প্রশান্ত ভট্টাচার্য
লেখক কবি ও সাংবাদিক।
আমরা পাকস্থলিতে বারুদ রেখেছি
সাহস থাকলে পেটে লাথি মারার হিম্মত দেখা।
আমার দুহাতে আত্মজের দ্রোহের আগুন
দম থাকলে করমর্দন কর শাহানশা।
হ্যাঁ, ৫ জানুয়ারির পর থেকে এটাই চেতনার পরতে পরতে বয়ে যাচ্ছে। এখন যদি চুপ করে থাকা শ্রেয় বলো, তবে তো বিলজিবাবের লাভ।
ফ্যাসিস্টরা আমাদের দেশের দখল নিয়েছে। প্রতিবাদের গর্ভগৃহে আঘাত করছে। কেননা, ওরা ভয় পেয়েছে। সাহসী ছাত্রদের কণ্ঠস্বরে ওরা ভীত। ঐশী শক্তির কাছে দানবের মূলাধার চক্র নড়ে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যার পীঠস্থান জেএনইউতে হিংসার ঘটনায় সেই ভয়েরই প্রতিফলন। মুখোশের আড়ালে তাই নাগিনীর বিষাক্ত নিঃশ্বাস। ওদের হিন্দুত্বের কর্মসূচির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো জেএনইউর বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের ওরা ভয় পেয়েছে। আর এই ভয় দেখাতে গিয়ে ওরা এক ক্রোধের জন্ম দিয়েছে। যারা ছিল রাজনীতি থেকে যোজন দূরে, শিক্ষার উৎকর্ষ কেন্দ্র সেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছেলেমেয়েরা আজ রাস্তায় নেমেছে। কে কবে শুনেছে, দিল্লির অভিজাত সেন্ট স্টিফেনের পড়ুয়ারা ক্লাস ছেড়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে! হ্যাঁ, সেটাই হয়েছে। জেএনইউর পড়ুয়াদের হস্টেলের ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে চলা আন্দোলন গুণগত পরিবর্তন হয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে ছিটকে পড়ল ফ্যাসিস্টদের এক হামলায়। তাওয়া আগেই গরম ছিল, নাগরিকত্ব নিয়ে মোদি-শাহর হিংস্র আক্রমণে ক্ষেপে ছিল দেশ, সেই আগুন চড়িয়ে দিল ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যারাতে জেএনইউর ঘটনা। নির্মাণ হচ্ছে এক নতুন বয়ান। গত ৪৫ বছরে এই প্রথম ভারত দেখল কোনও রাজনৈতিক দল, বিশিষ্ট কোনও রাজনৈতিক নেতা বা সাংস্কৃতিক নেতা ছাড়া গোটা দেশের সাধারণ মানুষ, ছাত্র-ছাত্রী পথের দখল নিয়েছে। ক্রোধ তাদের অন্তর থেকে এক গভীর প্রজ্ঞার জন্ম দিচ্ছে। বিদ্বেষ-বিষ নাশের শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছে। চারিদিকে গণনাদ উঠেছে। নানা বর্গের, নানা ধর্মের, নানা পেশার লোক পথে নামছে। নারী-পুরুষ-এলজিবিটিকিউ নির্বিশেষে। এক এক জন এক এক রকম স্লোগান দিচ্ছেন। বয়ান ভিন্ন তো কী, উদ্দেশ্য এক। তাই অতি আয়াসেই একে অন্যের স্লোগান বদলাবদলি করে নিচ্ছে! নাথুরামের বিপ্রতীপ যে ক্ষুদিরাম, সেই নির্মাণ হচ্ছে। জাতীয় পতাকা বইছেন, সত্তরের আগুনখেকো বিপ্লবী। মুখে তাঁর, ‘হাম ছিন কে লেঙ্গে আজাদি’ স্লোগান। কান ভেদ করে উঠে আসছে, ‘হাল্লাবোল হাল্লাবোল’। এই হিম ক্রোধের ভারত আমার চেনা না। এই অহিংস ভারত আমার চেনা না। এই শাহিনবাগ আমার চেনা না। এমনকী, মাথার ওপর খোলা আকাশ নিয়ে শীতের বৃষ্টি শরীরে ধারণ করে এই পার্ক সার্কাস ময়দান আমার চেনা না। ক্রোধের আগুন আজকের ভারতে অন্যমাত্রা পেয়েছে, কোনও চোরাগোপ্তা বা অন্তর্ঘাতে সে নেই। আমার এই ভারত