শতাব্দী দাশ
লেখক গদ্যকার, শিক্ষক এবং সমাজকর্মী।
আঁখি,
চেনা রূপকথা ঘেঁটে দেওয়া সেই ছবিটি তুমি বরং দেখ বারবার। রোমাঞ্চিত হও। আন্দোলিত হও।
মারতে মারতে ছেলেটিকে দিল্লি পুলিস মাটিতে শুইয়ে ফেলল। জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তখন টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়া। জলকামান৷ আর এলোপাথাড়ি লাঠি। ছেলেটা পালাচ্ছে, হিঁচড়ে টেনে আনছে পুলিশ। হঠাৎ… দৌড়ে এল তার হিজাব-ঢাকা বন্ধুনিরা। ঘিরে ধরেছে তারা সেই ছেলেকে। তর্জনী তুলে হঠিয়ে দিচ্ছে পুলিসকে। পুলিস পিছু হঠছে, মা-পাখির তর্জন-গর্জনে যেমন করে পক্ষীশাবকের আশা ছেড়ে পিছু হঠে মার্জার। তুমি আজ জানো, ওদের নাম লাদিদা আর আয়েশা। তাই তুমি আরও জানো, রাজকন্যাকে রাজপুত্রের ‘উদ্ধার’ করার দিন শেষ৷ খেলা ঘুরে গেছে৷
ওই যে জেএনইউতে প্লাস্টার করা পা-টি চেয়ারে তুলে সভা করছে দৃপ্তা নামের মেয়েটি, ওই যে মাথায় স্টিচ আর ভাঙা হাত নিয়ে ঐশী বলছে, ‘ডান্ডায় নয়, তর্কে জিতব’, কিংবা ওই যে লাজপত নগরে ভাড়াবাড়ির উপরতলা থেকে সূর্যা রাজাপ্পান ও তার বান্ধবী অমিত শাহের নাকের ডগায় প্রতিবাদী ব্যানার উড়িয়ে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হল, ওরা থাকতে তোমার নতুন রূপকথার অভাব কী?
আর এই দ্যাখো, পুনেতে ‘আওয়াজ দোওওও…’ বলে হুঙ্কার দিচ্ছেন গৌরী সাওয়ান্ত, লিঙ্গপরিচয়ে যিনি হিজড়া। সমবেত নারী-পুরুষ প্রতি-হুঙ্কার দিচ্ছেন ‘হাম এএএএক হ্যায়’। ‘হিজড়া’ শব্দে নিহিত গ্লানি মুছে যাচ্ছে। ভীরুকে ‘তুম হিজড়া হো ক্যায়া?’ বলার আগে পিতৃতন্ত্র থমকাচ্ছে। এই সাতরঙা স্পেকটাকল দেখার কপাল আমার হয়নি শৈশবে। তুমি ভাগ্যবান, এক অমিতসম্ভাবনাময় সময়ে তোমার শৈশবের সমাপতন।
চক্ষুষ্মান হও। এমন এক সময়কে চাক্ষুষ করছ, যখন শাহিনবাগের প্রবল শৈত্য উপেক্ষা করে ছাত্রছাত্রীদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে ধর্নায় বসেছেন অশীতিপর বৃদ্ধা মা থেকে কুড়ি দিনের শিশু কোলে তরুণী মা। ‘মা’ শব্দটি বারংবার উল্লেখ করলাম সচেতনেই, কারণ তাঁরা অনেকেই সমাজনির্দিষ্ট এই ভূমিকায় থিতু ছিলেন বেশ৷ পালিকা, সেবিকা, মা হয়ে থাকতে তাঁদের আপত্তি ছিল না৷ মাতৃত্ব ছাড়া বা মাতৃত্ববিহীন আর কী কী ভূমিকা তাঁদের হতে পারে, সে সম্পর্কে তাঁরা সম্যক সচেতন নন। কিন্তু ‘মাতৃত্ব’-কেও যদি একটা বিমূর্ত ধারণা ধরো, তবে তার মূল উপাদান নিশ্চয় সন্তানকে রক্ষা করার উদগ্র রোখ৷ সেই জেদই তাঁদের পথে নামাল।
