটির শিল্প। আসলে আমাদের প্রতিবাদ কুটির শিল্পের বেশি কিছু না। আসলে আমরা দেশভাগ, দাঙ্গা এসব দেখার পরেও কেউ ধর্মের নামে সুড়সুড়ি দিলে গলে যাই, আর আমাদের বাপ-পিতামোর পিকদানিটা, সতীদাহটা, তিন তালাকটা, -কত ভালো ছেল গো-বলে ডোকার ছেড়ে কাঁদতে বসি। আর এর জন্যে আমাদের একটা শত্রু খাড়া করতেই হয়। কখনও শত্রু নেড়ে, কখনও শত্রু হিঁদু, কখনও আবার কেরেস্তান! কখনও আবার এই দু পাতা ইংরেজি আর বিজ্ঞান পড়ে উচ্ছন্নে যাওয়া বিশ্ব বিদ্যালয়ের তাজা তাজা ছেলেমেয়েগুলো, যাদের গলার আওয়াজ রাষ্ট্রের কানে না পৌঁছক, ঈশ্বরের কানে ঠিক পৌঁছয়।
বিশ্বায়িত, সাইবার জালের পৃথিবী যখন হাতের মুঠোয়, যখন দেশের প্রায় সব ঘর খালি করে তরুণ তরুণীরা বিদেশের মাটিতে কাজ করছে, তখনো আমাদের মগজ ধোলাই করা হয়, কাগজ লাগবে, কাগজ। আর আমরা অমনি বাপ দাদা পরদাদার বাক্স প্যাঁটরা হাঁটকে কাগজ খুঁজতে লেগে যাই।
আমাদের রাস্তায় কেউ হাঁটলে, তার ছায়ায় আমাদের পা পড়লে জাত যায়। জাতের আগে যে ভাত সে কথা কে বলে? তাই যাদের বলা উচিত ‘ভাত দেবার ভাতার নয়, কিল মারবার গোঁসাই,’ তাদের আমরা ধূপ ধুনো গুগগুল জ্বালিয়ে বসাই। কারণ, সব যায় যাক, ধম্মো কম্মো তো রাখতে হবে।আরে মশাই, যে গরু দুধ দেয়, তার লাথি খাওয়া যায়, কিন্তু দুধ না দিয়ে হঠাৎ সোনা দিতে শুরু করলে মুশকিল। সোনা তো আর খাওয়া যায় না!
আমরা সত্যি স্বপ্নোত্থিত। কারণ হাতের কাছে দেখছি মৈথিলী কবিরা কী সব কবিতা লিখে ফেলেছেন সেই গুজরাট দাঙ্গার সময় থেকে।
অজিত কুমার আজাদ
নৈঃশব্দ
তাঁকে মারা হল
এ নিয়ে আমার কোন দুঃখ নেই
খোলা বাজারের মধ্যে
সবার সামনে মারা হল
এ নিয়েও আমার একটুও দুঃখ নেই
তাঁকে তড়পে তড়পে মারা হল
এনিয়েও আমার একটুও দুঃখ নেই
আমার স্রেফ দুঃখ এটাই
যে সবাই কেন চুপ করে ছিল তখন
সবাই কেন চুপ করে আছে এখনো?
মৃতের বয়ান
প্রথমে আমার নাম জিজ্ঞেস করা হল,
শুনে বিশ্বাস হল না।
তারপর ওদের নজর পড়ল
আমার গলায়।
দেখে বুঝতে পারল না
ওটা মাদুলি না তাবিজ
তখন সবার সামনে ওরা আমাকে নগ্ন করে দেখল,
তবু ওদের বিশ্বাস হল না।
শেষমেষ ওরা আমাকে মেরে ফেলল
কিন্তু তাজ্জব ব্যাপার,
তারপরেও ওরা নিশ্চিন্ত হতে পারল কোথায়?
আর সব শেষে গান্ধি
(গুজরাটের দাঙ্গায় নিহত নির্দোষ মানুষের নামে)
জন্ম ১৮৬৯
মৃত্যু ১৯৪৮
দাহ ২০০২
দেবেন্দ্র কুমার দেবেশ
মিথ্যের চাষ
সত্যের কথা ছিল নীতির সঙ্গে থাকার,
ধর্মের সঙ্গে থাকার, ন্যায়ের সঙ্গে থাকার,
সত্যের সত্য হবার কথা ছিল,
কিন্তু
নীতি মিথ্যাকে আপন করে নিল,
ধর্ম হাত মেলাল শক্তির সঙ্গে,
আর ন্যায় মিশে গেল সরকারের ডান্ডার সঙ্গে,
তাহলে সত্য বেচারা কোথায় যায়?
সে রাজার মুঠোয় এসে গেল।
ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন। এখন ঐশী, কনাহাইয়া এদের নিয়ে খোয়াব দেখছি আবার। সব ওরা করে দেবে, ওরা মার খাবে, রক্ত ঝরাবে (চিৎপুরের অধিকারী মশাই অবশ্য বলেছেন অক্ত নয় অক্ত নয় আনি অং)। হায় দুর্ভাগা এই দেশ, যেখানে শুধু নেতারই দরকার হয়। আমরা শুধু লাইক দেব। আগে ছিল তালিয়া, এখন লাইক। লাইক দিতে বুদ্ধি লাগে, আবার হাতেও ব্যথা হয়। তাই বুদ্ধিজীবী বলো বুদ্ধিজীবী, শ্রমজীবী বলো শ্রমজীবী।
তবে, এখন যা অবস্থা, পিঠ পুড়ছে, ফিরে শোয়ার সময়টুকুও নেই ভাইসব। ‘ফিরাক’ সিনেমায় নাসিরুদ্দিন বলেছিলেন সুর ঠিকঠাক লাগছে না। সুর তো কবেই কেটে গেছে। তার ছিঁড়ে গেছে। এখন ছেঁড়া তার, ভাঙ্গা মন, বেসুরো গলায় যে যেমন পারুন গান। গাইতে গাইতে গলা ভেঙে যাবে, তবু গান থামাবেন না। গানকে ওরা ভয় পায় যে।