ফ্যাসিস্টদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘হাম ছিন কে লেঙ্গে আজাদি’। এই জহ্লাদের রঙ্গমঞ্চে দাঁড়িয়ে আজকের ভারত যেন বলছে, এই মৃত্যু উপত্যকাই আমার দেশ, মরতে হলে এখানেই মরব। শাহিনবাগ থেকে পার্ক সার্কাস, স্কুল-কলেজের পড়ুয়ারা থেকে সাধারণ শ্রমজীবী, মুটে, হকার, জরির কাজ করা খেটে খাওয়া মেয়ে থেকে হিজাব পরা গৃহবধূ মাথা উঁচু করে বলছে, এ যদি মৃত্যু উপত্যকাও হয়, তবু আমার দেশ। কেউ প্রকাশ্য রাজপথে দাঁড়িয়ে সংবিধান পড়ছে। খঞ্জও জাতীয় পতাকা ওড়াচ্ছে। এমন ভারত আমি আগে কখনও দেখিনি। যেন মোদি-শাহদের, নাগপুরের খণ্ডিত ভারত গড়ার পাল্টা এক ভারত। আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় জনা কয় মুসলমান যুবক উদ্যত হাতে জাতীয় পতাকা তুলে ধরে রুখে দেয় হিংস্র হয়ে ওঠা প্রতিবাদীদের। ক্রোধ এখানে ধাত্রীর মতো জন্ম দেয় নতুন ভারতের। বঞ্চনা এখানে মৃত্তিকার মতো সহনীয় হয়ে নির্মাণ করে আধারের। এই অবস্থায় দেশের আধবুড়ো রাজনীতিক ভামরা ফুরসত খুঁজে বেড়াচ্ছেন গোটা আন্দোলনটা হাইজ্যাক করতে আর ফ্যাসিস্ট গরিলারা সংবিধানের গলা টিপে ধরে, দেশজুড়ে হিন্দু মুসলমান আলাদা করে দিতে চাইছে। ঠিক তখনই আমার দেশের সোনার চাঁদ ছেলেমেয়েরা নিজেদের কেরিয়ারের ঝুঁকি নিয়ে আজ রাস্তায়। তার পাশে না আছে বিচারব্যবস্থা, না আছে আইনসভা, তবু তারা ভালো রেজাল্ট করে দামি চাকরি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার আপাত সরল পথ থেকে নেমে বিবিধের মাঝে মিলনের গান গাইছে। এমনকী, বিদেশের মাটিতে দেড়েমুশে বেঁচে থাকা অমর্ত্য সেন, ভেঙ্কি রামকৃষ্ণান, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, রঘুনাথ রাজনরাও তানাশাহির বিরুদ্ধে গর্জে উঠছেন। দীপিকা পাড়ুকোনের মতো ভার্চুয়াল পৃথিবীর মেয়েও ঐশীর দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে সহানুভুতির স্পর্শে মোড়া হাত। এই আন্দোলন সাধারণ মানুষের চৈতন্যের স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি ও প্রত্যয়। রাজনৈতিক দলগুলো কিছুটা দায়ে পড়ে বাধ্য হয়েই এর অনুগামী। এমন পরিস্থিতিতে এক দারুণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে আমার ভারত। হয় সে তথাকথিত দক্ষিণপন্থার সবচেয়ে আগ্রাসী শক্তির নখদন্তে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হবে, নয় ওই রক্তস্রোত ছাপিয়ে তারুণ্যের হাত ধরে নতুন ভারত উঠে দাঁড়াবে আর আসমুদ্রহিমাচলকে কাঁপিয়ে গর্জে উঠবে, ভাত দে হারামজাদি, নইলে মানচিত্র খাবো। মিশেল ফুকো সতর্ক করেছেন, আমাদের সকলের মধ্যে, আমাদের মাথার মধ্যে, এবং আমাদের প্রতিদিনের আচরণে ফ্যাসিবাদ বাস করে, সেই ফ্যাসিবাদ যা আমাদের শক্তিকে ভালোবাসে, আমাদেরকে প্রভাবিত করে এবং শোষণ করে সেই একই জিনিসটি কামনা করে।
সেই আমাদের মধ্যকার ফ্যাসিবাদকে হত্যা করেই আমরা ফ্যাসিস্টদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেব বহুত্ববাদের ভারতকে। শাহিনবাগ থেকে পার্ক সার্কাস, জেএনইউ থেকে যাদবপুর– তারই নান্দীমুখ।