পাভেল ভ্লাসফের মা পেলাগেয়া নিলভনাকে প্রায় সকলেই আমরা চিনতাম আকৈশোর৷ অন্তঃপুরবাসিনী মায়ের পতাকা কাঁধে তুলে নেওয়ার গল্প গোর্কিতে পড়েছিলাম। অথচ নিজের স্থান-কালে চোখে দেখেছি শুধু ‘মাধবীলতা’-দের নিয়ে রোম্যান্টিসিজম৷ বাবা মিছিলে যাবেন, মা সংসার সামলাবেন– এটাই তো ছিল ‘স্বাভাবিক’। তারপর তুমি আর আমি একসঙ্গে দেখতে পেলাম রোহিত ভেমুলার মা রাধিকা ভেমুলাকে, নাজিব আহমেদের মা ফতিমা নাফিসাকে। ‘মাতৃত্ব’ নামক ব্যক্তিগত বা পার্সোনাল ভূমিকাটিকে পলিটিকাল হয়ে গেল চোখের সামনে। তাই বলি, খেলা ঘুরছে।
কিংবা ধরো কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দান। ‘লেডিজ এন্ট্রি’ ব্যানার ঝোলানো আছে যেখানে, তার মধ্যে দিয়ে আমরা ঢুকলাম– তুমি আর আমি৷ অকালবৃষ্টি। শীত৷ তাঁবু খাটানোর অনুমতি নেই। বিশাল তিরঙ্গা তবু অমলিন, উড্ডীন। জাতীয় পতাকার সামনে ভীমরাও আম্বেদকর। মুসলমান নন তিনি, তবে দলিত বটে৷ ভারতীয় সংবিধানের এই রূপকার জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের সাংবিধানিক সমানাধিকারের কথা বলেছিলেন। এইবার বলো তবে, দেশপ্রেমিক কে? যে দেশের রাজার প্রতি অনুগত, সে? নাকি যে দেশের সাংবিধানিক আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সে? এই প্রশ্নের উত্তর যে এখনই খুঁজে নিতে হচ্ছে তোমাকে, সে কারণেই তুমি ভাগ্যবান৷
এখানে যে মেয়েদের দেখছ, এঁদের অনেকেই গতকালও ভাবতে পারতেন না, ‘খুলি আসমান’-এর তলায় স্লোগান দেবেন। পরপুরুষকে মুখ দেখানোও তাঁদের বারণ ছিল৷ যে মা মেটিয়াবুরুজ থেকে এসেছেন সন্তান কোলে, তিনি বাড়ি থেকে বাচ্চার স্কুল পর্যন্ত রাস্তাটুকু ছাড়া কলকাতা চিনতেন না। এই যে হিজাবি নাফিসা, সায়েন্স কলেজে পিএইচডি করছে, বাড়ি-ল্যাব-ইউনিভার্সিটি জুড়ে তার চারপাশে ছিল অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত লক্ষণরেখা। কিন্তু তার বাইরে আনাগোনা মানা ছিল তারও। সেই মেয়ে ইতোমধ্যে মাঠে-ময়দানে কাটিয়ে ফেলেছে দু-এক রাত। নেচে নেচে স্লোগান দিচ্ছে সে। কে বলে রাজনীতি শুধু জটিল হিসেব? কে বলে রাজনীতি প্রাণের কার্নিভাল নয়?
–বাবা-মা আপত্তি করল না এইবেলা?
–নাঃ। পরশু আমি ছিলাম রাতে। কাল ছিল আমার বোন৷ আজ আবার আমি থাকব।
এই মেয়েরা যবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই জিতে ঘরে ফিরবে, সে ফেরা কি আর হবে আগের ফেরার মতো? ঘড়ির কাঁটা নির্দিষ্ট ঘর পেরোলে যে ত্রস্ততা, তা কি ফিরবে আর? খেলা যে ঘুরছে! যে পুরুষ অভিভাবক আজকের আন্দোলনে মেয়েকে বা স্ত্রীকে জড়িয়ে পড়তে দিলেন, তিনি কাল কোন মুখে বেঁধে রাখবেন তাদের?
আর এই দেখো এসে গেছেন সোমা আফরিন। গৃহবধূ। বাঙালি মুসলিম। জমায়েত শুরু করেছিলেন তো উর্দুভাষী মুসলিম মহিলারা। ক্রমে বাঙালি মুসলিমরাও জড়ো হয়েছেন। সোমার দাবি, বাংলা স্লোগানও চাই। চাই বাংলা গান৷ ‘ধন্যধান্য পুষ্পে ভরা’ ধরলেন। গলা মেলালো সবাই। ‘এই দেশেতে’ কথাটায় বারবার জোর দিয়ে বললেন, ‘মনে রাখবেন এই লাইনটা…আমার এই দেশেতেই জন্ম যেন, এই দেশেতেই মরি!’ অসহায়তাই তো স্পর্ধার জন্ম দেয়৷
ওঁকে দেশ থেকে তাড়াবে কে?
খেলা ঘুরছে! হিজাব ঢাকা মাথারা পুলিশগাড়ির বনেটে আর্ট পেপার বিছিয়ে লিখে নিচ্ছে পোস্টার… এইসব অনর্থ ঘটছে এ শহরে। এই দেখো কিশোরী তুতো বোনেরা এসেছে, বসেছে পাশাপাশি। দুইজন উর্দু মিডিয়াম,একজন বাংলা মিডিয়াম। স্কুল করেই তারা ছুটে এসেছে এখানে৷ তাদের মায়েরা বসেছে পিছনের সারিতে। মা-বাবা ময়দানে পড়ে থাকলে স্কুলফেরত শিশু বা কিশোর-কিশোরী খায় কী? কেন? ময়দানেই সমবেত উদ্যোগে আসে বিকেলের কাটা কেক, রাতের ভাত বা বিরিয়ানি৷
শিশুদের হাতের পোস্টার দ্যাখো তুমি৷ তাদের পোস্টারে ঐশী, তাদের পোস্টারে এনআরসির প্রতি প্রত্যাখ্যান। যে বাচ্চারা ছুটে বেড়াচ্ছে মা-মাসি-পিসিদের ফাঁক গলে, জিজ্ঞেস করে জানা গেল, তারাও জানে, এনআরসির মানে৷ কারণ অরাজনৈতিক থাকা একটি প্রিভিলেজের নাম৷
তারা আরও জানে, ‘এ বায়না করার সময় নয়’, ‘এখন যা পাওয়া যায় খেয়ে নিতে হবে, ঘুম পেলে এলিয়ে পড়তে হবে মাঠে’। কিন্তু ‘আজাদি’ স্লোগান উঠলে গলা মেলাতে হবে। তাদের কণ্ঠে স্কুলে শেখা ‘উই শ্যাল ওভারকাম’৷ তোমার স্কুলেও শিখিয়েছে সে গান, কিন্তু হাতে-কলমে তার মানে বুঝলে এখানে এসে৷
সমবেত কণ্ঠ ছাড়া রাষ্ট্রকে প্রতিহত করার আর কোনো অস্ত্র নেই তাদের। তাদের সঙ্গে আলাপ করাতেই তোমাকে নিয়ে আসা গণতন্ত্রের এই তীর্থক্ষেত্রে।
জেনে রেখো, পিতৃতন্ত্র আর ফ্যাসিবাদ একই সাপের দুই মাথা। আর জেনো, দলিত ও সংখ্যালঘুকে কোণঠাসা করে যারা, সেই অতিদক্ষিণপন্থী শক্তি নারীকেও চার দেওয়ালে ফিরতে বাধ্য করে, তৃতীয় লিঙ্গকেও অবমাননায় ছুড়ে ফেলে তারা। তাই এসপ্ল্যানেডের মোড়ে বা রামলীলা ময়দানে তিরঙ্গার পাশে রেনবো পতাকা। তাই রোজাভা, ব্রাজিল, পোল্যান্ড, নিকারাগুয়া, চিলিতে মেয়েদের বা এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান৷
তাই এ লড়াই তোমার, আমার। এবং তোমাদের আধো উচ্চারণে স্লোগান শুনতে বড় মিঠে।
‘এই লড়াই জিতবে কে?
তুমি আমি, আবার কে?’
ঋদ্ধ হও। দীক্ষিত হও।
শুভেচ্ছা।
মা
*নিরাপত্তার কারণে পার্কসার্কাসের মহিলাদের নাম পরিবর্তিত